somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিদেশ নির্ভরতা ও স্বদেশের বিপর্যয়

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ১০:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটি দেশ স্বাধীন এবং সার্বভৌম কি না তা মূলত নির্ভর করে সম্পদের উপর সে দেশের জনগণের মালিকানা, কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কি না তার উপর। সে হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন। যে সীমিত অনাবয়নযোগ্য সম্পদ (তেল-গ্যাস-কয়লা) এ দেশের মানুষের জন্য হতে পারে পরম কল্যাণের সেই সম্পদই তাঁর জন্য চরম বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তেল-গ্যাস-কয়লার উপর আধিপত্য কায়েম করার জন্য যেমন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সক্রিয় তেমনি সরকার-আমলা-আত্মবিক্রিত বুদ্ধিজীবিরা এ সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছে।
কথাগুলো বলা প্রয়োজন হলো এজন্য যে, বর্তমানে দেশে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে সাগরবক্ষের গ্যাস এবং ফুলবাড়ীর কয়লা উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে উত্তোলন করতে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, সভা-সমাবেশে সরকার ও আত্মবিক্রিত সুশীল বুদ্ধিজীবিরা কোম্পানির পক্ষে প্রচারণায় মত্ত। কোম্পানির পক্ষে যুক্তিগুলো কি ধরণের? ‘আমাদের পুঁজি নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, প্রযুক্তি নেই, অভিজ্ঞতা-দক্ষতা নেই সুতরাং বিদেশীদের উপর নির্ভর না করে উপায় নেই’, ‘গ্যাস-তেল-কয়লা রপ্তানি করলে দেশের লাভ, উন্নয়ন হবে’, ‘কয়লা উত্তোলনের জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতি শ্রেষ্ঠ কেন না এতে বেশী কয়লা উঠানো যায়’ ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কিত এ দৃষ্টিভঙ্গী কোম্পানিকেই পরিপুষ্ট করে কিংবা বলা যায় কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গীই এভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
গত ২৫ অক্টোবর ড. তারেক শামসুর রেহমান দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় ‘জ্বালানী নিরাপত্তা ও রনো ভাইয়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে’ একটি কলাম লিখেছেন। সেখানে তিনি ‘জ্বালানী নিরাপত্তা’ নিশ্চিত করার জন্য সমুদ্রসীমায় গ্যাস উত্তোলন এবং উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের কথা বলেছেন। সমুদ্রসীমায় গ্যাস উত্তোলনের জন্য তিনি ভরসা করতে চাচ্ছেন বিদেশী কোম্পানির উপর এজন্য যে, ‘অনুসন্ধান এবং উত্তোলন কাজে বিপুল অর্থ ও কারিগরি জ্ঞান প্রয়োজন’ তা জাতীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের নেই। আসলে কি তাই?
১৯৮৯ বাপেক্স প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে বিদেশী কোম্পানি যে ১৭টি কূপ খনন করে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে সেগুলোর সম্ভাব্যতা প্রথমে যাচাই করে পেট্রোবাংলা/বাপেক্স। সালদা নদী, শাহবাজপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ-২, বেগমগঞ্জ, শ্রীকাইলে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বাপেক্স। বিদেশী কোম্পানি নাইকো (ফেনী-২), টাল্লোর (লালমাই, ভাঙ্গুরা, চাঁদপুর) ২-ডি সিসমিক সার্ভে করা, কন্ট্রোল পয়েন্ট স্থাপন করে দেয়া এমনকি কূপ ড্রিলিং (ওয়ার্ক ওভার) করে দেয় বাপেক্স। পেট্রোবাংলার বিজিএফসিএল-এর হবিগঞ্জ-৯ কূপ খনন করে দিয়েছে বাপেক্স। এছাড়া কম খরচে কূপ খননের যোগ্যতা-দক্ষতার প্রমাণ আছে এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানটির। দেশী/বিদেশী কোম্পানির মিলিত সাফল্যের হার যেখানে ৩:১ সেখানে বাপেক্স-এর সাফল্যের হার ২.২৫:১ (১৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করে ৮ টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার)। তাও পুরাতন যন্ত্রপাতি দিয়ে। নতুন ড্রিলিং রিগ কেনার জন্য প্রয়োজন ৮০ কোটি টাকা; সেটি সময়মতো না দেয়া সত্বেও বাপেক্স-এর সাফল্যের হার দেশে কাজ করা যে কোন আইওসি’র চাইতে বেশী।
অন্যদিকে অক্সিডেন্টাল এবং নাইকো মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় যে ব্লো-আউট ঘটিয়েছে তাতে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ছাড়াও আর্থিক হিসেবে সে ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার উপরে যে টাকা এখন পর্যন্ত সরকার আদায় করেনি। সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যার কারণে ৩০ বার উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হয় কেয়ার্ন এনার্জি। এমনকি তড়িঘড়ি করে ক্যাপাসিটির বেশী উত্তোলন করতে গিয়ে গ্যাস উত্তোলনের অনেক আগে তার উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করে। শেভ্রন লাউয়াছড়াতে কিভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল সে ইতিহাসতো কমবেশী সবারই জানা। উৎপাদন ক্ষমতা নষ্ট করার মতো সে ধরনের কোন ইতিহাস পেট্রোবাংলা/বাপেক্সের নেই। এমনকি পঙ্গু করার শত চেষ্টা কিংবা সময়মতো যন্ত্রপাতি, জনবল না দেয়া, লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করার নানা অপচেষ্টা সত্বেও পেট্রোবাংলা ২০০৮-‘০৯ অর্থবছরে ৩৩৪৯ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে যার মধ্যে বাপেক্স এর পরিমাণ ৮২ কোটি টাকা। পেট্রোবাংলা সরকারকে প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস দিতে পারে ২৫ টাকায় যেখানে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে খরচ হয় ২৫০ টাকা। যার জন্য প্রতি বছর গ্যাস-বিদ্যুৎ অতি উচ্চ মূল্যে কেনার জন্য জনগণের পকেট থেকে এ বাবদ ভতুর্কি দিতে হয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। এতে বাজেট ঘাটতি বাড়ে, অতি কষ্টে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ বাড়ে, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ে।
জনাব তারেকের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, সমুদ্রের গ্যাস উত্তোলন করতে কমপক্ষে ৭/৮ বছর সময় লাগবে। প্রতি বছর তার জন্য প্রয়োজন গড়ে ১০০০ কোটি টাকা মাত্র। একটি দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য এ অর্থ কি খুব বেশী? যেখানে ভর্তুকির পরিমাণ ৪০০০ কোটি টাকার মতো! এছাড়া পেট্রোবাংলা ও তার অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে ট্যাক্স, ভ্যাট, লভ্যাংশ মিলিয়ে গত অর্থ বছরে যেখানে ৩৩৪৯ কোটি টাকা দিয়েছে (এই পরিমাণ আগের অর্থ বছরের তুলনায় বেশী) এবং বছরে বাপেক্স আয় করে গড়ে ১৩’শ কোটি টাকা। তারপরও কি জনাব তারেক বলবেন, অর্থের অভাব? জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অভিজ্ঞতা-যোগ্যতা-দক্ষতা নেই? বিদেশীদের হাতে গ্যাস ক্ষেত্র তুলে দেওয়া দরকার?
মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস এবং পেট্রোবাংলা সমবয়সী। পেট্রোনাসকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার কারণে সেটি এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিপরীতে জন্মের পরপরই পেট্রোবাংলা/বাপেক্সকে অথর্ব একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার প্রক্রিয়া চলছে। সে প্রক্রিয়া বিভিন্ন সরকারের আমল পেরিয়ে এখনও জায়মান। অল্প কয়েকটি উদাহরণ দিলেই চিত্রটি পরিষ্কার হবে। (১) পেট্রোবাংলাকে একটি নির্দিষ্ট দরে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও কেয়ার্নকে তৃতীয় যে কোন পক্ষের কাছে (বর্তমান গ্যাস সংকটের সুযোগে) বহুগুণ বেশী দামে বিক্রয় করে আকাশচুম্বি মুনাফার সুযোগ দেয়া হয়েছে। (২) বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনকে দুই দফায় ১২ ও ১৩ নম্বর ব্লকে বিনা প্রতিযোগিতায় বিরাট এলাকায় সিসমিক জরীপ করার কাজ দেয়া হয়েছে - বিধি অনুসারে দেশে জাতীয় সংস্থা বাপেক্সকে দেবার কথা। (৩) সুনির্দিষ্ট বিধি লংঘন করে বিনা প্রতিযোগিতায় শেভরনকে ৫৫.৭ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে চালু গ্যাস পাইপ লাইনের চাপ বাড়ানোর জন্য কমেপ্রসার যন্ত্র সরবরাহ ও সংস্থাপনার কাজ দেয়া হয়েছে। কেন? এজন্য কি যে, তাদের যোগ্যতা নেই? নাকি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে অতি মুনাফা বৃদ্ধির রাস্তা পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য এ প্রক্রিয়া? রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ-পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি আমদানি, ট্রেনিং, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগ খুলে যেখানে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, দক্ষ জনশক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করা যায় সেখানে এ কাজগুলো না করে জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অদক্ষ, পঙ্গু করার নীতি নেওয়া হয়েছে কাদের স্বার্থে? এছাড়া দক্ষতার কথা যদি ধরি তাহলে, এটি কি এমন জিনিস যেটি ‘একদা সুন্দর প্রভাতে হঠাৎ করিয়া আসমান হইতে পড়িবে? নাকি গড়িয়া তুলিতে হইবে?'‌
মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস কিংবা ভেনেজুয়েলার পিডিভিএসএ - এসব প্রতিষ্ঠান অফশোরে আগে থেকেই দক্ষ হয়ে জন্ম নিয়ে কাজ শুরু করেনি। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এবং পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠান লালিত পালিত হয়েছে। সে ধরনের কাজ এ দেশের সরকার করতে পারে। কিন্তু করছে না। কেন?
এবার আসি ফুলবাড়ী প্রসঙ্গে। জনাব তারেক উন্মুক্ত খননের পক্ষে। এশিয়া এনার্জিও চায় উন্মুক্ত খনন। কারণ উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হলে সুড়ঙ্গ পদ্ধতিতে উত্তোলিত কয়লার চাইতে বেশী পরিমাণ পাওয়া যাবে এবং রপ্তানি করা হলে তাতে তাদের অতিলাভ হবে। সুতরাং উন্মুক্ত পদ্ধতি এশিয়া এনার্জির কাছে শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক যে ঘটনাগুলো ঘটতে থাকবে সেগুলোর শিকার হবে দেশের মানুষ ।
ফুলবাড়ীতে উত্তোলনযোগ্য কয়লার মজুদ আছে ৫৭২ মিলিয়ন টন। এশিয়া এনার্জির কয়লা প্রকল্পের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রায় ১.৫ মিলিয়ন টন কয়লা উত্তোলন হবে যা ২০১১ সাল নাগাদ এই পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ১৫ মিলিয়ন টন-এ। এর মধ্যে ১২ মিলিয়ন টন রপ্তানি হবে যার ৪ মিলিয়ন টন যাবে ভারতে। শুধু ৩ মিলিয়ন টন দেশের ভেতর ব্যবহার হবে। এছাড়া উন্নতমানের সিলিকা (বালি), সিরামিক বালি ও মাটি, মধুপুর ক্লে, নুড়িপাথরসহ যা যা পাওয়া যাবে সেখানে তার হিসাব বাদ দিয়ে। শুধু কয়লার হিসাব ধরলে প্রতিবছর প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা হিসেবে ৩০ বছরে কোম্পানি আয় করবে মোট ১ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা। অথচ বিনিয়োগ করবে ৯২৫০ কোটি টাকা। যদিও তারা হিসাব বাড়তি দেখিয়ে বলেছে ৭৯২০০ কোটি টাকা (মূলধনী খরচ ১৩ হাজার কোটি টাকা বাকিটা অপারেটিং খরচ)। লাভ প্রথম হিসাবে ১৬২১%, পরের হিসাবে ১০০%। এর নাম কি লাভ, নাকি লুণ্ঠন?
অন্যদিকে কয়লা সম্পদের মালিক যে জনগণ তাদের হিসাবটা দাঁড়ায় কি রকম? ৬% রয়্যালটি ও ট্যাক্স মিলিয়ে ৩০ বছরে বাংলাদেশ পাবে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। বছরে ১৫০০ কোটি টাকার একটু বেশী। অথচ কয়লা মাটির নীচে থাকা অবস্থাতেই সেখানে অর্থনৈতিক উৎপাদন হয় ১৮০০ কোটি টাকা। অন্যান্য ক্ষতি বাদ দিয়ে নীট আর্থিক ক্ষতি ৩০০ কোটি টাকা।
কোম্পানির তথ্য অনুযায়ী খনি এলাকা ১৩৫ বর্গ কি.মি.। পানি নিষ্কাশনসহ যেসব পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৬৫৬.৩৩ বর্গ কি.মি.। এই ক্ষতির হিসাবটি কি রকম? খনি এলাকাটি খুবই উর্বর, তিনফসলী জমি, কৃষিফলন খুব ভালো (বাংলাদেশের ধান ভাণ্ডার বলা হয় ঐ অঞ্চলটিকে), অর্থনৈতিকভাবে খুবই সক্রিয় জনগোষ্ঠী, অকৃষিখাতের তৎপরতাও দ্রুত সমপ্রসারণশীল, ঘনবসতি এলাকা। উন্মুক্ত কার্যক্রম শুরু হলে পুরো এলাকার আউশ আমন ইরি বোরো ধান, গম, সরিষা, আলু, ভুট্টা, কলা, আখ, পাট, মরিচ, রশুন, পিঁয়াজ, শাকসব্জি, অগুণতি ফলজ ও বনজ বৃক্ষ, নদী, বিল, সহস্রাধিক মৎস খামার, হাঁস-মুরগী, গবাদী পশু ইত্যাদি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এছাড়া রয়েছে দোকান-পাট, ব্যবসা। অর্থাৎ সমস্ত এলাকার অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক তৎপরতা বিলুপ্ত হবে।
ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প বিচার বিশ্লেষণ করে মত দেবার জন্য সরকার থেকে ২০০৬ সালে প্রফেসর নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতামত হল: বিপুল পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের ফলে খনি এলাকার ঘিরে বহুদূর পর্যন্ত পানির স্তর এমনভাবে নেমে যাবে যা উত্তরবঙ্গ জুড়ে আবাদ সংকট, খাবার পানির সংকট তৈরি করবে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যাপকভাবে আর্সেনিক ও অন্যান্য বিষাক্ত রসায়ন দূষণের শিকার হবে যা বিস্তৃত এলাকায় মানবিক বিপর্যয় ঘটাবে। উপরের মাটির আবরণ সরাবার ফলে বৃষ্টি ও জালের মতো ছড়ানো নদ-নদী খাল-বিল দিয়ে দূষণ পুরো উত্তরবঙ্গ তো বটেই দেশের অন্যান্য অঞ্চলকেও আক্রান্ত করবে, পুরো উপত্যকা দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যস্ত হবে। (বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্ট, সেপ্টেম্বর ২০০৬)
১৯৮৭-১৯৯১ সময়কালে যুক্তরাজ্যের খনিজ অনুসন্ধান ও কনসালট্যান্সি ফার্ম হিসেবে খ্যাত মেসার্স ওয়ার্ডেল আর্মস্ট্রং-এর হিসাব অনুযায়ী ৩০ বছরের খনি জীবনে প্রতি সেকেন্ডে সেখানে ৮ থেকে ১০ হাজার লিটার পানি প্রত্যাহার করতে হবে। এত দীর্ঘসময় ধরে এভাবে ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের যে ফলাফল তা যে ভয়াবহ বিপর্যয় তৈরি করতে পারে সেটা খনির জন্যও অনুকূল নয় (ডেইলি স্টার, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৭) ।
এছাড়া কত প্রাণবৈচিত্র্য-জীববৈচিত্র্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এগুলো হচ্ছে সামান্য ক্ষতি! প্রায় ২ লক্ষ মানুষ উচ্ছেদ করে, কোম্পানির হিসাব মতে, ২১০০টি স্বল্পমেয়াদী এবং ১১০০টি দীর্ঘমেয়াদী চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি হবে। এটি এই দেশের মানুষের লাভ! যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে আগ্রাসী ভূমিকা চালিয়ে যাচ্ছে সেই মার্কিন সরকার মনটানা সীমান্তের কাছে একটি উন্মুক্ত খনির উদ্যোগে প্রবল আপত্তি জানিয়েছে। গত ২০০৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে পাঠানো চিঠিতে এই আপত্তির কারণ হিসেবে বলা হয় কানাডা সীমান-বর্তী এলাকায়, মার্কিন সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল উত্তরে পাহাড়ী অঞ্চলে এই উন্মুক্ত খনি করলে তাতে তাদের সীমানায় গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক, ঝর্ণা এবং পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম প্রাকৃতিক লেকের অপূরণীয় ক্ষতি হবে (ওয়াশিংটন পোষ্ট, ৯ মার্চ, ২০০৭)।
ভূমি, মাটি, পানি, পরিবেশকে কোন ক্ষতি না করে উত্তোলনের নতুন নতুন পদ্ধতি নিয়ে দেশে দেশে গবেষণা হচ্ছে। বিশেষত বায়ুমন্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি যেভাবে পুরো বিশ্বকেই ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে সেখানে এই গবেষণার গুরুত্ব অনেক। কয়লাকে গ্যাসে রূপান্তর করে তার ব্যবহার এর অন্যতম। যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসে রূপান্তরিত কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্ট বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পদ্ধতিই কয়েক দশকের মধ্যে কয়লা ব্যবহারের প্রধান পদ্ধতি হয়ে উঠবে। এই পদ্ধতি বাংলাদেশে ব্যবহার করা যায়।
জনাব তারেক আরেকটি কথা বলছেন যে, আন্দোলনের ফলে ভুল বার্তা বিদেশ পৌঁছে যেতে পারে। আমি মনে করি, ভুল নয় সঠিক বার্তাটাই পৌঁছাচ্ছে বিদেশের কাছে। সেটি হলো; দেশের সম্পদের মালিক এ দেশের জনগণ, সম্পদ বিদেশী কোম্পানির লুণ্ঠন-মুনাফার জন্য নয় কিংবা রপ্তানির জন্য নয়, দেশের সম্পদ জনগণের সর্বোচ্চ কাজে ব্যবহারের জন্য, ধ্বংসযজ্ঞের উপর দাঁড়ানো বহুজাতিক কোম্পানির লুণ্ঠনধর্মী মুনাফা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া দেশের মানুষ মেনে নেবে না।
সুতরাং কোম্পানির বিবেচনায় নয় দেশের মানুষ বিবেচনায় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন সম্ভব নয়। সাগরবক্ষের গ্যাস-তেল ৮০ ভাগ রপ্তানির সুযোগ রেখে কনোকো ফিলিপস এবং টাল্লোকে দেয়ার যুক্তিযুক্ত কোন কারণ নেই।
পুঁজি নেই, প্রযুক্তি নেই, দক্ষতা নেই, যোগ্যতা নেই কিংবা আমরা পারবো না; সমাজের মধ্যে এ কথাগুলো ছড়ালে কিংবা হীনমন্ম্যতাবোধে আক্রান্ত হলে কাদের সুবিধা? সুবিধা হয় কোম্পানির, সুবিধা হয় কোম্পানির সহযোগী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর, সহযোগী সরকারের, সুবিধা হয় কমিশনভোগী এজেন্ট, দালাল, ইতিহাসবোধশূন্য ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের (বহুজাতিক কোম্পানি আর তাদের সহযোগী শাসকদের দ্বারা ‘উন্নয়ন’-এর নামে নাইজেরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, সোমালিয়া, সুদানের লুণ্ঠনের ইতিহাস মনে রাখে না)। তার বিপরীতে জাতীয় কমিটির আন্দোলনের কারণে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিবিয়ানার গ্যাস রপ্তানি হতে পারেনি, টাটার বিনিয়োগ থাবা থেকে আপাতত রেহাই পেয়েছে গোটা জাতি, বিএনপি এবং জোট সরকারের সময় এশিয়া এনার্জির ফুলবাড়ীর ধ্বংসপ্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারেনি এখন পর্যন্ত, বন্দর রক্ষা পেয়েছে - এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এ আন্দোলন করতে গিয়ে জাতীয় কমিটির উপর পুলিশী-সন্ত্রাসী হামলা, মামলা হয়েছে, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। কমিটির অর্থের উৎস সম্পর্কে নানা সময় প্রশ্ন করা হয়েছে। নেতৃবৃন্দকে নানা সময় নানা ভাবে হেনস্তা করার প্রক্রিয়াও জারি আছে। জেনে-বুঝে কিংবা না জেনে-না বুঝে। তারেক শামসুর রেহমান কোন যাচাই-বাছাই না করে সে ধরনেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
জনাব তারেক কমিটির সদস্য সচিবের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একাধিকবার যাওয়ার বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আমরা জানি, আনু মুহাম্মদ একাধিকবার নয়, একবার, ১৯৯৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। এই একবারের কথা ধরেই ঊনারা ‘একাধিকবার’ বলতে চান। এটি হচ্ছে একটি নমুনা যে, জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দের নামে কীভাবে অপপ্রচার চালানো হয়।
তিনি সাম্রাজ্যবাদের দালাল বানানোর প্রক্রিয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন এবং এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার আকাঙ্ক্ষাও ব্যক্ত করেছেন। কিন' তাঁর সন্দেহ দূর করার জন্য জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ কি কি উদ্যোগ নিতে পারে? তিনি বলছেন ‘আনু’রা হচ্ছে সমাজের ‘বিবেক’। তাহলেতো সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বিবেককে তো সন্দেহ করে শয়তান, সেটি কি জনাব তারেক ভুলে গেছেন? এখন জনাব তারেক কোন পক্ষে যাবেন সেটি তাঁকেই ভাবতে হবে। শয়তানের না বিবেকের পক্ষে? যদি বিবেকের পক্ষে হয় তাহলে তাঁর উচিৎ যে কোন তথ্য পেলে সেটি যাচাই-বাছাই-পর্যালোচনা করে গ্রহণ-বর্জন করা। শয়তানের বিপক্ষে কলম ধরা। ঊনি শিক্ষক মানুষ। সুতরাং ঊনি বিজ্ঞানমনষ্ক হবেন সেটি মানুষ আশা করে।
একটি দেশ দখল করতে হলে কয়েকটি কাজ করা দরকার হয়। প্রথমত: সরকারকে হাত করা কিংবা দখলদারদের পছন্দমাফিক সরকার বসানো। দ্বিতীয়ত: আত্মবিক্রিত বুদ্ধিজীবিদের নিজেদের তাঁবে নিয়ে আসা। তৃতীয়ত: জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধীরে ধীরে ধ্বংস করার নীতি গ্রহণ করা। চতুর্থত: পুরো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘আমরা পারবো না’ ধরনের হীনমন্মতার বোধ তৈরী করা। অভিজ্ঞতায় বলে, এ কয়েকটি কাজ বাংলাদেশে বেশ ভালভাবেই হয়েছে।

[এ লেখাটি বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠানো হয়েছিল কিন্তু কেউ তা ছাপতে রাজি হয়নি।]

সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০১০ রাত ২:১৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×