সিএমএম কোর্টের বাইরে আমরা অপেক্ষা করছিলাম। আনু মুহাম্মদ (জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়), রেহনুমা (সাংবাদিক, লেখক), সাদিয়া আরমান (ব্যারিস্টার) আর আমি। গিতি আরা নাসরিন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)-এর আসার কথা ছিল; আসতে পারেননি। মোশরেফা মিশুকে ১ টার সময় ২১ নং আদালত কক্ষে হাজির করা হবে; তার অপেক্ষা করছিলাম। রাস্তায় যানজটের কারণে প্রিজন ভ্যান আসতে আসতে ২টা বাজল। কোর্টে ওঠাতে আরো আধ ঘন্টা। মিশু’র পক্ষে জহির, সাদিয়া আরমান লড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। হাজির করা হলো মিশুকে। পেছনের সারির বেঞ্চিতে দুইজন নারী পুলিশের দায়িত্বে তাঁকে রাখা হলো। অন্য পুলিশরা গেটে, দাঁড়িয়ে উকিল ছাড়া কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে যতটুকু দেখা যায় তাঁকে, দেখলাম। মাথার ভার রাখতে পারছিলেন না। বারবার সামনে নুইয়ে পড়ছিলেন। শ্বাস নেওয়ার সময় বাঁশির চিকন সুর বের হচ্ছিল শ্বাসনালী থেকে। এ্যাজমার টান। চোখ মুখ ফোলা। সাদা কাপড় পড়ানো। বন্দি করে নিয়ে আসার সয় রাতে পড়ার কাপড় ছাড়তে দেয়নি পুলিশ। পরে বোধহয় অন্য কোনভাবে এই শাড়ীটি দেয়া হয়েছিল। সেটিই অবিন্যস্ত করে পড়িয়ে আনা হয়েছিল কোর্টে। চোখ বন্ধ কিন্তু অনবরত চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। প্রচণ্ড কষ্ট পেলে আপনাআপনি যেমন পানি পড়ে, সেরকম।
সাদিয়া আরমান পেশার কারণে মিশুর সাথে কথা বলার অনুমতি পেলেন। কথা বললেন। সব কথা বোঝা যাচ্ছিল না। খুব কষ্ট হচ্ছিল কথা বলতে। প্রচুর হাঁফাচ্ছে। প্রায় ফিসফিস করে সাদিয়াকে বললেন, ‘‘ ..আমি আর রিমান্ড সহ্য করতে পারবো না। ঘটনা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।’’ হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘‘আমি নরসিংদীতে ছিলাম। ১২ তারিখ রাতে ঢাকায় ফিরেছি। ১৩ ডিসেম্বর কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারিনি। ..রাত সোয়া ১টায় বোনের (জেবু) বারণ অমান্য করে ১২ জন পুলিশ বেডরুমে ঢুকে গেল। পুলিশকে বোঝালাম, আমি ভাঙ্গচুরের মতো কোন কিছুর সাথে জড়িত নই। ..ঔষধ পর্যন্ত নিতে পারি নাই। বুকে ব্যাথা।’’
সাদিয়ার সাথে কথা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পর মধ্যবয়সী মেজিস্ট্রেট আসলেন। বসলেন, কিছুক্ষণ মামলার কাগজপত্র উল্টালেন। আর মাঝে মধ্যে সাদিয়ার দিকে তাকালেন। তখন সাদিয়া মিশু যে ভাঙ্গচুরের ঘটনার সাথে কোনভাবে জড়িত না সেটি প্রমাণের জন্য ১২ তারিখের ঘটনাটি উল্লেখ করলেন এবং শারীরিক অসুস্থতার মানবিক দিকটি দেখার অনুরোধ করে রিমান্ড না দেওয়ার দাবী জানালেন। মেজিস্ট্রেটকে দেখে মনে হলো না যে, তিনি তাঁর কথা খুব একটা শুনেছেন। বললেন, ‘‘এতো আর্গুমেন্ট করে কোন কাজ নেই। মেডিক্যাল সহায়তা দেওয়ার জন্য একজন ডাক্তার দেখানোর সুপারিশ করা হলো এবং পুলিশ ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছে, দুইদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হলো।’’ রায় দিয়ে উঠে এজলাস ছেড়ে চলে গেলেন। মিশুর ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলো।
মিশুকে রায় অনুযায়ী রিমান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি চলছিল। কিন্তু তিনি দাঁড়াতে পারছিলেন না। বারবার পড়ে যাচ্ছিলেন। পুলিশ সেদিকে খুব একটা গা করছিল এমন বোধ হলো না। কোনভাবে টেনে হিঁচড়ে দুই নারী পুলিশ তাদের কাঁধে ভর দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। মিশুও চেষ্টা করলেন হাঁটার কিন্তু সেই শক্তিটুকুও আর বোধহয় অবশিষ্ট ছিল না। বার দুই পড়ে গেলেন সিঁড়ি ভাঙ্গার সময়। পেছন থেকে এক নারী কনস্টেবল এই অবস্থা দেখে ফোঁড়ন কাটছিল, ‘‘ আরে না, তেমন মারে নাই। ওনার কিছুই হয় নাই। ভান করতেছে।’’
আমরা কোর্ট থেকে বের হবার পর পথে ফোনে জেবু (মোশরেফা মিশুর বোন) আনু ভাইকে জানালো, ‘প্রিজন ভ্যানে মিশু অজ্ঞান হয়ে গেছেন। দায়িত্বরত পুলিশরা তাকে নিয়ে পাশের ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে গেছে। সেখানে নেব্যুউলাইজার দেওয়া হয়েছে।’ পরে খবর পেলাম, সে হাসপাতাল থেকে পিজি হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। সেখানে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। অবস্থা আরও অবনতি হওয়ায় সেখান থেকে আবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখন সেখানে আছেন। এর মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
জিজ্ঞাসাবাদ মানে তো নির্যাতন নয়; কী শারীরিক কী মানসিক। কিন্তু মিশুকে দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে যে, প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছে। অবর্ণনীয় অত্যাচার করার কোন বিধান প্রচলিত কোন আইনে কি আছে? প্রচলিত আইনের কোথাওতো একথা লেখা নেই। রিমান্ড আগেও ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তার পরিমাণ এবং মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল যথেষ্ট। এখন নির্বাচিত সরকার। সামরিক তত্ত্বাবধায়কী সরকার ব্যবস্থাকে নির্মূল করার আওয়াজ দিয়েইতো বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছিলেন! তাহলে এখন কেন সেই নির্যাতনী ব্যবস্থা রাখতে হবে? বিনা অপরাধে শাস্তি দিতে হবে? প্রমাণ ছাড়া কি কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়? তাহলে, আইন লংঘন করছে কে? মিশু কি অপরাধী? নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করা কি অপরাধ? যারা মানুষের মতো বেঁচে থাকার অধিকার নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করে তারা কী অপরাধী? না যারা এ ধরণের আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার জন্য ভয়-ভীতি দেখায়, বিনা বিচারে জেলে পুরে রাখে দিনের পর দিন; রিমান্ডের নামে অত্যাচার করে, মানসিক নির্যাতন করে, ২৪ ঘণ্টা পার হলেও প্রয়োজনীয় ঔষধ দেয় না, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় অসুস্থ মানুষটিকে মেঝেতে ঘুমাতে দেয় একটিমাত্র পাতলা কম্বল দিয়ে কিংবা রাস্তায় পিটিয়ে ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়; গুলি-টিয়ার সেল ছুঁড়ে নিরীহ মানুষ মারে; ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড চালায়; ষড়যন্ত্রী আখ্যা দিয়ে হাজার হাজার নিরীহ শ্রমিকের নামে মিথ্যা মামলা দেয়; খুনি-ধর্ষক-লুটেরা-দখলদার-বহুজাতিকদের স্বার্থরক্ষায় সক্রিয় থাকে; মজুরির আন্দোলনের অপরাধে শ্রমিক হত্যা, নারী শ্রমিকের উপর দুর্বৃত্ত পুরুষের হামলাকে বৈধ করে; তারা অপরাধী? রাষ্ট্র কার পক্ষে?
রাষ্ট্র তো বায়বীয় কিছু নয়। সাংগঠনিক কাঠামো, ব্যবস্থা। একে পরিচালনা করে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ, নির্দিষ্ট শ্রেণী-গোষ্ঠীর স্বার্থে। সুতরাং, তাদের চিন্তা-ভাবনা-মূল্যবোধ-সংস্কৃতি দ্বারাই পরিচালিত হয় রাষ্ট্র কাঠামো। তাই ক্ষমতাবানরা চায় না যে, মিশু বেঁচে থাকুন। অবশ্য, না চাওয়ারই কথা। কারণ, মিশু গার্মেন্ট শ্রমিকদের নিয়ে আন্দোলন করেন। মিশু বেঁচে থাকলে গার্মেন্ট মালিকদের সমস্যা। শ্রমিকের মজুরী না দিয়ে অবাধ লুণ্ঠন-পাচার করার ক্ষেত্রে মিশু একটি ঝামেলা। সুতরাং মিশুকে রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে করে মেরে ফেলতে হবে কিংবা আজীবনের জন্য পঙ্গু করে ফেলতে হবে যাতে অন্য কেউ এ ধরণের আন্দোলন করতে সাহসটি আর না পায়। এযাবত কারখানার গেটে তালা কিংবা ব্যবস্থার অভাবে শতশত শ্রমিক নিহত হয়েছে, কোন মালিকের বিচার হয় নাই। হাজার কোটি টাকা বকেয়া রেখে কোন মালিক শাস্তি পায়নি। যৌন নিপীড়ন, মারপিট, মজুরি না দেওয়ার অপরাধেও কোন মালিকের শাস্তির নজির নাই। এগুলোর প্রতিবাদ করলে শাস্তি দিতে সরকারের ক্ষমতা প্রয়োগের অভাব নাই।
রাষ্ট্র ক্ষমতবানদের পক্ষে কথা বলে, বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকাীদের শাস্তি দেয়। তা না হলে মেজিস্ট্রেট এসে মিশুর পক্ষের আইনজীবিদের কোন যুক্তি-প্রমাণ কানে না তুলে শুধুমাত্র পুলিশের চাওয়া আবেদনের প্রেক্ষিতে ২ দিনের রিমান্ডে নিল কেন? অসুস্থ জানা সত্ত্বেও কেন কোন ডাক্তার ডাকার কিংবা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করেনি ডিবি পুলিশ? করবে না। কারণ, অমানবিক হয়ে ওঠার জন্য তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কঠোর এবং ভয়ঙ্কর নির্যাতক, অত্যাচারী হতে পারলে তাদের পুরষ্কারের ব্যবস্থা আছে; রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আবার ক্ষমতাবান-মালিকদের পক্ষ থেকে। সুতরাং মিশু অত্যাচারিত হবেন যদিও ভাঙ্গচুরের ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়া সত্ত্বেও সরকার ষড়যন্ত্রী হিসেবে মিশুকে জড়ানোর অসম্ভব সব প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকবেন। ‘‘..ঘটনার সময় আগারগাঁও দিক হইতে আসা প্রাইভেট কারটিতে জামাত নেতা রফিকুল ইসলাম খান এর সহিত প্রাইভেট কারে ছিল বলিয়া ঘটনাস্থল-এলাকার লোকজনসহ সাক্ষীগণের জিজ্ঞাসাবাদে প্রকাশ পায় এবং জামাত নেতা রফিকুল ইসলাম খানের সাথে প্রাইভেটকারে আসামী মিশুকে দেখিয়াছে মর্মে জনশ্র“তি রহিয়াছে। আসামীকে পুনরায় পুলিশ রিমান্ডে আনিয়া আসামীদের সাথে অজ্ঞাতনাম ব্যক্তি/আসামী কে কে ঘটনাস্থলে ঘটনার সময় উস্কানীমূলক কথা বলিতে আসিয়াছিল তাদের গ্রেফতারসহ পুর্নাঙ্গ নাম ঠিকানা সংগ্রহ করার লক্ষ্যে এবং সরকারী পুলিশের গাড়ী ভাঙ্গচুরের সাথে জড়িত আসামীদের গ্রেফতারসহ মামলার প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করার লক্ষ্যে আসামীকে লইয়া পুলিশি অভিযান পরিচালনা করার নিমিত্তে ধৃত পুলিশ রিমান্ডে প্রাপ্ত আসামী মোশরেফা মিশু (৪৭)কে পুনরায় ০৫ (পাঁচ) দিনের পুলিশ রিমান্ডে পাওয়া একান্ত প্রয়োজন। (কাফরুল থানায় মিশুর বিরুদ্ধে অভিযোগনামায় বর্ণিত। মামলা নং ৭৬ তাং ৩০.০৬.১০। ধারা-১৪৩, ১৪৯, ৩২৩, ৩২৪, ৩২৫, ৩৩২, ৩৩৩, ৩৫৩, ৪২৭, ১১৪)’’। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যারা সক্রিয় আন্দোলনের সাথে জড়িত তাদের একজন মিশু। তাঁকেই এখন যুদ্ধাপরাধীদের সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে।
‘‘ যুদ্ধাপরাধী তারাই যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করেনা। অসা¤প্রদায়িক, শোষণহীন সমাজ, সম্পদ এবং উৎপাদনের উপর জনগণের মালিকানা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যারা বিরোধী তারাই প্রকৃত যুদ্ধাপরাধী। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাস্তবায়নের জন্য জনগণের লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে; মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’’ এ কথা এবং কাজ যে মিশু করেন, তিনি কীভাবে জামাত সংশ্লিষ্ট হয়ে যান? জামাত কী এই চেতনা ধারণ করে? মিশুর বিরুদ্ধে কেন তাহলে এ ধরণের অন্যায় এবং মিথ্যা অভিযোগ? মিশু প্রতিবাদের কারণে আজ বন্দি। মিশুর বন্দিত্ব মানে কী চেতনারও বন্দিত্ব? শৃঙ্খলকে মেনে নেওয়া? ইতিহাস কী বলে? গণতান্ত্রিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কিংবা আন্দোলনকারীদের কী এভাবে থামানো গেছে?
মেহেদী হাসান
২০.১২.১০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




