মন্দা অর্থনৈতিক অবস্থার কারনে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গ্রাম থেকে ইস্তাম্বুল শহরে দূরসম্পর্কের কাজিন মাহমুদ-এর আস্তানায় আসে ইউসুফ। উদ্দেশ্য কিছুদিন এখানে থেকে কোনো একটা জাহাজে খালাসীর চাকরি নিয়ে অবস্থার উন্নতি ঘটাবে। কিন্তু একদিকে অস্থির অর্থনৈতিক সময় অন্যদিকে নগরকেন্দ্রিক প্রতিকুল বাস্তবতায় সফল হয়ে ঊঠেনা তার কোনো প্রচেষ্টাই। তাই জীবন-জীবিকার তাগিদে আত্মীয়ের আশ্রয়ে পড়ে থাকে অনাকাঙ্খিত সময় ধরে, অনেকটা দৈবনুগ্রহের আশায়। গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধা মা’কে স্বান্তনা আর আশ্বাস দিয়ে দিয়ে, এবং চাকরির খোঁজে বন্ধুহীন শহরের অলি-গলি ঘুরে ঘুরে নিজেকে বারবার কেবল এক ভাগ্যাহতদের সারিতে আবিষ্কার করে ইউসুফ। তবু সে চেষ্টা চালিয়ে যায়।
মাহমুদ বিজ্ঞাপণী সংস্থার প্রতিষ্ঠিত ফটোগ্রাফার। কর্মক্ষেত্রে সফল হলেও ব্যক্তিজীবনে সেও পার করছে এক অস্থির সময়। অসুস্থ মা’র জন্য যথেষ্ট সময়, সেবা করতে না পারায় তার রয়েছে এক গভীর মনঃকষ্ট। সাবেক স্ত্রীর প্রতি, যে এখন অন্যের বিবাহিতা, তার জমে আছে চাপা কিন্ত গভীর এক অবদমিত ভালোবাসা। অন্যদিকে তার সাথে সংসারকালে এবর্শনজনিত জটিলতার কারনে সেই মেয়ে আর মা হতে পারবেনা বলে ভেতরে ভেতরে বিবেকের দংশনে জর্জরিত সে সবসময়। উদভ্রান্ত এ সময়টাতে অনেকটা নিজের কাছ থেকেই পালিয়ে থাকতে গিয়ে মাহমুদ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে একান্ত অন্তরংগ, নির্ঝঞ্ঝাট এবং গোছালো এক জীবনাচরণে। এরকম অবস্থায় চাকরির আশায় শহরে আসা বেকার আত্মীয়ের অযাচিত অবস্থান সে প্রথমে নির্লিপ্ত এবং কৌতুহলভরে মেনে নিলেও পরবর্তীতে তার কাছে সে হয়ে উঠে অস্বস্তিকর, শেষ পর্যন্ত অনেকটা উপদ্রবের মতো। ফলশ্রুতিতে কঠিন বাক্যবিনিময় এবং অসৌজন্যমুলক সংঘাত।
খুবই সাধারন, আটপৌরে এক বিষয়। আমাদের অনেকের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া, কারো কারো হয়তো অভিজ্ঞতালব্ধ কোনো ঘটনা। কিন্তু এই সাধারণ আবহের আড়ালে অন্তর্নিহিত হয়ে আছে দুটি প্রায় একই রকম বিপন্ন হৃদয়ের কাছাকাছি না আসতে পারার গল্প। সহজ, স্বাভাবিক দুটো মানুষ তাদের সকল সহজত্ব নিয়ে একে অন্যের কাছাকাছি আসার সব সুযোগ পেলেও শেষ পর্যন্ত বেছে নিলো পরস্পর থেকে দূরত্ব (uzak)। তবে মাহমুদ এবং ইউসুফ এই চরিত্র দুটির আপাত দ্বন্দমুখর এবং প্রায় নির্লিপ্ত সম্পর্কের আড়ালে গড়ে উঠেছিলো একটা অন্যরকম ভালোবাসা এবং সহমর্মিতার টান যেটা স্পষ্ট হয়ে দাগ কাটে দর্শকের মনের গভীরে, ছবির স্ক্রীনে নয়। একমাত্র এ কারনেই ছবিটা ভালো লেগেছে অন্য অনেক ভালো ছবির চেয়ে বেশী।
এছাড়া সিনেমাটিগ্রাফিটাও অসম্ভব সুন্দর। বিশেষ করে ছবির নিঃশব্দ অংশগুলার চিত্রায়ন ছিলো এক কথায় অসাধারণ। ছবিটার প্রেক্ষাপট ইস্তাম্বুলের মতো একটা শহরকে ঘিরে থাকলেও ছবি চিত্রায়নে বা সংলাপে এটাকে তেমনভাবে বিশেষায়িত করা হয়নি, যার কারনে ছবিটার সার্বজনীনতা দেশ-কাল-পাত্র ছাপিয়ে সহজভাবে সবাইকে আকৃষ্ট করে। ২০০৩ কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে Grand Prix জিতেছিলো ছবিটি। ২০০৪ সালে পেয়েছিলো বিদেশী ভাষায় শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে ফরাসী কালচারাল এওয়ার্ডও। কান ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার খেতাব পেয়েছিলেন যৌথভাবে মাহমুদ এবং ইউসুফ চরিত্রদানকারী যথাক্রমে মোযাফফার আজদেমীর এবং মেহমেদ এমিন।
আমার মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যখন জেনেছিলাম যে, শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার হাতে নেয়ার আগেই মাত্র ২৮ বছর বয়সে গাড়ী দূর্ঘটনায় প্রান হারিয়েছিলেন মেহমেদ এমিন।
আপনারা যারা ছবি-পাগল তারা পারলে ছবিটা দেখে নিবেন। আশ্বাস দিলাম- ঠকবেন না নিশ্চিত।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০০৮ রাত ১০:১৭