আমরা এখন আর অনেক কিছুতে আশ্চর্য হই না। অনুভূতির স্নায়ুগুলো দুর্বল হতে হতে নাই হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। অনেক কিছুই আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে। মেনে নিয়েছি। চোখের সামনে ঘটে অস্বাভাবিক ঘটনা, সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা করি। স্বাভাবিক মনে হয়। প্রশ্ন জাগে না। কিংবা জাগলেও, ভেবে নেই, ‘কিছুই করার নেই’, ‘যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলবে’, ‘নিয়তি’। কিন্তু তারপরও চলতে থাকা এই ‘স্বাভাবিকতা’কে প্রশ্ন করার মতো সাহস কারো কারো জেগে ওঠে। সেটিই ভরসা। না হলে তো বদল হতো না। বদল করার প্রশ্নের সাথে সেজন্য সংঘাত বাঁধে। এই সংঘাত না হলে প্রাগৈতিহাসিক যুগেই মানুষ পড়ে থাকতো। সেটি হয়নি। সেজন্য, যা হচ্ছে তা মেনে না নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন জরুরী। বিশেষ করে, যারা রাষ্ট্রের তদারকীতে থাকে তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানো কর্তব্য।
আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকা শহরের পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়ে এমনতর কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। রাজধানীতে ছয় হাজার ট্যাক্সি ক্যাব নামানোর সরকারী সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তিনি মহা বিরক্ত। বিরক্তি, ক্ষোভ নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘‘সরকারতো মুর্খ। যানজটে জনজীবন অস্থির, তার উপর ৬০০০ ট্যাক্সি ক্যাব নামাতে চাচ্ছে। এরা আসলে কী চায়? মানুষকে দেশে বসবাস করতে দেবে না?” বিরক্তিটা শুধু তাঁর একার নয়। রাজধানীতে বসবাসরত অধিকাংশ পরিবহণ যাত্রীদের। গন্তব্যে যেতে যদি নির্দিষ্ট সময়ের চাইতে অধিকাংশ সময় বাস-গাড়ীতে বসে থাকতে হয়, শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়, উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হয়, কর্তাব্যক্তিদের গালাগালি শুনতে হয়, অর্থের অপচয় হয়; তাহলে বিরক্তি, ক্ষোভ, অস্থিরতা, ঘৃণা আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। খুবই স্বাভাবিক।
জনগণের দিক থেকে খুবই স্বাভাবিক কিন্তু একটি ‘গণতান্ত্রিক’ সমাজ ব্যবস্থার জন্য খুবই অস্বাভাবিক এ অবস্থা একদিনে তৈরী হয়নি। জনগণের জীবন-মানের এই ক্রমাবনতি অতীতের ধারাবাহিকতার ফসল। সমাজ ব্যবস্থা পরিচালনের জন্য সরকারি যে নীতি-দর্শন, তার প্রতিফলন এ অবস্থা। বাজারি নীতি আর কিছু হোক মানুষ দেখে না। দেখে ক্রেতা, দেখে ভোক্তা। সরকার এই বাজার নীতির ধারক-বাহক বিধায় জনগণের কীসে লাভ, কীসে ভোগান্তি; তাতে তার নজর থাকার কথা নয়; রাখেওনি। নজরটি কর্পোরেটকেন্দ্রিক। কোন কোম্পানির কীভাবে লাভ হবে; তার দিকে নজর আছে বেশ। নাহলে কেন এই ট্যাক্সি ক্যাব নামানোর সিদ্ধান্ত?
যানজটে নাকাল রাজধানীবাসি। ঢাকা শহরের ৮ ভাগেরও কম সড়ক। তাতে অবশ্য কিছু এসে যায় না। লণ্ডন নগরে মোট সড়কের পরিমাণ ১৫ ভাগেরও কম। সেখানে যানজট নেই বললেই চলে। লস এঞ্জেলস-এ ৩০ ভাগেরও বেশী সড়ক। সেখানে তুলনায় অনেক বেশী যানজট। সমস্যাটি তাই পরিমাণের নয়। পরিকল্পনার। যানবাহনের ধরণ এবং চরিত্রের। সড়কের চাইতে যদি ব্যক্তিগত গাড়ীর সংখ্যা বেশী হয় তাহলে যানজট অবশ্যম্ভাবী। সেক্ষেত্রে, ট্রাফিকিং ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজালেও তাতে যানজট মুক্ত হওয়ার নয়। খুব স্বাভাবিক একটি হিসাব যে, ৫০টি ব্যক্তিগত গাড়ীতে গড়ে একশ’ জনও প্রতিদিন চলাচল করে না। কিন্তু স্থান সঙ্কুলান করে প্রায় ২০টি বড় বাসের সমান জায়গা। অথচ, ২০টি বাসে যাত্রী বহণ করে ১,০০০! প্রতিদিন গড়ে ১০০টি প্রাইভেট গাড়ী নামছে রাস্তায়। তাহলে, আড়াই দিনেই ২৫০টি গাড়ী নামানো হচ্ছে। এক মাসে ৭,৫০০টি। তাহলে, প্রধান-উপ সড়কগুলোতে যানজট তীব্র না হওয়ার কী কোন কারণ আছে? আমাদের এখনো সৌভাগ্য যে, চাবি খুলে প্রতিদিন ঘর থেকে বের হওয়া মাত্রই আমরা যানজট দেখছি না।
রাজধানীতে এখন প্রাইভেট গাড়ীর সংখ্যা ২,৩০,০০০ এর মতো। চার জনের হিসেবে তাতে লোক আটে ৯,২০,০০০। ঢাকা শহরে সংরক্ষিত হিসেবে প্রায় দেড় কোটি মানুষের বাস। এর মধ্যে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ বাস-গাড়ী ব্যবহার করেন না। বাকী থাকে শতকরা ৪০ ভাগ। প্রায় ষাট লক্ষ। এর মধ্যে প্রতিদিন প্রায় শতকরা ৭০/৮০ ভাগ মানুষ পরিবহণে যাতায়াত করেন ঝুলির গুড়া মাছের মতো ঠাসাঠাসি করে। যদি, যে সংখ্যায় প্রতিদিন ব্যক্তিগত গাড়ী নামানো হচ্ছে তার পরিবর্তে সমপরিমাণ বড় বাস নামানো হতো তাহলে কী হতো? দুই লক্ষ ত্রিশ হাজার বাসের মধ্যে ১,১৯,৬০,০০০ মানুষ আরামে যাতায়াত করতে পারতেন। ঢাকা শহরের মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের পরিবহণ সমস্যা দূর হতো। এখন যে পরিমাণ মানুষ যাতায়াত করেন তার প্রায় ৩ গুণ মানুষ অনায়াসে, নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারতেন। এছাড়া, ঢাকা শহরের চারপাশ জুড়ে যে নদী আছে, বিভিন্ন জায়গায় নদীর সাথে সংযোগ স্থাপনকারী যে খালগুলো আছে সেগুলোকে উদ্ধার-পুনরুদ্ধার-সংস্কার করে নৌপথকে কাজে লাগানো যেত। তাতে সড়কের উপর চাপ কমে যেতো। ট্রেন হতে পারতো আরেকটি অবলম্বন।
তুলনামূলক ব্যয় কিংবা লাভ বিবেচনা করে এ কাজগুলো করা যেতো। কিন্তু না করে কেন উত্তোরোত্তর ব্যক্তিগত গাড়ীর সংখ্যা বাড়ানোর অনুমতি দেওয়া হচ্ছে? কেনইবা, ট্যাক্সি ক্যাবের ব্যবস্থা? কাদের স্বার্থে? কারা এতে লাভবান হবে? জনগণের কোন অংশের উপকারে আসবে? ছয় হাজার ট্যাক্সি ক্যাবের জন্য যে গ্যাস প্রয়োজন তা আসবে কোথা থেকে, যেখানে গ্যাসের অভাবে অনেক শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে? ঢাকা শহর এখনই বিষাক্ত গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছে, তার উপর নতুন গাড়ি চলাচলের ফলে পরিবেশ দূষণ যে বৃদ্ধি পাবে, তার কী হবে? অসহনীয় যানজটের কারণে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে, নতুন আমদানী তাতে কী আরও ঘি ঢালবে না?
এর কোন উত্তর মন্ত্রী, এমপিদের নিকট থেকে পাওয়া যাবে না। এই উত্তর পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের কাছে নেই। কারণ, বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের ‘উন্নয়ন’ কীভাবে হবে কিংবা কোন কাজটি গুরুত্বপূর্ণ বা গুরুত্বপূর্ণ নয় তার সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিকানা তাদের এক্তিয়ারের মধ্যে নেই। এটি ঠিক করবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ-এর মতো আন্তর্জাতিক পুঁজির ব্যবস্থাপকবৃন্দ। ঠিক হবে তাদের কিংবা মার্কিন দূতাবাসের অফিসে বসে। জনগণের কাজ হচ্ছে ভোট দিয়ে সরকার ঠিক করা আর সরকারের কাজ হচ্ছে ব্যবস্থাপকদের ঠিক করা ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা। সে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী Ñ ‘‘বেসরকারী খাত সেবা প্রদান করবে এবং সরকার পরিবহণ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য পরিবেশগত ও কারিগরী মান নির্ধারণ ও অন্যান্য নিরাপত্তা মান নির্ধারণের জন্য দায়িত্ব পালন করবে। (নীতিমালার উদ্দেশ্য ২ (৪), এপ্রিল ২০০৪, জাতীয় স্থল পরিবহণ নীতিমালা, যোগাযোগ মন্ত্রণালয়)।’’ “পরিবহণ খাতে বেসরকারী অংশগ্রহণ অধিকতর উৎসাহিত করা হবে। (কৌশলগত নীতিমালা ৪ (৪.১.১), প্রাগুক্ত)। অর্থাৎ জনগণের কাছে সেবা প্রদানের কোন দায় সরকারের নেই; এই দায়িত্ব বেসরকারি কোম্পানির। কিংবা; সরকারের কাজ হবে ভারত, চীন, জাপান, জার্মান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ী কোম্পানিগুলোর বিক্রয় সহায়ক নীতিমালা/বিধি বিধান প্রণয়ন করা। ফলে, রাস্তা দাবড়ে বেড়াবে প্রাইভেট গাড়ী। টাটা-ইন্ডিকা, হোন্ডা, দাইয়ু, টয়োটা, ফোর্ড। যেসব যানে চড়া অধিকাংশের সাধ্যের বাইরে। সাধ্যের মধ্যে হতে পারতো গণপরিবহণ। সেটি কই?
০৮-১১-১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




