somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অাঁধ কিলো কমিউনিজম

২৭ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ ভোর ৪:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দিনটির রৌদ্রজ্জ্বল চমৎকারিত্ব তাতিয়ানা মিখাইলভনাকে ক্রমশঃ গ্রাস করে ফেলছিল। তিনি এতোটাই মুগ্ধ হয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিলেন যে, আসলে বুঝতেই পারছিলেন না, সত্যিই তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে। ব্রাইটনের ইংলিশ চ্যানেল কখন যে বদলে তার কাছে বাল্টিক সাগর হয়ে গেছে সে খবরও তার ছিল না। তিনি শুনতে পাচ্ছিলেন সমুদ্রের গর্জন, ঝাউ পাতার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক হাওয়ার সরসরানি, যদিও ব্রাইটনের সমুদ্র পারে ঝাউ গাছের কোনও চিহ্নই নেই। একমাত্র মানুষই বোধহয় পারে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নিজের চোখের সামনে অন্য কোনও কাঙ্খিত জায়গাকে টেনে আনতে, অবশ্য পশুরাও যে পারে না, তার খবর কে জানে? পশুদের ভাষা শুনে ফেলার মতো নবীত্ব তো আর নেই তাতিয়ানা মিখাইলভনার।
চড়া রোদ, অথচ সমুদ্রের বাতাসের কারণে তা শরীরে বসে যেতে পারছে না। অসংখ্য নর-নারী সমুদ্রের বালিতে শুয়ে আছে, শিশুরা অল্প পানিতে নেমে হৈ-চৈ করছে, তাদের বাবা অথবা মায়ের কেউ কেউ বেশ দূরে ভেসে গিয়ে শিশুদের ভয় দেখাচ্ছে_ তাতিয়ানা মিখাইলভনা যেনো এসব কিছুই দেখছেন না। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন, ভিড় থেকে একটু দূরে। যতো দূরে গেলে মানুষের চিৎকার কানে পেঁৗছে না, অথবা পেঁৗছুলেও মূল কথাবার্তা নয়, শুধুই শব্দমালা শোনা যায় তিনি বোধ করি ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে।
আর সে কারণেই তিনি বুঝতে পারছেন না এই সমুদ্রপারের নরনারীশিশুরা আসলে কোন্ ভাষায় কথা বলছে, ইংরেজি নাকি রম্নশ। যদি তিনি কান পেতে শুনতেন তাহলে হয়তো ধরতে পারতেন এ তার মাতৃভাষা রম্নশ নয়, ইংরেজি, তিনি ধরতে পারতেন কারণ তিনি লন্ডন এসেছেন প্রায় বছর হতে চললো, এখন কাজ চালানোর মতো ইংরেজি ভাষা তিনি শিখে গেছেন। ধীরে ধীরে অনায়াস হচ্ছেন শুধু এই ভাষায়, যে ভাষা জানাটা এক সময় তাদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ, কখনও কখনও শাসত্দিযোগ্য অপরাধও। অথচ মানুষের সীমাবদ্ধতা, তাকে ভাগ্যই বলা হোক বা অন্য কিছু, সেটাই এখন তাতিয়ানা মিখাইলভনাকে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এমন এক জায়গায় যেখানে তিনি সেই নিষিদ্ধ ভাষাতেই কথা বলছেন; বা বলা ভালো বাধ্য হচ্ছেন।
অবশ্য এই সমুদ্র পারে দাঁড়িয়ে তাতিয়ানা মিখাইলভনা বোধ হয় ইচ্ছে করেই নিজের কানের ভেতরে এক ধরনের শব্দ শোধনকারী যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে ইংরেজিকেও বদলে ফেলেছেন রম্নশ-এ। তিনি এও জানেন যে, বাল্টিকের যে সমুদ্রতট তিনি ছেড়ে এসেছেন সেখানে এখন আর রম্নশ ভাষা নয়, বরং স্থানীয় লাট্ ভাষাতেই কথা হয়; মানুষ রম্নশদের মতো তাদের ভাষাটাও এখন সেখানে অচ্ছুত, বিশেষ করে লাটভিয়ানদের কাছে। আসলে সব কিছুই এক সময় ফিরে ফিরে আসে, মানুষ বলে থাকে সমুদ্র কোনও কিছুই ফিরিয়ে দেয়, কোনও কিছুই জমিয়ে রাখে না, আসলে এর চেয়েও বড় সত্যি হলো সময় সব কিছুই ফিরিয়ে দেয়, আজকে যে বাক্য আমরা মুখ থেকে বের করে বাতাসে ভাসিয়ে দেই তাই-ই কোনও এক সময় বিশাল এক শব্দভান্ডার হয়ে ফিরে আসে আমাদেরই কাছে; হোক তা সিকি শতাব্দী অথবা তারও বেশি সময় পরে, কিন্তু আসে তো।
তাতিয়ানা মিখাইলভনার মনে আছে, তিনি তখন বেশ ছোট, যখন তার বাবাকে রিগা শহরে পাঠানো হয়েছিল। রাষ্ট্রের নির্দেশ যেতেই হবে। মস্কোর কাছেই ছোট্ট একটা শহরে তাদের ঘরবাড়ি ছিল, ছিল জমিজমাও কিছু, যদিও সে সবের মালিক অনেক, তখন 'যৌথ' শব্দের বেশ জমজমাট অবস্থা। বিপস্নব হয়ে গেছে, বিপস্নবের চিহ্ন সবার মনে বসিয়ে দিতে একের পর এক নির্দেশ আসছে ওপর থেকে। সেই ওপরটা যে কতো ওপরে তা কারো জানা ছিল না। তাতিয়ানা মিখাইলভনা বা তার পরিবারের মতো কৃষকেরা শুধু জানতে পারতেন যে, নির্দেশ পালন করতে হবে। তারা নির্দেশ পালনের জন্য প্রস্তুতও ছিলেন। কারণ এও তাদের জানা ছিল যে, নির্দেশ না মানলে কী করে মানাতে হয়, সেটা ওপরওয়ালাদের ভালো করেই জানা আছে। কো-অপারেটিভ কালখোজ-এর প্রধান পান্ডা, যিনি ওই কৃষি খামারের তাবারিশ বা প্রধান কমরেড তার বিরম্নদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকলেও কেউ তা মুখে উচ্চারণের সাহস করতো না, করতো না কারণ ওপরের সঙ্গে তার সরাসরি যোগাযোগ, তাছাড়া একে মেনে-গুনে চললে যদি ভালে াথাকা যায় তাহলে অসুবিধে কীসে? বিপস্নব মানে মাথা নত না করা নয়, বিপস্নব মানে বেঁচে থাকা _ এটাই তাতিয়ানার বাবা মিখাইল বরিসভ জেনেছিলেন। আর সে জন্য ওপরের নির্দেশানুযায়ী তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন রিগায়।
সেখানে তার জন্য তৈরি ছিল দু'রম্নমের একটি ফ্যাট, কিছু আসবাব, নিতানত্দই প্রয়োজনীয় যা। আর সেখানে যাওয়ার পরের দিনই যোগ দিয়েছিলেন স্থানীয় লোহার কারখানায়, যে কারখানায় তৈরি হতো ছোট্ট ও গোল একটা ধাতব পিণ্ড। সেই পিণ্ড কার কোন্ কাজে আসতো সেটা মিখাইল বরিসভের জানা ছিল না, জানার চেষ্টাও কখনও করেননি। কারণ সেসব প্রশ্ন করা মানা, যে সব প্রশ্ন রাষ্ট্রের নির্দেশ করা জানা অথবা না-জানার সীমা লংঘন করে। যে যার নিজের কাজ করে যাও, কাজ শেষে বাড়ি ফেরো, ফেরার পথে লাইন দিয়ে রম্নটি কেনো, পনির কেনো, কখনও কখনও দোকানে যদি সূর্যমুখীর তেল পাওয়া যায় তাহলে সেটা অথবা মার্জারিন; গরম্নর মাংসের একটা বড় টুকরো আর বছরের আলু তো ঘরেই মওজুদ থাকে। জীবনটা তখন এরকমই সরল আর সোজা। কোনও কারণে একটু বাঁকা হলেই স্থানীয় পার্টি অফিস, পুলিশ অথবা আরও বিশেষ কারো চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা, আর একবার চোখে পড়া মানে, আজীবন তার মাশুল গোনো। যদিও এই সিস্টেমটাই বুঝতে বুঝতে মিখাইল বরিসভদের দিন কেটে যাচ্ছিলো।
তবে মিখাইল বরিসভের সব কানত্দি আর শ্রানত্দি মুছে দিয়েছিল বাড়ির খুব কাছের এই সমুদ্র। এই বিশালত্বের দিকে তাকালে যে কোনও কিছুকেই তুচ্ছ মনে হয়। জীবনের সকল অপ্রাপ্তি এই সমুদ্রের কাছে খুব ুদ্র হয়ে যায়। নিজেকে অকিঞ্চিতকর মনে হয়, আর সে কারণেই তিনি স্ত্রী আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে সময়-অসময় চলে আসতেন এই সমুদ্রের পারে। নিজের ফ্যাটের জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়, কান পাতলে গর্জনও শোনা যেতো কিন্তু সকাল-দুপুর-বিকেল যখনই বরিসভ সময় পেতেন সবাইকে নিয়ে সমুদ্রের পারে হেঁটে বেড়ানো ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। সারি সারি ঝাউ গাছ, তলায় বিছানো শক্ত ঝাঁউয়ের ফল, গাঙচিলের ইতিউতি ওড়াওড়ি, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যেতো সমুদ্রের গল্প বলা। নিজেতো শুনতেনই, এমনকি পরিবারের সবাইকেই বরিসভ শিখিয়েছিলেন সমুদ্রের বলা এই গল্প শোনার কায়দা।
কোনও কোনও দিন বাড়ি ফিরেই বরিসভ তাতিয়ানাকে কাছে বসিয়ে জিজ্ঞেস করতেন, 'বলো তো, আজ সমুদ্র কোন্ গল্পটা বললো?'
বারো-তের বছরের তাতিয়ানা কিছু না ভেবেই বলতো, 'আজ সমুদ্র শুনিয়েছে অবাক দেশের মানুষের কথা, তারা মানুষ কিন্তু মাছের মতো, তাদের শরীর থেকে যে গন্ধ বের হয় তা শ্যাওলার মতো, তারা হাসে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দে, তারা কাঁদে বৃষ্টির মতো, তারা কবিতা লেখে বালির মতো ঝরঝরে শব্দে, তারা গান গায় অচেনা সমুদ্র-পাখির ভাষায়; একদিন সেই মানুষদের সমুদ্রে বান আসে, দীর্ঘ কানত্দিভরা পস্নাবণ, সেই পস্নাবণের রঙ লাল, সেই লাল-এ ঢেকে যায় সূযর্্য, কিন্তু পুরোপুরি ঢেকে যায় না সেই সূর্যটা, তার রঙটা শুধু যায় বদলে, তার চোখ হয়ে যায় পানকৌড়ির চোখের মতো, লাল গভীর লাল- সেই সূর্যটা আর কোথাও যায় না, সেই মৎসগন্ধা মানুষদের মাথার ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে, সারাৰণ, সারাদিন, সারা মাস, বছর; ওরা পোড়ে, পুড়ে খাক্ হয়ে যায়, তবু সূর্যটা যায় না, বুঝলে বাবা যায় না, যায় না.....তারপর সমুদ্র থেমে গেলো, কেমন যেনো চুপ হয়ে গেলো, বাতাস জিজ্ঞেস করলো, তারপর?
সমুদ্র চুপ।
ঝাউ পাতা জানতে চাইলো, তারপর?
সমুদ্র চুপ।
গাঙচিল ডুকরে উঠলো, তারপর কী হলো?
সমুদ্র চুপ, যেনো বোবা, ওর মুখে কোনও ভাষা নেই।
সমুদ্র কেন অমন হলো বাবা?_ তাতিয়ানা প্রশ্ন করে।
ততৰণে বরিসভ রান্নাঘরের টেবিলে বসে গেছেন, সিরকা থেকে তোলা শশাকে খুব সুন্দর কারে কেটে টুকরো করে রাখা, অাঁচারের বয়াম থেকে তোলা দু'টো টকটকে লাল টমেটো, এক টুকরো পনির, আর কালো রম্নটি, যার গন্ধ অনেকদিন ভিজিয়ে রাখা গমের মতো, ত্েব সুন্দর আর তারই পাশে একটা বোতল, গায়ের লেভেল থেকে তাতিয়ানা পড়তে পারে, নাম, সত্দালিচ্নায়া ভদ্কা। সত্দালিৎস্সা মানে রাজধানী, আর রাজধানী যেহেতু মস্কো সেহেতু এই বোতলটাও রাজধানী থেকে আসা, যে রাজধানীকে ও ছেড়ে এসেছে বেশ ছোট বেলায়।
এমন না যে তাতিয়ানা জানে না ওই বোতলে কী আছে? এরই মধ্যে ও খেয়েওছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ওর তেমন একটা ভালো লাগেনি কিন্তু আরও পরে, অনেক পরে যখন ও আলেগ ইভানভের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে তখন ওর মনে হয়েছে, এই একটি মাত্র বস্তু, গ্রহণের পর বোঝা যায়, 'এশ্তো তাকোই কমিউনিজমা?' (কমিউনিজম কী জিনিস)।
সত্যিইতো এই বস্তুটির সঙ্গে ওদের তো ঠিকমতো পরিচয়ই হয়নি কোনওদিন। ওরা শুধু শুনেছে, জেনেছে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন, কমু্যনিজম, স্যোৎসালিজম _ কিন্তু এগুলো আদৌও কী জিনিস, তাতো জানা হয়নি, শেখা হয়নি ওদের। স্কুলে পড়তে পড়তেই তাতিয়ানাও ঢুকে গিয়েছিলেন ওর বাবা যে কারখানায় কাজ করেন সেই কারখানায়। তাতিয়ানাও কখনও জানতে পারেননি যে, ওই গোলাকার ধাতব পিণ্ডটি আসলেই কোন্ কাজে লাগে। একদিন খুব গোপন মুহূর্তে আলেগ ইভানব ওকে বলেছিলেন, বলেছিলেন, এই ধাতব পাত যায় ৰারকভ শহরে, যেখানে আরও আরও সব বস্তুর সঙ্গে একে মেশানো হয়, তারপর সেখান থেকে আরও কোনও গোপন শহরে, যেখানে শুধু সেই শহরের বাসিন্দারাই যেতে পারবে, কিন্তু তারা ওই শহর থেকে বেরিয়ে আর কোথাও কোনও দিনই যেতে পারবে না, যার নাম আসলে 'যাকৃতিই গোরাদ' বা বন্ধ শহর। সেখানে কী হয় জানে না আলেগ, জানতেও চায় না, বেশি জানা তো জ্ঞান না, জ্ঞান হচ্ছে সেটাই যেটুকু পার্টি তোমাকে জানার অধিকার দেয়_ আলেগ-তাতিয়ানার কাছে জ্ঞান সেটুকুই।
তাতিয়ানা মিখাইলভনা অল্প একটু হেসে ফেলেন, কী ভাবছেন এসব তিনি? এই সমুদ্র আর সেই সমুদ্রে তো অনেক তফাৎ। তফাৎ সময়েও, এই তপ্ত দুপুরে তাতিয়ানা কোনও দিনই সেই সমুদ্রের পারে থাকেননি, তিনি গরম সহ্য করতে পারেন না। এমনকি তার মেয়ে কাতিয়াও পারে না। কী ভেবে যেনো নাম মেয়ের নাম রেখেছিলেন কাতিয়া, আসলে কাতরিনা। আলেগের মায়ের নাম, দাদির সঙ্গে না মিললে অবশ্য রাখা হতো না কখনও। কিন্তু তাতিয়ানা কিন্তু মেয়ের নাম কাতিয়া নয়, কাতরিনাই রাখতে চেয়েছে, ওর মনে পড়েছে ইকাতেরিনা এফতারায়া'র (ক্যাথরিন দ্যা সেকেন্ড) কথা। সেই ইতিহাস তাতিয়ানার জানার কথা নয়, জানতে পারতেনও না, কিন্তু হঠাৎই একদিন সেই সুযোগ হয়েছিল।
বরিসভ তখনও বেঁচে, একদিন ওদের বাড়িতে কিয়েভ থেকে বেড়াতে এসেছেন এক দম্পতি। মহিলাটি একটু বয়স্কা, কিন্তু পুরম্নষটি বেশ যুবক, বা বলা যায় বেশ শক্ত-সামর্থ; ওর বাবারই বয়েসী হবেন। খাবার টেবিলে সে রাতে কতো কথা, কতো গান, তাতিয়ানার মা গালিনা ইভানাভনা চমৎকার গাইতে পারতেন। সে রাতে গান, গানের পর গান গাইতে গাইতে ওদের যখন চোখ ঢুলু ঢুলু করছিলো ঘুমে তখনই ওর বাবার কানের কাছে মুখ এনে ওই ভদ্রমহিলা বলেছিলেন, 'বরিসভ, জানেন নাকি, ত্সার নিকোলাই এফতারোই (জার নিকোলাই দ্য সেকেন্ড) কে নাকি সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। যার নামে শহর, সেই ইকাতেরিনা তার স্বামী নিকোলাই, আর শিশু সনত্দানদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে ইকাতেরিনবুর্গে। মাটির নীচে ওদের অাঁটকে রাখা হয়েছিল অনেকদিরন ধরে, তারপর খুন করা হয়। বরিসভ, এটা পাপ, মানুষ হত্যা পাপ, বরিসভ। বরিসভ, এই পাপে আমরা শেষ হয়ে যাবো।'
ঃ এসব কী বলছেন আপনি? চুপ করম্নন, চুপ করম্নন, দেয়ালেরও কান আছে। দয়া করে চুপ করম্নন।
ঃ ঈশ্বর আছেন বরিসভ, ঈশ্বর আছেন।
ঃ না না ঈশ্বর বলতে কিছুই নেই। আমরা নিজেরাই নিজেদের ঈশ্বর, কাজ করবো, বংশবৃদ্ধি করবো, জীবন উপভোগ করবো, পার্টি আমাদের নিরাপত্তা দেবে, রাষ্ট্র আমাদের নিশ্চয়তা দেবে। আর কী চাই আপনার? আপনি এসব কী বলছেন? কোত্থেকে জেনেছেন? কে বলেছে আপনাকে এসব?
ঃ বরিসভ, আপনি নিজেও জানেন, আপনি যা বলছেন তা সত্যি নয়, তা সত্যি হতে পারে না। ব্যক্তি মানুষকে বাদ দিয়ে শুধু সমষ্টি নিয়ে রাষ্ট্র চলে না, টিকে থাকতে পারে না। ব্যক্তি মানুষের চাহিদা এবং তা পূরণের পরেই কেবল সমষ্টিকে একত্রে গাঁথা যায় বরিসভ। আমার কষ্ট হয় বরিসভ, যখন ভাবি, সেই সুন্দরী, ভোগী আর কোমলমতি মহিলা, ইকাতেরিনাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি কী করছিলেন? তারই নিজের নামে শহরটা, যেখানে তাদের রাখা হয়েছিল সেটা তাদের পরিচিত বাগান বাড়ি। কিন্তু বাইরে বেরম্নতে দেওয়া হয়নি। মাটির নীচে রাখা হয়। তারপর যখন হত্যা করা হয়, তখন? তখন? আহ্ আমি ভাবতে পারছি না বরিসভ। একবার ভেবে দেখুন বরিসভ, সেই শিশুরা, যে শিশুপুত্রের জন্য রাসপুতিনের কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন ইকাতেরিনা, যাকে কোন্ যাদুবলে রাসপুতিন বাঁচিয়ে তুলেছিলেন, জানি না, কিন্তু সেই শিশুকে যখন মেরে ফেলা হচ্ছে, তখন মামা ইকাতেরিনা (মা ইকাতেরিনা_ এমনকি জার নিকোলাসও ইকাতেরিনাকে মা বলে সম্বোধন করতেন, এটাই ছিল সবার কাছে তার পরিচয়) কী করছিলেন? চিৎকার করে কাঁদছিলেন বুঝি? বরিসভ বলুন না, দয়া করে বলুন।
ঃ আপনি আবেগমথিত হয়ে পড়েছেন, নিজেকে সংযত করম্নন। আপনি বেশি পান করেছেন বলে মনে হয়, আর নয়। আসলে আমাদের ঘরে তৈরি সামাগন (99% এ্যালকোহল) আপনাকে বড্ড উতলা করে ফেলেছে। চলুন আপনাকে বিছানা দেখিয়ে দিচ্ছি।
বরিসভ আর কথা বাড়াতে দেননি ভদ্রমহিলাকে, এক হিসেবে সেই ভদ্রলোক সহ ভদ্রমহিলাকে টেনেই খাবার টেবিল থেকে তাতিয়ানার ঘরে এনে ফেলেছিলেন। দু'কামরার ঘর, আর কোনও জায়গাও ছিল না। ভাগ্যিস, এই কামরায় দু'টো ডিভান ছিল। একটাতে ওরা দুই ভাই বোন আর অন্যটিতে ওই দম্পতি শুয়েছিলেন। রাতে তাতিয়ানার ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো, ওর ভাই তখনও অঘোরে অচেতন। তাতিয়ানা শুনছিলো নিঃশ্বাস আর প্রশ্বাসের সংঘর্ষ। ভদ্রমহিলা পুরম্নষটিকে বলছিলেন, ,'দোহাই আপনার থামবেন না রাসপুতিন, থামবেন না। আমাকে দিন, আরও দিন, আমি আরও চাই, অনেক চাই। ওহ্ রাসপুতিন'।
আর ভদ্রলোক আরও জড়ানো গলায় বলছিলেন, 'ওহ্ আমার ইকাতেরিনা, দ্যাখো শ্বেত তুষারে ছেয়ে গেছে সেন্ট পিটার্সবুর্গ, নেইভা নদীর ওপর তোমাকে নিয়ে হাঁটতে চাই একদিন মামা, হাঁটবেন আপনি? আপনার লেস লাগানো গাউনের প্রান্তু ছুঁয়ে থাকবে শুভ্র বরফ, তবুও ওদের ম্রিয়মান মনে হবে মা...মা আপনার গাউনের গাছে। আপনি হাসবেন, আপনার দনত্দরাশি চমকে উঠবে, এতো শুভ্রতা সহ্য করতে পারবে না প্রকৃতি, আপনি হাসবেন না মাম......'।
তাতিয়ানা চমকে চমকে উঠছিলো এই দম্পতির এসব কথায়, ও বুঝতে পারছিলো কী হচ্ছে ওখানে, কিন্তু তাতে ওর কোনও ৰোভ নেই, ওর মনে হয়নি ওরা খারাপ কিছু করছে। বরং স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল ওদের আচরণ। এমনটা তো হতেই পারে, অনেক গস্নাস ভদ্কা খাওয়ার পর শরীর কেমন লাগে সেটাতো তাতিয়ানার অজানা নয়, আর এতো সামাগন। তাতিয়ানা শুধু ইকাতেরিনার কথা ভাবছিল, অসম্ভব মমত্ব অনুভব করেছিল ইকাতেরিনার প্রতি, আর ভেবেছিলো, একদিন ওর মেয়ের নাম রাখবে ইকাতেরিনা। যদিও সোভিয়েত আমলে নামটি ছিল বিষের মতো, যেনো এই নাম রাখলেই বিষে নীলকণ্ঠ শিশুটির মৃতু্য হবে তখনই। আসলেই সেরকম কিছু হয় কি না, সেটাই তাতিয়ানা পরীৰা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে রাতে তাতিয়ানার আরও মনে হয়েছিল, এই ভদ্কা আর সামাগন বোধ হয় এক ধরনের রাজনীতি, যে রাজনীতি মানুষকে বুঁদ করে রাখে শুধু, আসল সত্যি থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তাই যখন পরবতর্ীকালে মিখাইল সের্গেইভিচ্ গর্বাচেভ এসে সুখোই জাকোন (এ্যালকোহল নিষিদ্ধকরণ) প্রয়োগ করেছিলেন তখন দুন্ধুমার কাণ্ড বেঁধে যাওয়ার জোগাড়। মনে হচ্ছিলো, নতুন বলশেভিক বিপস্নব বুঝি আসন্ন, তাই তড়িঘড়ি আবার সেই আইন তুলে নিতে হয়েছিল গর্বাচেভকে। অবশ্য ততোদিনে আরও অনেক শিথিলতা এসেছে। তিনজনে একত্রে বসে কথা বলার হারানো অধিকার ফিরে এসেছে, ফিরে এসেছে গুলাগ থেকেও অনেকেই।
তাতিয়ানা শুনেছিলেন পরে, সেই দম্পতিকে নাকি পাঠানো হয়েছিলো সেবের-এ (সাইবেরিয়ায়), যেখানে গেলে আর কেউ কোনওদিন ফিরে আসে না। ওদের জানাশোনা যাদেরই ওখানে নেওয়া হয়েছিল কেউই আর ফিরে আসেনি। তাতিয়ানা জেনেছিলেন, বুঝেছিলেন আরও বেশি, তাইতো সাহস করে সেই গর্বাচেভের আমলেও মেয়ের নাম রাখতে পারেননি, ইকাতেরিনা, বরং শাশুড়ির নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম রাখা হয়েছিল কাতিয়া। আদর করে তাকে ডাকা হতো, কাতুশ, কাতুলিয়া, কাত্ ..............আরও কতো কি?
ব্রাইটনের সূর্যের ওই্ ঔজ্জ্বল্য ভেদ করে তাতিয়ানা মিখাইলভনার করোটির ভেতর ঢুকে পড়ে কাতিয়া। এখন যা বয়স বত্রিশ। বিয়ে করেছে ওরই এক কাশমেটকে। দু'জনেই সমান ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে কিছু করার, কিন্তু পারছে কই? রিগা শহর থেকে ওদের হয়তো খুব শীগগিরই চলে যেতে হবে, কারণ ওরা সেখানে বিদেশি, ওরা রম্নশ। একসময় ওদেরকে জোর করে সেখানে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, আর এখন আবার সেখান থেকেই জোর করে তাড়িয়ে দেওয়া হতে পারে। তাতিয়ানা শঙ্কিত বোধ করেন খুব, আলেগ আছে ওর মতো, নিজে নিজে থাকেন, ওদের সেই পুরোনো বাড়িতে, যেখানে বরিসভ মারা গেছেন, মারা গিয়েছেন তাতিয়ানার মা গালিনা ইভানভনা। আলেগ এখন আরও বেশি ভদ্কা খায়, তাতিয়ানা এখান থেকে পাউন্ড পাঠান, সেই পাউন্ড ভাগাভাগি হয় বাবা আলেগ আর কন্যা কাতিয়ার মধ্যে, কাতিয়া বেশিরভাগটা নেয় কারণ তার স্বামী আছে, আছে ছোট্ট একটা মেয়েও। এখন আর ভয় নেই কোনও, তাতিয়ানা ওর সাত বছরের নাতনির নাম রেখেছেন ইকাতেরিনা। সত্যিইতো সে ইকাতেরিনা এফতারায়া বা দ্বিতীয় ইকাতেরিনা। তাতিয়ানা সমুদ্রপারের শিশুদের দিকে তাকান, তাকিয়ে ইকাতেরিনা এফতারায়াকে খুঁজতে থাকেন। কিছুৰন খোঁজার পর মনে হয়, আর নয়, এখানে নয়, এখানে তিনি কী করছেন? এতো সেই সমুদ্র নয়, সেই সূর্যও নয়, সেই ঝাউপাতার ফাঁক দিয়ে আসা শিরশিরে বাতাস কোথায় এখানে? তাতিয়ানা দ্রম্নত হাঁটতে থাকেন স্টেশনের দিকে, সেখান থেকে সোজা ট্রেন ধরে লন্ডন ফিরে যাবেন, এই চড়া রোদ তার আর সহ্য হচ্ছে না, একদম নয়। তাতিয়ানা হাঁটতে হাঁটতে একটা আইসক্রিম কেনেন, হাতে ধরা আইসক্রিম চাটতে চাটতে তাতিয়ানা মিখাইলভনা যেনো অতি দ্রম্নত নিজেই তার নাতনি ইকাতেরিনা এফতারায়া হয়ে যান। তারপর দ্রম্নত উঠে পড়েন ট্রেনে। অসংখ্য সিট, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ খুব, তিনি বেছে নেন জানালার দিকের সিটটা, তারপর সেটাতে বসেই চোখ বন্ধ করে ফেলেন তাতিয়ানা মিখাইলভ না। তখন তার বন্ধ চোখের সামনে আবার বিব্শি সাভেৎস্কি সাইউজ (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন)।
সবুজে সবুজে ভরা গম ৰেত, মাঝে লাল স্বাস্থ্যবান বিটের শাক, কিছুৰণ পর পরই সবুজ বার্জ বন। তাতিয়ানারা যাচ্ছেন লেনিনগ্রাদে, ততোদিনে সেন্ট পিটার্সবুর্গের নাম পরিবর্তিত হয়ে লেনিনগ্রাদ হয়ে গেছে। ততোদিনে অনেক মূর্তিও ভাঙা হয়ে গেছে, খাবারের দোকানের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। মানুষ চিনে গেছে ভালুত বা ফরেন কারেন্সি, এরমধ্যে সবুজ রঙা ডলার যেনো কতোদিনের পরিচিত, প্রায় প্রতিটি রম্নশ নাগরিকের কাছেই এর গুরম্নত্ব সীমাহীন। ইয়া লুভলু আমেরিকা (আই লাভ আমেরিকা) লেখা গেঞ্জি পরে ব্রা ছাড়া হেঁটে বেড়ায় মস্কোর রাসত্দায় পেরেস্ত্রোইকার সময় জন্ম নেয়া মেয়েটি। তার গোপনাঙ্গের বড় ঠোঁটটিতে সে টাট্টু এঁকেছে, সেটা আমেরিকার পতাকা। একজন আমেরিকান সাংবাদিককে সেই পতাকা দেখিয়ে সেই মেয়ে যেনো নতুন কলম্বাস হয়ে গিয়েছিল, আর আমেরিকান সাংবাদিকের তখন অবস্থা শাঠে শঠাং।
অবশ্য খবর এরকমও আছে যে, মস্কোতে এসে অনেক মার্কিন-ব্রিটিশ, আরব ছুটি কাটিয়ে যাচ্ছে_ মস্কোর বাতাসে ভাসছে মেয়েদের যোনীর গন্ধ। আর তার কোণে কোণে লুকিয়ে আছে টাকা। যেখানেই হাত দেওয়া যায় সেখানেই অর্থ, কী নেই সাইউজে? হঁ্যাহ্?
ভাঙা-চোরা জাহাজের খোল্? রাডারেও ধরা পড়ে না এমন যুদ্ধবিমান? পানিতেও নামতে পারে এমনতর হেলিকপ্টার? ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র? এমনকি পারমাণবিক বোমা তৈরির মালমশলস্না? কী নেই? সব আছে, সব আছে। এসো তোমরা এসো, মস্কো যেনো স্বৈরিণী নারী, দু'পা দু'দিকে ফাঁক করে বসে আছে, তোমরা এসে যথেচ্ছা তাকে সম্ভোগ করে যাও....কালো অথবা সাদা, অথবা বাদামি বা হলুদ, যে কোনও লিঙ্গই গ্রহণে তার কোনও আপত্তি নেই। কারণ এখানে খাবার নেই, কাঁচামাল আছে বাজার নেই, ক্রেতাও কম।
তাতিয়ানার মনে পড়ে সেই সব দিনগুলির কথা। লেনিনগ্রাদে গিয়েছিলেন কাজের জন্য হলো না। ফিরে এলেন, কিন্তু দেখে এলেন ইকাতেরিনার প্রাসাদ, এখন আবার সেই প্রাসাদ, তার ইতিহাস খুব জনপ্রিয়। তাতিয়ানা অবশ্য বুঝতে পারেন না, এতো ঘৃণাও বা কেন ছিল, কেনই বা আবার এই উপছে পড়া ভালোবাসা? শুধু কী তাতিয়ানা? তার প্রজন্মের কারো মাথাতেই ঢোকো না এই ঢ্যামনামো। একদা যে ধর্মকে ওরা বিষ্ঠার মতো বর্জন করেছিলেন, মসজিদ অথবা গীর্জাগুলিকে একসময় বদলে ফেলা হয়েছিল সুইমিং পুল অথবা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আবার সেগুলোকেই এতো খরচ করে মসজিদ বা গীর্জায় বদলানোর প্রয়োজনটা কোথায়?
মস্কো থেকে ওরা যখন ট্রেনে উঠছিলেন লেনিনগ্রাদে যাবেন বলে, তখনই কালো ্আলখালস্নায় মোড়া একদল পাদ্রী এসে ওদের কাছে ভিৰে চেয়েছিলেন, মস্কোর সবচেয়ে বড় ক্যাথিড্রালটি নির্মাণের জন্য। ওদের চেহারা ছিল এলাকার সব মাদি বেড়ালগুলোকে গর্ভবতর্ী করা হুলো বেড়ালটির মতো। তাতিয়ানা এক ঝলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন আর মনে মনে বলেছিলেন, 'পাশলি ইফসিয়ে না খুই' (ফাক্ ইউ অল)।
তারও আগে যখন মস্কো শহরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন তাতিয়ানা, আলেগ আর মেয়ে কাতিয়া, তখন তাতিয়ানার মনে হচ্ছিলো, বদলটা আসলেই ঘটেছে, সেই পঞ্চাশের দশকের মস্কো আর আশির মস্কো এক নয়, এরমধ্যে যা কিছু, যা কিছু নতুন, তা ওকে যেনো টানছিলো না কোনও মতেই। পুরোনোকে ভালোবাসার মধ্যে হয়তো এক ধরনের নির্ভরতা আছে, নতুনের ৰেত্রে যেটা শঙ্কা, তাতিয়ানার ভেতরে সেই উপলব্ধি আরও জোরদার হয়েছিল রেড স্কোয়ারে ক্রেমলিনের বর্ধিত অংশে শোয়ানো লেনিনের মমি দেখতে গিয়ে। ভাবতে অবাক লেগেছিল শায়িত লোকটাকে পণ্য হতে দেখে। পয়সা নেওয়া হয় না বটে কিন্তু বিদেশিদের আকৃষ্ট করার জন্য লেনিননে এভাবে শুইয়ে রাখার কী বা দরকার ছিল? শুয়ে শুয়ে লেনিনের মমি পকেট থেকে চেনওয়ালা ঘড়ি বের করে সময় দেখছেন, যেনো তার গোপন কোন কাজ আছে, যেনো ট্রটস্কি অথা সত্দালিনের সঙ্গে পরামর্শ করার আছে কিছু। স্ত্রী নাদেজ্ঝদা ক্রুপসকায়া হয়তো একটু পরেই চা নিয়ে আসবেন। তার আগে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া খানিকটা।
তাতিয়ানা মিখাইলভনা জানেন, ততোদিনে লেনিনের মূর্তি ভাঙা অথবা তার চরিত্র হননের তীব্রতা অনেক কমে গেছে। রাত বারোটার পরে স্থানীয় একটি কেবল চ্যানেলে লেনিনের আদলের এক লোক তার শিশ্নটা বের করে দর্শকদের দেখিয়ে বলেছে, 'স্মাতরি্ কাক ইয়া ইয়াবাল রাশিউ? (দেখুন, আমি কেমন করে রাশিয়াকে চুদেছি?) এমনতর দৃশ্যও দেখতে হয়েছে। আবার এমন গল্পও পত্রিকার পাতায় লেখা হয়েছে যে, একদা মহামতি লেনিনের স্ত্রী নাদেজ্ঝদা ক্রুপসকায়া উলিয়ানভ থেকে ফিরছিলেন মস্কো। পথিমধ্যে ট্রেনের ভেতর একদল সৈনিক তাকে ধর্ষণ করে। আর সেই সব সৈনিকদের একজন বা একাধিকের দেহে ছিল সিফিলিসের জীবাণু। নাদেজ্ঝদাও এই রোগে আক্রানত্দ হন, আর এ কারণেই মহামতি লেনিন কখনও সনত্দান নেননি, নাদেজ্ঝদাকে বুঝিয়েছেন, তাদের মিলনে যে সনত্দান হবে সেও আক্রানত্দ হবে ওই রোগে, সুতরাং কী দরকার সনত্দানের? তাতিয়ানা ঠিক মেলাতে পারেন না, কোন্ লেনিন সত্য, যে লেনিন রাশিয়াকে ধর্ষণ করে সেটি নাকি যে লেনিন ইচ্ছে করে সনত্দান নেওয়া থেকে বিরত থাকেন, ভবিষ্যতে সেই সনত্দান সিফিলিস আক্রানত্দ হতে পারে বলে? কোন্টি সত্য? সেটা শুধু তাতিয়ানা কেন, কেউই কি জানতে পেরেছেন? তাদেরতো জানতেই দেওয়া হয়নি, আবার কারো কারো ৰেত্রে জানতে জানতেই সময় পেরিয়ে গেলো, অতি প্রেম থেকে লেনিনকে অতি-ঘৃণার যুগ এসে গেলো।
তাতিয়ানা কাজ পেয়েছিলেন, পেয়েছিলেন একটা ছোট্ট দোকানে। সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুদির মতো সবকিছু বিক্রি করতে হবে। বেতন খুবই কম। যেহেতু তাতিয়ানা বা আলেগ কাউকেই পেনশন দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় না কারণ ওরা রম্নশ, তাই বাঁচার জন্য কিছু না কিছু তো করতেই হবে। রিগা শহর ছেড়ে অন্যত্র কোথাও যাওয়ার ইচ্ছে নেই, অবশ্য যাওয়ার উপায়ও নেই। কোথায় যাবে ওরা? মস্কো ভুলে যাওয়া এক শহর, যেখানকার বাতাসে এখন নিঃশ্বাস নিতে হলে রম্নবেল গুনতে হয়। আঙুল চিবিয়েতো খাওয়া সম্ভব নয়, নিজেকে বিক্রির মতো অবস্থাও তাতিয়ানার ছিল না। মেয়েটাকে হয়তো পাঠিয়ে দিতে পারতেন কোথাও। মাসে মাসেই ওদেছা অথবা অন্য কোনও নামী বন্দর থেকে রম্নশ মেয়ে ভর্তি করে জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছে। একুশ শতকের যৌনদাসী ওরা, যাচ্ছে, কিন্তু জানে না কী করতে হবে ওদের। শুধু জানে সেখানে জীবন রঙিন, এখানে সাদাকালো, খুবই সাদাকালো, কারণ সেই রঙিন সূর্যটা এতোটাই রঙহীন হয়ে গেছে যে, সবকিছু বিবর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত।
তাতিয়ানা তখন ভাবতেন, আচ্ছা এই যে জাহাজ ভর্তি হয়ে মেয়েরা যাচ্ছে, অজানায়, যেখানে তাদের সঙ্গে কী করা হবে না জেনেই, হয়তো তাদের কারো ঘরের কাজ করে দিতে হবে, হয়তো তাদের হাত-চোখ বেঁধে একসঙ্গে অনেককে লাইনে দাঁড় করিয়ে সঙ্গমে বাধ্য করা হবে, হয়তো...হয়তো....হয়তো আরও কতো কতো হয়তো, কিন্তু সেই রঙিন সূর্যের আমলে এই মেয়েরা কোথায় ছিল, এতো মেয়ে কী তাহলে ঘর থেকে বেরম্নতো না কখনও? নইলে রাতারাতি এতো মেয়ে রাসত্দায় নেমে এলো কী করে? তখন তো চলেছে, মাথার ওপর ছাদ ছিল, পরনে আমেরি্কান টি-শার্ট না থাকলেও বস্ত্র ছিল, পেটে শুকনো রম্নটির সঙ্গে শুধু পনির অথবা নিদেন ঘোড়ার মাংসের স্টু তো জুটতো দু'বেলা, তখন যেহেতু এরা জাহাজ ভর্তি করে যায়নি, এখন যাচ্ছে কেন? কেন যাচ্ছে? কেউতো ওদেরকে ঠেকাতেও পারছে না। ঠেকানোর উপায় নেই তো, বাঁধ তো ভেঙে গেছে, ওই যে তাতিয়ানার মনে হতো, মস্কো দু'পা ফাঁক করে বসে আছে, যাতে ওকে যে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই ভো্গ করে যায়।
মুদি দোকানে কাজ করতে করতে এক সময় তাতিয়ানা হাঁফিয়ে উঠতেন, কষ্ট হতো খুব। কিন্তু কাউকেই সেই কষ্টটা বুঝতে দেননি, কাঁদেননি কোনও দিনও। দুঃখে-শোকে আলেগটা পাঁড় মাতাল হয়ে গেলো, শুধু মদ গেলে আর ঝুম হয়ে বসে থাকে। কোনও কথা বলে না লোকটা। শুধু কাতিয়ার দিকে তাকিয়ে তাতিয়ানা অমানুষিক পরিশ্রম করে গেছেন, সামান্য বেতম থেকে বাঁচিয়ে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগতো খুব, এতো বড় দেশটা যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হলো তখন ভৌগলিক টুকরো নিয়েই গন্ডগোল হলো খুব, কিন্তু টুকরোগুলোর ভেতরে বাস করা মানুষগুলোর কী হবে তা নিয়ে কেউ কোনও দিন মাথা ঘামালো না। ওদিকে ভাগ হওয়ার পরের দিন থেকেই রাষ্ট্র যেনো সবকিছুকেই ব্যক্তির কাছে ফিরিয়ে দিলো ষোলো আনা গুনে গুনে, আর যেহেতু রাষ্ট্র কোনও ব্যক্তিকে চেনে না সেহেতু ব্যক্তির কাছ থেকে ষোল আনার ওপরে আঠেরো আনা নিতেও তার বাঁধলো না কিছুতেই। কেউ দিতে না পারলে নেই, রাষ্ট্র সেবা দিতে প্রস্তুত কিন্তু সেটা কিনতে হবে চড়া দামে, মূল্য দিতে না পারো তো মরো। তাতিয়ানা কেবলমাত্র তখনই অনুভব করেছিলেন যে, এখানেই মনে হয় ব্যক্তি থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়ে সমষ্টিতে মিলিয়ে দেওয়ার সফলতা, কিন্তু ততোদিনে তো রিগার সমুদ্র গল্প বলা বন্ধ করে দিয়েছে যদিও তার বাতাসের ঘ্রাণ তেমনই আছে, তীব্র, শিরশিরে অনুভ্থতি এনে দেওয়া।
দোকানের কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে তাতিয়ানার সবচেয়ে প্রিয় কাজ ছিলো নাতনি ইকাতেরিনাকে নিয়ে খেলা। ছোট্ট ইকাতেরিনা দাদিকে তার মায়ের চেয়েও বেশি চেনে। তার সমসত্দ আব্দার আহ্লাদ দাদির কাছে। রাতে দাদির পাশেই সে ঘুমোয় তার ছোট্ট বিছানায়। সকালে ঘুম থেকে জেগে গিয়ে দাদিকে খোঁজে, তাতিয়ানার তখন দোকানে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। নাতনির কাছে দাঁড়িয়ে ওর কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বলেন, 'সম্রাজ্জী দ্বিতীয় ইকাতেরিনার জন্য আজ কী আনতে হবে?'
ইকাতেরিনা বিছানায় আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলে, 'কিলাগ্রাম কমিউনিজমা' (এক কিলো কমিউনিজম)।
তাতিয়ানা অাঁতকে ওঠেন নাতনির কথা শুনে। তিনি প্রথমে বুঝতে পারেন না, এক কেজি কমিউনিজম কী করে কিনে আনবেন নাতনির জন্য। তিনি তাকিয়ে থাকেন নাতনির মুখের দিকে, ছোট্ট ইকাতেরিনাও কী বোঝে কে জানে, বলে, 'ওই যে সেদিন তুমি এনেছিলেন, মিষ্টির আর খুব মজা খেতে'।
হঠাৎই তাতিয়ানার মাথায় আসে ব্যাপারটা। ওদের দোকানে তার কিছুদিন আগেই একটা কেক এসেছে, যার নাম কমিউনিজমা, আসলে সেই লাল আমলেও এই কেকটা এতোই জনপ্রিয় ছিল যে, যে কেউ তার জন্য সারাদিন ধরেও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি। যদিও তখন এর নাম কমিউনিজম ছিল না, ছিল 'পিতিচিয়া মালাকো' বা পাখির দুধ। কিন্তু আজও তার অুন্ন জনপ্রিয়তার কারণেই তার বাজারও অপরিবর্তনীয়। আর সে কারণেই সেই লাল আমলের এই কেকটার নাম এর প্রস্তুতকারক কোম্পানীটি রেখেছে, কমিউনিজম। তাতিয়ানা ওর নাতনির দিকে তাকিয়ে থাকেন, বুকের ভেতর কষ্ট হয় খুব, কারণ এক কিলো কমিউনিজম কেনার মতো অর্থ তার নেই, বড়জোর আধা কিলো কমিউনিজম কিনে দিতে পারেন নাতনিকে, তার প্রিয়তম বংশধরকে...........আধ কিলো সমাজতন্ত্র, আধ কিলো কমিউনিজম...................
হাসতে হাসতে তাতিয়ানা নিজেকে টেনে নিয়ে আসেন ট্রেনের ভেতর। ব্রাইটনের ট্রেনটা অনেকৰণ ঝড়ের বেগে চলার পর এখন গতি কমিয়ে দিয়েছে, বোঝাই যাচ্ছে লন্ডন ভিক্টোরিয়া স্টেশন চলে এলো বলে। এইতো ভঙ্হল ব্রীজ পার হচ্ছে, নীচে থেমস, রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে, তাতিয়ানার ভেতরে এখন আর কোনও অস্থিরতা নেই, স্মৃতিচারণও নেই। কারণ ভিক্টোরিয়া স্টেশনে ঢুকতে ঢুকতে তাতিয়ানা মিখাইলভনার মনে হলো, তিনি এখন ইচ্ছে করলেই এক কেজি নয়, কয়েক কেজি কমিউনিজম কিনতে পারেন, একটি তিন তারা হোটেলের লবির কার্পেট ঝাড় দিয়ে আর টেবিলগুলো মুছে এক সপ্তাহে যা পান তা দিয়ে অনত্দতঃ পঞ্চাশ কেজি কমিউনিজম কেনা যায়; কিন্তু কিনে কী করবেন তাতিয়ানা? যে সময় প্রয়োজন ছিল সে সময় তো পার্টির গুদামে কমিউনিজম পঁচলো, দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে তা খুঁজে না পেয়ে মানুষ তো ভুলেই গেলো কমিউনিজমের কথা; অথচ তাতিয়ানা মিখাইলভনার মতো অনেকেই তা ভুলতে চাননি, ফেলতেও চাননি_ একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে তাতিয়ানা মিখাইলভনা ট্রেন থেকে নামলেন; ভিক্টোরিয়া স্টেশনে তখনও অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড় শুরম্ন হয়নি, তিনি অনায়াসেই বেরম্নতে পারলেন ব্যসত্দতম সড়কে, যেখান থেকে তিনি বাস ধরবেন তার ঘরে ফেরার, যে ঘরে একটি কালো মেয়ের সঙ্গে তিনি একটা রম্নম শেয়ার করেন, তিনি টিউব ধরবেন না, কারণ তাতিয়ানা মিখাইলভনা পয়সা বাঁচাচ্ছেন, কোনওদিন যদি আবার তাকে এক কিলোগ্রাম কমিউনিজম কিনতে হয়, তখন যাতে কম না পড়ে!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×