সম্পদের উপর জনগণের শতভাগ মালিকানা, কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির লংমার্চ ‘উন্মুক্ত না, বিদেশী না, রফতানি না’ শ্লোগানকে ধারণ করে গাজীপুর এবং উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলার ৬০টি স্থানে জনসভা, মতবিনিময় সভা, পথসভায় লক্ষাধিক মানুষের সমর্থন ও সংহতি নিয়ে বড়পুকুরিয়া হয়ে ফুলবাড়ীতে এসে পৌঁছায় ৩০ তারিখ। পথিমধ্যে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণ শেষে ফুলবাড়ীতে প্রায় লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই ধরনের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কোন গুরুত্বই পায়নি জাতীয় দৈনিকগুলোতে। সংবাদ মাধ্যমে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ঘটনাটি প্রচার না করার নীতি অবলম্বন করেছে। এর মাধ্যমে আরেকবার প্রমাণ হলো যে, মূল ধারার প্রচার মাধ্যম ক্ষমতাবানদের দখলে। ক্ষমতাবানদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত। সরকার এবং সরকার পরিচালনাকারী গোত্র (আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র কর্পোরেট, সংস্থা, দূতাবাস) যা চায়, যেভাবে চায়; সে ধরণের সেবা দিতে প্রচার মাধ্যমগুলো সচেষ্ট এবং নিবেদিত। এ কারণে দেশের অধিকাংশ মানুষ জাতীয় জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে না। অথচ কোন মন্ত্রী কোন হাটে বাজার করতে গেলেন কিংবা কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নতুন কোন শাখা উদ্বোধন হলো সেটি ফলাও করে ছাপানো-দেখানো হয়। এ ধরণের বিজ্ঞাপনমার্কা খবরের পাশাপাশি যারা দেশের সম্পদ উপর জনগণের কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ নিতে সচেষ্ট সে সব ব্যক্তিদের বক্তব্য ফলাও করে প্রচার করা হয় বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নামে। যে খবরের বাজার মূল্য যত বেশী প্রচার মাধ্যমে সে খবরের ঠাঁই হয় তত বড় আকারে। দু’একটি প্রচার মাধ্যমে না হলেই নয় এমনভাবে লংমার্চের খবর এবং গৎবাঁধা কথা প্রকাশ করেছে। এই পত্রিকাগুলোতে গ্যাস, কয়লাক্ষেত্রের বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশ করে কিন্তু এর বিপরীতে প্রতিবাদী কর্মসূচি যে জারী রয়েছে সেটি প্রকাশে প্রচণ্ড অনীহা প্রকাশ করেছে। শুধু এই লংমার্চেরই নয়; অতীতে যে কয়টি লংমার্চ, রোডমার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল, প্রতিটির ব্যাপারেই তাদের এই ভূমিকা বজায় থেকেছে। বিশ হাজার থেকে উন্নীত হয়ে লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ হলেও এসব প্রচার মাধ্যমের নীতি-কৌশলে কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
উদাহরণ হিসেবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরের বিবিসিকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। তিনি বিবিসিকে বলেছেন যে, যাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান নেই; এরকম কিছু লোক সাধারণ মানুষকে উস্কানী দিচ্ছেন লংমার্চের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে; তারা মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন। হোসেন মনসুরের মুখ থেকে বের হওয়া এই বক্তব্য শুধু তার বক্তব্য নয়। এই কথা বিশ্বব্যাংকের, এডিবি-র, এশিয়া এনার্জির মুখপাত্রের। এই কথা খনিজ সম্পদের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী-উপদেষ্টার। এই কথা বর্তমানের শুধু নয়; অতীতেরও। বর্তমান মহাজোটের সরকার ক্ষমতায় আসার আগে হোসেন মনসুর যখন জাতীয় কমিটির আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন এবং উন্মুক্ত খনি, বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন প্রকাশ্যে; তখন বিরোধী অবস্থানে থাকা সরকার এবং বিনিয়োগ বোর্ডের চেয়ারম্যান, উপদেষ্টারা তৎকালীন সময়ে একই ধরণের বক্তব্য প্রচার করেছেন। ক্ষমতার পালাবদলে এখন হোসেন মনসুর এবং উপদেষ্টা গং স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছেন। জাতীয় কমিটির আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এখন যদি এই প্রশ্ন করা হয় যে, যখন জাতীয় কমিটির সাথে হোসেন মনসুর আন্দোলন করেছেন তখন কি তিনি বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বর্জিত ছিলেন? কিংবা তিনি যেসমস্ত তথ্য জাতীয় কমিটিকে দিয়েছিলেন তা বিশেষজ্ঞ জ্ঞানহীনভাবে দিয়েছিলেন? কিংবা, জাতীয় কমিটির সাথে যুক্ত যে সকল আইনজীবী, অর্থনীতিবিদ, জ্বালানী এবং পানি বিশেষজ্ঞ, ভূতত্ত্ববিদ, লেখক, সাংবাদিক ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন, তাদের সাথে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন তখন কি তিনি তাদের পরিচয় না জেনেই আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন? অচেতন ক্ষমতা কখনো কখনো অন্ধই করে না, অজ্ঞও করে দেয়।
কেউ কেউ এ প্রশ্নও তুলেছেন যে, জাতীয় কমিটির লংমার্চ করার প্রয়োজনীয়তা কী? দায়িত্বপ্রাপ্তদের সাথে আলোচনা করেই তো সমস্যা সমাধান করা যায়। কমিটি এর জবাব বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। কিন্তু কোন কাজ হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা যায়নি। কারণ হলো, এ সমস্ত মন্ত্রী আমলাদের কেউ কেউ বহুজাতিক কোম্পানির কর্মচারী, উপদেষ্টা, কেউ কেউ আছেন কমিশনভোগী। এ ব্যাপারে পাল্টা প্রশ্ন করা দরকার যে, যদি আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতো তাহলে অক্লান্ত পরিশ্রম করে, খেয়ে না খেয়ে, মশার কামড় খেয়ে শত শত মাইল পথ পাড়ি দেওয়ার কী দরকার পড়ল? আলোচনাই যদি শেষ কথা হয় তাহলে সংসদীয় কমিটির সাথে জাতীয় কমিটির যে বৈঠক হয়েছিল তাতে সমাধান হলো না কেন? জাতীয় কমিটি কি আলোচনায় অনাগ্রহী? তাতো নয়। কারণ, জাতীয় কমিটিই বিভিন্ন সময় আগ বাড়িয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে। সরকার বরং বিভিন্ন অজুহাতে তাতে আগ্রহী হয়নি। তাহলে, জাতীয় কমিটির বিরুদ্ধে এই প্রচারণা কেন?
আন্দোলনের যৌক্তিকতা নিয়ে এ ধরণের প্রশ্ন যারা করে তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান, বিবেচনা বোধ নিয়ে সন্দেহ জাগাটা তাই স্বাভাবিক। যারা জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে দেশের সম্পদ বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দেয় তাদের সম্পর্কে কিন্তু এ ধরণের প্রশ্ন করা হয় না। অপরদিকে জাতীয় কমিটি যখন তথ্য প্রমাণ হাজির করে; ধ্বংসযজ্ঞের নমুনা বর্ণনা করে, কারা দায়ী তা প্রকাশ করে তখন তাদের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। জাতীয় কমিটি ফুলবাড়ীতে যখন লংমার্চের ঘোষণা প্রদান করে Ñ
১. গ্যাস ও কয়লা সম্পদসহ সকল খনিজ সম্পদের উপর শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য বহুজাতিক কোম্পানির দখলাদারিত্ব থেকে এই সম্পদ মুক্ত করতে হবে। তার লক্ষ্যে পিএসসি ২০০৮ বাতিল করতে হবে। আর মালিকানায় অংশীদারিত্বের নামে পূর্ণ দখলদারিত্বের কোন পিএসসি চুক্তি স্বাক্ষর না করার নীতি নিশ্চিত করতে হবে।
২. জাতীয় কমিটির প্রস্তাবিত সংসদে উত্থাপিত খনিজ সম্পদ রফতানি নিষিদ্ধকরণ আইন পাশ করতে হবে।
৩. গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১০ জ্বালানী নিরাপত্তার নামে পাশকৃত আইন বাতিল করে জ্বালানী মন্ত্রণালয়কে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও বহুজাতিক কোম্পানির সেবাদাসত্বের হাত থেকে মুক্ত করতে হবে।
৪. বাংলাদেশের জনগণের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য অমূল্য পানি সম্পদ এবং আবাদী জমির অচিন্তনীয় ক্ষতির কারণ উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নিষিদ্ধ ও এশিয়া এনার্জিকে বহিষ্কারসহ ঐতিহাসিক ফুলবাড়ী চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে।
৫. এছাড়া কেয়ার্ন এনার্জি ও হেলিবার্টনের সাথে তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি, শেভ্রন ও নাইকোর কাছ থেকে বাংলাদেশের ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় না করা, শেভ্রনকে লাউয়াছড়া ধ্বংস করে গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি প্রদান এবং সর্বোপরি ভেনেজুয়েলা থেকে বিতাড়িত, ইরাকে ধ্বংসযজ্ঞের জন্য দায়ী দুর্বৃত্তদের অন্যতম ব্যক্তির মালিকানাধীন কনোকো ফিলিপসকে সমুদ্রের গ্যাসব্লক তুলে দেয়ার অপতৎপরতা এই সবই প্রমাণ করে এই সরকারও অতীতের ধারাবাহিকতায় বহুজাতিক কোম্পানির হাতে দেশকে তুলে দিতে সক্রিয়। দুর্নীতি, রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব, শ্রেণীর চরিত্র, সরকারের মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানির কমিশনভোগীদের আধিক্য এই সবই এর পেছনের কারণ। এই মহা সমাবেশ এই নীতি পরিবর্তনের পাশাপাশি কেয়ার্ন এনার্জি ও হেলিবার্টনের সঙ্গে কৃত তৃতীয় পক্ষের কাছে গ্যাস বিক্রির চুক্তি অবিলম্বে বাতিল এবং বহুজাতিক কোম্পানির রাহুগ্রাস থেকে জ্বালানী মন্ত্রণালয়কে মুক্ত করার দাবি জানাচ্ছে।
৬. বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস, উন্নয়ন অভিজ্ঞতা, দাসত্ব ও শৃঙ্খলের বেদনা থেকে আমরা দেখেছি শুধুমাত্র জাতীয় সম্পদের উপর বহুজাতিক শকুন পুঁজির লোভী আগ্রাসনের জালে আটকে থাকার কারণে কীভাবে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বিপুল সম্পদ থাকা স্বত্ত্বেও ভয়াবহ দারিদ্রের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশকে সেরকম একটি অঞ্চলে পরিণত করবার অপচেষ্টায় যখন বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠী, বহুজাতিক কোম্পানি, সাম্রাজ্যবাদী দূতাবাস ও শাসক শ্রেণী নিয়োজিত তখন কেবলমাত্র দাসত্বের শৃঙ্খলমুক্ত মানুষের নতুন ঠিকানাই পারে বাংলাদেশকে রক্ষা করতে, এর ভবিষ্যতকে নতুনভাবে নির্মাণ করতে। জাতীয় কমিটির আন্দোলন এই লক্ষ্যেই নিয়োজিত। লুটেরা, সাম্রাজ্যবাদের সেবাদাস, দাসত্ববোধে ক্লেদাক্ত কিছু ব্যক্তি ছাড়া বাংলাদেশের সব মানুষেরই স্বার্থ এই আন্দোলনে নিহিত। সেজন্য এই আন্দোলনে পরাজিত হবার কোন উপায় নেই। খণ্ড খণ্ড বিজয়ে সমৃদ্ধ আন্দোলন এই লং মার্চের মধ্য দিয়ে জাতীয় জাগরণের নতুন পর্বে প্রবেশ করেছে।
৭. উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি, বিদেশী মালিকানা ও রফতানির সুযোগ রেখে প্রণীত কয়লা নীতি প্রতারণা ও চালাকির সঙ্গে চারদলীয় জোট প্রণীত কয়লানীতির ধারাবাহিকতা। ফুলবাড়ী তথা জাতীয় স্বার্থ পরিপন্থী এই কয়লা নীতি তাই এই মহাসমাবেশ প্রত্যাখান করছে।
৮. বড়পুকুরিয়ায় ভুল ডিজাইন, চীনা কোম্পানিসহ সরকারি দুর্নীতির কারণে যে ভূীম ধ্বস ও ক্ষয় ক্ষতির সৃষ্টি হয়েছে জমির মালিকানা অক্ষত রেখে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিকে নিরাপদ করার জন্য এই মহা সমাবেশ দাবী জানাচ্ছে। ২০১১ সালে চীনা কেম্পানির সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে জাতীয় সংস্থার পরিচালনায় এই খনি কার্যকর করতে হবে।
৯. জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
তখন এই ঘোষণা প্রণয়ন বিশেষজ্ঞ জ্ঞান ছাড়া কি সম্ভব? কিংবা এই ঘোষণাকে ধারণ করা ছাড়া কোন বিশেষজ্ঞ জ্ঞান কি সম্ভব?
মেহেদী হাসান
০১-১১-১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




