বাবা,
একা থাকাটা বড় কষ্টের, বেদনার । তবুও তুমি একা থাকতে ভালোবাস । পছন্দ কর আমাদের এরকম একা ফেলে যেতে । তাই না ?
আমি আর আপু । খুব ছোট ছিলাম তখন । বয়স কত হবে – ৪ কি ৫ । মনে পরে বাবা , আমরা সবাই এক রিকশায় উঠে বসতাম ? আমি , আপু , মা আর তুমি । তোমার দু’পায়ে দুই ভাই- বোন বসতাম । কী যেন এক নির্ভরতা ছিল সেই ভ্রমণ গুলোতে । তখন বুঝিনি । ছোট ছিলাম যে । টগবগ টগবগ শব্দে কল্পনায় ঘোড়া চড়তাম দুই ভাই বোন । ছোটবেলার সেই কল্পনার ঘোড়ার শব্দ এখনো আমার কানে বাজে - টগবগ টগবগ …।
মাঝে মাঝে বিকেল বেলা তুমি আমাদের তোমার বুকে আকড়ে ধরে শুয়ে থাকতে, ঘুম পাড়ানোর জন্য । কিছুটা ডানপিটে ছিলাম তখন । খেলার সময় চলে গেল বলে আমরা আস্থির হয়ে থাকতাম ; তারপর ঘুমিয়ে যেতাম । বাবা, বিশ্বাস কর । এখন মাঝে মাঝেই গভীর রাতে আমি সেই ছোট্টটি হয়ে যাই । তোমার বুকের ওম পাবার জন্য মরিয়া হয়ে যাই আমি । পাশের খালি বিছানায় হাতড়ে বেড়াই পাগলের মত । এখন আর ঘুম আসে না । শূন্য দৃষ্টি উপরের ছাঁদ ভেদ করে চলে যায় ঐ তারার দেশে । শূন্যতার হাহাকার । এই আমার ভেতরে আর ওই আকাশে ।অস্থিরতা কান্না হয়ে ঝড়ে পড়ে ।
আমাদের পড়ালেখা নিয়ে খুব সিরিয়াস ছিলে তুমি । কোন পরীক্ষায় খারাপ করলে খুব বকা ঝকা করতে । মা যে কয়বার তোমার বকা ঝকা থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন তার হিসেব নেই । ভীষণ ভয় পেতাম তোমাকে ।এখন বুঝি তোমার ওই কড়া শাসনে না থাকলে খুব ক্ষতি হয়ে যেত আমাদের । আশপাশের অস্থির সমাজে নিজেকে একা সামলে এতদূর চলে আসা আমাদের পক্ষে কখনও সম্ভব হত না । এখন বুঝি । তখন বুঝি নি কেন ?
বড় অসময়ে চলে গেলে তুমি । আর একটু সময় দিলে না ।
তোমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে তোমার গর্বের সীমা ছিল না । স্বপ্নেরও ।আমি যখন কোনো পরিক্ষায় ভাল রেজাল্ট করতাম , তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পারতাম; কী অদ্ভুত পরিতৃপ্তির ছায়া ছড়িয়ে থাকত তোমার চোখে মুখে । আনন্দে দিশেহারা ছোট্ট ছেলের মত সবাইকে নিজ থেকে তোমার ছেলের কৃতিত্ত্বের কথা বলে বেড়াতে । খুব লজ্জা পেতাম আমি । তোমাকে পরে বলতাম ; “এইভাবে কেউ বলে।”
তুমি হাসতে । চোরা চোখে এক ঝলক আমি তোমার হাসিটা দেখে নিতাম । আমি জানি তুমি টের পেতে না । তোমার এরকম হাসির উপলক্ষ্য তৈরী করতে আমি মরিয়া ছিলাম । বিশ্বাস করো ।
ঐ বার । ঐ যে আমি যখন খুব অসুস্থ হয়ে গেলাম । হাসপাতালে ভর্তি হতে হল ।ডাক্তার বিপদ মুক্তির ঘোষণা দিতে চায়নি । রাত জেগে তুমি আমার পাশে শুয়ে ছিলে ।আমি তোমার ফুঁপিয়ে কান্না মাঝে মাঝে টের পেয়ে যেতাম ।খুব অপ্রস্তুত লাগত নিজেকে । এখন যখন আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি । এই ভার্সিটির হলে।
রাত জেগে কেউ আমার জন্য কাঁদে না ।কিংবা ধমক দিয়ে কেউ বলে না , ঔষধ খাস নি কেন ? কেন রোদে গেলি ? বাবা , একবার এসে এই বকা গুলো দিয়ে যেতে পারবে আমায় । খুব প্রয়োজন যে বাবা । আর একবার । ।
সেদিনটা তো ভুলতে পারছি না ।সকালবেলা কোর্টে গেলে তুমি ।আমি বাড়ি ছিলাম না তখন । দুপুরে খবর পেলাম তুমি হাসপাতালে । দৌড়ে গেলাম । সি.সি.ইউ, আই.সি.ইউ. তে তোমাকে না পেয়ে স্বস্তি পেলাম । হয়ত তেমন কিছু হয় নি বলে বাসায় চলে গেছ ।ইমার্জেন্সির কাছে গিয়ে শুনতে পেলাম আম্মুর গগনবিদারী চিতকার । ধ্বক করে উঠল বুকটা । গিয়ে দেখি স্ত্রেচারে শুয়ে আছ তুমি । সেই সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। নির্জীব । বাবা , আমার মনে নেই আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম কি না । তবে হ্যাঁ , তোমার ঠোঁটের দিকে আমি অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম । আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম তুমি আমাকে ডাকছো । ভিতরে তোলপাড় হয়ে আছড়ে পড়লাম আমি তোমার উপর ।কান্নারা তখন বাঁধ্ন হারা । আমার মাথায় হাত বুলিয়ে তখন অনেকে সান্তনা দিচ্ছিল । কই তুমি তো একবারও আমার মাথায় হাতটা রাখলে না । কষ্ট বাবা । বড় কষ্ট। পরে জ়েনেছি , দু’টো মামলার এজলাস শেষে বের হয়ে তুমি বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ো । তারপর…।
তুমি কি সে সময় মনে মনে আমার নাম ধরে প্রচুর ডেকেছিলে ? আমি শুনতে পাই নি যে ।
বাবার লাশের গোসলে নাকি সন্তানকে থাকতে হয় । আমার সামনে অরা তোমার গায়ে সাবান মেখে দিল, গরম জলে গোসল করালো তোমায় । তুমি নিশ্চল । সন্তান হয়ে এই দৃশ্যটা আমার জন্য কতটা সহ্য করা যায় বলো ? ব্যাথা । বড় ব্যাথা বাবা এই বুকটায় । কান্নারা জমে যেন পাথর হয়ে বসে আছে বুকে। বড় ব্যাথা ।
ছোট মেয়েটার কথা কি তোমার এখন মনে পড়ে না ? যাকে এক নজর দূরে রাখতে চাইতে না । যার সাথে ছোট্ট বাচ্চার মত খুনসুটি করতে । আবার ও যখন অভিমানে কেঁদে বুক ভাসাতো ; ‘আম্মু, আম্মু’ বলে বুকে জ়ড়িয়ে রাখতে । চোখের জলে একাকার মেয়েটির ঠোঁটের কোণে হঠাত করে হাসির ঝিলিক দেখা দিত । অদ্ভুত সুন্দর লাগত মুহূর্তটা ।এই মেয়েটা এখন কার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে হঠাত করেই হেসে ফেলবে ? বলো ? বাবা, আমি তোমাকে বলছি ।
বাড়ির আলমিরাতে এখনও সেই ক্রেস্টগুলো সাজানো আছে ।
ভালো রেজাল্ট এর জন্য আমি বিভিন্ন সময় পেয়েছিলাম ।তুমি যখন অসুস্থ ছিলে তখন নাকি প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে সেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চুপি চুপি কাঁদতে । আমি বাড়ি গেলে তুমি বুঝতে দিতে না কিছুই ।এত্ত ভালোবাসতে কেনো আমায় ? বাবা, আমি ঐ ক্রেস্ট গুলোর দিকে এখন তাকাতে পারি না । কেন যেন ।
নিষ্ঠুর এই শহরে এখন নিজেকে বড় অসহায় লাগে । মনে হয় আমার ভেতরে কোথাও কোন জরুরী অঙ্গ এখন নেই । বড় শূন্য লাগে সবকিছু । এই চিঠি লিখতে গিয়ে কতবার যে কাগজগুলো কান্নার পানিতে ভিজিয়েছি তার হিসেব নেই ।মাত্র তো চার বছর হল তুমি নেই ।সারা জীবন ই যে কষ্ট গুলো বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাকে । কেমন করে সইবো বলো ?
-তোমার ছেলে

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



