somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দেবদ্রোহ (উপন্যাস: পর্ব- আটাশ)

১২ ই নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একুশ

মধ্যাহ্নের পর পর পুরুষেরা কেউ চাষের কাজ থেকে, কেউ পশুচারণ থেকে, কেউবা শিকার থেকে বাটীতে ফিরে স্নান সেরে আহারে বসে; আবার অনেকে আহার শেষ করে বিশ্রামরত; নারীরা গৃহকর্মে ব্যস্ত আর শিশু-কিশোররা নিজেদের মতো হই-হুল্লোর কিংবা খেলাধুলায় মত্ত; এমন সময় ঘোষকের ঢেঁড়া বাঁজতে শুরু করে। ঘোষকের ঢেঁড়া বাজানো মানেই নৃপতির পক্ষ থেকে নতুন কোনো বার্তা, নতুন কোনো যজ্ঞ কিংবা উৎসবের কথা ঘোষণা করা। বরারারের মতোই ঘোষককে দেখে নানা বয়সের মানুষ এগিয়ে গিয়ে পথের মধ্যে তাকে ঘিরে ধরে। ঘোষক অনবরত ঢেঁড়া বাজাতেই থাকেন, মানুষ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে, কিন্তু ঘোষক ঘোষণা শুরু না করে অনবরত বাজাতেই থাকেন দেখে একজন তরুণ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘ও ঘোষক, তোমার বাজনা শুনতে আসিনি, তোমার চেয়ে ঢের ভালো বাদক বহির্ষ্মতীতে আছে, যাদের বাজনা আমরা নিত্য সন্ধ্যায় শুনে থাকি, তুমি কী বলবে বলো দেখি!’

ঘোষক মৃদু হাসেন আর নেচে নেচে বাজাতেই থাকেন। আরেকজন প্রৌঢ় বলেন, ‘নাতিকে নিয়ে বৈদ্য’র বাটীতে যাব, যা বলবার তাড়াতারি বলো।’

একজন বৃদ্ধা বলেন, ‘আরে জানি জানি কী বলবে, ঐ পাতকিনী অনূকাটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, লজ্জায় মানুষকে মুখ দেখাবে কেমন করে, তাই হয়ত নিজেকে সলিল সমাধি দিয়েছে সরস্বতীর বুকে!’

তার কথায় কেউ কেউ সমর্থন করে, কেউ কেউ নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আজ প্রভাতের আলো ফোটার পর পরই বহির্ষ্মতীতে এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে যে অনূকাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সত্যবাকের কথায় জানা যায় যে, রাত্রে অনূকার গাত্রতাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল, বৈদ্যমশাইও ছিলেন অনেক রাত্রি পর্যন্ত। বৈদ্যমশাই চিকিৎসা দিয়ে গৃহে ফিরে যাবার পর সত্যবাক আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী আশী পালা করে গভীর রাত্রি পর্যন্ত অনূকার মাথায় জলপট্টি দেয় আর অনূকা অবিরাম প্রলাপ বকতে থাকে নিন্দ্রার ঘোর না আসা পর্যন্ত। গভীররাত্রে অনূকা নিদ্রায় আচ্ছন্ন হবার পর সত্যবাক নিজে জেগে থেকে আশীকে শয্যায় যেতে বলে। আশী শয্যায় যাবার পর অনেকক্ষণ জেগে ছিল সত্যবাক, কিন্তু শেষরাত্রে ক্লান্তির ভারে কখন যে সে অনূকার পাশেই নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তা বুঝতে পারেনি। ভোরভেলায় যখন তার নিদ্রা ভঙ্গ হয় দেখে অনূকা শয্যায় নেই! প্রথমে সে ভাবে অনূকা হয়ত বাইরে গেছে প্রকৃতির ডাকে সারা দিতে। সে বাইরে গিয়ে অনূকাকে ডাকতে থাকে, কিন্তু অনূকার সাড়া পাওয়া যায় না। ভাবে তাহলে নিশ্চয় অনূকা আশ্রমে গেছে, আশ্রমে গিয়েও অনূকাকে পায় না সে, এমনকি অনূকার অশ্বটিও দেখতে পায় না। তখনই বাটীতে ফিরে সবাইকে জানায় সত্যবাক, সবাই মিলে সারা বহির্ষ্মতীতে খোঁজে কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না অনূকাকে। বহির্ষ্মতীর বাইরেও নানা দিকে মানুষ পাঠানো হয় অনূকার সন্ধানে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত তার কোনো সংসাদ পাওয়া যায়নি।

ঘোষক ঢেঁড়ায় দ্রুত লয় তোলেন, তারপর তার হাতের কাঠি থেমে যায়, তিনি বলতে শুরু করেন- ‘ঘোষণা, ঘোষণা ঘোষণা….সিংহের ন্যায় সাহসী, পখতের অশ্বের ন্যায় দূরন্ত, ব্রহ্মাবর্তের মানবদের প্রিয় শাসক নৃপতি বেণ আজ থেকে ব্রাহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন!’

এই পর্যন্ত বলে ঘোষক দ্রুতলয়ে ঢেঁড়ায় কাঠির বারি দেন। কৌতুহলী মানুষ একে-অন্যের মুখের দিকে তাকায়, কানাকানি করে, আবার কৌতুহলী হয়ে তাকায় ঘোষকের দিকে, ঘোষক কী বলতে চান! ঘোষক আবার বলতে শুরু করেন, ‘নৃপতি বেণ বার্তা পাঠিয়েছেন যে, আজ থেকে তিনি স্বর্গের শাসন মান্য করবেন না, দেবপতি ইন্দ্রের আদেশ মান্য করবেন না, দেবপতিকে কোনো প্রকার কর প্রদান করবেন না। আজ থেকে ব্রহ্মাবর্তে যজ্ঞ নিষিদ্ধ, ব্রাহ্মণগণকে দান-দক্ষিণা করতে কেউ বাধ্য নয়। অব্রাহ্মণদের মতো ব্রাহ্মণদেরও ভূমি চাষ, পশুপালন ও পশুশিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। নৃপতি বেণের সাম্রাজ্যে মানুষের মধ্যে উঁচু-নিচু কোনো ভেদাভেদ থাকবে না। ব্রহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলেই তাদের অপরাধের জন্য একই রকম দণ্ড ভোগ করবে, আইনের শাসনের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য থাকবে না।’
এই পর্যন্ত বলার পর ব্রাহ্মণ তরুণ ভূপেশ তেড়ে গিয়ে ঘোষকের গালে চড় মারে, তার সঙ্গে এগিয়ে আসে আরো কয়েকজন ব্রাহ্মণ তরুণ। প্রচণ্ড জোরে চড় খেয়ে ঘোষক টলে যান, টাল সামনে নিজের গালে হাত দিয়ে কাতর স্বরে বলেন, ‘আমায় মারছ কেন! আমি কী দোষ করেছি?’

ভূপেশ বলে, ‘সন্ধে হতে এখনো ঢের বাকি, এরই মধ্যে সোমরস পান করে দেবপতি আর ব্রাহ্মণদের অসম্মান করে উল্টাপাল্ট কথা বলছ, এত বড় সাহস তোমার! এর জন্য কী দণ্ড হবে তোমার জানো?’

‘আমি কিঞ্চিৎ সোমরস পান করেছি বটে, কিন্তু মোটেও উল্টাপাল্টাও কিছু বলিনি। আমি যে আদেশ পেয়েছি, তাই ঘোষণা করছি। তুমি শুধু শুধু আমায় মারলে।’
‘কোন নির্বোধ মূর্খ তোমায় আদেশ দিয়েছে? কার এতবড় সাহস?’
‘যাঁর এই আদেশ দেবার অধিকার আছে, সাহস আর ক্ষমতা আছে, তিনিই দিয়েছেন।’
‘নাম বলো চটজলদি, নইলে সেই কূপকণ্ডুকের মুণ্ডচ্ছেদের আগে আমি তোমার মুণ্ডচ্ছেদ করব বলে দিচ্ছি!’

ঘোষক তেড়ে ওঠেন, ‘সেই দিন আর নেই, সেই দিন ভুলে যাও, আমার মুণ্ডচ্ছেদ করলে তোমার বংশের কারো ঘাড়ে একটা মুণ্ডও থাকবে না! আমাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং ব্রহ্মাবর্তের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা- নৃপতি বেণ।’

ঘোষক এবং ব্রাহ্মণ যুবকদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সকলেই যেন চমকে ওঠেন নাম শুনে, অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ঘোষকের দিকে তাকান তারা, যেন বেণ এই নির্দেশ দিতে পারেন না!

একজন ব্রাহ্মণ তরুণ ঘোষকের বাহু ধরে বলে, ‘তুমি নৃপতির নামে মিথ্যে বলছ!’
ঘোষক গর্জে ওঠেন, ‘তাহলে যাও, গিয়ে নৃপতির কাছে জিজ্ঞেস করো, আমার সময় ক্ষেপণ করছ কেন? ছাড়ো আমার বাহু।’
ঘোষক ধুলো ঝাড়ার মতো নিজের বাহু থেকে তরুণের হাত সরিয়ে দেন।

‘যাচ্ছি, তবে দেবপতি ইন্দ্রের দিব্যি দিয়ে বলছি- যদি তোমার কথা মিথ্যে হয়, তাহলে পাহাড় থেকে নিচে ছুড়ে ফেলে তোমায় হত্যা করব।’ ঘোষককে শাসায় তরুণ।

‘যাও, যাও; আমিও আসছি, আমার গালে চড় মারার জন্য শীঘ্রই তোমার বিচার হবে।’

অগ্নিচোখে ঘোষকের দিকে তাকায় ব্রাহ্মণ তরুণের দল। তারপর তারা ছুটতে থাকে নৃপতি বেণের বাটীর দিকে, তাদের পিছু নেয় নানা বয়সের কৌতুহলী ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় মানুষ, যারা এখনো বিভ্রান্ত, যাদের চোখে-মুখে এখনো এই অবিশ্বাস যে নৃপতি বেণ ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতার ঘোষণা দিতেই পারেন না, দেবগণ-ব্রাহ্মণগণকে অমান্য করার সাহস তাঁর নেই! ঘোষক একা দাঁড়িয়ে ছুটন্ত মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসেন, তারপর বহির্ষ্মতীর অন্যান্য মানুষকে জানাতে আবার ঢেঁড়ায় বারি দিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ান- ‘ঘোষণা, ঘোষণা, ঘোষণা….।’


(চলবে.......)

সর্বশেষ এডিট : ১২ ই নভেম্বর, ২০২২ সকাল ১১:২৮
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×