somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- তিন)

০২ রা অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৪:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বেণ উশখুশ করতে থাকেন ইন্দ্রের বার্তা শোনার জন্য, কল্পকের দীর্ঘ ভণিতা শুনে মনে মনে কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখে হাস্যপুষ্প ফুটিয়ে রাখেন যাতে তাঁর বিরক্তি কল্পক কিংবা অন্য দেবতা এবং অপ্সরগণের চোখে ধরা না পড়ে। কল্পককে কিছুটা ভাঁড় মনে হয় তাঁর। দেবপতি ইন্দ্রের বার্তা কল্পক আত্মস্থ করে এসেছেন, কেননা পাতালের কোনো কোনো অনার্য জাতির মতো স্বর্গ এবং ব্রহ্মাবর্তের আর্যরা লিখতে জানেন না, তাদের কোনো লিপি নেই। তারা শাস্ত্র রচনা থেকে শুরু করে শাস্ত্রশিক্ষা এবং বার্তা বিনিময় সবকিছু মুখে মুখে করে থাকেন, বংশ পরম্পরায় এমনিভাবেই চলছে। বেণ এবং আগত দর্শকের বিরক্তির উদ্রেক করে কল্পক আরো কিছুক্ষণ ভণিতা করেন, তারপর তার সুললিত কণ্ঠে বলতে শুরু করেন দেবপতি ইন্দ্রের বার্তা-

‘সম্মানীত নৃপতি; মান্যবর ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং স্বর্গের দেব-দেবীগণের পক্ষ থেকে আপনি আমার শুভেচ্ছা ও সাধুবাদ গ্রহণ করুন। আপনার প্রতি আমি এবং অন্যাণ্য দেবতাগণ দারুণ সন্তুষ্ট। দেবতাদের মুখে এখন কেবল আপনার প্রশংসা আর বীরত্বের কথা শুনতে পাই। এই মুহূর্তে ব্রহ্মাবর্তের সবচেয়ে সাহসী এবং যোগ্য ব্যক্তি আপনি, সঙ্গত কারণেই আমরা আপনাকে নৃপতি হিসেবে মনোনীত করেছি। স্মরণে রাখবেন- আজ থেকে আপনি ব্রহ্মাবর্তের মানবদের শাসক, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনার, আপনি তাদের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা। নৃপতিকে একই সঙ্গে হতে হয় নমনীয় এবং কঠোর। দণ্ড সকল মানুষকে শাসন করে, দণ্ডই রক্ষা করে। মানুষ নিদ্রিত থাকলে দণ্ড জাগ্রত থাকে; পণ্ডিতগণ দণ্ডকে ধর্ম বলেছেন। নৃপতি সর্বদা ন্যায় আচরণ করবেন, শত্রুর প্রতি তীক্ষ্ণ দণ্ড বিধান করবেন, স্নেহভাজন বন্ধুর প্রতি সরল এবং ব্রাহ্মণের প্রতি ক্ষমাশীল হবেন। নৃপতি সর্বদাই মনু, ঋষি আর ব্রাহ্মণগণকে মান্য করবেন, তাদের সুপরামর্শ গ্রহণ এবং নির্দেশ পালন করবেন। ব্রাহ্মণ কোনো ভুল করলেও নৃপতি তার বিচার করতে পারেন না, ব্রাহ্মণকে কোনো শাস্তি দিতে পারেন না। ব্রাহ্মণের অবস্থান সকলের উপরে, ইহজগতে ব্রাহ্মণ ন্যায়-অন্যায়ের উর্দ্ধে; ব্রাহ্মণ তার কর্মফল ভোগ করবেন পরকালে, আর তা নির্ধারণ করবেন স্বয়ং পরমপিতা। নৃপতি ব্রাহ্মণদেরকে দান করবেন, তিনি সর্বদা লক্ষ্য রাখবেন যে তাঁর শাসিত ভূখণ্ডে কখনো যেন কোনো ব্রাহ্মণ ক্ষুধায় পীড়িত না হন, ব্রাহ্মণ ক্ষুধা পীড়িত হলে সেই ভূখণ্ড শীঘ্রই ক্ষুধাক্লিষ্ট হয়। কদাচিৎ ব্রাহ্মণের উপর অসদাচরণ করলে সেই নৃপতির পতন অনিবার্য। নৃপতি ইন্দ্র ও অগ্নিকে পূজা করবেন, দেবতাদের অনুগত থাকবেন, নিয়মিত যজ্ঞ করে যজ্ঞের অর্ঘ্য এবং কর দেবপতির নিকট প্রেরণ করবেন।
নৃপতির প্রতি প্রজাদেরও কিছু কর্তব্য রয়েছে; প্রজাগণ অন্ন, পানীয়, বৃক্ষ, পশু, মাংস, মধু, ছানা, রস, ফুল, ফল, চামড়ার দ্রব্য, মাটির ভাণ্ড প্রভৃতি কর হিসেবে নৃপতিকে প্রদান করবেন। সর্বদা নৃপতিকে মান্য করবেন। জোঁক, বাছুর ও মৌমাছি যেমন একটু একটু করে রক্ত, দুধ, ও মধু পান করে; তেমনি নৃপতিও অল্প অল্প করে প্রজাদের নিকট থেকে কর আদায় করবেন।
নৃপতি সর্বদা বকের ন্যায় বিষয়সমূহের চিন্তা করবেন, সিংহের ন্যায় পরাক্রম করবেন, বৃকের ন্যায় অপহরণ করবেন এবং শশকের ন্যায় পলায়ন করবেন। সর্বদা নিজের দূর্বলতা ঢেকে, শত্রুর দূর্বলতা খুঁজে বের করে আঘাত করবেন।
নৃপতি, আপনি আর্য বীর, অনার্য জাতির ওপর কখনো সদয় হবেন না। অনার্যদেরকে তাদের বসতি থেকে উৎখাত করবেন; তাদের বাসভূমি, গবাদীপশু এবং চারণভূমি আপনার করতলগত করে আর্যভূমির বিস্তার ঘটাবেন, অনার্যদের অস্ত্র হস্তগত করে তাদের ওপরেই তা প্রয়োগ করবেন। আপনার হাত ধরে ভারতবর্ষে আর্যজাতির প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তৃত হোক।
আশা রাখি আপনি আমার কথা মর্মে অনুধাবন করে ধর্মে মতি রেখে ব্রহ্মাবর্ত পরিচালনা করবেন। আপনার এবং আপনার ব্রহ্মাবর্তবাসীর কল্যাণ হোক। আপনার জয় হোক। আপনার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনায়- দেবপতি ইন্দ্র’

দেবপতি ইন্দ্রের বার্তা শেষ করে কল্পক মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে বলেন, ‘নৃপতি বেণের জয় হোক।’

সমবেত জনতাও উঠে দাঁড়িয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে সমস্বরে বলেন, ‘নৃপতি বেণের জয় হোক।’

জয়ধ্বনি দিতে দেখে বেণ সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কল্পক, ঋষি অত্রি, দেবগণ, অপ্সরা ত্রয় এবং সমবেত জনতাকে অভিবাদন জানান করজোড়ে মাথা নত করে।

তিনবার জয়ধ্বনি দেবার পর কল্পক তাঁর আসনে গিয়ে উপবেশন করলে সমবেত জনতা এবং বেণও নিজ নিজ আসনে উপবেশন করেন। অনুষ্ঠানের ঘোষক উঠে দাঁড়িয়ে হেমা নামের একজন অপ্সরাকে মঞ্চে এসে নৃত্য করার অনুরোধ জানালে হেমা আসন ছেড়ে মঞ্চে গিয়ে সকলকে অভিবাদন জানিয়ে বাদ্যের তালে তালে নৃত্য শুরু করেন। এতক্ষণ যে-সব মানুষ এদিকে-ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নেশায় চুর হয়ে এলোমেলো গল্প করছিল কিংবা তর্ক-বিতর্ক করছিল, কেউবা ছাতু খাচ্ছিল আর সোমরস পান করছিল, হেমার নৃত্য শুরু হতেই তারা মঞ্চের কাছে এসে ঘন হয়ে বসে। যারা আগে থেকেই বসে অর্ধ-নিমীলিত চোখে ঢুলছিল, তাদের চোখও স্ফীত হয়ে যায় নৃত্যের ছন্দে। সকলেই প্রবল কৌতুহলে অপেক্ষা করছিল অপ্সরাদের নৃত্য দেখার জন্য।

বেণ এমন এক সময়ে নৃপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন যখন ব্রহ্মাবর্তের মানব গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে আভ্যন্তরীণ রেষারেষি ও অন্তর্কোন্দল উদগ্র হয়ে উঠেছে, মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে, দূর থেকে দেবতাদের পক্ষেও কঠিন হয়ে পড়েছে মানব গোষ্ঠীগুলোকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। ক্ষমতা নিয়ে, গবাদী পশু নিয়ে, পশু শিকার করতে গিয়ে কিংবা শিকার করা পশুর মাংসের ভাগ নিয়ে, পাশা খেলা নিয়ে, ভূমি কিংবা ফসলের ভাগ নিয়ে, নারীর অধিকার নিয়ে নিজেদের মধ্যে কলহ-রক্তপাত এমনকি প্রাণহানীর মতো ঘটনাও প্রায়শঃই ঘটে চলেছে।

ব্রহ্মাবর্তে এই বিশৃঙ্খলার শুরু হয় চাক্ষুস মনুর সময়কালে। অবশ্য এই সময়ে শুধু ব্রহ্মাবর্তেই নয়, স্বর্গেও ভাঙাগড়া চলছিল। আর্যদের দাপটে স্বর্গ ও ব্রহ্মাবর্তে অনার্যরা হীনবল হয়ে পড়লে আর্যদের নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। কাশ্যপ ও দিতির পুত্র দৈত্য হিরণ্যকশিপু তখন জৈষ্ঠ্যতা এবং নিজ যোগ্যতা বলেই স্বর্গের নৃপতি হন, কিন্তু কাশ্যপ ও অদিতির পুত্র আদিত্যরা তাদের বৈমাত্রেয় ভ্রাতাকে নৃপতি হিসেবে মেনে নিতে সম্মত নয়, তারা হিরণ্যকশিপুকে উৎখাত করার জন্য নানাবিধ চক্রান্ত শুরু করে। এই চক্রান্তের অংশ হিসেবেই বিষ্ণু হিরণ্যকশিপুকে দূর্বল করার জন্য তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা হিরণ্যক্ষকে হত্যা করে। ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ হিসেবে হিরণ্যকশিপু যজ্ঞাদি বন্ধ করে দেন, আদিত্যরা তখন সুযোগ বুঝে হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করে আর মিথ্যা প্রচার করে যে হিরণ্যকশিপু অত্যাচারী নৃপতি ছিলেন। কিন্তু এই মিথ্যা প্রচারে স্বর্গের সাধারণ আর্যরা তুষ্ট হয় না, জনরোষ বাড়তে থাকে আদিত্যদের বিরুদ্ধে, চতুর আদিত্যরা জনরোষ শান্ত করতে হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদকে স্বর্গের নৃপতির আসনে অধিষ্ঠিত করে, কিন্তু পিছন থেকে শাসনকার্যের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তারাই নেয়। হিরণ্যকশিপুর পরে নৃপতি হন বিরোচন ও বলি, ততদিনে আদিত্যরা আরো অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বামন নামক বিষ্ণু ছলনা করে নৃপতি বলির সাম্রাজ্য দখল করে নেয়, প্রাণ বাঁচাতে বলি এবং অন্য দৈত্য ও দানবরা স্বর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যান সুতল অঞ্চলে। ব্রহ্মার এক আর্য গোষ্ঠী চার গোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়- দেব, মানব, দৈত্য ও দানব। মানবদের সঙ্গে দেবতাদের কোনো শত্রুতা নেই, মানবরা দেবতাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে সবসময়, কেননা মানবদেরকে ছলনা করে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করা হয়নি, যেমনটা করা হয় দৈত্য ও দানবদের সঙ্গে। ফলে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত দৈত্য ও দানদের সঙ্গে দেবতাদের শুরু হয় শত্রুতা, যা আজও চলছে। দৈত্য ও দানবরা মানবদের প্রস্তাব দিয়েছিল তাদের পক্ষালম্বন করার জন্য, তাহলে তাদেরকে আর ইন্দ্রকে কর দিতে হবে না, দেবতারা মানবদের আক্রমণ করলে দৈত্য-দানবরা মানবদের পক্ষে যুদ্ধ করবে। কিন্তু মানবরা সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি, হয়ত এজন্যই যে দৈত্য ও দানবদের চেয়ে এখন দেবতারা অধিক শক্তিশালী। দৈত্য ও দানবরা স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হবার পর বেশ কয়েকবার যুদ্ধ করেছে দেবতাদের সঙ্গে, প্রত্যেকবারই পরাজিত হয়েছে তারা, আপাতত তারা শান্ত আছে। স্বর্গে কিছুটা শান্তি ফিরলেও, ব্রহ্মাবর্তে ক্রমশ বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকে। বিশেষত ভূমিকম্প-মহাপ্লাবনের পর থেকে। প্রকৃতির সে কী ভয়াবহতা, মানুষ-পশুপাখির সে কী অসহায়তা, সে কী নিদারুণ দুঃসময়!

তখন বর্ষাকাল, সাতদিন ধরে অনবরত চাক ভাঙা মধুর মতো বৃষ্টি হয় চমরি গাইয়ের পালের ন্যায় অঞ্জনপুঞ্জ মেঘ ভেঙে, আর সেই সঙ্গে কী প্রচণ্ড মেঘের গর্জন! বজ্রাঘাতে মানুষ মরে, বৃক্ষ ফেটে হয় চৌচির আর অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়। বর্ষায় এমনিতেই সরস্বতী নদী তখন খরস্রোতা, তার ওপর প্রবল বৃষ্টিতে দু-কূল ছাপিয়ে যায় জল। পর্বতগুলোর মধ্যে মধ্যে আটকে থাকে রাশি রাশি জল, ফসলের ক্ষেত, চারণভূমি সব ডুবে যায়, চতুর্দিক তখন জলে টইটম্বুর। সেই প্রচণ্ড বর্ষণের মধ্যেই হঠাৎ একদিন ভোরবেলায় শুরু হয় ভূমিকম্প, ভূমিতে ফাটল ধরে, পর্বতে ধ্বস নামে, গৃহ ধ্বসে পড়ে। তারপর শুরু হয় সেই বীভৎস জলপ্লাবন, ফুসে ওঠা সরস্বতী নদী আর পর্বতের মধ্যে মধ্যে আটকে থাকা জলের তোড়ে ভূমি-পাথর ধ্বসে যায় আর ভেসে যায় শত শত বসতি, অমন বিরাটাকার পর্বতগুলো ভেঙে পড়ে শিশুর হাতের বালুগৃহের ন্যায়, বিরাটাকৃতির বৃক্ষরাজি শিকড়চূত হয়ে উপড়ে পড়ে আর ভেসে যায় জলের তোড়ে। মানুষ, গবাদীপশু আর বন্যপশুর গগণবিদারী আর্তচিৎকার শোনা যায় কেবল; কে-ই বা তখন কাকে সাহায্য করে, সকলেই অসহায়, নিজের নিজের প্রাণ বাঁচাতে তৎপর! চোখের সামনে কারো স্ত্রী-সন্তান জলের তোড়ে ভেসে যায়, কারো-বা পিতা-মাতা ভূমিচাপা পড়ে, কারো শরীরের অর্ধেক কাঁদায় গেঁথে থাকে, কিন্তু কারো কিছুই করার থাকে না, চোখের পলকে সবকিছু তছনছ হয়ে যায়!

স্বায়ম্ভূব মনুর হাতে গড়া ব্রহ্মাবর্ত ক্রমশ আরো সমৃদ্ধ হয়েছিল স্বারোচিষ মনু, উত্তম মনু, তামস মনু এবং রৈবত মনুর হাত ধরে। স্বর্গের মতোই ব্রহ্মাবর্তও অনেক বিস্তার লাভ করেছিল, জনসংখ্যা অনেক বেড়েছিল, আর্যশূন্য শূন্য এক ভূখণ্ড আর্যদের প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরে উঠেছিল। কিন্তু চাক্ষুস মনুর সময়ে এসে সব ধুলিস্যাৎ! প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বেই নিদারুণ মানবিক অবক্ষয় শুরু হয় চাক্ষুস মনুর সঠিক নেতৃত্বের অভাবে। আর্যদের নিজেদের মধ্যেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব উদগ্র হয়ে ওঠে, যত্রতত্র পাহাড় কেটে বসতি ও ফসলের ভূমি তৈরি করা হয়, ইন্দ্র ও বরুণদেবের পরামর্শে প্রাকৃতিক জলাধারের মুখে বাঁধ দিয়ে নতুন করে জলাধার খনন করা হয়; যা ক্রমশ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনে ব্রহ্মাবর্তে। সর্বনাশা মহাপ্লাবন সমগ্র ব্রহ্মাবর্তকে যেন মহাশ্মশান বানিয়ে দেয়, মৃত্যুর মহাছোবলে এক ধাক্কায় ব্রহ্মাবর্তের জনসংখ্যা অর্ধেকেরও কমে নেমে আসে।

বিভীষিকাময় মহাপ্লাবনের পরে স্বজন-প্রিয়জন হারিয়ে যারা বেঁচে থাকে- তারা শোকে মূহ্যমান, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, যেনবা অর্ধমৃত মানব! ভেঙে পড়া এই মানুষদের জীবনের পথে ফিরিয়ে আনতে দেবগণ মনুর আসনে অধিষ্ঠিত করেন বিবস্বানপুত্র বৈবস্বতকে। বৈবস্বত মনু আবার নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখান সর্বস্ব হারানো মানুষদের, ঘুরে দাঁড়াবার অনুপ্রেরণা যোগান। স্বর্গ থেকে দেবগণও বারবার আসেন সঠিক পরামর্শ দিয়ে ব্রহ্মাবর্তে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফেরাতে। সেই প্রাকৃতিক দূর্যোগে স্বর্গ, ব্রহ্মাবর্ত, অতল, বিতল, সুতল সব স্থানই কমবেশি ক্ষতি হয়; তবে ব্রহ্মাবর্তের ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি, যা সহসাই পূরণ হবার নয়। স্বর্গে জলপ্লাবন হয়নি, কেবল ভূমিকম্পে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মহাপ্লাবনে ব্রহ্মাবর্তের মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরোক্ষভাবে স্বর্গও ক্ষতিগ্রস্ত হয়; কেননা স্বর্গের দেবতাদের জীবনযাত্রার মান অনেকটাই ব্রহ্মাবর্তের মানবদের ওপর নির্ভরশীল। ব্রহ্মাবর্তের মানবদের প্রদত্ত কর স্বর্গের জীবনমান ঠিক রাখে। স্বর্গের ভূমি রুক্ষ হওয়ায় ফসলের চাষ হয় খুব কম, সেখানে পশুপালন-ই জীবিকার প্রধান উৎস, আর কিছু ফল উৎপাদিত হয়। বৎসরের প্রায় অর্ধেক সময় তুষারাবৃত থাকে স্বর্গভূমি। ফলে ব্রহ্মাবর্তের মানবরা কর হিসেবে যে ফসল, গবাদীপশু ও অন্যান্য পণ্য স্বর্গের দেবগণকে দান করে; তা দিয়ে বেশ কিছুকাল জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন দেবগণ। ভূমিকম্প ও মহাপ্লাবনে ব্রহ্মাবর্তের অর্ধেক মানুষের মৃত্যু, বিপুল সংখ্যক গবাদী পশুর মৃত্যু, অরণ্য ও চারণভূমির ক্ষতি এবং ফসলি ভূমি বিনষ্ট হওয়ায় স্বর্গের জীবনযাত্রায়ও বিরাট বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে দেব ও মানব উভয়ে মিলেই চেষ্টা করে ব্রহ্মাবর্তকে আবার বাসযোগ্য করে তুলতে। স্বজন ও সম্পদ হারানোর বেদনা ভুলে মানবদের জীবন আবার গতিশীল হতে শুরু করে। আবার শুরু হয় চাষাবাদ, পশুশিকার, পশুচারণ; কিন্তু আগের সেই শৃঙ্খলা আর ফিরে আসে না মানবদের জীবনে। বৎসরের পর বৎসর কেটে যায়, কিন্তু নানা কারণে গোত্রে গোত্রে কিংবা একই গোত্রের মানুষে মানুষে হানাহানি-মারামারি ক্রমশ বেড়েই চলে। ব্রহ্মাবর্তের মানবদের এই অসহিষ্ণুতা-অবক্ষয়ের বিষয়ে দেবতারাও চিন্তিত-উদ্বিগ্ন বোধ করেন। ব্রহ্মাবর্তের আর্যদের মধ্যেই যদি এমন অন্তর্কোন্দল লেগে থাকে, তবে তারা শত্রুকে কিভাবে মোকাবেলা করবে? কিভাবে তারা লড়াই করবে শক্তিশালী কিরাত, নিষাদ, পণি, রাক্ষস প্রভৃতি অনার্য জাতির বিরুদ্ধে? কিভাবে তারা সপ্তসিন্ধুর পারে আর্য রক্তের প্রভাব বিস্তার করবে? ব্রহ্মাবর্তের মানুষের মধ্যে কিভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায় তা নিয়ে স্বর্গের নেতৃস্থানীয় দেবতাদের সঙ্গে কয়েক বার বৈঠক করেন দেবপতি ইন্দ্র। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয় ব্রহ্মাবর্তের গোত্রগুলোর ভেতর থেকে একজন নৃপতি নির্বাচিত করার, যিনি মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবেন, যার নিয়ন্ত্রণে থাকবেন সকল গোত্র-প্রধান, আর গোত্র-প্রধানগণের নিয়ন্ত্রণে থাকবে স্ব স্ব গোত্রের মানুষেরা। নিরীহকে নৃপতি রক্ষা করবেন আর অপরাধীকে দণ্ড দেবেন। নৃপতির উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন মনু, আর বিভিন্ন সময়ে সুপরামর্শ দেবার জন্য তো ব্রাহ্মণগণ থাকবেনই।

গত শরৎকালের প্রারম্ভে দেবগণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন ব্রহ্মাবর্তে নৃপতি মনোনীত করার, তখনই দেবপতি ইন্দ্রের নির্দেশে বশিষ্ট এবং কয়েকজন দেবতা ব্রহ্মাবর্তে এসে বিভিন্ন গোত্রের প্রধানগণকে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন এবং দেবপতি ইন্দ্রের সিদ্ধান্তের কথা জানান, যা বসন্তেই বাস্তবায়ন করতে ইচ্ছুক দেবপতি। কয়েকদিন পরেই দেবগণ ফিরে যান স্বর্গে। হেমন্ত থেকেই স্বর্গে তুষারপাত শুরু হয়, বরফাচ্ছাদিত হয়ে থাকে চতুর্দিক, এসময় দেবতারাই প্রকৃতির সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকেন। শীতকালের কয়েকমাস ব্রহ্মাবর্তের সঙ্গে স্বর্গের কোনো যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে, তুষারপাতের কারণে স্বর্গ এবং ব্রহ্মাবর্তের যাতায়াতের পথ তখন দূর্গম হয়ে পড়ে, ফলে এসময় স্বর্গ থেকে কোনো দেবতা যেমনি ব্রহ্মাবর্তে আসেন না, তেমনি ব্রহ্মাবর্তের কোনো মুনি-ঋষিও স্বর্গে যান না। ফলে কে হবেন প্রথম নৃপতি তা নিয়ে ব্রহ্মাবর্তের মানুষ বেশ সরগরম ছিল শীতকালের কয়েক মাস, বেশ কয়েকজন গোত্রপতি নৃপতি হতে ভীষণ উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন, সকলেরই পক্ষে-বিপক্ষে মত ছিল, তর্ক-বিতর্ক ছিল।

শীত চলে গিয়ে বসন্ত আসতেই স্বর্গ থেকে দেবপতি ইন্দ্রের বার্তা নিয়ে ব্রহ্মাবর্তে আসেন দেবতা বায়ু, লেখ, কল্পক, সপ্তর্ষিমণ্ডলীর অন্যতম ঋষি অত্রি এবং তিনজন অস্পরা। তারা ব্রহ্মাবর্তের পুরোহিত এবং ঋষিদের সঙ্গে বৈঠক করেন, এরপর গোত্র-প্রধানদের ডেকে বৈঠকে জানিয়ে দেন যে ব্রহ্মাবর্তের প্রথম নৃপতি হবেন ব্রহ্মাবর্তের প্রতিষ্ঠাতা স্বায়ম্ভূব মনুর বংশধর অঙ্গ এবং সুনীথার পুত্র বেণ! যেহেতু দেবগণ, পুরোহিতগণ এবং ঋষিগণ বেণকে নৃপতি হিসেবে মনোনীত করেছেন ফলে যে-সব গোত্র-প্রধান নিজেরা নৃপতি হতে চেয়েছিলেন, তারা ভেতরে ভেতরে কিছুটা মনোক্ষুন্ন থাকলেও বেণকে নৃপতি হিসেবে স্বীকার করে নেন।

হেমার নৃত্য দেখে দর্শকরা দারুণ উল্লসিত, বিস্ময়ে যেন তাদের চোখের পলক পড়ে না! হেমার পরে নৃত্য করতে মঞ্চে ওঠেন অপ্সরা অন্তরা। অন্তরার পরে কল্পকের সংগীতের সঙ্গে মঞ্চে নৃত্যের নিপুণ নিনাদ তোলেন অপ্সরা সুরোত্তমা। সকলের দৃষ্টি ঘুরতে থাকে সুরোত্তমার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে! কেউ কেউ কানাকানি করতে থাকে যে এমন সুগঠিত কিন্তু মেদহীন শরীর তারা পিতৃপুরুষের জন্মে দ্যাখেনি, নৃত্য তো নয়ই! ব্রহ্মাবর্তের মানবীরাও সুন্দরী, কিন্তু স্বর্গের অপ্সরারা যেন সুন্দরের ওপরে বাড়তি কারুকার্য করা এক অনিন্দ্য সুন্দরী, যাদের সৌন্ধর্য ব্যাখ্যাতীত! ব্রহ্মাবর্তের মানবীরাও নৃত্যে নিপুণ, কিন্তু অপ্সরাদের নৃত্যের সময় যেন তাদের অঙ্গে প্রজাপতির ন্যায় দুটি ডানা যুক্ত হয়, যা ব্রহ্মাবর্তের মানবীদের চেয়ে তাদের এগিয়ে রাখে!



(চলবে.....)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০২২ বিকাল ৪:২১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×