চার
নৃপতি বেণ আর তাঁর ভৃত্য মারীচ গাভীর দুগ্ধ দোহনে ব্যস্ত, এর আগে চারটি চমরি গাইয়ের দুগ্ধ দোহন করা হয়েছে, সেই দুগ্ধ নিয়ে গৃহে গেছেন অঙ্গ, এতক্ষণে সুনীথা কিংবা হংসপাদা দুগ্ধ জ্বাল দিতে বসে গেছেন। বেণের মোট গরু আছে বাহাত্তরটি, এর মধ্যে গাভী আটাশটি, এই আটাশটি গাভীর মধ্যে ষোলটি দুগ্ধবতী। চমরি গাই আছে আঠারোটি, এর মধ্যে দুগ্ধবতী ছয়টি। এই ষোলটি দুগ্ধবতী গাভী আর ছয়টি দুগ্ধবতী চমরি গাইয়ের মধ্য থেকে প্রতিদিন পালা করে আটটি গাভী এবং চারটি চমরি গাইয়ের দুগ্ধ দোহন করেন, বাকি গাভী এবং চমরি গাইয়ের দুগ্ধ বাছুরকে খাইয়ে দেন। সবগুলো দুগ্ধবতী গাভী এবং চমরি গাই দোহন করেন না এজন্য যে এত দুগ্ধ এবং দুগ্ধ থেকে প্রস্তুত ছানা ভোজন করার মানুষ নেই। পরিবারে তারা মানুষ মোটে ছয়জন, আর ভৃত্য মারীচ। পড়শী সকলেরই পর্যাপ্ত দুগ্ধবতী গাভী এবং চমরি গাই আছে। এই আটটি গাভী এবং চারটি চমরি গাইয়ের দুগ্ধও তাদের নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি। নিজেদের প্রয়োজন মতো রেখে উদ্বৃত্ত দুগ্ধ ও ছানা ভৃত্য মারীচকে দিয়ে বিভিন্ন ঋষিদের আশ্রম এবং ব্রাহ্মণদের গৃহে পাঠিয়ে দেন, কখনো কখনো নিজেও বয়ে নিয়ে যান। কেবল তিনি নন, প্রায় সকলেই ঋষিদের আশ্রম এবং ব্রাহ্মণদেরকে দুগ্ধ-ছানাসহ নানা প্রকার আহার সামগ্রী দান করেন। এটাই আর্যসমাজের রীতি। প্রত্যেক দিন প্রভাতে বেণ এবং মারীচ গাভী ও চমরি গাইয়ের দুগ্ধ দোহন করেন, অঙ্গ দুগ্ধ বয়ে নিয়ে যান গৃহে আর দুগ্ধ জ্বাল দিয়ে সংরক্ষণ কিংবা ছানা তৈরির কাজটি করেন সুনীথা এবং হংসপাদা।
গরু আর চমরি গাই ছাড়াও বেণের আটটি অশ্ব, বাইশটি মেষ এবং বত্রিশটি ছাগল আছে।
দুগ্ধ দোহন করা হলে সকালের আহার সেরে আর্য পুরুষরা কেউ তৃণভূমিতে পশু চরাতে যায়, কেউ বন্যপশু শিকার করতে যায়, আর যব চাষের মৌসুমে মাঠে যায় চাষের কাজে। এখন অবশ্য চাষের কাজ নেই; এবছর যব কেটে মাড়াই করে গৃহে তোলা হয়ে গেছে। বিভিন্ন গোত্রের আর্য পুরুষেরা দলে ভাগ হয়ে পালা করে পশু চরাতে যায় তৃণভূমিতে। একদল একদিন পশু চরাতে যায় তো আরেক দল যায় বন্যপশু শিকার করতে কিংবা কেউ কেউ বাড়িতে শুয়ে-বসে বিশ্রাম নেয়। বেণের ভৃত্য আছে, তাই তিনি প্রতিদিন নিজে না গিয়ে ভৃত্য মারীচকে পাঠান পশু চরাতে কিংবা শিকার করতে; তাঁর যেদিন ইচ্ছে হয় সেদিন যান। তবে শিকার করতে তিনি আনন্দ পান বলে প্রায়ই শিকারে যান। যেমন আজ তিনি শিকারে যাবেন বলে আগেই সিদ্ধান্ত নেন।
দুগ্ধ দোহন করা শেষ হলে দুগ্ধ নিয়ে নিজেদের গৃহের আঙিনায় ফিরে আসেন বেণ এবং মারীচ, দুগ্ধপাত্র নামিয়ে রেখে তারা দুজনই আঙিনার দক্ষিণকোণের জলের পাত্র থেকে হাত-পা ধুয়ে শালবৃক্ষের নিচে গিয়ে বসেন, বেণের থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসে মারীচ আর বেণের পাশে বসেন অঙ্গ। শালবৃক্ষকে আর্যরা মনে করে বিষ্ণুর আশির্বাদপ্রাপ্ত বৃক্ষ, তাই অঙ্গ শালবৃক্ষের কাছে গৃহনির্মাণ করেছিলেন। গোত্রের মানুষেরা তাদের নৃপতি বেণ ও তাঁর পরিবারের জন্য নতুন যে দুটি গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছে সেই গৃহের পিছনে এবং আঙিনার পাশে বেশ কয়েকটি শালবৃক্ষ আছে। দেবতাগণ স্বর্গে ফিরলেই বেণের পরিবার সেই নতুন গৃহে উঠবেন। ব্রহ্মাবর্তে প্রচুর শালবৃক্ষ আছে। শালবৃক্ষের পাতা ঝরে নতুন পাতা গজিয়ে এখন ফুল ফুটেছে; শালফুল নরম, রোমশ আর শ্বেতবর্ণের পাপড়িগুলো হলদে আভাযুক্ত, মিষ্টি গন্ধ ছড়ায়। সারারাত্রি ফুল ঝরে বৃক্ষতলায় ছড়িয়ে ছিল, সকালে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিয়েছেন সুনীথা, তারপর আবারও কিছু ফুল পড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, সে-গুলোর গন্ধ ভেসে আসতে থাকে নাকে। হংসপাদা মৃৎপাত্রে রুটি আর মাংস দিয়ে গেলে আহার শুরু করেন বেণ, অঙ্গ ও মারীচ। একটু পর আগের দিনের ছানা আর বড় এক পাত্র করে দুগ্ধ দিয়ে যান, তারপর আবার এসে রেখে যান কিছু ফল। অঙ্গ এবং বেণ দুজনই ভোজনরসিক, প্রচুর খেতে পারেন। অঙ্গ এই ভূ-মণ্ডলে পঞ্চাশ শরৎ পার করে দিলেও এখনো তার শক্তি তরুণের মতোই!
বেণের আহার শেষ হতেই ধারালো বর্শা হাতে প্রতিবেশী প্রভাষ এসে বলেন, ‘ভ্রাতা, আজ শিকারে যাবে বলেছিলে, যাবে না?’
‘হ্যাঁ যাব। একটু অপেক্ষা কর।’ এঁটো হাত ধুতে ধুতে বলেন বেণ।
হাত ধুয়ে গৃহে প্রবেশ করেন বেণ, পরনের বাস খুলে নেংটি পরেন, তারপর ধনুক আর তূণ নিয়ে বাইরে এসে শালবৃক্ষের নিচে নামিয়ে রাখেন। প্রাতঃরাশ সেরে অর্চিকে নিয়ে পৃথু গৃহের আশপাশেই কোথাও খেলছিল, হঠাৎ আঙিনায় এসে পিতাকে শিকারে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে দেখে বলে, ‘পিতাশ্রী, আমিও তোমার সঙ্গে শিকারে যাব।’
বেণ বলেন, ‘এখন না বাছা, তুমি আরেকটু বড় হও, তারপর তোমাকে শিকারে নিয়ে যাব।’
‘না, আমি এখনই যাব।’
প্রভাষ বলেন, ‘তুই শিকারে গিয়ে কী করবি রে?’
‘তীর নিক্ষেপ করে মৃগ শিকার করব।’
‘বাপরে, একেবারে নৃপতিপুত্রের মতই কথা!’
বেণ পুনরায় গৃহে প্রবেশ করে অনেকগুলো তীর হাতে নিয়ে ফেরেন, তূণের পাশে তীরগুলো নামিয়ে রেখে অধিক তীক্ষ্ণ তীরগুলো বেছে বেছে তূণে রাখতে থাকেন। পৃথু পিতার কাছে এসে বসে একটা তীর হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, ‘পিতাশ্রী আমি শিকারে যাব, আমাকে নিয়ে চলো।’
বেণ বলেন, ‘জঙ্গলে যে অনেক হিংস্র প্রাণি আছে বৎস, তাদের সঙ্গে লড়াই করতে হলে তোমাকে যে আরো বড় হতে হবে।’
‘আমি তো এখন অনেক বড় হয়েছি, অর্চির মতো ছোট পুঁচকি নেই!’
পৃথুর কথায় সকলেই হাসেন। প্রভাষ হংসপাদার উদ্দেশে বলেন, ‘শুনেছ বৌদি, তোমার পুত্র নাকি অনেক বড় হয়ে গেছে, তাহলে এখন ভালো একটি কন্যা দেখে ওর বিবাহ দিয়ে দাও।’
হংসপাদা বলেন, ‘তুমি তো ওর কাকাশ্রী, তোমারও তো দায়িত্ব আছে, দাও না একটা কন্যা খুঁজে।’
‘আমার কন্যা থাকলে আমি তোমার পুত্রকে জামাতা করতাম, এমন সুন্দর নৃপতিপুত্রকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইতাম না।’
সুনীথা প্রভাষকে বলেন, ‘এক পাত্র দুগ্ধ পান করে যা প্রভাষ।’
‘আমার পেট তো ভরা জেঠিমাতা।’
‘এই বয়সে একপাত্র দুগ্ধ বেশি পান করলে কিচ্ছু হবে না।’
‘বেশ, বলছ যখন দাও।’
প্রভাষ উনুনের কাছে গিয়ে বসলে সুনীথা উনুনের ফুটন্ত চমরি গাইয়ের দুগ্ধ থেকে কাঠের হাতা দিয়ে ছোট পাত্রে তুলে ওর দিকে এগিয়ে দেন। প্রভাষ দুগ্ধে চুমুক দিতে দিতে বলেন, ‘বুঝলে জেঠিমাতা, গতকাল একপাত্র ছানা আর কিছু যব দিয়ে এলাম পুরোহিত মশাইকে, তা পুরোহিতের স্ত্রী বললেন কিনা- “এত কম আনলে হয়, পরেরবার আরেকটু বেশি করে এনো বৎস, আমাদের তো চলতে হবে।” বলো জেঠিমাতা, গাত্রদাহ হয় না এমন কথা শুনলে! আরে বাপু, আমার যা সামর্থ তাই তো দেব! আমারও তো গৃহে স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতা আছে। এবার এমনিতেই আমার যবের ফলন ভালো হয়নি। তার ওপর একটা ভূমির যব পঙ্গপালের আক্রমণে নষ্ট হলো।’
‘থাক, এসব বলতে নেই, তাতে নিন্দে করা হয়, ব্রাহ্মণের নিন্দে করলে পাপ হয়।’
‘আমার এসব সহ্য হয় না জেঠিমাতা। ওদের তো কর্ম করে আহার করতে হয় না, বসে বসে মানুষের দানে আহার করে, আমাদের মতো কর্ম করে আহার করতে হলে বুঝতে পারত যে একমুঠো যবের জন্য কত ফোঁটা ঘাম ঝরাতে হয়!’
‘হতচ্ছাড়া এসব বলতে নেই, পাপ হবে। চুপ করে দুগ্ধটুকু শেষ কর দেখি।’
তীর বেছে তূণে ভরা শেষ বেণের। তিনি তাড়া দেন প্রভাষকে, ‘তোর হলো?’
‘হ্যাঁ, চলো।’
দুগ্ধে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে পড়েন প্রভাষ, ‘যাই গো জেঠিমাতা।’
‘ভালো মতো ফিরে এসো বাছা।’
বেণ এবং প্রভাষ চলে গেলে সুনীথা হংসপাদার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘প্রভাষ একটা পাগল। কী বলতে যে কী বলে তার ঠিক নেই!’
‘ওর মনটা বড় ভালো, মনে কোনো প্যাঁচ নেই।’ বলেন হংসপাদা।
‘তা ঠিক বলেছ। বৌমা, দুগ্ধের পাত্রটা নিয়ে এসো তো, ঘন হয়ে গেছে, নামিয়ে ফেলতে হবে।’
হংসপাদা বড় একটি পাত্র নিয়ে এসে উনুনের পাত্রের দুগ্ধ তাতে ঢেলে রাখেন, তারপর হাতের শূন্য পাত্রটি পুনরায় উনুনে চাপিয়ে আরেকটি পাত্রে রাখা গাভীর দুগ্ধ ঢেলে দেন। গাভীর দুগ্ধ থেকে ছানা তৈরি করা হবে।
হঠাৎ কয়েকজন মানুষের চিৎকার শুনে শাশুড়ি-বৌমা একে অন্যের মুখের দিকে তাকান, তারপর যে-দিক থেকে চিৎকার ভেসে আসে সেদিকে তাকিয়ে কান খাঁড়া করেন। মানুষজন দৌড়তে থাকে চিৎকারের দিকে। ‘বাঘে ধরেছে’ শব্দ দুটি কেবল বুঝতে পারেন হংসপাদা এবং সুনীথা।
সুনীথা বলেন, ‘পৃথু কোথায় বৌমা?’
‘এখানেই তো ছিল, গেল কোথায়!’
‘শীঘ্র দেখ।’
পৃথুর নাম ধরে ডাকতে থাকেন হংসপাদা কিন্তু কোনো সাড়া পাওয়া যায় না। ওদিকে মানুষের চিৎকার আরো জোরালো হতে থাকে। হংসপাদা এবং সুনীথা দুজনেই বিচলিত বোধ করেন, হংসপাদা উঠে পৃথুকে ডাকতে ডাকতে ব্যস্ত পায়ে ছুটতে থাকেন মানুষের হট্টগোলের দিকে।
(চলবে.....)