আল মাহমুদ, একজন কবি। আমি তাকে বলি-মানবতাবিরোধী কবি। এখন কেউ বলতেই পারেন, আল মাহমুদ আবার কবে মানবতাবিরোধী অপরাধ করলেন? তিনি কি গোলাম আজম, কাদের মোল্লা বা মীর কাশিমদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন কিংবা মানুষ হত্যা করেছেন?’ না, কবি আল মাহমুদ তাদের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেননি বা তিনি নিজে মানুষ হত্যা করেননি। একজন কবি চাপাতি দিয়ে মানুষ হত্যা না করেও মানবতাবিরোধী অপরাধ করতে পারেন তার হাতের কলম দিয়ে; তার শিক্ষা, চিন্তা, দর্শন, আদর্শ এবং প্রজ্ঞা দিয়ে। আল মাহমুদ সেই অপরাধই করেছেন। তিনি তার কলম, শিক্ষা, চিন্তা, দর্শন, আদর্শ এবং প্রজ্ঞা দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। কীভাবে তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন তা বুুঝতে হলে আমাদেরকে তার একটি কবিতা পড়তে হবে এবং তারপর আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ায়। তার কবিতাটির নাম ‘বকতিয়ারের ঘোড়া’। আসুন আমরা আগে তার কবিতাটি পড়ি-
মাঝে মাঝে হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে ওঠে
মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি;
আমি তখন স্বপ্নের ভেতর জেহাদ, জেহাদ বলে জেগে উঠি।
জেগেই দেখি কৈশোর আমাকে ঘিরে ধরেছে।
যেন বালিশে মাথা রাখতে চায় না এ বালক,
যেন ফুৎকারে উড়িয়ে দেবে মশারি,
মাতৃস্তনের পাশে দু’চোখ কচলে উঠে দাঁড়াবে এখুনি;
বাইরে তার ঘোড়া অস্থির, বাতাসে কেশর কাঁপছে।
আর সময়ের গতির ওপর লাফিয়ে উঠেছে সে।
না, এখনও সে শিশু। মা তাকে ছেলে ভোলানো ছড়া শোনায়।
বলে, বালিশে মাথা রাখো তো বেটা। শোনো
বখতিয়ারের ঘোড়া আসছে।
আসছে আমাদের সতেরো সোয়ারি
হাতে নাংগা তলোয়ার।
মায়ের ছড়াগানে কৌতূহলী কানপাতে বালিশে
নিজের দিলের শব্দ বালিশের সিনার ভিতর।
সে ভাবে সে শুনতে পাচ্ছে ঘোড়দৌড়। বলে, কে মা বখতিয়ার?
আমি বখতিয়ারের ঘোড়া দেখবো।
মা পাখা ঘোরাতে ঘোরাতে হাসেন,
আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।
যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,
আর মানুষ করে মানুষের পূজা,
সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।
দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে
দ্যাখো, দ্যাখো।
মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক
তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার
নিশেন ওড়ায়।
কোথায় সে বালক?
আজ আবার হৃদয়ে কেবল যুদ্ধের দামামা
মনে হয় রক্তেই ফয়সালা।
বারুদই বিচারক। আর
স্বপ্নের ভেতর জেহাদ জেহাদ বলে জেগে ওঠা।
কে এই বখতিয়ার, মায়ের মুখে যার কেচ্ছা শুনে কবির হৃদয়ে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে, জেহাদের জন্য কবির হৃদয়ে হাহাকার জাগে, কবি বারুদেই অন্তিম তৃপ্তি পান কিংবা রক্তেই খুঁজে পান সমাধান?
ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী, যার নেতৃত্বে তুর্কি সেনারা বাংলা আক্রমণ (১২০২ মতান্তরে ১২০৩ সালে) করে। ইসলামী আক্রমণ মানেই হত্যা, সম্পদ লুণ্ঠন, নারী লুণ্ঠন এবং ধর্ষণ, মন্দিরকে মসজিদ বানানো, স্বাধীন মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা। বখতিয়ার খলজীও তাই করেছিলেন, জয় করেছিলেন বাংলার একটি অংশ। আর এর আগে তিনি কী করেছিলেন? একই পথ অবলম্বন করে মগধ তথা বিহার জয় করেছিলেন। বিহার জয় করার সময় আর একটি ক্ষতি তিনি করেছিলেন, যা কখনোই পূরণ হবার নয়। বিহারের বিক্রমশীলা এবং নালন্দা বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করেছিলেন; যেখানে কেবল সারা ভারতবর্ষই নয়, ভারতবর্ষের বাইরে থেকেও মানুষ বিদ্যা অর্জনের জন্য আসতেন, বিহারের আবাসিক হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতেন। বিহারের এইসব নিরপরাধ ছাত্র এবং শিক্ষকদের নির্মমভাবে হত্যা করে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয় বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে তুর্কি সেনারা। এই বৌদ্ধবিহার দুটির পাঠাগারে লক্ষ লক্ষ বই ছিল, সেই সব বই তারা আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করেছিল। ওই বইগুলির সঙ্গে ওরা ধ্বংস করেছিল ভারতবর্ষের তথা মানবসভ্যতার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের একটা অংশ, অসংখ্য মানুষের শত শত বছরের জ্ঞান ও চিন্তার নির্যাস; যার অনেক কিছুই আর কখনোই উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি, চিরতরে লুপ্ত হয়েছে। মানব সভ্যতার এই অপূরণীয় ক্ষতি বখতিয়ার খলজী করেছেন।
বই ধ্বংসকারী, মানবসভ্যতার ইতিহাস এবং ইতিবাচক ঐতিহ্যের পরম্পরায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী একজন অসভ্য-বর্বরকে নিয়ে একজন কবি কিভাবে ইতিবাচক কবিতা লিখতে পারেন? হত্যাকারী, সম্পদ লুণ্ঠনকারী, নারী লুণ্ঠন এবং ধর্ষণকারী, স্বাধীন মানুষকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা একজন সন্ত্রাসবাদীর কর্মকাণ্ড কিভাবে একজন কবিকে উদ্বুদ্ধ করে বা একজন কবি কিভাবে সেই বর্বরটির প্রতি মোহমুগ্ধ হয়ে থাকতে পারেন?
অথচ আশ্চর্য হলেও সত্য বখতিয়ার খলজীর মতো বর্বরের কর্মকাণ্ড কবি আল মাহমুদকে মুগ্ধ করেছে, কবির হৃদয়ে জেহাদের দাদামা বাজিয়েছে!
একজন কবির হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করতে পারে? একজন কবি কখনো বারুদে অন্তিম তৃপ্তি খুঁজে পান? একজন কবি কখনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই রক্তে সমাধান দেখতে পান?
একজন কবির হৃদয় তো শান্তির আহ্বান করবে; একজন কবি তো বারুদ নয়, ফুলের গন্ধে অন্তিম তৃপ্তি পাবেন; একজন কবি তো রক্তে নয় বন্ধুত্বে সমাধান খুঁজে পাবেন।
অথচ কবি আল মাহমুদের হৃদয় যুদ্ধের জন্য হাহাকার করে উঠেছে, বারুদের গন্ধে তিনি অন্তিম তৃপ্তি খুঁজে পেয়েছেন, রক্তে তিনি সমাধান খুঁজে পেয়েছেন। সঙ্গত কারণেই আমি তাকে বলি-মানবতাবিরোধী কবি।
এবার ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে আসি। মুক্তিযুদ্ধে তার ভূমিকা কী ছিল? অনেকেই দাবি করে থাকেন যে তিনি মুক্তিযুদ্ধ করেছেন? জীবনের অন্তিমলগ্নে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেও দাবী করেছেন যে তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা! ডাঁহা মিথ্যে কথা। তিনি কোন সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন কেউ প্রমাণ দেখাতে পারবেন? পারবেন না। কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় পালিয়ে ছিলেন, উঠেছিলেন তার ভগ্নীপতি হোসেন তৌফিক ইমামের বাসায়। হোসেন তৌফিক ইমাম প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সচিবের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। দেশ যখন এক ক্রান্তিলগ্ন পার করছে, তখন তিনি তরুণ বয়সী একজন কবি হওয়া সত্ত্বেও অস্ত্রহাতে বা কলম হাতে যুদ্ধে যোগ দেননি। তার পরিবার তখন দেশে ছিল এই অজুহাতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু লেখেননি। তিনি কী করেছেন? ভগ্নীপতির বাসায় থেকেছেন-খেয়েছেন আর কলকাতা শহরের অলি-গলি ঘুরে বেরিয়েছেন, পতিতার সঙ্গে ফুর্তি করেছেন, কবিতা লিখেছেন (মুক্তিযুদ্ধের নয়), পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্নজনকে ধরে সেই কবিতা পত্রিকায় ছাপিয়েছেন, এমনকি তখন তিনি ‘আল মাহমুদের কবিতা’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থও প্রকাশ করেছেন!
এইসব কথা আমি বানিয়ে বলছি না, তার নিজের লেখা আত্মজীবনী ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ গ্রন্থে এসব আছে। তাহলে তিনি জীবনের শেষ বয়সে এসে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবী করলেন কেন? আমার ধারণা বয়সের ভারে তিনি আত্মজীবনীতে কী লিখেছিলেন সে-সব বিস্মৃত হয়েই সাক্ষাৎকারে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবী করেছেন। লক্ষ্য করে দেখবেন, মিথ্যা বলা যাদের স্বভাব, তারা কিছুদিন পরেই ভুলে যায় অতীতে কী বলেছিল, বিভিন্ন সময়ে একই ঘটনার বিভিন্ন বয়ান দিয়ে থাকে।
আল মাহমুদ সেই প্রজাতির ধূর্ত কবি, যিনি জীবনের অধিকাংশ সময়ই শাসকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন, তার আদর্শের রঙ বদল করেছেন। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের সঙ্গে তাল মিলিয়েছেন, জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের শাসনামলে জলপাই রঙের আদর্শ ধারণ করেছেন। স্বৈরশাসক এরশাদের আমলে দেশের অনেক কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষক, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ যখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন করেছেন, রাজপথে জীবন দিচ্ছেন, তখন কবি আল মাহমুদ স্বৈরশাসকের কোলে বসে মধু পান করছেন! স্বৈরশাসকের উপহার দেওয়া প্লট গ্রহণ করেছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে তিনি আর তার আদর্শের রঙ বদলাতে পারেননি, কারণ ততোদিনে তিনি জামায়াতের ঝোলায় এমনভাবে ঢুকে পড়েছেন যে সেখান থেকে আর বের হয়ে আসা সম্ভব নয়, আর আসতে চাইলেও স্বাধীনতার স্বপক্ষের বুদ্ধিজীবীদের কারণে হয়তোবা আসতে পারতেন না। ফলে আমৃত্যু তিনি জামায়াতের বুদ্ধিজীবী হয়েই থেকেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে জামায়াত এবং জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র শিবির-মানুষ হত্যা, সম্পদ লুণ্ঠন, ধর্ষণ, মানুষের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অপরাধ করেছে; সেই জামায়াত এবং ছাত্র শিবিরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন আল মাহমুদ, তাদের দেওয়া সংবর্ধনা গ্রহণ করেছেন, বক্তৃতা দিয়েছেন। ছাত্র শিবিরের ফেসবুক পেজ থেকে আল মাহমুদ এর একটি ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে, যেখানে তিনি বলছেন-‘এখন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সম্বন্ধে একটু বলি-আমি এদের ভালবাসি, কারণ, আমার জানা মতে ইসলামী ছাত্রশিবির একমাত্র ছাত্র সংগঠন যারা এখনো নৈতিক বল এবং ইমানের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমি মনে করি এরা বিজয়ী হবে।’
এমন একজন মানবতাবিরোধী কবি, তিনি যতো ভাল মানের কবিতাই লিখুন না কেন, একজন মানবিক মানুষের মনে তার প্রতি ভালবাসা জন্মায় না, তার মৃত্যুতে হৃদয় ব্যথিত হয় না, বরং বুকের কন্দরে উদগত হয় ঘৃণা আর তা প্রকাশ হয় কথায় কিংবা লেখায়। সঙ্গত কারণেই এমন একজন মানবতাবিরোধী কবি’র মৃত্যু আমাকে ব্যথিত করে না।
এহেন একজন ঘৃণ্য কবিকে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো হয়নি বা তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানো হয়নি বলে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, এর মধ্যে কেউ কেউ রাষ্ট্রের ছোটলোকিপনা খুঁজে পেয়েছেন। কেন রাষ্ট্র তাকে শ্রদ্ধা জানাবে? রাষ্ট্রের জন্য তিনি কী করেছেন? রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালে রাষ্ট্রের পক্ষে একটি শব্দও যে কবির কলম থেকে বের হয়নি, রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে স্বাধীনতার বিরোধীতা করা পক্ষের সঙ্গে যিনি হাত মিলিয়েছেন, তাদের দেওয়া উপঢৌকন গ্রহণ করেছেন এবং তাদের রক্তাক্ত হাতের ফুলের মালা কণ্ঠলগ্ন করেছেন, সেই রাষ্ট্রবিরোধী কবিকে শ্রদ্ধা জানানো রাষ্ট্রের উচিত নয়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সঠিক কাজটিই করেছে।
ঢাকা।
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:২৭