somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নিষ্কৃতি

০৯ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাসান সাহেব তন্নতন্ন করে রক্তজবা গাছ খুজলেন।পেলেন না, দরকারের সময় কিছুই পাওয়া যায় না।অথচ এই নার্সারিতেই সবসময় তিনি আসতে-যেতে জবা গাছ দেখেন। দেখা যাবে, তিনি পোলাওয়ের চাল নিয়েগেছেন, বাসায় তেল বা গরম মশলা নেই।পোলাও রান্না হবে না।বুলবুল পোলাও পছন্দ করে।বকুলের পছন্দ রক্তজবা।যেদিন তিনি পুকুর পাড়ের জবাগাছ কেটে ফেললেন, বকুল সারাদিন ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো।দুদিন কিছুই খেল না।অত্যন্ত মায়াবতী এই মেয়েটার হাতে সকালে চা না পেলে সারাদিন শূন্য শূন্য লাগে।বকুলের মায়ের অবশ্য সন্তানের রাগ-অভিমান নিয়ে মাথাব্যাথা নেই।

হাসান সাহেব প্রতিদিনের মতই তার মায়ের ঘরে উঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,"মা, ভালো আছো?শরীর ভালো?" ছফিনা বেগম চিৎকার করে বলবেন,"হ বালা আছি।দিন দিন খুকি অইতাছি।প্রত্যেক দিন ঢং করস, বালা লাগে না!" প্রতিদিন তিনি একই উত্তর দেন, তবু হাসান সাহেব বাড়ি ফিরেই খোঁজ নেন, অফিসে যাবার সময় মাকে জানিয়ে যান।

হাসান সাহেব প্রতিদিন রাত ৮টার খবর দেখেন আর হা-হুতাশ করেন, দেশ রসাতলে যাচ্ছে; এদেশের ভবিষ্যৎ নেই। সপ্তাহে দুদিন বৃহস্পতি-শুক্রবার রাত ৯টায় মীরা আর অরুণকে পড়াতে বসেন। আজ শুক্রবার, মীরা আর অরুণ জোরেশোরে পড়ছে যাতে বাবা বুঝতে পারে পড়াশোনা ভালো চলছে।
ওরা দুজন জমজ। অরুণ আতঙ্কে একটু কেঁপেকেঁপে উঠছে, সে গতকাল স্কুলে ফুটবল খেলতে গিয়ে প্যান্ট ছিড়ে ফেলেছে। আগেও ছিড়েছে, মা সেলাই করে দিয়েছেন।তার কি করার আছে, প্যান্ট হাটুর কাছে টাইট হয়ে গেছে!সে পঞ্চম শ্রেণিতেও একই প্যান্ট পরেছে। আজ মা বাসায় নেই, রাগ করে মামাবাড়ি চলে গেছেন।বলে গেছেন আর আসবে না, প্রতিদিন শুধু ভাত মা খেতে পারেন না।মার নাকি শুধু ভাত খেতে খেতে কলজে পচে গেছে।

অরুণ ফিসফিস করে মীরাকে বলল," নিশ্চয়ই বাবা জেনে গিয়েছে, আমার প্যান্ট ছিড়ে গেছে! বাবার কাছেতো কিছুই গোপন থাকে না!" মীরা সাহস দিয়ে বললো," ভয় পাস না।'লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতুম মিনাজ জলিমিন' ২১ বার পড়। আল্লাহ তোরে বাঁচাবে।"
"আমিতো আজকে নামাজও পড়ছি।তয় আত্তাহিয়াতু পারি না।মীরা, আল্লায় আমার দোয়া কবুল করবনি?"

মীরা উত্তর দেয়ার সুযোগ পেল না।হাসান সাহেব পাটিতে বসেছেন।পড়া ধরবেন। তিনি উপপাদ্য ২ আর Your Favourite Person প্যারাগ্রাফ লিখতে বললেন। অরুণ ভাবছে, এই দুইটাই সে পারে না। উপপাদ্য কেন মুখস্থ করতে হবে সে ভেবে পায় না।অথচ মীরা গড়গড় করে লিখছে।বুবু ধারেকাছে নেই, আম্মা বাসায় নেই, তাকে কে বাঁচাবে আল্লাহ জানে!দাদা বারান্দায় বসে আছে কিন্তু সে কখনো মার ফেরাতে আসে না। অরুণ My favourite person is my father এই এক লাইন লিখে বসে আছে;আর পারে না।মীরাও বসে আছে, সে উপপাদ্য লিখতে পারছে না। তার জ্যামিতি বক্সও অরুণ হারিয়ে ফেলেছে।

হাসান সাহেব অরুণকে খুব মারছেন।অরুণ "ও আল্লাহ, ও বুবু, ও দাদি" বলে চিৎকার করছে। ছফিনা বেগম হাসান সাহেবকে গালি দিচ্ছেন,"হারামজাদা, পুলাডারে মারস কেন?তুই কি চ্যাটের ছাত্র আছিলি, তিনবারে ম্যাট্রিক পাস দিছস।খবরদার পোলারে মারবি না।" হাসান সাহেব কথা শুনছেন না।
মীরা বকুলকে জড়িয়ে বললো," ও বুবু, অরুণ কি মারা গেছে?অরুণ মারা গেলে কি আমিও মারা যাবো?বুবু, ও বুবু!"

আজ HSC রেজাল্ট দিবে।হাসান সাহেব ম্যানেজারের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে দুপুরে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরলেন। এক পাতিল দই, এক কেজি মিষ্টি আর এক কেজি গরুর মাংস কিনেছেন।সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বিকালে বুলুর মাকে আনতে যাবেন।ছেলেমেয়ে এ+ পেয়েছে শুনে খুশিতে অবশ্যই ফিরে আসবে। বকুল, বুলবুল, মীরা সবাই অত্যন্ত বুদ্ধিমান। গবেট কেবল অরুণ! তার ঘরে এমন গবেট কিভাবে জন্ম নিল, তিনি ভেবে পান না!

বকুল দাদির ঘরে বসে আছে।সে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। কিন্তু বুলবুল ICT'তে ফেল করেছে।সে দরজা বন্ধ করে বসে আছে।কিছুতেই দরজা খুলছে না। মীরা অরুণ বাবার হাতের দই মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে, আজ এগুলো আর খাওয়া হবে না!

হাসান সাহেব বুলবুলের ঘরের দরজায় লাথি মারছেন।বকুল ভাবছে, সে পাস না করে ভাইয়া পাস করলেই ভালো হত, বাবা খুশি হত। PSC, JSC'তে বুলবুল গোল্ডেন এ+ পেয়েছে, বাবা খুব খুশি হয়েছিল।ধার করে খাসি জবাই করেছিলেন, সব আত্মীয়-স্বজন বাসায় এসেছিল।সে সাধারণ এ+ পেয়েছে। অথচ SSC'তে সে গোল্ডেন পেল, বুলবুল পেল না।বাবা কোন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন না,কেমন গম্ভীর হয়ে থাকলেন!এই যে আজও সে গোল্ডেন পেয়েছে, বাবা ভালো করে জিজ্ঞেসই করলেন না।ভাইয়াটাও পাজি, সবগুলায় লেটার আর ICT'তে কেউ ফেল করে?

অরুণ মীরা জড়াজড়ি করে কাঁদছে।পাশেই বকুল বসে আছে, সে নিঃশব্দে কাঁদছে।হাসান সাহেব নকলা হাসপাতালের ইমারজেন্সি বিভাগের বারান্দায় এমাথা থেকে ওমাথা হাটছেন।বুলবুল দু'হাতের রগ কেটে ফেলেছে। ডক্টর সাঈদ তাকে ডেকে পাঠালেন, ছেলে কথা বলতে চায়।

বুলবুল বাবার হাত ধরল।
"বাবা বিশ্বাস কর আমি একা খুব চেষ্টা করেছি, ICT কিছুই বুঝিনি;এলগরিদম,বাইনারী, ওয়েবসাইট তৈরি! তোমার কাছে লজ্জায় প্রাইভেট পড়ার কথা বলতে পারিনি। হলে স্যার বললেন, দেখে দেখে লিখে দিতে!আমার মন সায় দেয়নি।" হাসান সাহেব ঠান্ডা গলায় বললেন,"তুই হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরবি না।"

হাসান সাহেব আবার বারান্দায় পায়চারি শুরু করলেন। অরুণ, মীরা, বকুল আগের মতই দূরের চেয়ারে বসে আছে, ফুপিয়ে কাঁদছে।

সচরাচর ডাক্তার রোগীর আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে না।দরকারী কথাগুলা বলে নার্স বা তার সহকারী। ডক্টর সাইদ সহজভাবে হাসান সাহেবকে বললেন,"শুনুন, বুলবুল মারা গিয়েছে। আপনার ছেলেমেয়েদের কাছে যান, তাদের সান্ত্বনা দিন।মনকে শক্ত করুন।"
হাসান সাহেব ভেউভেউ করে কেঁদে ফেললেন।
"ও ডাক্তার, আমার ছেলেটা খুব সহজ-সরল বোকা ছিল।জীবনে কোন ক্লাসে সেকেন্ড হয় নাই।কি হতো পরিক্ষায় একটু দেখে লিখলে?"
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ১২:৩০
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×