কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের জাতীয় কবি। অথচ এই কবির শৈশব-কৈশোর যেমনি বৈচিত্র্যময় তেমনি দুঃখ-কষ্টে ভরপুর ছিল। ১৮৯৯ সালে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। কথিত আছে তার পূর্বপুরুষেরা পাটনা থেকে এসেছিলেন, কাজী হিসেবে অর্থাৎ বিচারক হয়ে। নজরুল জন্মের বহুকাল আগেই তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিলুপ্ত হয়।
জন্মের আট বছর বয়সেই পিতৃহারা হন। অভাব অনটন ও কষ্টের জীবনযাপনের জন্য তার নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। অবশ্য জন্মের পরপরই তাকে অন্য আরেকটি নামে ডাকা হতো, তারা ক্ষ্যাপা চলে। এই নামে ডাকার কারণ অবশ্য আছে। নজরুলের মা পুত্রসন্তান কামনা করেন তারা ক্ষ্যাপা নামে এক তান্ত্রিক সাধুর শরণাপন্ন হন। নজরুলের জন্ম হলে ওই সাধুর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তার নামানুসারে তারা ক্ষ্যাপা বলে ডাকা হতো।
১৯১০ সালে গ্রামের মক্তবে বাল্যশিক্ষা সমাপ্ত করেন। অভাব-অনটনে বেশি দূর এগোতে পারেননি। জীবন-জীবিকার জন্য মক্তব্যে শিক্ষকতা, গ্রামে মোল্লাগিরি এবং হাজী পাহলোয়ানের মাজারে খাদেমগিরি করেন।
মাত্র ১৩ বছর বয়সে লেটো নাচের দলের জন্য গান ও কবিতা রচনা করেন। পালাগান শকুনি-বধ্, মেঘনাদবধ, চাষার সঙ, রাজপুত্র ও আকবর বাদশা নির্মাণ করেন। কবি গানের দলে দলনেতা ছিলেন।
অর্থের অভাবে একজন গার্ডের অধীনে বাবুর্চিগিরি এবং হুগলির এম বখশ নামক ব্যক্তির রুটির দোকানে পাঁচ টাকা বেতনের চাকরি করেন।
নজরুল খুব সুন্দর বাঁশি বাজাতেন। তার বাঁশির সুরে পথচারীদের ভিড় জমে যেত। তার বাঁশি শুনে ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত কাজী সিমলা গ্রামের দারোগা কাজী রফিকুল্লাহর গৃহে আশ্রয় লাভ করেন এবং বছরখানেক সময়ও খানকার দরিরামপুর হাইস্কুলে অবৈতনিক ছাত্র হিসেবে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। দুরন্তপনা যার স্বভাব তিনি কি এক জায়গায় বেশি দিন থাকতে পারেন? বছর শেষে কাউকে না জানিয়ে ওখান থেকে পালিয়ে আসেন। ফিরে এলেন আসানসোল, ভর্তি হলেন স্কুলে। প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জক মল্লিক। কাশিমবাজারের মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্রের দানে স্কুলটি চলত। নজরুল সেখানে বেতন মওকুফসহ আনুষঙ্গিক কিছু সুযোগ-সুবিধা চেয়েছিলেন। কিন্তু পাননি।
পরবর্তীকালে রানীগঞ্জের শিয়ালসোল (বর্ধমান) হাইস্কুলে ভর্তি হলেন। এখানে স্থানীয় জমিদারের দাণ্যি পেলেন। অবৈতনিক ছাত্র এবং মুসলিম হোস্টেলে থাকা-খাওয়া ছাড়াও মাসিক সাত টাকা বৃত্তি পেলেন।
অষ্টম শ্রেণীতে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করায় তার মেধা দেখে কর্তৃপক্ষ তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে দশম শ্রেণীতে উঠালেন।
এরই মধ্যে তার পরিচয় হয় শৈলজানন্দের মতো লেখকের সাথে। ১৯১৭ সালে স্কুলের শেষ ধাপে এসে পড়াশোনার পাট চুকালেন। যোগ দিলেন কিশোর নজরুল ডাবল কোম্পানিতে। ট্রেনিং শেষে শিগগিরই তাকে নওশেরার সীমান্ত প্রদেশে এবং সেখান থেকে রেজিমেন্টসহ করাচি পাঠিয়ে দেয়া হলো।
তার কর্মদক্ষতা দেখে দ্রুত হাবিলদার পদে প্রমোশন হয়। এটি ছিল ইন্ডিয়ান কমিশন্ড অফিসার পদ। তিনি কোয়ার্টার মাস্টার ছিলেন। এই সময় তার মুক্তমন ও সাহিত্যের প্রভাব অন্যদের অনুপ্রাণিত করত।
এভাবে তিনি কৈশোরের চাঞ্চল্য কাটিয়ে ধীরে ধীরে সম্মুখে এগোতে থাকেন। নজরুলের অ্যাকাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও অসম্ভব প্রতিভাধর ছিলেন। আত্মসচেতনতা তাকে সুশিক্ষিত করে তোলে; তাই তো আজো তার সুবিশাল সাহিত্যকর্ম নিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে গবেষণা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


