বুধবার সেনানিবাসের রজনীগন্ধা বাসায় সঙ্গে আলাপকালে ওই সময়ের হৃদয় বিদারক ঘটনার বর্ণনা দেন শহীদ সেনা সদস্যদের পবিারের সদস্যরা। বছর পার হলেও ঘটনার বিচার, পরিবারের বর্তমান পরিস্থিতি, সরকারি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়নসহ সার্বিক বিষয় তুলে ধরেন তারা। বিডিআর বিদ্রোহে নিহত অধিকাংশ সেনা কর্মকর্তার পরিবারে রয়েছে একাধিক শিশু সন্তান। স্ত্রীদের সব দুশ্চিন্তাই ওই শিশু সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে। এতিম ছেলে মেয়েদের সব দায়িত্ব এখন তাদের উপর। কিন্তু আর্থিক সহায়তা নেই। পরিবারগুলো জানিয়েছে, সরকারের কাছ থেকে একাকালীন ১০ লাখ টাকা ছাড়া আর কিছুই পায়নি তারা। এখন সংসার চলছে বেসরকারি ব্যাংকের অনুদানে। পরিবারগুলোকে ভাগ করে বেসরকারি ব্যাংক অনুদান দিচ্ছে। কিন্তু কতদিন দিবে তার নিশ্চয়তা নেই। সরকারের পক্ষ থেকে ফ্যাট দেয়ার কথা থাকলেও এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি হয়নি। এ বিষয়ে আর কোন কথা শুনেনি তারা।
শহীদ কর্ণেল গুলজাদের পরিবার
শহীদ কর্ণেল গুলজারের স্ত্রী মিসেস গুলজার বলেন, সেদিনের ভয়ঙ্কর স্মৃতি এখনো আমাদের তাড়া করে। প্রতি মূহুর্তে আতঙ্কের মধ্যে থাকি। রাতে ঘুমাতে কষ্ট হয়। তিনি দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে বলেন, আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন। যেন লেখাপড়া করে মানুষ হয়। প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে। তিনি বলেন, নতুন করে হারানোর আর কিছুই নেই। যা হবার হয়েছে। এখন কি হবে না হবে চিন্তা করি না। একমাত্র আল্লাহ আমাদের ভরসা। মেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তায় থাকি। মিসেস গুলজার দুঃখ করে বলেন, যা হারানোর হারিয়ে ফেলেছি। এখন কি হবে কি হতে পারে তা নিয়ে আর চিন্তা করিনা। শহীদ কর্ণেল গুলজারের দুই মেয়ে। বড় মেয়ে নবম শ্রেণীতে এবং ছোট মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ছে। মিসেস গুলজারের দাবী খুনীদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। এই অপেক্ষায় আছি।
শহীদ কর্ণেল নকিবুর রহমানের পরিবার
শহীদ কর্ণেল নকিবুর রহমানের স্ত্রী নিশাদ রহমান বলেন, যাকে হারিয়েছি তাকে তো আর ফিরে পাব না। তবে সরকারের কাছে একটাই দাবী, যারা প্রকৃত দোষী তাদের যেন সর্বোচ্চ শাস্তি হয়। খুনী ঘাতকদের ফাঁসি যেন দেখে যেতে পারি। কথা বলার এক পর্যায়ে মিসেস নকিব কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার জীবনে দুঃখের দিন, কষ্টের দিন একটাই। সেটা হলো ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এর চেয়ে বড় কোন দুঃখ কষ্ট আমার জীবনে নেই। বিয়ের পর গত ১৯ বছর একত্রে ছিলাম। জীবনে কোন দিন এক মূহুর্তের জন্যও শহীদ কর্ণেল নকিবের কাছ থেকে দুঃখ কষ্ট পাইনি। তিনি বলেন, সরকার তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সাহায্য সহযোগিতা করে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকেও নিয়ম মোতাবেক সহযোগিতা পাচ্ছি। বর্তমানে ক্যান্টনমেন্টের যে বাড়ীতে আছি সেখানে যাতে ১০ বছর থাকতে পারি সেই প্রত্যাশা করছি। শহীদ কর্ণেল নকিবুর রহমানের এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে নাবিল ইবনে নকিব। সে উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছে। মেয়ে নুছরাত বিনতে নকিব ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ছে। শহীধ কর্ণেল নকিবুর রহমানের বাড়ী খুলনা সদরে।
শহীদ কর্ণেল মোঃ রেজাউল কবীরের পরিবার
শহীদ কর্ণেল রেজাউল কবীরের স্ত্রী সাঈদা সুলতানা স্বামাীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, খুনীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক এটাই দাবী। তবে কেন এই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটানো হলো কারা এর পেছনে জড়িত। এই রহস্য অবশ্যই উদঘাটন করতে হবে। তিনি বলেন, আমি আমার স্বামীকে ফিরে পাব না। আমার সন্তানেরা তার বাবাকে পাবে না। কিন্তু সরকারের উচিত হত্যাযজ্ঞের পেছনের মূল রহস্য বের করা। আমরা জানতে চাই কেন এটা হলো। কেন শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের রক্ষা করা হলো না। র্যাব, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সংস্থার এতসব ফোর্স ছিল। তারপরেও কেন ব্যবস্থা নেয়া হলো না। এ প্রশ্ন আমার ছেলে মেয়েদের। ছেলে মেয়েরা এখনো বিষয়টি মেনে নিতে পারে না। আমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি। শহীদ রেজাউল কবীরের এক ছেলে দুই মেয়ে। বড় ছেলে ফয়সাল কবির, মেয়ে রায়সা কবির ও রামিজা কবির।
শহীদ লে. কর্ণেল সাইফুর ইসলামের পরিবার
বিডিআর বিদ্রোহে নিহত শহীদ লে. কর্ণেল সাইফুল ইসলামের স্ত্রী শাহিনুর পারভীন জবার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু এখন ছোট ছেলে দশম শ্রেণীর ছাত্র আদদ্বীনকে নিয়ে। আরো দুই ছেলের একজন চাকরি করছেন ট্রাস্ট ব্যাংকে, অন্যজন আছেন সেনাবাহিনীতে। সেনা সদর দপ্তরের বাসায় এখন ছোট ছেলে দ্বীনকে নিয়ে তিনি একাই থাকেন। পিলখানার নৃশংস ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘স্বামীর সাথে প্রথম যখন সেনানিবাসে এসেছিলাম, তখন মনের মধ্যে ছিল আনন্দ, এক ধরনের গর্ব। এখন আমরা পেয়েছি শুধুই চোখের পানি আর বিধবার সাদা শাড়ী।
তিনি বলেন, স্বামী হারালাম, সব হারালাম। এখন বেঁচে থাকাই আমার জন্য কষ্টকর হয়ে গেছে। সেদিনের দুঃসহ বর্ণণা আর স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। বলেন, একসময় সেনাবাহিনী, র্যাব নিয়ে গর্ব করতাম। এখন ভাবি কি হবে এসব দিয়ে। সেনাবাহিনী চাইলে ১০ মিনিটের মধ্যে বিডিআর বিদ্রোহের বিচার করা সম্ভব। তিনি বলেন, সব বিষয়ে আমরা আশাবাদী। সরকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে পরে আর কোন আলোচনা হয়নি। ফ্যাটের বিষয়েও কিছু হযনি। তবে আমরা আশাবাদী সরকার এতিম ছেলে মেয়েদের পাশে এসে দাড়াবে। জবা বলেন, সেনাবাহিনীর চাকরির টাকা দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হতো। তবুও শান্তিতে ছিলাম। কত কষ্ট করে সংসার গুছিয়ে রাখতাম। এখন তো কিছুই নেই। সব শূণ্য। একটি ছবি দেখিয়ে বলেন, এটাই ওর সঙ্গে আমার জীবনের শেষ ছবি। পূর্বাচলের প্লটে দাঁড়িয়ে ঘটনার কিছুদিন আগে তোলা ছবি। এই ছবি নিযে এত আলোচনা হবে ভাবতে পারিনি। ঘটনার সময় ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা যখন পিলখানা থেকে বের হওয়ার কথা স্মরণ করে বলেন, যখন বের হচ্ছি। তখন অগণিত অস্ত্র আমাদের দিকে তাক করে এগিয়ে আসে জোয়ানরা। আমি আমার ছেলেটির জন্য প্রাণ ভিক্ষা চাই। বের হওয়ার পর কোন সেনা সদস্য বা ব্যাবের সহযোগিতা পাইনি। সাধারণ মানুষ আমাদের সহয়তা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যে সিভিলিয়ানদের ভয় করতাম। তারাই আমাদের রক্ষা করেছে। সেনাবাহিনী কিছুই করতে পারল না।’ তার ছোট ছেলে আদদ্বীন বাবাকে স্মরণ করে ডায়েরী লিখে। ডায়েরীতে দ্বীন লিখেছে ‘বাবা তুমি তো বলেছিলে, মাকে দেখে রাখতে। আমি কথা দিলাম দেখে রাখব।’ বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলে, আমাদের প্রত্যাশা একটাই বিচার, বাবাকে তো পাবনা, যারা এত কষ্ট দিয়ে বাবাকে মেরেছে তাদের বিচার চাই। বিচার সেনা আইনে হতে হবে। পড়তে গেলে, ঘুমাতে গেলে বাবার কথা মনে পড়ে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারি না।
শহীদ মেজর মোছাদ্দেক হোসেনের পরিবার
বিডিআর বিদ্রোহে শহীদ মেজর মোছাদ্দেক হোসেনের স্ত্রী কোহিনুর হোসেন এখনো ভাবতেই পারছেন না তার স্বামী নেই। তিনি বলেন, মাঝে মাঝে মনে হয় কোন বিদেশী মিশনে কর্মরত আছেন তার স্বামী। শিগগিরই ফিরবেন। কোন এক ভোরে দরজায় এসে কড়া নাড়বেন। সেনিবাসের বাসায় ছোট মেয়ে নাজিয়া তাবাস্সুমকে নিয়ে থাকেন তিনি। বড় মেয়ে নাজিফা তাবাস্সুম ময়মনসিংহ ক্যাডেট কলেজে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কোহিনুর হোসেন বলেন, আমার স্বামী ছিলেন অন্যদের চেয়ে আলাদা। অনেক বেশি ‘কেয়ারিং’ ছিলেন তিনি। প্রতিটি বিষয়ে খোঁজ রাখতেন। এমনকি মোবাইলে টাকা শেষ হয়ে গেলে নিজে রিচার্জ করে দিতেন। তিনি বলেন, এখন প্রতিটা সময় আতঙ্কে থাকি। একটু শব্দ পেলেই ভয় পাই। ভাই-ভাবীদের ফোন করি। তিনি বলেন, বিচারটাই আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া। কারণ নিরস্ত্র অফিসারগুলো নৃশংসভাবে মারা গেল। কিন্তু নির্দেশ দিলে তারা লড়াই করে মরত। তার স্বামীর সাহসের উদাহরণ দিয়ে বলেন, বিয়ের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের চাররির সময় একদিন আমাকে বলছিল, এখন যদি কেউ আক্রমন করে, আমি গুলি শুরু করব। আমি মারা গেলে তুমি গুলি করবা। তখন আমি হাসছিলাম। এত সাহসী মানুষ এভাবে নিসস্ত্রভাবে মারা গেল? তিনি বলেন, সেনাবাহিনী চাইলেই সবকিছু করা সম্ভব। তখন দেশে নতুন সরকার ছিল। সরকার হয়তো সবকিছু বুঝে ওঠতে পারেনি। কিন্তু সেনাবাহিনীতো সবকিছু জানতো। শুরুতে ব্যবস্থা নিয়ে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না। মিসেস মোছাদ্দেক বলেন, আমার মেয়েগুলোকে নিয়ে আমার আশঙ্কা এখন। তারা কিছুতেই বাবাকে ভুলতে পারেনা। এক রাতে দেখি বড় মেয়েটা বিছানায় নেই। পরে দেখি বারান্দায় দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞাস করলে বলে, তারার মধ্যে আব্বুকে খুজঁছি। তিনি বলেন, এখন আমাদের বিশেষ সাহায্য দরকার। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সহায়তায় এখন আমাদের সংসার চলছে। এই সাহায্য কতদিন চলবে তাও বলতে পারছিনা। বিচারের ব্যাপারে তিনি বলেন, নিশ্চয়ই তাদের বিচার হবে। জাতির জনকের হত্যার বিচার যখন হয়েছে। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার বিচারও হবে।
শহীদ লে. কর্ণেল আবু মুসা মোঃ আইয়ুব কায়সারের পরিবার
শহীদ লে. কর্ণেল আবু মুসা মোঃ আইয়ুব কায়সারের স্ত্রী নুসরাত জাহান পিলখানার নৃশংস ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, সেদিনের কথা ভুলা দায়। প্রতি মূহুর্তে ঘুরেফিরে বিদ্রোহের দিনের স্মৃতিই মনে পড়ে। তিনি বলেন, আমার স্বামী মারা গেলেন। আমরা সবকিছু হারালাম। এখনও তার কিছুই হলো না। আমরা সঠিক বিচার চাই। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। মিসেস কায়সার বলেন, এখনো আমরা আতঙ্কে থাকি। আমাদের নিরাপত্তা দরকার। বিডিআরের ডালভাত কর্মসূচী নিয়ে মিথ্যা প্রচারণার কারণে মানুষ আমাদের উপর ক্ষেপে আছে। সমাজে আমাদের কটাক্ষ করা হয়। ঘটনার বিচার না হলে আমাদের সমাজে বাস করা কঠিন হয়ে পড়বে। আইয়ুব কায়সারের দুই মেয়ে বড় মেয়ে কারিসা নুসরাত এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। ছোট মেয়ে সাইকা নুসরাত সবে মাত্র হাটছে। মিসেস কায়সার বলেন, সরকারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা ছাড়া আমরা কিছুই পাইনি। কোন মনিটরিং নেই। শুরুতে কিছুদিন খোঁজ খবর নিলেও এরপর আর কোন খবর নেই। আমাদের প্লট দেয়ার কথা থাকলেও পরে আর কিছুই হয়নি।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, সর্বশেষ ২৫ তারিখ সকাল ১০টায় আমার সাথে ল্যান্ডফোনে কথা হয়। আমাকে বলছিল, আমরা বন্দি আছি। সমস্যা নেই। মিসেস কায়সার বলেন, পরে আমরা বুঝতে পারলাম সে হয়তো জানতো মারা যাবে। কিন্তু আমাদের বুঝতে দেয়নি। সকাল সাড়ে ১০টা আবার বড় মেয়ের সাথে কথা হয় বলে জানান মিসেস কায়সার।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১০ সকাল ৮:০৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



