জার্মানির পুব আর পশ্চিমের একসঙ্গে এই বিকাশ ঘটেছে বহু জায়গায়৷ তবে এখনও রয়ে গেছে মন ও মানসের পার্থক্য৷ আছে এমনকি পরস্পর সম্পর্কে কিছু বিরূপ মনোভাবও৷ কেউ কেউ এটাকে ‘মস্তিষ্কে ঢুকে যাওয়া এক দেয়াল' হিসেবেও চিহ্নিত করছেন৷ পুবের জার্মানদের পশ্চিমে এমনকি একটু বক্রোক্তি করে ‘অসিস' বলা হয়৷ আর পুবের মানুষদের কাছে পশ্চিমের জার্মানরা হল ‘ভেসিস'৷ বার্লিন প্রাচীর পতনের ২০ বছর পরেও বহু পূর্ব জার্মান ভাবনায় ও অনুভূতিতে পশ্চিমের জার্মানদের চেয়ে কেন এখনও অন্য রকম?
বার্লিন প্রাচীরের পতন এক ঐতিহাসিক মাহেন্দ্র্যক্ষণ জার্মানদের জন্য৷ এরই হাত ধরে ১৯৯০-এর ৯ নভেম্বর দুই জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ৷ মুছে যায় ইউরোপের বিভাজন৷ জার্মানদের দীর্ঘ লালিত পুনরেকত্রীকরণ এক বাস্তব সত্য৷ কিন্তু ভাবনার দেয়ালখানা কারো কারো মন থেকে যেন দূর হচ্ছে না৷ এইত মাত্র কয়েক বছর আগেও পূর্বাঞ্চলের নাগরিকদের নিয়ে পশ্চিমের মানুষরা বারবার অনুযোগ করেছে৷ তাদের লক্ষ্য করে বলেছে: ‘তোমাদের আক্ষেপের যেন শেষ নেই ' অথবা ‘তোমরা তোমাদের সেই পূর্ব জার্মানি আবার ফিরে পেতে চাও'৷ জনমত সমীক্ষার ফল থেকে অথবা নির্বাচনি রায় থেকে অবশ্য এ ধরণের মতামতের সপক্ষে কোন প্রমাণ মেলে না৷ তবে এই প্রশ্ন তোলাটা সঙ্গত হবে যে পুবের শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ২০ বছর পরেও সেখানকার মানুষদের মানসিক অবস্থাটা আদতে কেমন৷ এর সুস্পষ্ট কোন উত্তর কেউ এখনও দিতে পারছেন না৷
পূর্বাঞ্চলের মানুষদের মাঝে দেখা দেয়া এক ধরণের অতীতচারিতা তাদের সম্পর্কে দ্রুত বিরূপ মনোভাব তৈরি করতে ভূমিকা রাখে৷ একে বলা হয়েছে অস্টালজিয়ার স্রোত৷ জার্মান অস্ট অর্থাৎ কিনা পুব আর নসটালজিয়া এই দুই শব্দ মেলে তৈরি হয়ে যায় নতুন শব্দ অস্টালজিয়া -পুব-কাতরতা৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে পুবের বেশ কিছু বড় শহরে এমন সব দোকান এখনও চোখে পড়বে যেখানে সাবেক পূর্ব জার্মানির স্মৃতিবাহী বহু পণ্যই পাওয়া যাবে৷ এরকমই একটি দোকানের ক্রেতা বললেন, ‘‘আমি এই দোকানে কি কি পাওয়া যায় তা দেখতে এসেছি৷ হ্যাঁ, এই জিনিসটা আমি কিনছি৷ এটা আমার পছন্দ হয়েছে৷ বাথটাবে ব্যবহারের এই বাবল্ বাথটা ভালই ! পূর্ব জার্মানির সময় থেকেই এটা আমার চেনা৷''
পুব-কাতরতার এরকম কিছু দৃষ্টান্ত বাদ দিলে পূ্র্বাঞ্চলে অস্টালজিয়ার সেই দমকা হাওয়া বহু দিন হল গত হয়েছে৷ তবে কিছু কিছু বিষয়ে পুবের জার্মানরা এখনো বেশ স্পর্শকাতর৷ বেশ কিছু জরিপ থেকে তার প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ লাইপজিগ শহরের ডঃ ইভ স্টোবেল-রিশ্টার জার্মানির পূর্বাঞ্চলের মানুষরা কতটা সুখী তা নিয়ে সমীক্ষা চালিয়েছেন গত ২২ বছর ধরে৷ পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায় তাদের জীবনযাত্রায় তারা কতটা সন্তুষ্ট এ নিয়ে তাদের প্রশ্ন করা হয়৷ দীর্ঘদিন ধরে চালিত এই সমীক্ষা থেকে তাদের অনুভূতি ও ভাবনার একটা স্পষ্ট ছবি মেলে৷ জরিপ প্রথম শুরু হয়েছিল ১৯৮৭ সালে৷ সাবেক পূর্ব জার্মানির জীবনযাত্রা প্রসঙ্গে ডঃ স্টোয়েবেল রিশ্টার জানান, ‘‘তখন এক ধরণের নিরাপত্তা ছিল৷ অবশ্য তার নেতিবাচক দিকও ছিল৷ যেমন ধরুন, বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করার পর রাষ্ট্রের পছন্দমত কোন জায়গায় তিন বছর কাজ করার জন্য আমাকে দায়বদ্ধ হতে হয়েছে৷ তবে এটাও আমি জানতাম যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ হবার পর আমি নির্দিষ্ট একটা চাকরি পাবোই৷ অথবা ধরুন, আমি শিক্ষানবিশির সুযোগ পেয়েছি৷ আমি জানি যে এর পর কোন কারখানায় খুব সম্ভবত আমি কাজ করব৷ জীবনে এই নিরাপত্তার একটা বড় রকমের গুরুত্ব আছে বইকি৷''
জরিপে আরো দেখা গেছে পূর্বাঞ্চলের মানুষের মধ্যে মৌলিক সামাজিক মূল্যবোধগুলো এখনো টিকে আছে৷ এই মূল্যবোধগুলোর তাৎপর্য এত বছর পরেও ফিকে হয় নি৷ এখনকার গোটা ফেডারেল জার্মানির প্রতি কেন পূর্বাঞ্চলের বহু মানুষের মনে উষ্ণ অনুরাগ দেখা দেয় নি, এ হলো তার অনেক কারণের একটি৷ পূর্ব জার্মানদের মূল্যবোধ পশ্চিম জার্মানদের মূল্যবোধ থেকে আলাদা, তবে তাকে খারাপ বলা যাবে না, বলেছেন ডঃ ইভ স্টোবেল রিশ্টার৷ তাঁর কথায়: ‘‘আমি এটাকে খারাপ মনে করি না৷ এখন যদি জার্মানিতে সাবেক জিডিআর আমলের কিছু জিনিস চালু করা হয়, যেমন ধরুন এখনকার ছোট বাচ্চাদের দেখাশোনা করার ব্যবস্থা বা স্কুলশিক্ষার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন ওঠানো হয় তাহ লে স্বভাবতই মানুষ ক্ষুব্ধ হবে৷ ১৯৮৯ সালে ওখানকার সব কিছুই খারাপ বলে দেখা হয়েছিল এবং তা অবশ্যই বাতিল করতে হয়েছিল৷ পূর্ব জার্মান রাষ্ট্রে ভাল কিছু খুঁজে পাওয়ার সুযোগ দেয়া হয় নি৷ তার মানে এই নয় যে সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষরা সেই পুরনো জিডিআর রাষ্ট্রকেই আবার ফিরে পেতে চায়৷ তারা শুধু চায়, এই জিনিসগুলোকে আরো যুক্তির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করা হোক৷''
ফিরে যাচ্ছি সাবেক পূর্ব জার্মানির মানুষদের মূল্যবোধ এবং চিন্তা-চেতনার দিকে৷ বার্লিন প্রাচীর পতনের অপার আনন্দ উচ্ছাসের পর্ব যখন শেষ তখন পূর্ব জার্মানির মানুষরা তাদের পুরনো অনেক জিনিস না পাওয়ার অভাববোধে তাড়িত হতে থাকে৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে মুদির দোকানের বেশ কিছু ছোট-খাটো জিনিস, উল্লেখযোগ্য কিছু টেলিভিশন অনুষ্ঠান, বেশ কিছু সামাজিক কর্মকান্ড - সব যেন একরাতেই উধাও হয়ে যায়৷ Sonnenalle এবং Goodbye Lenin - আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত এই দুটি জার্মান ছবিতে পূর্ব জার্মানির হারিয়ে যাওয়া বেশ কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছিল৷ ২০ বছর পর আজও বার্লিন ও তার আশপাশে এমন কিছু ছিটেফোটা জিনিস চোখে পড়বে যা ছিল শুধুই সাবেক পূর্ব জার্মানির৷ যেমন সাবেক পূর্ব জার্মান আমলের জনপ্রিয় গাড়ি Trabant সংক্ষেপে Trabi ৷ এটি দুই স্ট্রোক ইঞ্জিনের একটি বাহন৷ চালাতে তেল এবং গ্যাস দুটিরই প্রয়োজন৷ প্রচন্ড শব্দ করে৷ সাধারণত এই ট্রাবান্ট ঘন্টায় ৮০ থেকে ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারে৷ যদি নতুন কোন ট্রাবান্ট হয় তাহলে অনায়াসে তা ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত গতি তুলতে সক্ষম৷
এই ট্রাবান্টগুলো হারিয়ে গেছে৷ ইদানিং তা সহজে চোখে পড়ে না৷ হঠাৎ করে যদি দু একটা চোখে পড়ে যায় তাহলে সবাই বেশ কৌতূহল নিয়ে দেখে৷ পর্যটকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছবি তুলতে৷ ট্রাবান্টে এখন শুধুমাত্র ট্যুরিস্টরাই চড়ে৷
১৯৮৫ সালে যেখানে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ছিল আজ তার কাছেই দাড়িয়ে রয়েছে ভেলোড্রম এ্যারেনা৷ সেখানে আয়োজন করা হয়েছে মেলার৷ সে কারণে মানুষের প্রচন্ড ভিড়৷ সবাই ব্যস্ত৷ এবং সেখানে বিক্রি হচ্ছে সাবেক পূর্ব জার্মানির কিছু পণ্য৷ যেমন- ভিটা কোলা, ইমনু মল্ট কফি, fetzer চকোলেট বার, রয়েছে প্রসাধন সামগ্রী৷ এমনকি একজন বিক্রেতা খদ্দেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে ফ্রাইং প্যানে বাজনা বাজিয়ে৷ এ ধরণের প্যান শুধুমাত্র তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতেই পাওয়া যেত৷
ভেলোড্রমে নানা ধরণের মেলা বসে৷ রামোনা ওটেৎসিয়া Scot Messen und Marketing কোম্পানি থেকে এসেছে৷ সে জানাল, বার্লিন প্রাচীর পতনের পর ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মত এ ধরণের মেলার আয়োজন করা হয়৷ রামোনা বলল, বলা যেতে পারে যে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পরেই এই পণ্যগুলো আর পাওয়া যাচ্ছিল না৷ সত্যি বলতে রাতারাতি সব উধাও হয়ে গিয়েছিল৷ বলে তা বোঝানো যাবে না৷ যে দেখেছে শুধু সে-ই বুঝবে৷ এক রাতেই বাজার পাল্টে গিয়েছিল৷ সবাই ঝুঁকে পড়েছিল নতুন সব পণ্যের দিকে কিন্তু দেখা গেছে ঘুরে ফিরে তারা তাদের পুরনো পণ্যগুলোই আবার খুঁজছে৷ যেহেতু আমরা এই মেলার আয়োজন করেছি তাই আমরা ভেবেছি পুরোনো কিছু পণ্য রাখলে কেমন হয় ? তখন আমরা হারিয়ে যাওয়া পণ্যগুলো খুঁজেছি৷ এবং দেখা গেছে সবাই সেগুলো কিনতে ঝুঁকে পড়েছে৷
সেখানে সাবেক পূর্ব জার্মানির বেশ কিছু ম্যাগাজিন পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিল৷ শোভা পাচ্ছিল ইলেকট্রনিক্সের কিছু পণ্য, সিগারেট৷ অনেকেই আবার সাবেক পূর্ব জার্মানির টাকা অর্থাৎ মার্ক ল্যামিনেট করেও বিক্রি করছিল৷ তবে উল্লেখযোগ্য ছিল তৎকালীন পূর্ব জার্মানির বেশ কিছু রেকর্ড, গানের ক্যাসেট এবং রেডিও ৷ ছিল দপ্তরে ব্যবহৃত টাইপরাইটার৷ যেন সবকিছু আলাদিনের চেরাগ থেকে বের করা হয়েছে৷ এমনকি সে সময়ের একটি সরকারি অফিসের ক্যান্টিন থেকে মেনুর কপি তুলে আনা হয়েছে৷ লাল চামড়ার মলাটে মোটা সোনালি অক্ষরে লেখা, এক কোনায় সাবেক পূর্ব জার্মান সরকারের রাজনৈতিক দলের লোগো৷
একটি হোস্টেলের নাম ওস্টেল৷ সেখানে ৭০ এর দশকের আসবাব পত্র সাজানো৷ ফুলদানি, বিছানার চাদর এমনকি ওয়াল পেপার পর্যন্ত বহন করছে সাবেক পূর্ব জার্মানির স্বাক্ষর৷ দেয়ালে ঝুলছে তৎকালীন পূর্ব জার্মানির সাবেক নেতা এরিশ হনেকারের ছবি৷ এই ওস্টেলের প্রতিষ্ঠাতা ড্যানিয়েল হেলবিশ৷ ড্যানিয়েল জানাল এখানে যে সব অতিথি আসেন তারা এক ধরণের আতিথেয়তা আশা করেন, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য এক ধরণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁরা ফিরে যান৷
তাঁরা সব সময় মনে করতেন যে সাবেক পূর্ব জার্মানি ছিল অন্ধকার, সেখানে আলোর ছোঁয়া নেই, রংতো নে-ই৷ সবকিছু হবে পুরনো, ধ্বংসের কাছাকাছি৷ কিন্তু আমরা নিজেরাই দেখেছি যখন আমরা সবকিছু একসঙ্গে সাজিয়েছি কত রঙিন জিনিস আমরা তুলে ধরতে পেরেছি৷ কত মূল্যবান পণ্যই না আমাদের সংগ্রেহে ছিল৷ আমি বলতে পারি সাবেক পূর্ব জার্মানির অন্তত ৫০ টি ভিন্ন ভিন্ন মডেলের রেডিও আমাদের এখানে আছে, আরো আছে ১৮০ ধরণের টেবিল ল্যাম্প৷
কিন্তু পূর্ব জার্মান সংস্কৃতি ধরে রাখতে বা ফিরে পেতে পূর্বাঞ্চলের মানুষরা কতটা বদ্ধপরিকর ? পূর্ব এবং পশ্চিম জার্মানির একত্রীকরণের পর তারা কি হারিয়েছেন যা আর কিছুতেই ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না ? বার্লিনের ফ্রি ইউনিভার্সিটির গবেষক ডঃ ইয়োখেন স্টাট জানালেন পূর্বাঞ্চলের মানুষরা ঠিক কোন জিনিগুলোর অভাব সবচেয়ে বেশি বোধ করে৷
আপনি যদি কাউকে জিজ্ঞেস করেন সাবেক পূর্ব জার্মানি সে ফিরে পেতে চায় কিনা তাহলে খুব বেশি মানুষ আপনি পাবেন না, যারা বলবে ‘হ্যাঁ, আমি চাই'৷ যার অভাব তারা সত্যি সত্যি বোধ করে তা হল একত্রে থাকা, একসঙ্গে সবকিছু ভাগ করে নেয়ার যে মানসিকতা ছিল তা এখন আর তাদের চোখে পড়ছে না৷ একজনের সঙ্গে আরেক জনের যে যোগাযোগ, যে একাত্মতা - তার কোন অস্তিত্ব আর নেই৷ প্রয়োজনে- অপ্রয়োজনে আরেকজনের কাছে সাহায্য চাওয়া, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া - তা একেবারেই নেই৷ এর প্রয়োজন অনুভূত হয় সব সময়ই৷
প্রতিবেদক: মারিনা জোয়ারদার
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ৮:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



