ক্ষুধা পেলে মানুষ খাবে। এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত থাকবে যেহেতু মানুষ উৎপাদন করে, খাদ্য ফলায়, শ্রমশক্তি ব্যয় করে। খুব সহজ এবং সাধারণ একটি কথা। কিন্তু এই সহজ এবং সাধারণ কথাটি বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। কীভাবে নয়, কেন নয়, সমস্যাটি কোথায়, সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব কি না, সেটি একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে এই প্রবন্ধে।
বর্তমান যে বিশ্বে আমরা বসবাস করছি, সেখানে প্রতিদিন ১০০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনযাপন করছে। প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে ১ জন, প্রতি রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়। অথচ, প্রতিদিন যে খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে তা দিয়ে প্রত্যেকটি মানুষকে খাইয়ে আরও উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ তা হচ্ছে না। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, যে কৃষকরা এই খাদ্য উৎপাদন করছে তাদের মধ্যেই এই সংখ্যা সবচাইতে বেশী। এর মধ্যে নারী কৃষকদের অবস্থা চরম। উন্নয়নশীল বিশ্ব বলে যাদের আমরা জানি, সে বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ এবং সারা বিশ্বের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ খাদ্যের যোগানদাতা এই নারী কৃষক। কৃষাণীগণ শষ্য বুনে, পরিচর্যা করে এবং ফসল কাটে অথচ তাদের হাতে সমগ্র কৃষি জমির শতকরা ১ ভাগও নেই। এবং তারাই অভুক্ত থাকে সবচাইতে বেশী। শতকরা ৭০ ভাগ নারী এবং মেয়েরা চরম দারিদ্র্য, ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করে।
শিল্পায়িত খাদ্য ব্যবস্থা আমাদের যে জায়গায় নিয়ে এসেছে সেখানে সহজে বিষয়টি উপলব্ধি বোধের মধ্যে আসবে কি না সন্দেহ। প্রতিদিন খেতে বসে এই প্রশ্নগুলো মনে আসবে কি না যে, কারা এই খাবারগুলো উৎপাদন করছে? তাঁরা কীভাবে জীবন যাপন করছে? তাঁরা খেতে পারছে কি না? কিংবা তারা আপাদমস্তক দেনায় ডুবে রয়েছে কি না কোন কেমিক্যাল অথবা কৃষি কোম্পানির কাছে, যারা তাদের মুনাফা সর্বোচ্চকরণের ধান্দায় মত্ত? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মা, দাদীরা যে জমিতে ফসল ফলিয়েছে এবং এখন সে ফসল ফলায় সেটি কি সে ধরে রাখতে পারবে কি না? নাকি জিন প্রযুক্তির উদ্ভাবিত বীজ তাঁকে তাঁর জীবন তাঁর জমি থেকে উচ্ছেদ করবে? কিংবা ফসল ফলানোর পর তাঁদের নিজেদের খাদ্যের জন্য কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? কতটা তাঁরা উৎপাদন করে, কীভাবে করে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা প্রয়োজন, এটি অনেকের বোধের মধ্যে না আসাটাই স্বাভাবিক। কারণ, যে বিশ্বে আমরা বসবাস করছি সেখানে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র, কতিপয়ের শাসন ব্যবস্থা আমাদের কাছে এই তথ্যগুলো হাজির করে না নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে।
১৯৯৪ সালে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন টেরিফ এন্ড ট্রেড (এঅঞঞ) (উরুগুয়ে রাউন্ড আলোচনার সমাপ্তির পরে যেটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডঞঙ) নামে যাত্রা শুরু করে) উরুগুয়ে রাউন্ডে কৃষি কোম্পানিগুলোর কৃষি নিয়ে বৃহৎ বাণিজ্য করার জন্য যে সমস্ত বাধা নিষেধগুলো ছিল সেগুলো দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো যা এতোদিন জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে কৃষক উৎপাদন, প্রয়োগ করতো সেগুলো তাঁর হাত থেকে নিয়ে নেওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করলো। এগুলো করা হলো ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতির নামে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি চুক্তি এবং ‘মুক্ত’ বাজার নীতি মানে হলো; বহুজাতিক, অতিজাতিক কর্পোরেশনগুলোর কৃষির উপর একচ্ছত্র আধিপত্য। অর্থাৎ কৃষক তাঁর নিজ জমিতে তাঁর আবহাওয়া, প্রাণবৈচিত্র্য, পানি, মাটি ইত্যাদি বিবেচনা করে কিংবা প্রাকৃতিকভাবে এতোদিন যে ফসল ফলাতো সেটি আর করতে পারবে না। এমনকী যে বীজটি সে এতোদিন ধরে উৎপাদন, পুনরুৎপাদন করতো সেটিও তাঁর এখতিয়ারের মধ্যে রাখতে পারবে না। ঞৎধফব জবষধঃবফ ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু জরমযঃং বা ঞজওচং চুক্তির ২৭ (বি) ধারা অনুসারে, জিন প্রযুক্তি বা মাইক্রোবায়োলজীর ব্যবহারে উৎপন্ন উদ্ভিদ, জীব গবেষণা পদ্ধতি ও এর মাধ্যমে সৃষ্ট জীবের মেধাস্বত্ত্ব সংরক্ষণ করা যাবে। বলা হলো, প্রায় সকল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এর স্বত্ত্বাধিকারী যে কোনরূপ ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদনে পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আইনসিদ্ধ একচেটিয়া অধিকার ভোগ করবে। অর্থাৎ মূলত: ক্ষমতা, অর্থ, প্রযুক্তি, কাঠামো ইত্যাদি যেহেতু বহুজাতিক কোম্পানির করতলগত সুতরাং একচেটিয়া অধিকার থাকবে তারই। সর্বোপরি ক্ষুদ্র কৃষকের হাতে তাঁর নিজের জমিটুকুনও থাকবে না। সামাজিক সম্পত্তি বেসরকারি বহুজাতিক কর্পোরেশনের অধিনস্ত করার পাকা বন্দোবস্ত হলো। নিজ জমি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে কার জন্য? অতিজাতিক কোম্পানির সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য। অতি উৎপাদনের জন্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘মেধাস্বত্ত্ব আইন’ মানে হলো তাই। বহুজাতিক কর্পোরেশন ব্যতীত খোদ কৃষক কর্তৃক বীজ উৎপাদন, পুনরুৎপাদন কিংবা রক্ষণাবেক্ষন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মোটকথা, এখন থেকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বর্তালো কর্পোরেশনগুলোর উপর যারা কীনা একচেটিয়া ব্যবসায়, মুনাফা ছাড়া চোখে কিছু দেখে না।
বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি নানা আবরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়িত হওয়া শুরু করল। কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি হলো পুরো শষ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধারা পাল্টানোর কর্মসূচি। নানা ছদ্মবেশে প্রচার-প্রচারণা চলল। দেব-দেবী-পুরোহিত-মৌলভী-ঋষি-গায়ক-কবি কেউ আর বাদ পড়েনি সেই প্রচারণা থেকে। কোম্পানির তৈরী করা হাইব্রীড বীজ বপনের জন্য ক্ষুদ্র কৃষককে উৎসাহিত করার ব্যাপক আয়োজন চলতে থাকে পুরো ৮০-র দশক জুড়ে। ফল কী দাঁড়ালো? যখন কৃষকরা সেই বীজ কিনলেন তখন খোদ তাঁদের নিজেদের উদ্ভাবিত বীজ হারাতে শুরু করলেন। কর্পোরেটের ফলন উচ্চমাত্রায় করার জন্য প্রচুর সার, কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ফলন অতি উচ্চমাত্রার হয় ঠিকই কিন্তু মাটি হারাতে শুরু করে তার উর্বরতা। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আশেপাশের পানি থেকে শুরু করে মৎস সম্পদ সব বিনাশী প্রক্রিয়ার বলী হয়। সরকার এবং কর্পোরেশনের মিলিত প্রচারণার ফাঁদে পড়ে কৃষক। ফাঁদে পড়ার বিষয়টি কৃষকের গোচরে আসতে সময় নেয়। প্রক্রিয়াটি ভয়ানক মজার। একবার যদি কোম্পানির বীজ, সার, কীটনাশক কেনা হয় কোন কোম্পানি থেকে তাহলে বার বার কোন না কোন কোম্পানির দ্বারস্থ হতে হয়। কেননা খোদ কৃষক উদ্ভাবিত বীজ যেহেতু কৃষকের হাতে নেই সুতরাং কোম্পানির বীজ না হলে ক্ষেতে শষ্য ফলবে না। বীজ, সার ইত্যাদি কেনার জন্য কোম্পানি কিংবা এনজিও-র ঋণতো আছেই। এই আকাক্সক্ষায় কৃষক ঋণ গ্রহণ করে যে, যেহেতু অধিক ফলন হবে সুতরাং তাঁর ঋণের অর্থ ফেরৎ দিতে কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু অসৌভাগ্যবশত সেই অধরা স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। কারণটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সব অতি-র কারণে জমির উর্বরা শক্তিও অতি কমে যায়। একসময় শষ্য উৎপাদনের পরিবর্তে গন্ধযুক্ত শ্যাওলা উৎপাদন ছাড়া আর কিছুর উৎপাদন সম্ভবপর হয় না। একদিকে ফলনের মার খাওয়া অন্যদিকে ঋণের বোঝা। এই দুই মিলে কৃষক নিজেকেই বোঝা মনে করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুধুমাত্র ১৯৯৭ সালে ২০০,০০০ ভারতীয় কৃষক আত্মহত্যা করে এই কারণে। এ কারণে কর্পোরেটের কৃষি অর্থনীতিকে অনেকে ‘আত্মহত্যার অর্থনীতি’ বলে থাকেন। এই আত্মহত্যার অর্থনীতিকে অন্যদিক থেকে ‘দারিদ্র্য নির্মাণের’ অর্থনীতিও বলা যায়।
মনসান্টোর মতো কর্পোরেশন যারা নিজেদের দাবী করে ‘জীবন রক্ষাকারী’ হিসেবে তারা বিভিন্ন সময় প্রতিশ্র“তি দেয় যে তাদের উদ্ভাবিত জীনপ্রযুক্তি দ্বারা উদ্ভাবিত বীজ অধিক ফলন ফলাবে এবং সারা বিশ্বের ক্ষুধা দূর করবে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যে, এটি নির্মম প্রতারণামূলক কথা ছাড়া আর কিছু নয়। অভিজ্ঞতা বলে, এর বিপরীতটিই সত্য। তাদের উদ্ভাবিত বীজের কারণে বিশ্বে ক্ষুধিতের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ এবং এই অতিদারিদ্র্য অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের বীজ বিক্রি করার একটি উছিলা। অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে মূলত তাদের জন্য। কৃষক প্রাকৃতিক উপায়ে যে বীজ এবং সার ব্যবহার করতেন তার ফলে উৎপাদন কম হতো ঠিকই; কিন্তু জমি বন্ধ্যা হতো না। এখন সরকারের ‘সবুজ বিপ্লব’-এর বদৌলতে জমি বন্ধ্যা। ‘সবুজ বিপ্লব’ কৃষিতে অতি-র উলম্ফন ঘটিয়েছে। অতিমাত্রায় ফলন, অতিরিক্ত টাকা, অতিরিক্ত ব্যয়, অতিরিক্ত পরিশ্রম, অতিরিক্ত পানি, অতি ক্ষুধা। বিপরীতে কৃষক প্রতিনিয়ন ঊন থেকে আরও ঊন মানুষে পরিণত হয়েছেন। এক সময় নাই হয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করছেন।
এ সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতি নামক মিথের মধ্য দিয়ে। ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতি বীজ, সার, কীটনাশক কোম্পানির বাণিজ্যকে অবাধ করেছে, কর্পোরেটের আধিপত্য বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে, কৃষি আরও বেশী মাত্রায় যুক্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে; সর্বোপরি দরিদ্র মানুষের খাদ্য এবং জীবনের নিরাপত্তাকে অনিশ্চিত করে ধনীদের ভাণ্ডার পূর্ণ করার নীতিতে অবিচল থেকেছে।
২০০৮ বছরটি ছিল ক্ষুধার্তদের রায়টের বছর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যের প্রচুর উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও খাদ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে পৃথিবীর নানা স্থানে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ২০০৫ থেকে খাদ্য দ্রব্যের দাম ভয়ঙ্করভাবে বাড়তে শুরু করে। ২০০৮ এর মধ্যে প্রধান প্রধান খাদ্যের দাম শতকরা ৮৩ ভাগেরও বেশী বেড়ে যায়। সেই বৃদ্ধি আজ অবধি অব্যাহত আছে। চাহিদা এবং যোগানের অসামঞ্জস্যতাকে কেউ কেউ এ সমস্যার জন্য দায়ী করে থাকেন। যেটি কোন কোন সময় সব দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। মূল কারণ অন্যত্র, যেটি প্রায়শই জনমানুষের অগোচরে থাকে। সেটি হলো, সারা বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানি। কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস এদের হাতেই। যদিও ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতির প্রবক্তারা বলে থাকেন যে, বাজার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরী করবে। সে কথাটি পণ্যদ্রব্য তা যে কোন ধরণের হোক না কেন, কোন ক্ষেত্রেই খাটে না। ভারসাম্যহীনতা যে এ ধরণের অর্থনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এটি মন্দাবস্থা থেকেই টের পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে অথচ ক্রয়ক্ষমতা বিপরীতে কমার কারণে বিভিন্ন দেশে দাঙ্গাবস্থারও সৃষ্টি হয়।
গত কিছুদিন আগে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড (সিবোট) সূচকে দেখা গেল ভুট্টার দাম বেড়ে গেছে শতকরা ৮.৫০ ভাগ। ১৯৭৩ সালের তেল সঙ্কটের পর এককভাবে পণ্যের দাম এই মাত্রায় বেড়ে গেল। সয়াবিন, গম এবং অন্যান্য প্রধান খাদ্যশষ্যের দামও একই পথ ধরলো। দাম বৃদ্ধির কারণ, কেউ কেউ বললেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণে শস্য উৎপাদন মার খেয়েছে, তাই দামের এই উলম্ফন। এটি একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু ব্রাজিলের মতো বড় অর্থনীতি কিংবা ‘উন্নত’ দেশে শস্য উৎপাদনের ধরণ এবং উদ্দেশ্য পরিবর্তনের কথা সামনে আসছে না। ভুট্টা অনেক জমি নিয়ে চাষ হচ্ছে, বড় বড় খামারের মালিকরা ভুট্টা চাষ করছে এজন্য না যে তা দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বরং উন্নত দেশের গাড়ী চালানোর জন্য জ্বালানী প্রয়োজন এবং সে চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাপকহারে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এবং এই জ্বালানী কিংবা ভুট্টার বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অল্প কয়েকটি কোম্পানির দ্বারা। ফাটকা পুঁজি এই বাজারে বড় একজন খেলোয়াড়।
এর বিপরীত চিত্রটিও বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। বিশ্বের কোন কোন দেশে জিন প্রযুক্তির উদ্ভাবিত খাদ্যশস্য বা জিএম খাদ্যের বিরোধীতা করছে। বিরোধীতা করছে যেসমস্ত এনজিও তাদের নিয়েও অনেক ধরণের প্রশ্ন আছে। এনজিওগুলো গরীব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অর্গানিক ফুড-এর কথা বলছে। তাদের কথায় চটক আছে কিন্তু তাতে বাজার নাটকের মূল চরিত্রের কোন হেরফের ঘটছে না। তারা বলছে যে, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে জিএম বীজ কিংবা কীটনাশকের পরিবর্তে কৃষকরা চাচ্ছেন তাদের উদ্ভাবিত স্থানীয় বীজ ব্যবহার করতে এবং বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা স্বার্থের বিপরীতে সরকারি কৃষি গবেষণা ও নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী শস্য উৎপাদন করতে। এনজিওদের এ ধরণের কথাবার্তা অনেক সময় শুনতে ভালো লাগলেও বিষয়টিকে এতো সরলভাবে দেখার কোন উপায় নেই। কেননা, সরকারি খাদ্য এবং কৃষি গবেষণা যে নিরেট ভালো মানুষী চেহারা নিয়ে উপস্থিত হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। এই গবেষণা কৃষকদের চাহিদা, জ্ঞান কিংবা মূল্যবোধকে যে সর্বদা ধারণ করবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ হলো, সরকারি গবেষণার অন্তরালে ইউএসএইড, বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে থাকতে পারে। স্বাধীন গবেষণা তখনই সম্ভব যখন সরকারের কৃষি এবং কৃষক ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী, নীতিমালা বাজার অর্থনীতিকেন্দ্রিক হবে না। যদি বাজার অর্থনীতি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে কী সরকার, কী বেসরকারী এনজিও, প্রত্যেকের মূল মনোযোগের বিষয় হবে কৃষি অর্থনীতিকে বহুজাতিকের আধিপত্যের মধ্যে ফেলে দেওয়া। ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর মাইকেল পিমবার্ট আফ্রিকার কর্মরত এনজিও, বিশেষজ্ঞদের কর্মপ্রণালী বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, অনেক বিজ্ঞানী এবং বড় বড় এনজিও বিশ্বাস করে যে বাজারের উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রাইভেট পাবলিক মালিকানা (পিপিপি) আফ্রিকার সমস্ত মানুষের ক্ষুধা দূরীকরণে অনেক বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এরা ক্ষুদ্র খামারীদের বিষয়গুলোকে আমলে নেয় না। তার ফলে কী ঘটে? ক্ষুদ্র কৃষকরা নতুন নতুন কোম্পানির হাইব্রীড বীজ কেনে, সার-কীটনাশক কেনে বাকীতে এবং সবশেষে ঋণের দায় মেটাতে না পেরে তাদের সামান্য কিছু জমি তাও হারাতে হয়। আর সে জমি বড় বড় কর্পোরেটের অধীনস্ত হয়।
পিমবার্টের কথার সাথে আরও খানিকটা যোগ করা যায় যে, আফ্রিকার শুধু নয় সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, যে দেশের সরকারের সম্পদের উপর কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ নেই এবং মেরুদণ্ডহীন অবস্থা; সেসব দেশেই এনজিও, বিশেষজ্ঞরা জিএম ফুডের পরিবর্তে ক্ষুধা নিবারণের জন্য অর্গানিক ফুড-এর কথা বলে থাকে; বলে থাকে ক্ষুদে কৃষক কিংবা ক্ষুধার্তদের স্বার্থে নয় বরং নতুন উপায়ে ভিন্ন নামের ভিন্ন ধারার কর্পোরেটের অধীন করার জন্য, বাজারের সাথে আরও বেশী মাত্রায় সম্পৃক্ত করার জন্য। যার ফলে আর কিছু হোক আর না হোক এ সমস্ত এনজিও মার্কা তত্ত্বে কৃষকের ক্ষুধা নিবারণ হয় না বিপরীতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই কেবল বৃদ্ধি পায় এবং এনজিওওয়ালাদের রুটি রুজির ব্যবস্থা পোক্ত হয়।
মেহেদী হাসান
২২.১০.১০
ক্ষুধা পেলে মানুষ খাবে। এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় বন্দোবস্ত থাকবে যেহেতু মানুষ উৎপাদন করে, খাদ্য ফলায়, শ্রমশক্তি ব্যয় করে। খুব সহজ এবং সাধারণ একটি কথা। কিন্তু এই সহজ এবং সাধারণ কথাটি বর্তমান পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। কীভাবে নয়, কেন নয়, সমস্যাটি কোথায়, সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব কি না, সেটি একটু খতিয়ে দেখার চেষ্টা হয়েছে এই প্রবন্ধে।
বর্তমান যে বিশ্বে আমরা বসবাস করছি, সেখানে প্রতিদিন ১০০ কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনযাপন করছে। প্রতি ৬ জন মানুষের মধ্যে ১ জন, প্রতি রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়। অথচ, প্রতিদিন যে খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে তা দিয়ে প্রত্যেকটি মানুষকে খাইয়ে আরও উদ্বৃত্ত থাকার কথা। অথচ তা হচ্ছে না। অবাক হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, যে কৃষকরা এই খাদ্য উৎপাদন করছে তাদের মধ্যেই এই সংখ্যা সবচাইতে বেশী। এর মধ্যে নারী কৃষকদের অবস্থা চরম। উন্নয়নশীল বিশ্ব বলে যাদের আমরা জানি, সে বিশ্বের শতকরা ৮০ ভাগ এবং সারা বিশ্বের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগ খাদ্যের যোগানদাতা এই নারী কৃষক। কৃষাণীগণ শষ্য বুনে, পরিচর্যা করে এবং ফসল কাটে অথচ তাদের হাতে সমগ্র কৃষি জমির শতকরা ১ ভাগও নেই। এবং তারাই অভুক্ত থাকে সবচাইতে বেশী। শতকরা ৭০ ভাগ নারী এবং মেয়েরা চরম দারিদ্র্য, ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিনাতিপাত করে।
শিল্পায়িত খাদ্য ব্যবস্থা আমাদের যে জায়গায় নিয়ে এসেছে সেখানে সহজে বিষয়টি উপলব্ধি বোধের মধ্যে আসবে কি না সন্দেহ। প্রতিদিন খেতে বসে এই প্রশ্নগুলো মনে আসবে কি না যে, কারা এই খাবারগুলো উৎপাদন করছে? তাঁরা কীভাবে জীবন যাপন করছে? তাঁরা খেতে পারছে কি না? কিংবা তারা আপাদমস্তক দেনায় ডুবে রয়েছে কি না কোন কেমিক্যাল অথবা কৃষি কোম্পানির কাছে, যারা তাদের মুনাফা সর্বোচ্চকরণের ধান্দায় মত্ত? শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মা, দাদীরা যে জমিতে ফসল ফলিয়েছে এবং এখন সে ফসল ফলায় সেটি কি সে ধরে রাখতে পারবে কি না? নাকি জিন প্রযুক্তির উদ্ভাবিত বীজ তাঁকে তাঁর জীবন তাঁর জমি থেকে উচ্ছেদ করবে? কিংবা ফসল ফলানোর পর তাঁদের নিজেদের খাদ্যের জন্য কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? কতটা তাঁরা উৎপাদন করে, কীভাবে করে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা প্রয়োজন, এটি অনেকের বোধের মধ্যে না আসাটাই স্বাভাবিক। কারণ, যে বিশ্বে আমরা বসবাস করছি সেখানে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র, কতিপয়ের শাসন ব্যবস্থা আমাদের কাছে এই তথ্যগুলো হাজির করে না নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে।
১৯৯৪ সালে জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন টেরিফ এন্ড ট্রেড (এঅঞঞ) (উরুগুয়ে রাউন্ড আলোচনার সমাপ্তির পরে যেটি ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডঞঙ) নামে যাত্রা শুরু করে) উরুগুয়ে রাউন্ডে কৃষি কোম্পানিগুলোর কৃষি নিয়ে বৃহৎ বাণিজ্য করার জন্য যে সমস্ত বাধা নিষেধগুলো ছিল সেগুলো দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদির মতো বিষয়গুলো যা এতোদিন জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে কৃষক উৎপাদন, প্রয়োগ করতো সেগুলো তাঁর হাত থেকে নিয়ে নেওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্ত পাকাপোক্ত করলো। এগুলো করা হলো ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতির নামে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কৃষি চুক্তি এবং ‘মুক্ত’ বাজার নীতি মানে হলো; বহুজাতিক, অতিজাতিক কর্পোরেশনগুলোর কৃষির উপর একচ্ছত্র আধিপত্য। অর্থাৎ কৃষক তাঁর নিজ জমিতে তাঁর আবহাওয়া, প্রাণবৈচিত্র্য, পানি, মাটি ইত্যাদি বিবেচনা করে কিংবা প্রাকৃতিকভাবে এতোদিন যে ফসল ফলাতো সেটি আর করতে পারবে না। এমনকী যে বীজটি সে এতোদিন ধরে উৎপাদন, পুনরুৎপাদন করতো সেটিও তাঁর এখতিয়ারের মধ্যে রাখতে পারবে না। ঞৎধফব জবষধঃবফ ওহঃবষষবপঃঁধষ চৎড়ঢ়বৎঃু জরমযঃং বা ঞজওচং চুক্তির ২৭ (বি) ধারা অনুসারে, জিন প্রযুক্তি বা মাইক্রোবায়োলজীর ব্যবহারে উৎপন্ন উদ্ভিদ, জীব গবেষণা পদ্ধতি ও এর মাধ্যমে সৃষ্ট জীবের মেধাস্বত্ত্ব সংরক্ষণ করা যাবে। বলা হলো, প্রায় সকল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে এর স্বত্ত্বাধিকারী যে কোনরূপ ক্রয়-বিক্রয়, উৎপাদনে পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে আইনসিদ্ধ একচেটিয়া অধিকার ভোগ করবে। অর্থাৎ মূলত: ক্ষমতা, অর্থ, প্রযুক্তি, কাঠামো ইত্যাদি যেহেতু বহুজাতিক কোম্পানির করতলগত সুতরাং একচেটিয়া অধিকার থাকবে তারই। সর্বোপরি ক্ষুদ্র কৃষকের হাতে তাঁর নিজের জমিটুকুনও থাকবে না। সামাজিক সম্পত্তি বেসরকারি বহুজাতিক কর্পোরেশনের অধিনস্ত করার পাকা বন্দোবস্ত হলো। নিজ জমি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে কার জন্য? অতিজাতিক কোম্পানির সর্বোচ্চ মুনাফার জন্য। অতি উৎপাদনের জন্য। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘মেধাস্বত্ত্ব আইন’ মানে হলো তাই। বহুজাতিক কর্পোরেশন ব্যতীত খোদ কৃষক কর্তৃক বীজ উৎপাদন, পুনরুৎপাদন কিংবা রক্ষণাবেক্ষন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। মোটকথা, এখন থেকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বর্তালো কর্পোরেশনগুলোর উপর যারা কীনা একচেটিয়া ব্যবসায়, মুনাফা ছাড়া চোখে কিছু দেখে না।
বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি নানা আবরণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়িত হওয়া শুরু করল। কাঠামোগত সংস্কার কর্মসূচি হলো পুরো শষ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার ধারা পাল্টানোর কর্মসূচি। নানা ছদ্মবেশে প্রচার-প্রচারণা চলল। দেব-দেবী-পুরোহিত-মৌলভী-ঋষি-গায়ক-কবি কেউ আর বাদ পড়েনি সেই প্রচারণা থেকে। কোম্পানির তৈরী করা হাইব্রীড বীজ বপনের জন্য ক্ষুদ্র কৃষককে উৎসাহিত করার ব্যাপক আয়োজন চলতে থাকে পুরো ৮০-র দশক জুড়ে। ফল কী দাঁড়ালো? যখন কৃষকরা সেই বীজ কিনলেন তখন খোদ তাঁদের নিজেদের উদ্ভাবিত বীজ হারাতে শুরু করলেন। কর্পোরেটের ফলন উচ্চমাত্রায় করার জন্য প্রচুর সার, কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। ফলন অতি উচ্চমাত্রার হয় ঠিকই কিন্তু মাটি হারাতে শুরু করে তার উর্বরতা। অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আশেপাশের পানি থেকে শুরু করে মৎস সম্পদ সব বিনাশী প্রক্রিয়ার বলী হয়। সরকার এবং কর্পোরেশনের মিলিত প্রচারণার ফাঁদে পড়ে কৃষক। ফাঁদে পড়ার বিষয়টি কৃষকের গোচরে আসতে সময় নেয়। প্রক্রিয়াটি ভয়ানক মজার। একবার যদি কোম্পানির বীজ, সার, কীটনাশক কেনা হয় কোন কোম্পানি থেকে তাহলে বার বার কোন না কোন কোম্পানির দ্বারস্থ হতে হয়। কেননা খোদ কৃষক উদ্ভাবিত বীজ যেহেতু কৃষকের হাতে নেই সুতরাং কোম্পানির বীজ না হলে ক্ষেতে শষ্য ফলবে না। বীজ, সার ইত্যাদি কেনার জন্য কোম্পানি কিংবা এনজিও-র ঋণতো আছেই। এই আকাক্সক্ষায় কৃষক ঋণ গ্রহণ করে যে, যেহেতু অধিক ফলন হবে সুতরাং তাঁর ঋণের অর্থ ফেরৎ দিতে কোন অসুবিধা হবে না। কিন্তু অসৌভাগ্যবশত সেই অধরা স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। কারণটি পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। সব অতি-র কারণে জমির উর্বরা শক্তিও অতি কমে যায়। একসময় শষ্য উৎপাদনের পরিবর্তে গন্ধযুক্ত শ্যাওলা উৎপাদন ছাড়া আর কিছুর উৎপাদন সম্ভবপর হয় না। একদিকে ফলনের মার খাওয়া অন্যদিকে ঋণের বোঝা। এই দুই মিলে কৃষক নিজেকেই বোঝা মনে করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শুধুমাত্র ১৯৯৭ সালে ২০০,০০০ ভারতীয় কৃষক আত্মহত্যা করে এই কারণে। এ কারণে কর্পোরেটের কৃষি অর্থনীতিকে অনেকে ‘আত্মহত্যার অর্থনীতি’ বলে থাকেন। এই আত্মহত্যার অর্থনীতিকে অন্যদিক থেকে ‘দারিদ্র্য নির্মাণের’ অর্থনীতিও বলা যায়।
মনসান্টোর মতো কর্পোরেশন যারা নিজেদের দাবী করে ‘জীবন রক্ষাকারী’ হিসেবে তারা বিভিন্ন সময় প্রতিশ্র“তি দেয় যে তাদের উদ্ভাবিত জীনপ্রযুক্তি দ্বারা উদ্ভাবিত বীজ অধিক ফলন ফলাবে এবং সারা বিশ্বের ক্ষুধা দূর করবে। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন যে, এটি নির্মম প্রতারণামূলক কথা ছাড়া আর কিছু নয়। অভিজ্ঞতা বলে, এর বিপরীতটিই সত্য। তাদের উদ্ভাবিত বীজের কারণে বিশ্বে ক্ষুধিতের সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ এবং এই অতিদারিদ্র্য অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের বীজ বিক্রি করার একটি উছিলা। অন্যভাবে বলা যায়, বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে মূলত তাদের জন্য। কৃষক প্রাকৃতিক উপায়ে যে বীজ এবং সার ব্যবহার করতেন তার ফলে উৎপাদন কম হতো ঠিকই; কিন্তু জমি বন্ধ্যা হতো না। এখন সরকারের ‘সবুজ বিপ্লব’-এর বদৌলতে জমি বন্ধ্যা। ‘সবুজ বিপ্লব’ কৃষিতে অতি-র উলম্ফন ঘটিয়েছে। অতিমাত্রায় ফলন, অতিরিক্ত টাকা, অতিরিক্ত ব্যয়, অতিরিক্ত পরিশ্রম, অতিরিক্ত পানি, অতি ক্ষুধা। বিপরীতে কৃষক প্রতিনিয়ন ঊন থেকে আরও ঊন মানুষে পরিণত হয়েছেন। এক সময় নাই হয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করছেন।
এ সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতি নামক মিথের মধ্য দিয়ে। ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতি বীজ, সার, কীটনাশক কোম্পানির বাণিজ্যকে অবাধ করেছে, কর্পোরেটের আধিপত্য বিস্তৃত করতে সহায়তা করেছে, কৃষি আরও বেশী মাত্রায় যুক্ত হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে; সর্বোপরি দরিদ্র মানুষের খাদ্য এবং জীবনের নিরাপত্তাকে অনিশ্চিত করে ধনীদের ভাণ্ডার পূর্ণ করার নীতিতে অবিচল থেকেছে।
২০০৮ বছরটি ছিল ক্ষুধার্তদের রায়টের বছর। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে খাদ্যের প্রচুর উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও খাদ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে পৃথিবীর নানা স্থানে দাঙ্গা সংঘটিত হয়। ২০০৫ থেকে খাদ্য দ্রব্যের দাম ভয়ঙ্করভাবে বাড়তে শুরু করে। ২০০৮ এর মধ্যে প্রধান প্রধান খাদ্যের দাম শতকরা ৮৩ ভাগেরও বেশী বেড়ে যায়। সেই বৃদ্ধি আজ অবধি অব্যাহত আছে। চাহিদা এবং যোগানের অসামঞ্জস্যতাকে কেউ কেউ এ সমস্যার জন্য দায়ী করে থাকেন। যেটি কোন কোন সময় সব দেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। মূল কারণ অন্যত্র, যেটি প্রায়শই জনমানুষের অগোচরে থাকে। সেটি হলো, সারা বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন এবং কৃষি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানি। কৃষি পণ্যের দাম বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস এদের হাতেই। যদিও ‘মুক্ত’ বাজার অর্থনীতির প্রবক্তারা বলে থাকেন যে, বাজার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরী করবে। সে কথাটি পণ্যদ্রব্য তা যে কোন ধরণের হোক না কেন, কোন ক্ষেত্রেই খাটে না। ভারসাম্যহীনতা যে এ ধরণের অর্থনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এটি মন্দাবস্থা থেকেই টের পাওয়া যায়। প্রতিনিয়ত খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ে অথচ ক্রয়ক্ষমতা বিপরীতে কমার কারণে বিভিন্ন দেশে দাঙ্গাবস্থারও সৃষ্টি হয়।
গত কিছুদিন আগে শিকাগো বোর্ড অব ট্রেড (সিবোট) সূচকে দেখা গেল ভুট্টার দাম বেড়ে গেছে শতকরা ৮.৫০ ভাগ। ১৯৭৩ সালের তেল সঙ্কটের পর এককভাবে পণ্যের দাম এই মাত্রায় বেড়ে গেল। সয়াবিন, গম এবং অন্যান্য প্রধান খাদ্যশষ্যের দামও একই পথ ধরলো। দাম বৃদ্ধির কারণ, কেউ কেউ বললেন, খারাপ আবহাওয়ার কারণে শস্য উৎপাদন মার খেয়েছে, তাই দামের এই উলম্ফন। এটি একটি কারণ হতে পারে। কিন্তু ব্রাজিলের মতো বড় অর্থনীতি কিংবা ‘উন্নত’ দেশে শস্য উৎপাদনের ধরণ এবং উদ্দেশ্য পরিবর্তনের কথা সামনে আসছে না। ভুট্টা অনেক জমি নিয়ে চাষ হচ্ছে, বড় বড় খামারের মালিকরা ভুট্টা চাষ করছে এজন্য না যে তা দিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। বরং উন্নত দেশের গাড়ী চালানোর জন্য জ্বালানী প্রয়োজন এবং সে চাহিদা পূরণের জন্য ব্যাপকহারে ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এবং এই জ্বালানী কিংবা ভুট্টার বাজার নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে অল্প কয়েকটি কোম্পানির দ্বারা। ফাটকা পুঁজি এই বাজারে বড় একজন খেলোয়াড়।
এর বিপরীত চিত্রটিও বিশ্ব প্রত্যক্ষ করছে। বিশ্বের কোন কোন দেশে জিন প্রযুক্তির উদ্ভাবিত খাদ্যশস্য বা জিএম খাদ্যের বিরোধীতা করছে। বিরোধীতা করছে যেসমস্ত এনজিও তাদের নিয়েও অনেক ধরণের প্রশ্ন আছে। এনজিওগুলো গরীব মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অর্গানিক ফুড-এর কথা বলছে। তাদের কথায় চটক আছে কিন্তু তাতে বাজার নাটকের মূল চরিত্রের কোন হেরফের ঘটছে না। তারা বলছে যে, প্রচুর অর্থের বিনিময়ে জিএম বীজ কিংবা কীটনাশকের পরিবর্তে কৃষকরা চাচ্ছেন তাদের উদ্ভাবিত স্থানীয় বীজ ব্যবহার করতে এবং বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা স্বার্থের বিপরীতে সরকারি কৃষি গবেষণা ও নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী শস্য উৎপাদন করতে। এনজিওদের এ ধরণের কথাবার্তা অনেক সময় শুনতে ভালো লাগলেও বিষয়টিকে এতো সরলভাবে দেখার কোন উপায় নেই। কেননা, সরকারি খাদ্য এবং কৃষি গবেষণা যে নিরেট ভালো মানুষী চেহারা নিয়ে উপস্থিত হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। এই গবেষণা কৃষকদের চাহিদা, জ্ঞান কিংবা মূল্যবোধকে যে সর্বদা ধারণ করবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ হলো, সরকারি গবেষণার অন্তরালে ইউএসএইড, বিশ্বব্যাংক কিংবা আইএমএফের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়ে থাকতে পারে। স্বাধীন গবেষণা তখনই সম্ভব যখন সরকারের কৃষি এবং কৃষক ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গী, নীতিমালা বাজার অর্থনীতিকেন্দ্রিক হবে না। যদি বাজার অর্থনীতি কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে কী সরকার, কী বেসরকারী এনজিও, প্রত্যেকের মূল মনোযোগের বিষয় হবে কৃষি অর্থনীতিকে বহুজাতিকের আধিপত্যের মধ্যে ফেলে দেওয়া। ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর মাইকেল পিমবার্ট আফ্রিকার কর্মরত এনজিও, বিশেষজ্ঞদের কর্মপ্রণালী বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, অনেক বিজ্ঞানী এবং বড় বড় এনজিও বিশ্বাস করে যে বাজারের উন্নত প্রযুক্তি এবং প্রাইভেট পাবলিক মালিকানা (পিপিপি) আফ্রিকার সমস্ত মানুষের ক্ষুধা দূরীকরণে অনেক বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এরা ক্ষুদ্র খামারীদের বিষয়গুলোকে আমলে নেয় না। তার ফলে কী ঘটে? ক্ষুদ্র কৃষকরা নতুন নতুন কোম্পানির হাইব্রীড বীজ কেনে, সার-কীটনাশক কেনে বাকীতে এবং সবশেষে ঋণের দায় মেটাতে না পেরে তাদের সামান্য কিছু জমি তাও হারাতে হয়। আর সে জমি বড় বড় কর্পোরেটের অধীনস্ত হয়।
পিমবার্টের কথার সাথে আরও খানিকটা যোগ করা যায় যে, আফ্রিকার শুধু নয় সারা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে, যে দেশের সরকারের সম্পদের উপর কর্তৃত্ব, নিয়ন্ত্রণ নেই এবং মেরুদণ্ডহীন অবস্থা; সেসব দেশেই এনজিও, বিশেষজ্ঞরা জিএম ফুডের পরিবর্তে ক্ষুধা নিবারণের জন্য অর্গানিক ফুড-এর কথা বলে থাকে; বলে থাকে ক্ষুদে কৃষক কিংবা ক্ষুধার্তদের স্বার্থে নয় বরং নতুন উপায়ে ভিন্ন নামের ভিন্ন ধারার কর্পোরেটের অধীন করার জন্য, বাজারের সাথে আরও বেশী মাত্রায় সম্পৃক্ত করার জন্য। যার ফলে আর কিছু হোক আর না হোক এ সমস্ত এনজিও মার্কা তত্ত্বে কৃষকের ক্ষুধা নিবারণ হয় না বিপরীতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাই কেবল বৃদ্ধি পায় এবং এনজিওওয়ালাদের রুটি রুজির ব্যবস্থা পোক্ত হয়।
মেহেদী হাসান
২২.১০.১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




