somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- ছাব্বিশ )

১০ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উনিশ

‘বিচা…..র, বিচা….র, বিচা…র; কঠিন বিচার। স্ত্রীলোক হয়ে অবিবাহিত কন্যার সতীত্ব নষ্ট করার অপরাধের বিচার। নকুলের জ্যেষ্ঠকন্যা এবং সত্যবাকের জ্যেষ্ঠ স্ত্রী অনূকার বিরুদ্ধে আজ অপরাহ্ণে বিচার বসবে নৃপতির সভাগৃহে। বিচা…..র, বিচা….র, বিচা…র, কঠিন বিচার….।’

বহির্ষ্মতীতে ঢেঁড়া পিটিয়ে বিচারের সংবাদ ঘোষণা করেন প্রৌঢ় ঘোষক পূর্ণভূষণ। অবশ্য তার নিজের নামটি ঢাকা পড়ে গেছে ঘোষক শব্দের আড়ালে, বহির্ষ্মতীর ছেলে-বুড়ো সবাই এখন তাকে ঘোষক বলেই ডাকে। ঢেঁড়ার শব্দ শুনলেই মানুষ বুঝতে পারে যে নৃপতির পক্ষ থেকে কিছু ঘোষণা করা হবে। মানুষজন যে যেখানে থাকে সেখান থেকেই কান খাঁড়া করে অথবা গৃহ থেকে বেরিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় ঘোষকের কাছে। এবারের ঘোষণা শুনে সবাই চমকে যায়, অবিশ্বাস্য ঠেকে কানে যে অনূকা এমন কাজ করতে পারে! মানুষ স্থানে স্থানে জটলা পাকায় আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা করে অনূকাকে নিয়ে। সবার চোখে অনূকা এখন অত্যন্ত কুতসিৎ রুচির এক নারী, বিচারে তার কী দণ্ড হয় তাই দেখার অপেক্ষায় সবাই।

সভাগৃহে কেদারায় উপবিষ্ট মনু বিবস্বাত, নৃপতি বেণ, প্রধান পুরোহিত উদয়গিরি; সভাগৃহ সংলগ্ন আঙিনায় কয়েকজন ঋষি ও ব্রাহ্মণ, আর তাদের সম্মুখে হাঁটু ভাঁজ করে ভূমিতে বসা অনূকা; আর অনূকার পিছন দিকে কিছুটা দূরত্বে বসা ব্রাহ্মণ যুবক কেশব, নীলধ্বজ ও কীচক। আর বাটীর প্রাচীরের বাইরে তিনদিকে দাঁড়িয়ে বিচারকার্য দেখতে আসা অসংখ্য মানুষ, এইসব মানুষের কৌতুহলী দৃষ্টি এখন অনূকার দিকে। অনূকার চেহারায় ভীতির ছাপ নেই, তবে ফুটে আছে বিষন্নতার পুষ্প, তার চুল এলিয়ে আছে, ঊর্ধ্বাঙ্গে শুভ্র নিবি, পরনে ধূসর বাস, নগ্ন পা। শশীয়তীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের কারণে অনূকা এখন বিচারের সম্মুখীন, কিন্তু শশীয়তীকে এখানে আনা হয়নি। কারণ শশীয়তী এখনো কিশোরী, দণ্ডবিধি মতে সে এখনো নাবালিকা, তাই তার কোনো দোষ নেই। অনূকা সাবালিকা এবং বিবাহিতা স্ত্রী, নাবালিকার সতীত্ব নষ্ট করার দোষে সে দোষী এবং এখন বিচারের মুখোমুখি।

অনূকা প্রাচীরের বাইরের মানুষের মাথার অনেক উপর দিয়ে দীর্ঘক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর তাকায় তার প্রিয় কাকাশ্রী নৃপতি বেণের দিকে, বেণের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই শুষ্ক হাসি দেয় সে, বেণ দৃষ্টি নামিয়ে নেন। বেণের প্রতি অনূকার কোনো অনুযোগ কিংবা অভিমান নেই তাকে এইভাবে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য, কেননা সে জানে যে বেণের কিছু করার নেই। মনুর বিধান আর সমাজের রীতি মেনে সমাজ পরিচালনা করাই নৃপতির কাজ, সমাজের চোখে অপরাধীকে দণ্ড দেওয়াই নৃপতির কাজ, এখানে প্রিয়জন কিংবা আত্মীয় দেখে বিচার করার কোনো সুযোগ নেই। আর তাদের সমাজে যেখানে ব্রাহ্মণদের কথাই শেষ কথা, নৃপতিকে যেখানে ব্রাহ্মণদেরকে তুষ্ট করে চলতে হয়, সেখানে বেণের যত প্রিয়ই সে হোক না কেন, তার জন্য বেণ কিছুই করতে পারবেন না।
মনু উদয়গিরির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বিচারকার্য শুরু করা যাক।’

উদয়গিরি বলেন, ‘বিলক্ষণ, যত দ্রুত বিচারকার্য শেষ করা যায় ততই মঙ্গল, এই পাতকিনীর রূপ দর্শনও পাপ! নৃপতি কিছু বলবেন?’
অনূকার বিরুদ্ধে বিচারকার্য শুরু করার পক্ষে মত দিতে বেণের বক্ষ বিদীর্ণ হলেও তিনি বলেন, ‘বিচারকার্য শুরু করা হোক।’

বেণ চোরা দৃষ্টিতে একবার তাকান অনূকার দিকে, অনূকার শূন্য দৃষ্টি, যেন সে কিছুই দেখছে না! ওর এই দৃষ্টি বর্শার মতো বুকে বিদ্ধ হয় বেণের। তিনি মনে মনে অনুশোচনা করেন এই ভেবে যে- ইস, ঘটনাটি যদি আমি আগে জানতে পারতাম, তাহলে ওকে কোথাও পালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে ওকে রক্ষা করতে পারতাম!

আজ মধ্যাহ্নে ব্রাহ্মণ যুবকেরা আশ্রম থেকে অনূকাকে ধরে নিয়ে এসে হাত বেঁধে ফেলে রাখে নৃপতির বাটীর আঙিনায়। বেণ তখন গৃহে ছিলেন না। তিনি যখন সংবাদ পান, ততক্ষণে সংবাদটি সর্বত্র জানাজানি হয়ে গেছে, ব্রাহ্মণদের ভেতরে ক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছে। আগে থেকেই ব্রাহ্মণদের ক্ষোভ রয়েছে অনূকার ওপর, যখন সে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে তখন থেকে, ব্রাহ্মণগণ চাননি অনূকা কন্যা হয়ে অন্য কন্যাদের অস্ত্র শিক্ষা দিক। কিন্তু অনূকার আশ্রম প্রতিষ্ঠায় বেণ কৌশলে স্বয়ং দেবী সরস্বতীর অনুমতি পাইয়ে দেওয়ায় ব্রাহ্মণগণ তখন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেননি। কিন্তু মনে তাদের ক্ষোভ ছিল, এখন সুযোগ পেয়ে তাদের ক্ষোভের অগ্নি লকলক করে উঠেছে।
মনু বলেন, ‘সাক্ষীকে উপস্থিত করা হোক।’

ঘোষক ঢেঁড়ায় বারি দিয়ে বলেন, ‘সাক্ষীদের সামনে এসে দাঁড়ানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।’

সাক্ষী ব্রাহ্মণপুত্র কেশব, নীলধ্বজ এবং কীচক পিছন থেকে উঠে সামনে এসে দাঁড়ালে মনু বলেন, ‘দেবপতি ইন্দ্রের নামে শপথ করে বলবে যে তোমরা কী দেখেছ। কেশব আগে বলো।’

কেশব প্রথমে মনুর দিকে, তারপর বেণের দিকে তাকায়, এরপর বলে, ‘মধ্যাহ্নে আমি, নীলধ্বজ আর কীচক স্নানে যাচ্ছিলাম, যাবার সময় ভাবলাম এমন সুন্দর আশ্রম, আমাদেরই ভগিনীগণ এখানে শিক্ষা লাভ করে, একটু দেখে যাই। গিয়ে দেখি আশ্রম ছুটি হয়ে গেছে, কোনো শিক্ষার্থী নেই। গৃহের অভ্যন্তরে কেমন যেন শব্দ শুনতে পেলাম, তারপর বাতায়নে উঁকি দিয়ে আমরা যা দেখলাম, তাতে ঘৃণায় আমার গা গুলিয়ে উঠল, বিজ্ঞজনদের সামনে সে-কথা বলতেও লজ্জা লাগে।’

উদয়গিরি বলেন, ‘কী দেখেছ স্পষ্ট করে বলো।’

কেশব মাটির দিকে তাকায়, বলতে ইতস্তত করে। অনূকা কেশবের দিকে তাকিয়ে উপরের ঠোঁট দাঁতে চেপে ধরে। বিবাহের কিছুকাল পর সে যখন সত্যবাকের সংসার ছেড়ে আশ্রমে গিয়ে ওঠে, তারপর থেকে প্রায় নিত্যদিনই আশ্রমের আশপাশে ঘুর ঘুর করত কেশব, আশ্রমেও যেত। কেশবের উদ্দেশ্য যে ভালো নয় তা বুঝতে পারলেও কিছু বলত না অনূকা, কেননা নিজের প্রতি তার এই বিশ্বাস ছিল যে কেশব যদি অসৎ উদ্দেশ্যে তার ওপর চড়াও হয় তা প্রতিরোধ করবার শারীরিক সামর্থ্য তার আছে, কেশবও তা জানত বলেই তাকে একা পেয়েও কখনো তার ওপর শক্তি প্রয়োগ করার সাহস দেখায়নি। তারপর কেশব একদিন আশ্রমে গিয়ে অনূকার মুখোমুখি হয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব দেয়। অনূকা অবাক হয় না, সে শান্তস্বরে বলে, ‘জানো তো, আমার তীর নিক্ষেপের হাত খুব ভালো। আবার যদি কখনো তোমাকে আশ্রমে দেখি, ঠিক দুই ভ্রূ’র মাঝ বরাবর তীর বিঁধিয়ে দেব।’

তারপর থেকে কেশবকে আর কখনো আশ্রমে দেখেনি অনূকা। কিন্তু তার ওপর নিশ্চয় দৃষ্টি রাখত কেশব, কখন কে আশ্রমে আসত সব সংবাদ রাখত। শিক্ষার্থীদের ছুটির পর আশ্রমের এদিকটায় তেমন কেউ আসত না শশীয়তী ছাড়া। মাঝে মাঝে আঙিনাতেই সে আর শশীয়তী দুষ্টুমীতে মেতে উঠত, একে অন্যকে জড়িয়ে ধরত, চুম্বন করত। কেশসজ্জা করার সময়েও তারা খুঁনসুটিতে মেতে উঠত, অলিন্দে একজন আরেকজনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকত, একে অন্যকে আদর করত। দূর থেকে তাদের ভালোবাসার উদযাপন হয়ত দেখে থাকবে কেশব, আর দেখার পর থেকেই সে হয়ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। নইলে গৃহের অভ্যন্তরে তার আর শশীয়তীর মিলনের সময় কেশব আরো দুটি ব্রাহ্মণ যুবক নিয়ে উপস্থিত হলো কেমন করে!

কেশবকে ইতস্তত করতে দেখে উদয়গিরি আবার বলেন, ‘কালক্ষেপণ করছ কেন, কী দেখেছ সেটা বলো?’

‘আমরা আশ্রমে পা রাখতেই গৃহের ভেতর থেকে কারো কান্নার শব্দ পেলাম। দ্রুত বাতায়নের কাছে এগিয়ে গিয়ে গৃহের ভেতরে তাকিয়ে দেখি…।’

উদয়গিরির চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘কী দেখলে?’

‘দেখলাম অনূকা জোর করে শশীয়তীর যৌনাঙ্গে অঙ্গুলি প্রক্ষেপণ করছে, আর শশীয়তী ওর হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য ছটফট করে কাঁদছে।’

‘মিথ্যে কথা, নির্জলা মিথ্যে কথা! ও মিথ্যে কথা বলছে।’ প্রায় চিৎকার করে কেশবের কথার প্রতিবাদ করে অনূকা।
‘চুপ করো পাতকিনী!’ গর্জে ওঠেন উদয়গিরি।
‘বিশ্বাস করুন আপনারা, ও মিথ্যে কথা বলছে।’ দৃঢ়কণ্ঠে বলে অনূকা।

মনু শান্ত স্বরে বলেন, ‘অনূকা কেশবকে কথা বলতে দাও, তুমিও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে। বলো কেশব।’

কেশব আবার শুরু করে, ‘অনূকার নির্যাতনে শশীয়তীকে ব্যথায় কাতড়াতে দেখে আমাদের অন্তর কেঁদে ওঠে, আমরা দ্বার ঠেলে গৃহে ঢুকে শশীয়তীকে উদ্ধার করি আর ওই পাতকিনীকে ধরে নিয়ে এসে এখানে বেঁধে রেখে আপনাদেরকে সংবাদ দেই।’

অনূকা দু-দিকে মাথা নাড়ে। কেশবের পর নীলধ্বজ ও কীচকের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলে তারাও একই কথা বলে। অনূকা অগ্নিচোখে সাক্ষীত্রয়ের দিকে তাকিয়ে ওদের দিকে থু থু ছিটিয়ে বলে, ‘শকুনের দল, আমাকে খুবলে খেতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে বলছে! মিথ্যে কথা, মিথ্যে কথা, আপনারা ওদের কথা বিশ্বাস করবেন না।’

এবার মুখ খোলেন নৃপতি বেণ, ‘অনূকা, তুই বলছিস ওরা তোর নামে মিথ্যে কথা বলছে, তাহলে সত্যটা কী এবার তুই বল।’
‘আমি, আমি শশীকে স্নেহ করি, ভালোবাসি কাকাশ্রী। শশীর মঙ্গলের জন্য আমি নিজের জীবনও বিসর্জন দিতে পারি, তাহলে ওকে আমি নির্যাতন করবো কেন! আপনারা শশীকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন না, আমি ওকে নির্যাতন করেছি কী না?’

কেশব চিৎকার করে ওঠে, ‘ওই পাপাচারী মিথ্যে বলছে, ও শশীয়তীর যৌনাঙ্গে অঙ্গুলি প্রক্ষেপণ করেছে!’

বেণ রাগত চোখে কেশবের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমরা তোমার কথা শুনেছি কেশব, অনূকার কথার মধ্যে কথা বোলো না।’

অনূকা বেণের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দুজন মানুষ কিভাবে ভালোবাসবে, সেটা একান্তই তাদের দুজনের ব্যাপার, বাইরের মানুষের তাদের বাতায়নে উঁকি দেওয়া অন্যায়। হ্যাঁ, আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই- একজন স্বামী এবং একজন স্ত্রী যেমনি দুজন দুজনকে ভালোবাসে, আমি আর শশীও তেমনি দুজন দুজনকে ভালোবাসি কাকাশ্রী।’

উদয়গিরি যেন আঁৎকে ওঠেন! মনু, বেণ, এবং অন্যান্য ব্রাহ্মণ ও ঋষিদের দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বলেন, ‘শুনলেন আপনারা ওই পাতকিনীর কথা! দুজন কন্যা নাকি নিজেদেরকে স্বামী-স্ত্রীর মতো ভালবাসে! হে ঈশ্বর, এমন কথা শোনাও পাপ!’

প্রাচীরের বাইরের উৎসুক মানুষেরাও অবাক হয়, তাদের মধ্যে কানাকানি হয়, গুঞ্জন ওঠে। কেউ কেউ বলতে থাকে, ‘এই জন্যই সত্যবাকের মতো অমন ভালো পুত্রটির সঙ্গে সংসার না করে, আশ্রমে থাকে। আশ্রম চালানোর নামে এইসব নষ্টামী কাণ্ড করে।’

অনেকেই ছিঃ ছিঃ করতে থাকে এবং তা অনূকার কানেও পৌঁছায়, অনূকা বলে, ‘আপনারা ছিঃ ছিঃ করতে পারেন, আমাকে ঘৃণা করতে পারেন, আমার গায়ে থু থু ছিটাতে পারেন, এমনকি সবাই মিলে এখন আমাকে মেরেও ফেলতে পারেন। কিন্তু তার আগে আমাকে বলুন তো- মানুষ খুন করা, নিরীহ জাতিকে তাদের বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন কিংবা নারী হরণ করার চেয়েও কি দুটি নারী মনের ভালোবাসা কিংবা শরীরের মিলন অপরাধ? আরেকটি কথা আপনাদের জানানো দরকার, আমার অঙ্গটা নারীর, কিন্তু অন্তরটা পুরুষের। কোনো পুরুষ অঙ্গের প্রতি আমার আকর্ষণ নেই, আকর্ষণ নারীর প্রতি, বিষয়টি বুঝতে আমারও সময় লেগেছে। এজন্যই আমি বিবাহ করতে চাইছিলাম না, কিন্তু পরিবারের চাপে আমি সত্যবাককে বিবাহ করতে বাধ্য হই। কিন্তু বিবাহের পর একটি দিনের জন্যও না আমি সুখী ছিলাম, না সত্যবাককে সুখী করতে পেরেছি। এজন্যই সত্যবাককে আবার বিবাহ করতে বলে আমি আশ্রমে বাস করতে শুরু করি। আশ্রমে আসার পর আমার আর শশীর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, আমরা একজন আরেকজনের সুখে হাসি, একজন আরেকজনের দুঃখে কাঁদি। আমরা দুজন দুজনকে পেয়ে ভীষণ সুখে ছিলাম আজ মধ্যাহ্নে অন্যায়ভাবে আমাদের ওপর আক্রমণ চালানোর আগ পর্যন্ত। হে বিজ্ঞজন, দুজন মানুষের ভালোবাসা অন্যায় হতে পারে না, হোক সেই দুজন মানুষ নারী কিংবা পুরুষ। আমি আর শশী দুজন-দুজনকে ভালোবাসি, আমরা এই সমাজ কিংবা সমাজের মানুষের কোনো ক্ষতি করছি না। আমরা কেবল দুজন-দুজনকে ভালোবেসে শান্তিতে বাঁচতে চাই। হে বিজ্ঞজন, আপনারা আমাদের এই শান্তিতে বাঁচার অধিকারটুকু কেড়ে নেবেন না।’

শেষ বাক্যগুলো কাতরস্বরে বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনূকা। বিচার দেখতে আসা মানুষের ফিসফিসানিতে বোঝা যায় যে তারা কেউ এখনো অনূকাকে দণ্ড দেবার পক্ষে, অনূকার কথা শুনে কেউ দ্বিধান্বিত, কারো কারো চোখ ছলছল করে ওঠে আর ভাবে ঠিকই তো বলেছে অনূকা, দুজন নারী কিংবা দুজন পুরুষ ভালবেসে নিজেদের মতো থাকলে, তাতে সমাজের মানুষের কী! এই শেষোক্ত ভাবনার মানুষ সংখ্যায় খুব কম হলেও তারা মনে করে যে অনূকা আর শশীয়তী দুজন দুজনকে ভালোবাসে, ভালোবেসে ওরা যা-ই করুক না কেন তা করছিল গৃহের অভ্যন্তরে, সেখানে বাইরের লোকের উঁকি দেবার দরকার কী!

কিন্তু এই শেষোক্ত মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের ভাবনা আর শাস্ত্রজ্ঞ, সমাজপতি কিংবা সমাজের অধিকাংশ মানুষের ভাবনার মধ্যে পার্থক্য অনেক, এই মুষ্টিমেয় মানুষের ভাবনার কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে।

উদয়গিরি প্রথমে বেণ তারপর মনুর মুখে দৃষ্টি স্থির রেখে বলেন, ‘সবই তো শুনলেন আপনারা, ওই পাতকিনী নিজের মুখেই সব অপরাধ স্বীকার করলো। দুজন পুরুষ কিংবা দুজন নারীর ভালোবাসা কখনো ভালোবাসা নয়, এটা পাপ, ব্যাভিচার, অপরাধ। এই বিষয়ে সর্বজন সম্মানীত মনুর শাস্ত্রে বিধান আছে, ব্রাহ্মণ সমাজের পক্ষ থেকে মনু মহোদয়ের কাছে আমার নিবেদন এই যে তিনি শাস্ত্র অনুযায়ী বিধান দেবেন। আপনারা আমার সঙ্গে একমত তো?’

উদয়গিরি অন্য ব্রাহ্মণগণের দিকে তাকালে তারা সমস্বরে বলেন, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’

সবাই কৌতুহলী হয়ে মনুর দিকে তাকান তার বিধান শোনার জন্য। মনু গম্ভীর মুখে কয়েক মুহূর্ত মৌন থাকেন, তিনি যথেষ্ঠ বিব্রত, অনূকার প্রতি তার এক ধরনের প্রচ্ছন্ন স্নেহও ছিল, কিন্তু আজ তাকে স্নেহান্ধ হলে চলবে না, শাস্ত্রের বিধান সকলের সামনে সঠিকভাবে উপস্থাপন করাই তার দায়িত্ব। তার পূর্বের কোনো একজন মনু সমলিঙ্গে মিলনের শাস্তির বিধান দিয়ে গেছেন, পরবর্তী মনুগণ সেই বিধান অনুসরণ করেছেন, পূর্বজ মনুদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাকে একইভাবে অনুসরণ করতে হবে, এটাই রীতি।

মনুকে মৌন দেখে অনেকে ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে ওঠে, একজন ঋষি বলেন, ‘কালক্ষেপণ করবেন না মনু মহোদয়। এই পাপীষ্ঠার সম্মুখে উপবিষ্ট থাকাটাও অস্বস্তির, আপনি বিধান দিন, ওকে আমাদের সম্মুখ থেকে নিয়ে যাক।’

মনু ক্ষণিকের জন্য চোখ বন্ধ করেন, চোখ খুলে অনূকার দিকে মুহূর্তের জন্য একবার তাকিয়েই দৃষ্টি সরিয়ে প্রাচীরের বাইরের জনতার মাথার উপর দিয়ে শূন্যে তাকান, তারপর বার দুয়েক কাশি দিয়ে বলেন, ‘সমাজে ন্যায়, শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে আমার পূর্বজ মনুগণ কিছু শাস্ত্রীয় বিধান দিয়ে গেছেন, আমিও স্বল্প কিছু বিধান তৈরি করেছি। সেই শাস্ত্রীয় বিধান অনুযায়ী যে-কোনো অপরাধের দণ্ড সম্পর্কে নৃপতি এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে অবহিত করা আমার দায়িত্ব, আর সেই দণ্ড যাতে সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় তা দেখার দায়িত্ব নৃপতির। সমলিঙ্গে প্রেম বা বিবাহ প্রকৃতিবিরুদ্ধ; প্রকৃতির ধর্ম উৎপাদন, তাই ঈশ্বর সকল প্রজাতির প্রাণির মধ্যেই পুরুষ ও স্ত্রীজাতি সৃষ্টি করেছেন। পুরুষের জন্য পুরুষ বা স্ত্রীজাতির জন্য স্ত্রীজাতি নয়, পুরুষ এবং স্ত্রীজাতি একে অপরের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। শাস্ত্রে আছে- সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য স্ত্রীলোক ও সন্তান উৎপাদনার্থে পুরুষ সৃষ্ট হয়েছে। সুতরাং যা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, তা ধর্ম ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ; আর যা ধর্ম ও শাস্ত্রবিরুদ্ধ, তা সমাজবিরুদ্ধ। অনূকা একজন সাবালিকা স্ত্রীলোক, সাবালিকা স্ত্রীলোক হয়ে সে একজন নাবালিকা কন্যার সতীত্ব নষ্ট করেছে; যা ধর্ম ও শাস্ত্রমতে ব্যাভিচার, অপরাধ।’

মনু থামেন, বেণের দিকে তাকান, অনূকার দিকে তাকান। অনূকার কী দণ্ড হবে তা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে আর কৌতুহলে মনুর দিকে তাকিয়ে থাকেন অনেক মানুষ, অনূকার দণ্ড দেখার অপেক্ষায় আছে তারা। আবার কিছু মানুষের বুক দুরু দুরু কাঁপে অনূকার ক্ষতির আশঙ্কায়! বেণের বুকও কাঁপে, তাঁর অন্তর কাঁদেও।

মনু ঘোষণা করেন, ‘অনূকার অপরাধের দণ্ড সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা আছে- যে স্ত্রীলোক কন্যাকে অঙ্গুলি প্রক্ষেপে নষ্ট করে, তৎক্ষণাৎ তার মাথা ন্যাড়া করে তার দুইটি অঙ্গুলি কর্তন করতে হবে এবং তাকে গাধার পিঠে চড়িয়ে ঘোরানো হবে।’



(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৪:৩৫
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমিও যাবো একটু দূরে !!!!

লিখেছেন সেলিম আনোয়ার, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২২

আমিও যাবো একটু দূরে
যদিও নই ভবঘুরে
তবুও যাবো
একটু খানি অবসরে।
ব্যস্ততা মোর থাকবে ঠিকই
বদলাবে শুধু কর্ম প্রকৃতি
প্রয়োজনে করতে হয়
স্রষ্টা প্রেমে মগ্ন থেকে
তবেই যদি মুক্তি মেলে
সফলতা তো সবাই চায়
সফল হবার একই উপায়।
রসুলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×