somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যশোর রোড

২৬ শে মার্চ, ২০১২ ভোর ৪:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল" নীতিটা মেনে চলি। সেটা ক্রমশ স্থুলকার হতে চলা শরীরের জন্য হতে পারে, হতে পারে বিদ্যুত নামক অসংখ্য নেগেটিভের নিয়মমাফিক চলে যাওয়ার দরুণ কিংবা হতে পারে রাত্রির গ্রামীন পরিবেশটা উপভোগ্যতার জন্যেও। তবে এটা ঠিক আমার ভালো লাগে, সরু রাস্তা দিয়ে হাটতে হাটতে অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলা। মাঝে মাঝে আলোকিত করে পাশ দিয়ে ছুটে চলে যায় বৃহৎ কোনো যান। ফুরফুরে বাতাস শরীরের জন্য যেমন উপভোগ্য, মনের জন্যেও বলা চলে অসাধারণ একটা দাওয়ায়। কারন সেটা শরীরকে অনুভুত করে গেলেই মনটা চাঙ্গা করে দিয়ে যায়। আজ মনটা একটু বেশিই খারাপ। আমাদের নিত্যকার দেশ নিয়ে চিন্তিত হওয়াটা নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে আজ। আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠি আলোচনার টেবিলে কিংবা কর্মব্যস্ততার মাঝেও। সেটা আমাদের দেশের প্রতি অকৃত্তিম ভালোবাসার জন্যই। তারপরো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় সত্যিই কি ভালোবাসি আমরা আমাদের স্বস্বিকৃত মাকে? এটা উপস্থাপন করতেই গোলোযোগের শুরু। তাদের যুক্তি আমাদের ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। হতে পারে আমরা দূর্ণিতি করি, হতে পারে অন্যের অসততা হজম করি নির্বিকার চিত্তে, হতে পারে অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ শুধুমাত্র আলোচনার টেবিলেই সীমাবদ্ধ কখনো সেটা অন্যায়কারীর সম্মুখে প্রকাশিত হয়না। তবুও আমরা ভালোবাসি আমাদের মাকে, মাতৃভুমিকে তবে সেটা নিজেকে ভালোবাসার পরেই। ক্লান্ত কন্ঠে কেউ কেউ তখন বলে "দেখেন নিজের উপরে কি কারো স্থান করে দেওয়া সম্ভব!"। তাদের যুক্তিতে অযৌক্তিকতা নেই তবু মেনে নেওয়াটা কষ্টের। ভাবাটা কষ্টের যে একসময় অসংখ্য মানুষ দিয়েছিলো এই মাকেই অবস্থান তাদের জীবনের উপরেও। বাজি ধরেছিলো নিজের জীবনকে এই মাকে একটু ভালো থাকতে দেওয়ার জন্য। নির্মম অত্যাচার সহ্য করেছিলো হাসিমুখে মায়ের কষ্ট লাঘবের জন্য। তবে এখন কেনো সম্ভব নয়। ভাবতে ভাবতে কখন যে রাস্তার নির্জন দিকে অবস্থিত সুপ্রাচীন বটগাছের কাছে চলে এসেছি বুঝতে পারিনি। এতদুরে কখনো আসা হয়নি আগে কখনো, কোনো রাত্রিতে। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখছি একজন লোক বসে সুগভীর মগ্নতায় কিছু একটা এঁকে চলেছেন। এগিয়ে যায় তার দিকে, এমন ক্ষ্যাপা লোক আমি আগে দেখিনি কখনো।
- কি করছেন এত রাতে এখানে?
- দেখছোনা ছবি আঁকছি!
- কিসের ছবি দেখতে পারি?
ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে লোকটা আবার মনোনিবেশ করেন তাঁর ছবি আঁকায়। একটানে কিছু এলোমেলো দাগ টেনে সামনে তুলে ধরেন তাঁর অঙ্কনের খাতাটা। রাত্রির অস্পষ্টতা এবং শিল্প বুঝতে না পারার অক্ষমতার দরুন অবাক চোখে তাকি থাকি তাঁর এবং তাঁর ছবিটির দিকে। বিশ্ময়মাখা চোখে জিজ্ঞাসু কন্ঠে বলি,
- কি এঁকেছেন এটা?
এবার আমি তাকে ক্লান্ত এবং হতাশ দেখি। বলে " তুমি কি কিছুই শুনতে পাচ্ছোনা? কিছুই দেখতে পাচ্ছোনা?"
না সুচক উত্তর পেয়ে হতাশার যায়গা যেনো ক্রোধ ভর করলো তার উপর। বললেন "সামনের দিকে তাকাও। বিস্তৃত করো চোখ। কি? দেখতে পাচ্ছো শতশত মানুষ হাঁটছে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে। পিছনে ফেলে এসেছে স্বপ্নময় অতীত। তারা হাটছে নাঙ্গা পায়। আকাশটার দিকে তাকিয়ে চাচ্ছে একফোটা জল। শুনতে পাচ্ছো কি লাখো লাখো আহাজারি। পেছনে স্বজনের দুর্ঘন্ধময় লাশ ফেলে ছুটে চলছে একদল মানুষ। তাদের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, ঠিক তারা তোমার আমার আমার মত মানুষ নয়। তাদের কঙ্কালসার দেহের দিকে তাকিয়ে দেখো একটুকরো শুকনো রুটি তাদের জন্য অমৃত, সপ্তম স্বর্গে বসবাসের ন্যায়। তাকিয়ে দেখো ক্ষুদার্ত শিশু, উলঙ্গ হয়ে কেঁদে কঁদে উঠছে। মা তার আঁচলে মুখ ঢাকছেন নিজের ব্যর্থতার জন্য। তুমি কি আসলে দেখতে পাচ্ছোনা একরাশ হায়েনা তাদের পিছু নিয়েছেও। এই হাড্ডিসার মানুষের রক্ত মাংস ভক্ষনের লিপ্সায়? তুমি কি আসলেই দেখতে পাচ্ছোনা রাত্রির আঁধারকে আলোকিত করে মাথার উপর দিয়ে ছুটে চলছে বোমারু বিমান?"
ঠিক তখনি অলৌকিক ঘটনা যেনো ঘটে যায়, আমি শুনতে পাই অজস্র কলকাকলি আমাকে ঘিরে। আমাকে কিংবা আমাদেরকে উপেক্ষা করে ছুটে চলছে অসংখ্য স্বপ্ন। তাদের চোখে অস্রু আছে কিন্তু সেই অস্রুর মাঝেও কোথাও যেনো আশা উঁকি মেরে যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি বৃদ্ধ পিতা সন্তানের হারানোর ব্যাথা অস্পষ্ট সুরে আহাজারি করছে সন্তপর্নে যেনো টের না পেয়ে যায় তাদেরকে বধ করতে আসা হায়েনার দল। কব্জি উড়ে যাওয়া শিশুটির মুখ চেপে এগিয়ে চলছে কোনো কোনো মা। কোনো কোনো সন্তান ঘাড়ে তুলে নিয়েছে মৃতপ্রায় মাকে। আমি খুঁজে পাচ্ছিনা নিজের চেয়ে বড় কিছু নেই আমাদের দেওয়া তত্ব কথাটা। কারন ক্ষুদার্ত, পিপাসার্ত অসংখ্য মানুষ ভাগ করে নিচ্ছে টুকরোর চেয়ে টুকরো হয়ে থাকা খাবার পানীয়। বড় হয়ে উঠেছে অসংখ্য শৈশব হারিয়ে ফেলা শিশুদের পেট। আধপেটা সন্তান জড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের পানিতে ভাসছে কোনো দুঃখিনি মা। নিজের স্বপ্ন সুখ বিসর্জিত হয়ে পড়ে আছে হইতো অনেক দুরের কোনো গাঁয়ে। যেখানে সোনালি ধান কেবল উঠে আসার অপেক্ষায় আছে। আমি শুনতে পাই দূরে বেঁজে চলছে কোনো কর্কশ সাইরেন, তাতে কেঁপে উঠছে ছুটে চলা মানুষের দল। মাটিতে মিশে যাচ্ছে বোমারু বিমানের উড়া উপলক্ষে।"

হঠাৎই তীব্র আলোকে আমারো চোখ ধাঁধিয়ে যাই, আমিও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে সরে যাই। তখনি দেখি একটি বাস প্রায় আমার পাশ দিয়ে ছুটে যেয়ে পড়ে রাস্তার ধারে ক্ষেতটির মাঝে। ছুটে যাই দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বাসটির পাশে। শিশুদের চিৎকার, মায়ের আহাজারিতে যায়গাটা সহসাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। আমি হয়ে উঠি অসহায়। সেই চিত্রকরকে কোথাও দেখিনা, দেখিনা অজস্র মানুষকে যারা এতক্ষন ঘিরে ছিলো আমাকে। রক্তাক্ত হয়ে উঠে আমার দেহ অসংখ্য মানুষের রক্তের স্রোতে। আমি বের করে আনার চেষ্টা করি তাদেরকে একে একে। সেইসাথে সেলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যায় গুরুত্বপুর্ণ নাম্বার গুলোতে। উত্তর আসে না। আমি তীব্র আশা করতে থাকি একটি উত্তরের জন্য। কিংবা ভোরের জন্য যখন এই পথ লোকে লোকারন্য হয়ে উঠবে। তাহলেও বাঁচতে পারবে কিছু স্বপ্ন, কিছু আশা। তবে কেনো জানি আজকের রাত্রিটা দীর্ঘ থেকেও দীর্ঘতর মনে হচ্ছে আমার কাছে। জানা নাই ভোর হবে কিনা। যে ভোরের জন্য লক্ষ্ লক্ষ্ লোক জীবন দিয়েছিলো হাসিমুখে, সেই ভোরকে আসতেই হবে। হোকনা সেটা বিলম্বিত তবুও তো বাঁচবে কিছু প্রাণ। সেই ভোরের অপেক্ষায় বসে আছি, থাকবো কিংবা থাকতে হবে।

কিছু কথাঃ সেপ্টেমবর অন যশোর রোড একটা বিখ্যাত কবিতা । যা রচনা করেছিলেন বিখ্যাত মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ১৯৭১ এ যশোর সীমান্তের শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করে। এই কবিতা নিয়ে পরে মৌসুমি ভৌমিক অসাধারণ একটা গান করেন। আমার বাড়ি যশোর রোডে হওয়ার কারনে কিছু একটা লেখার ইচ্ছা ছিলো। তাই গল্প লিখতে চেয়েছিলাম, যে গল্পটা লিখতে চেয়েছিলাম সেটা মনে হয় হয়নি। তবে কাছাকাছি কিছু একটা হয়েছে। এতেই তৃপ্ত।

উৎসর্গঃ সকল বিদেশীকে যাঁদের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্থানিদের অবিচার যাঁদেরকেও কাঁদিয়েছিলো। যাঁরা শত প্রতিকুলতার মাঝেও ছুটে এসেছিলেন সাহায্যের ডালি নিয়ে। শ্রদ্ধা তাদের প্রতি।
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×