somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন অশিক্ষিত-গ্রাম্য-দরিদ্র- নারী খাদিজা!

২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নানা ধরনের বৈষম্যে আক্রান্ত আমাদের সমাজ। ধনী-গরীব বৈষম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্য, বয়স ছোট-বড় বৈষম্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিত বৈষম্য, গ্রাম-শহর বৈষম্য ইত্যাদি আরো নানা ধরনের বৈষম্য। অনেকে এই বৈষম্যগুলোর একটা বা দুইটার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকা সত্ত্বেও অন্য বৈষম্যগুলোকে পরম নিষ্ঠায় বুকের ধারণ করে থাকে বা এগুলো সম্বন্ধে অসচেতন থাকে। যার ফলে দেখা যায় অনেক নারীবাদী যারা পুঁজিবাদী মনোভাবাপন্ন তারা ধনী-গরীব বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে না। আবার আরেক দল যারা একই সাথে নারী-পুরুষ বৈষম্য এবং ধনী-গরীব বৈষম্যের বিরোধিতা করে তবে তারা বয়স ছোট-বড় বৈষম্য, শিক্ষিত- অশিক্ষিত বৈষম্য, গ্রাম-শহর বৈষম্যের আওতামুক্ত নয়।

আমাদের সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হলেও সকলেই একই সাথে সকল বৈষম্যের শিকার নয়। কেউ হয়ত একটি বা দুইটি বৈষম্যের শিকার তবে অন্য বৈষম্যের সুবিধাভোগী। একজন দরিদ্র পুরুষ ধনী-গরীব বৈষম্যের শিকার হলেও নারী-পুরুষ বৈষম্যের সুবিধা পুরোমাত্রায় ভোগ করে। পুরুষতান্ত্রিকতায় আচ্ছন্ন একজন দরিদ্র পুরুষ নারীর উপর শারীরিক- মানসিক নির্যাতন চালাতে বা নারীকে ধর্ষণ করতে পিছপা হয় না। শিক্ষিত প্রগতিবাদীরা অশিক্ষিত লোকজনের সাথে অবজ্ঞাপূর্ণভাবে কথা বলে। রিক্সাওয়ালার সাথে তুই-তোকারী করে এমন শহুরে শিক্ষিত প্রগতিবাদীর অভাব নেই। এমন অনেক প্রগতির ঝান্ডাধারী আছেন যাদের সামনে বয়সে ছোট কেউ সিগারেট ফুঁকলে তাদের মনে জখম তৈরী হয়। নেতৃত্বের যথেষ্ট গুণাবলী থাকা সত্বেও শুধু বয়সে অন্যদের চেয়ে ছোট হওয়ার কারনে বামপন্থি সংগঠনগুলোতেও নেতৃত্বে আসতে পারে না সংগঠনের নিষ্ঠাবান তরুণ কর্মীরা। এরকম অনেক উদাহরণ দেয়া যায়।

যাহোক, আমাদের সমাজে এমন কেউ কেউ আছেন যারা প্রায় সকল ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়। শ্বশুর-শাশুড়ির হাতে খুন হওয়া খাদিজা হল তেমনই একজন। এই খাদিজা একজন নারী হওয়ার ফলে সে নারী-পুরুষ বৈষম্যের শিকার। অশক্ষিত হওয়ার ফলে শিক্ষিত-অশক্ষিত বৈষম্যের শিকার। গরীব হওয়ার ফলে ধনী-গরিব বৈষম্যের শিকার। গ্রাম্য হওয়ার ফলে গ্রাম-শহর বৈষম্যের শিকার। খাদিজা যেহেতু নারী ফলে পুরুষতন্ত্র তার বিরুদ্ধে কাজ করবে অবিরত। খাদিজা যেহেতু গরীব তাই ধনীরা তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবে না। খাদিজা অশিক্ষিত ফলে শিক্ষিতরা তার ছায়া মাড়াবে না। খাদিজা যেহেতু গ্রাম্য তাই শহুরে প্রগতিবাদী এবং নারীবাদীদের সহমর্মিতা পাওয়া থেকে সে বঞ্চিত হবে। অশিক্ষিত- গ্রাম্য-দরিদ্র- নারী খাদিজা খুন হলে এই সমাজের কারো কিছু যায় আসে না। ফলে খাদিজা হত্যাকাণ্ড এমনকি শহুরে শিক্ষিত- নারীবাদী- প্রগতিবাদীদের হৃদয় স্পর্শ করতে অসমর্থ হয়।

এই খুন হওয়া খাদিজা যদি শহুরে মধ্যবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোন নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হত তাহলে আজকে এই হত্যাকাণ্ডের খবর শহুরে গণমাধ্যম কর্তৃক পুরো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ত। দেশের প্রায় প্রত্যেকটি বড় বড় সংবাদ পত্রের শিরোনাম হত “ অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী খুন”। ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলোতে একই শিরোনামে ট্রল চলত কয়েকদিন ধরে। শহুরে নারীবাদী- প্রগতিবাদী আন্দোলন কর্মীরা এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলত। গ্রামাঞ্চলের কোন ঘটনায় যে শহুরে প্রগতিবাদীরা মোটেই বিক্ষুদ্ধ হন না ব্যাপারটা তা নয়। তবে ঘটনাটিকে বহুমাত্রিক, চমকপ্রদ, বিশাল এবং অদ্ভুত হতে হয়। একজন মানুষ খুন হলে চলে না, খুন হতে হয় অনেককে। তবু তারা প্রথমেই এগিয়ে যায় না। যদি শহুরে গণমাধ্যমগুলো গ্রামাঞ্চলে তাদের বাজার টিকিয়ে রাখার স্বার্থে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হয় তবেই কেবল সেখানে শহুরে প্রগতিবাদী-নারীবাদী- মানবাধিকার কর্মীরা ভিড় করে। “খবর এত বেশী থাকে যে গ্রামাঞ্চলের বা মফস্বলের গুরুতপূর্ণ খবর শহরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে তাদের আবেদন হারিয়ে ফেলে। উচিত নয় তবুও এমনটা হয়। এটাই নির্মম সত্য।” একজন সংবাদকর্মী খোলাখুলিভাবে এমনটাই ব্যক্ত করলেন।

কোন মতেই-কোন ক্রমেই শহুরে প্রগতিবাদী-নারীবাদী- মানবাধিকার কর্মীরা খাদিজা হত্যার বিচারের দাবীতে আন্দোলনে সক্রিয় হবে না কারন এখানে তো কোন চমক নেই, নেই কোন বর্ণিলতা। এটা হাজার বছর ধরে ঘটে চলা একটা ঘটনামাত্র। এরকম শত শত ঘটনা হরহামেশা ঘটে চলেছে। কালের প্রবাহে এই ঘটনা তার রঙ হারিয়ে আজকে বিবর্ণ। এই নিতান্তই সাদা-কালো ঘটনাটি আজকের শহুরে রঙিন গণমাধ্যমগুলোর কাছে নিতান্তই মূল্যহীন। খাদিজা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে শহরে কোন আন্দোলন হবে না কারন শহুরের গণমাধ্যম ঘটনাটিকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে আন্দোলনের শক্ত, সুরক্ষিত ভিত্তি বা ছাদ তৈরী করে নি । গণমাধ্যমের বিপুল প্রচারের সুরক্ষিত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই, গণমাধ্যমের পোক্ত মাউথপিসের সামনে মুখ নিয়েই কেবল তারা আন্দোলন পরিচালনা করে, অন্যথায় নয়।

আজকে ঢাকা শহরে সুন্দরবন রক্ষার তাগিদে জোর আন্দোলন হচ্ছে। এই সুন্দরবন রক্ষা করতে হবে কার স্বার্থে? মানুষের স্বার্থে নিশ্চয়ই। এই বৈষম্য ভিত্তিক সমাজে যদি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার না থাকে, যদি সেখানে সামান্য কয়েক টাকার যৌতুকের বিনিময়ে মানুষকে অবিরত খুন হতে হয় তাহলে আমরা সুন্দর বন দিয়ে কি করবো? খুন হওয়া খাদিজা হয়ত মানুষ নয়। যদি মানুষ হত তাহলে সুন্দরবন নিয়ে যারা আন্দোলন করছে তারা খাদিজা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারটি সম্বন্ধে অবগত থাকত এবং এই নিয়ে দু-চারটা কথা হলেও বলত। খাদিজা হচ্ছে একজন দরিদ্র-অশিক্ষিত- গ্রাম্য- নারী মাত্র। তাই খাদিজা হত্যার বিচারের দাবীতে শহর থেকে কোন আওয়াজ আসে না, আসবে না। শহুরে লোকজনদের উপর পুলিশের লাঠিপেটা হলে আন্দোলন হয় অথচ গ্রাম্য নারী খুন হয়ে গেলেও তা নিয়ে শহরাঞ্চলে কোন আন্দোলন তো দূরের কথা এই নিয়ে তেমন কোন গুঞ্জনও উঠে না।

খাদিজা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে যদি কোন আন্দোলন হয় তবে তা করতে হবে গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত, দরিদ্র, খেঁটে খাওয়া, অনারীবাদী- অপ্রগতিবাদী মানুষদেরই। শহরের শিক্ষিত নারীবাদী- প্রগতিবাদীদের কাছে আবেদন-নিবেদন করে কোন লাভ নেই বরঞ্চ এতে করে তাদের কাছে আমাদের শুধু হেয় প্রতিপন্ন হতে হবে।

তবে এই শহুরে প্রগতিবাদী-নারীবাদীদের মধ্যে দু-একজন হয়ত সত্যিকার অর্থেই প্রগতিবাদী-নারীবাদী যারা গ্রাম-শহর বৈষম্যকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে বলে আমি আশা করি। তারা হয়ত খাদিজা হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবীতে আন্দোলনে এগিয়ে আসবে কিংবা আন্দোলনকারীদের মানসিক সমর্থন জানাবে এবং তাদের করা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা দিয়ে নানা রকমভাবে সহযোগিতা করবে।

যারা বৈষম্যের মূলোৎপাটন করতে চান তাদের প্রতি আমার বক্তব্য হলো সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে একযোগে লড়াই পরিচালনা করতে হবে। নচেৎ তেমন কোন লাভ হবে না। কারন বৈষম্যগুলো একে অপরের সাথে খুবই জোরালোভাবে গ্রন্থিবদ্ধ থাকে। আলাদাভাবে শুধু কোন একটির অপসারণ সম্ভব নয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:১৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×