বাবুল মিয়া ফুূচুত ফুচুত করিয়া তাহার ঘাড়ে এবং পাঞ্জাবির বগলে সুগন্ধি স্প্রে করিল। আজ পশ্চিম পাড়ায় চৌধুরী সাহেবের বাসায় তাহার নিমন্ত্রণ আছে। ইহাকে ঠিক নিমন্ত্রণ বলা যায়না, বলা যায় সে এক প্রকার কিছুটা জোর করিয়া কিছুটা ঘুষ দিয়ে ওই স্থানে উপস্থিত থাকিবার উপায় বাহির করিয়াছে। শেফালী বানুর চোখে যুগপৎ ভয় এবং জিজ্ঞাসা দেখিয়া মনে মনে গালি দিল --'মর *গি। তোর কারনেই আমার এই দুর্দশা।' মেয়েছেলের চিন্তা করিয়া লাভ নাই, বাবুল মিয়া শেফালী বানুর কথা বাদ দিয়া চৌধুরী সাহেবদের কথা ভাবা শুরু করিল। ওনাদের এক সময় এই এলাকায় যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। ওনার দাদার চার পুরুষের জমিদারি ছিলো। জমিদারি না থাকিলে ও ঠাটবাট এখনো খুব একটা কম নাই। এলাকার এখনো অনেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান মেম্বারের বদলে চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে যাইয়া সুবিচার প্রত্যাশা করে।
শেফালী বানু ভয়ে ভয়ে স্বামীর দিকে তাকাইলেন। স্বামী কামাই রোজগার কিছুই করে না বরং তাহার রোজগার হইতে নিয়মিত খাবলা মারিয়া লইয়া যায় , মাঝে মাঝেই এমনকি বলিবারও প্রয়োজন বোধ করে না। সে একখানা গার্মেন্টস এ সপ্তাহের সাড়ে নয় দিন কাজ করে। তাহার একার রোজগারে সংসার চালানো বড়ই কষ্ট সাধ্য কিন্তু সে কখনো অভিযোগ করে না। স্বামী মাঝে মাঝে এদিক ওদিক হইতে ধার-কর্জ করে যাহা শেফালি বানুকেই শোধ করিতে হয়। এরপরেও মাথার উপরে ছাতা হিসেবে স্বামী থাক সে এই কামনাই করে। লোকটা মাঝে মাঝেই কোন কিছু না জানাইয়া কয়েকদিনের জন্য উধাও হইয়া যায়। ভাব দেখিয়া মনে হইতেছে আজও কয়েকদিনের জন্য যাইতেছে। ছোট ছেলেটার শরীর খারাপ। কয়েকদিন ধরিয়া জ্বর। গায়ে ব্যাথার কথাও বলে। ডেঙ্গু হইল কিনা তাহা খোদা জানেন। বাবুল মিয়ার মাঝে কখনো সে অপত্য স্নেহের কোন নমুনা দেখে নাই। বড় মেয়ে দুইজন তাহার আগের পক্ষের। উহাদের প্রতি বাবুল মিয়ার কোন স্নেহ থাকিবে তাহা সে আশা করে না , কিন্তু ছেলে তো বাবুল মিয়ার নিজের ঔরসজাত। কাজ হইতে ছুটি পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার। গার্মেন্টসের সুপারভাইজার বড় খারাপ মানুষ, ছুটি চাহিলে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। অতীতে দু এক বার ছেলেকে ফেলানীর দাদীর নিকট রাখিয়া গিয়াছে, কিন্তু সেই বুড়ি এখন আবার দিনের বেলা ভিক্ষা করে। গাজীপুরের এই এলাকায় ভিক্ষা করিলেও দিনে অন্তত এক দেড়শত টাকা থাকে। বুড়ি ভিক্ষা বাদ দিয়া তাহার ছেলেকে শুধু শুধু দেখিবে কেন? আর কিছু না হইলেও দুপুরের খাওয়ার এবং অন্তত ৫০ টা টাকা তাহাকে দিতে হইবে। সাহস সঞ্চয় করিয়া সে শুষ্ক মুখের স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিল-' কোথাও বাহির হইতেছেন?'
--'তোমাদের মতো তো সারাদিন মোবাইল টিপিলেতো আমার চলিবে না। কাম আছে । বাহিরে যাওয়ার লাগবো। ৬০০ টা টাকা দাও।' তাহার নিজের সাধ্য নাই মোবাইলে টাকা ভরিয়া কথা বলে। মেজ মেয়েটা তাহাকে মাঝে মাঝে মাসে-পনেরো দিনে একবার ফোন করে। মোবাইল টিপার খোটা সেইখান হইতে আসিল। মেজ মেয়েটার কথা ভাবিয়া তাহার চোখে পানি আসে যায়। ইহাই গরিবের নিয়তি। চোখের পানি সংবরণ করিয়া সে বলিল- 'ছাওয়ালটার জ্বর।'
--'ছাওয়াল টার জ্বর তা আমি কি করিবো ? আমি কি ডাক্তার না কবিরাজ?'
--'না, বিশু ডাক্তারের হোমিও ওষুধ তো কয়দিন ধরিয়া চলিতেছে, যদি একটু সরকারি হেল্থ সেন্টারে লইয়া যাইতেন, আমি তো এই সব বুঝি না।'
--'টাকা দাও, দিরং হইয়া যায়। আমারে দিয়া না পোষায় তো আগের ভাতারের কাছে যাও।'
তাহার আগের পক্ষ ছিল রাস্তার এক মাস্তান। তাহাকে এক প্রকার জোর করিয়া উঠাইয়া লইয়া গিয়াছিল। তাহার দরিদ্র পিতার পক্ষে সম্ভব হয় নাই বাধা দেওয়ার। শুধু মাস্তানের পা জড়াইয়া তাহার পিতা কান্নাকাটি করিয়া বলিয়া ছিল--'আমার মেয়েটাকে রাস্তায় ছুড়িয়া ফেলিয়া দিয়েন না, অন্তত পক্ষে ঘরের বউ করিয়া তুলিয়া নিন।' পিতার থাকিবার মধ্যে আড়াই শতক জমির উপর একখানা মাটির ঘর ছিল। রিক্সা চালাবার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় পিতার মৃত্যুর পর ওই ঘর বিক্রি করিয়া টাকা আনিয়া দেওয়ার জন্য আগের পক্ষ তাহার উপর অমানুষিক শারীরিক নির্যাতন চালাইতো। একদিন মারপিট করিয়া রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় ফেলিয়া দেয়। প্রতিবেশীরা মৃত ভাবিয়া পুলিশে খবর দিলে পুলিশ আসিয়া তাহার আগের স্বামীকে ধরিয়া লইয়া যায়। লোকটা জেলে থাকিতেই মরিয়া গিয়াছে। বাবুল মিয়ার পিতার নিকট তাহার পিতার কিছু কর্জ ছিল। নারীর মাথার উপর ছাদের মত স্বামী থাকা দরকার। সমাজপতিরা নির্ধারণ করিয়া দিয়াছে বাবুল মিয়ার সহিত তার বিবাহ হইবে। ইহা তাহার নিয়তি । ইহা সে মানিয়া লইয়াছে। আগের পক্ষের বড় মেয়ের বয়স যখন পনেরো বছর ঐ সময়ে এক হিরোইন খোরের সহিত বাবুল মিয়া তাহার বিবাহ দিয়া দেয়। স্বামীর অত্যাচারের সেই মেয়েও মারা গিয়াছে অনেক বছর। বাবুল মিয়ার সহিত তাহার বিবাহের পর বাবুল মিয়া নির্দেশমতো পিতার ভিটা বিক্রি করিয়া দিয়াছে। আড়াই লক্ষ টাকা আসিয়াছিল। বাবুল মিয়া ঐ টাকা তাহার মেজ মেয়েকে মধ্যপ্রাচ্যে চাকুরিতে পাঠানোর খরচ বাবদ লইয়া লইয়াছে। নিন্দুকেরা বলে মেয়েকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাইতে বাবুল মিয়ার কোন টাকা খরচ হয় নাই, বরং দালালের নিকট হইতে আরো টাকা লইয়াছে। নিন্দুকের কথায় শেফালী বানু কান দেয় না। তাহার নিয়তিতে যাহা আছে তাহাকে সে অতিক্রম করিতে পারিবে না। আগের পক্ষের সহিত তার সম্পর্ক বলিতে আছে ওই মেজো মেয়ে। মেয়ে তাহার নিকট কখনো কোনো অভিযোগ করে না, তবে গলার স্বর শুনিয়া বুঝিতে পারে মেয়ে ভালো নাই, অত্যাচার এর মধ্যে আছে। কিন্তু তাহারই বা কি করিবার আছে?
বাবুল মিয়ার মেজাজ খারাপ হইতে শুরু করিল। শেফালি বেগমকে দেখিলেই তাহার মেজাজ চড়িয়া যায়। শেফালী বানু দেখিতে অসুন্দর নয় বরং আটচল্লিশ বছর বয়স হওয়ার পরেও তাহার শরীরের বাধন যথেষ্ট ভালো। তবে বাবুল মিয়া কখনো তাহার পিতার মৃত্যুর সহিত শেফালী বানুর সম্পৃক্ততা ক্ষমা করিতে পারিবে না। তাহার পিতা হাঁপের রুগী ছিল। একদিন রাতে বাবুল মিয়ার পিতার হাঁপের টান উঠিলে বাবুল মিয়া শেফালী বানুর পিতার রিকশায় করিয়া নিজ পিতাকে নিয়া হাসপাতালে উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বার বার তাড়া দেয়ার পরেও ওই বুড়া ঠিক মতো রিক্সা না টানিতে পারার কারণে হাসপাতালে আসিতে বিলম্ব ঘটে। হাসপাতালে আসিবার আধা ঘন্টা পর ডাক্তার দেখিয়া জানায় তাহার পিতা শেষ। বাবুল মিয়া নিশ্চিত, হাসপাতলে আর কয়েক মিনিট আগে আসিলে তাহার পিতা বাঁচিয়া যাইতো। তাহার পিতা দুর্দান্ত লোক ছিল। কথার দ্বারা লোককে মুগ্ধ করিয়া রাখিতে পারিতো। একবার ওয়ার্ড কমিশনারও হইয়াছিল। লোকে যদিও তার সেই ওয়ার্ড কমিশনার আমলের অনেক দুর্নাম করে, কিন্তু বাবুল মিয়া জানে তাহার পিতা কোন দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। হ্যাঁ , কিছুটা স্বজনপ্রীতি হইয়াছিল বটে, কিন্তু দুর্নীতি হয় নাই। শেফালী বানুর দিকে তাকাইলেই তাহার মৃত পিতার কথা মনে পড়িয়া যায়। খান* মা*। দেরী হইয়া যাইতেছে। চৌধুরী সাহেবেরা আগামী কাল ভোরে হাওড়ে মৎস্য বিহারে যাইবেন। পনেরো দিনের জন্য। চৌধুরী সাহেবদের বাড়ির ম্যানেজারকে বিগত কিছুদিন ধরিয়া কিছু চা-সিগারেট খাওয়াইয়া সে খুশি রাখার চেষ্টা করিতেছে । সেই ম্যানেজার বাবুল মিয়ার হইয়া চৌধুরী সাহেবের নিকট সুপারিশ করিয়াছে যে বাবুল মিয়া ভালো মাছ চেনে। চৌধুরী সাহেবের নৌকার বহরে তাহার জায়গা হইলে সমাজে তাহার প্রতিপত্তি এক লাফে অনেকখানি বাড়িয়া যায়। থাকা-খাওয়া নৌবহরের সহিতই হইবে। হয়তো চৌধুরী সাহেবরা ধূমপানের ব্যবস্থাও রাখিবে। না ও রাখিতে পারে। নিজের ব্যবস্থা নিয়ে করিয়া রাখা উত্তম, পরে পস্তাইতে হইবে না। এমনিতে সে স্টার সিগারেট খায়। কিন্তু ওই নৌবহরে সকলের সামনে স্টার খাইলে তো আর মান সম্মান থাকে না। অনেক বাবুদের ই সে বাংলা ফাইপ টানিতে দেখিয়াছে। নৌবহরে খাইলে বাংলা ফাইপ ই সে খাইবে। দিনে দুই- তিন খানা করিয়া হইলেও দুই সপ্তাহে মিনিমাম দুই প্যাকেট সিগারেট লাগে। এক প্যাকেট বাংলা ফাইপ এর দাম তিনশত টাকার কাছাকাছি। টাকা হস্তান্তরে স্ত্রীর বিলম্ব দেখিয়া সে গটগট করিয়া উঠিয়া স্ত্রীর টিনের কৌটা হইতে পাঁচশত টাকার দুখানা নোট বাহির করিয়া হাঁটা দিল। পিছন হইতে শেফালী বানুর কাতর জিজ্ঞাসা-- 'কবে ফিরিবেন?'
--'সময় হইলেই ফিরিব।'
শেফালী বানু জানে না রোম যখন পুড়ছিল নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিল।*
সেই সমস্ত রাজনীতিবিদদের জন্য উৎসর্গ করলাম শেফালী বানুদের চিন্তায় যাদের রাতে ঘুম আসে না, আঙুলের ফাঁকে তসবি দানা অনবরত ঘুরতে থাকে।
ছবি- বরাবরের মতো চোরাই। কেরালার হাউসবোট।
*রোম পোড়ার সময়ে নিরোর বাশি বাজানোর ঘটনার ঐতিহাসিক ভিত্তি নাই, তবে ভালো শোনায় বলে এখানে অ্যাড করা হলো।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৯ রাত ৩:৪৫