স্মৃতি-
ব্যথাগুলো থিতিয়ে যায়, বাহ্যতঃ মনে হয়, নাই।
সব ব্যথা আছে, থাকে, থামেনি কোন কষ্টবোধ কোনদিন।
কোন্ ব্যথা হারায়না কোনদিন?
মরমের ব্যথা যত যন্ত্রণা থেকে থেকে জ্বলে উঠে
প্রিয়জনের বিয়োগ-ব্যথা – বাবার, মায়ের।
কখনো ভুলতে পারিনি সেসব প্রিয়জনকে
যাদের শুইয়ে দিয়েছি মাটির বিছানায়
শেষ মুহূর্ত অবধি কাছে থাকার অদম্য আগ্রহে
চিরতরে হারানোকে প্রলম্বিত করার নিস্ফল আকাঙ্খায়
নেমেছিলাম যাদের ক্ববরে
তাঁদের স্মৃতি প্রতি মুহুর্তে জ্বলছে অন্তরের ভাটায়।
‘রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে’র মতো
কাব্যময় হয়ে নয়।
এ স্মৃতি, এ জ্বালা – করুণ, কঠোর, অসহ্য!
জীবনের ধারা তবুও বয়ে চলে নদীর মতো
দুঃখের স্রোতকে সুখের সব অনুভবকে ফেরী করে
বন্দরে বন্দরে।
ইচ্ছা করে খুলে দেখি মাটির সে গহ্বরগুলো
দেখি, কীভাবে তাঁরা শুয়ে আছে, কেমন আছে
দেখতে ইচ্ছা করে কিভাবে তাঁরা নাই হয়ে আছে।
মা-
বর্ষা আসলে মায়ের কথা মনে পড়ে
অঝোর ধারায় যখন বৃষ্টি পড়ে
তখন রোমান্টিসিজমে উজ্জীবিত হইনা
স্মৃতির ভারে দুঃখে
মাঝে মাঝে ভেংগে পড়ি। শংকিত থাকি
কেউ না দেখে ফেলে অবাধ্য অশ্রুবিন্দু।
মা বলেছিলেন, ‘তুই আয়। আমি যেন তলিয়ে যাচ্ছি।’
সব কাজ ফেলে ছুটে গিয়েছিলাম ঢাকায়।
ছিলাম মায়ের পাশে। এটেনডেন্টের বেডে না শুয়ে
আম্মার পাশে ফ্লোরে বিছানা পেতে থাকতাম
যেন কোন অস্ফুট ডাকেও উঠে বসতে পারি।
ভাবিনি এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবেন তিনি।
ঘুম থেকে উঠে কখনো বলতেন,
‘তোমাকে দেখেতো আমার অমুক ছেলের মতো মনে হচ্ছে।’
রুমে সবসময়ে আমাকে দেখে
হয়তোবা ভাবতেন, তিনি আমার বাসায় আছেন।
মাঝে মাঝে বলতেন-
‘কিরে, বউ কোথায়? ফ্যকাল্টিতে গেছে নাকি?’
সোজা হয়ে শুতে পারতেন না।
দিন-রাত হেলান দিয়ে বসে থাকতেন।
ইশারায় নামাজ পড়তেন।
জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মা, কার কথা আপনার মনে পড়ছে?
প্রতিবারই বলেছেন,
‘তোর বাবা আর আমার বাজানের কথা’।
কর্মস্থলে ফিরার পরের দিনই মায়ের ইন্তিকাল ঘটে।
বিদায় নেয়ার সময়ে মায়ের দুআ চাইলাম।
মাথায় হাত রেখে অনেক দুআ করলেন।
জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া ….।
বাবা-
অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা
শুধু অনুভব করা যায়, বোঝানো যায়না।
বাবা ছিলেন সুপুরুষ, আদর্শ মানুষ।
তরুণ বয়সে সংগঠনবাদীতার অন্ধ আবেগে
থাকতে পারিনি তাঁর মৃত্যুকালীন সময়ে।
এ দুঃখ, কষ্ট সীমাহীন। এই অপরাধবোধ
নিত্য পোড়ায় আমাকে।
আগে কখনো বাবার প্রসঙ্গ আসলে
চুপ করে থাকতাম বা উঠে যেতাম নীরবে।
বিয়ের আসরে আমার অঝোর ধারায় কান্না দেখে
কন্যাপক্ষ ভেবেছিল, কোন পূর্ব সম্পর্কের বিষয়
হবে হয়তোবা। ঘরের সবাই বুঝেছিল -
ও, বাবার জন্য কাঁদছে।
এখন আর ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদি না।
কিন্তু দুঃখ কি গেছে? এতটুকুও নয়।
শুধু আরো গভীরে প্রোথিত হয়েছে।
বাবার স্মৃতি নিয়ে কিছু লিখতে
আমি অপারগ।
কাঁচা-পাকা চুল-দাঁড়ির এই মধ্যবয়সী লোকটিও
তাঁর বাবা-মায়ের কাছে এখনো
ছোট্ট শিশুটি মাত্র। যদি আবার শিশু হতে পারতাম!
স্মৃতিই একমাত্র সহায় ….।
অনুভব-
মাঝে মাঝে মনে হয়, জুমানজি’র এলানের মতো
যাদুর জগতের মায়ার আবেশ কেটে গেলে
একদিন চেঁচিয়ে উঠবো, ‘আই এ্যম হোম …
মাম-ডেড, আই এ্যম হোম … ’।
কেউ একজন বকা দিবেন অন্যজন প্রশ্রয় দিবেন।
তা নিয়ে তাঁরা কিছুক্ষণ ঝগড়া করবেন।
আমিও চাই শিশু হতে, কৈশোরকে ফিরে পেতে
বড়দের উপর অন্যায় আবদার করতে।
জানি, জীবনের এই ধারা একমুখী
ফিরতি কোন ট্রেন নাই। পথ শুধু সামনের দিকে।
আমিও যে কখনো ছোট ছিলাম, শিশু ছিলাম
এগারো জনের এক বর্ধিষ্ঞু পরিবারে
অতি আদরের একজন ছিলাম – সেটি খুঁজে পাই
যখন বাবা-মা’র কথা মনে পড়ে।
২৪/০৪/২০১১ চ.বি.।