নৃপতি বেণ, পুরাণের একজন প্রতিনায়ক এবং সনাতন ধর্মবিশ্বাসী যেসব মানুষ তাঁর সম্পর্কে জানেন, তাদের কাছে তিনি ঘৃণিত এক চরিত্র। কিন্তু কেন তিনি ঘৃণিত? কী তাঁর অপরাধ? তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে ঈশ্বরের আরাধনা কিংবা দেবতাদেরকে উৎসর্গ করে যজ্ঞ করলে কোনো ফল লাভ হয় না, প্রকৃতি ঈশ্বর কিংবা দেবপতি ইন্দ্র বা অন্য কোনো দেবতার নিয়ন্ত্রণে নয়; ঝড়, অতিবৃষ্টি কিংবা অনাবৃষ্টি, ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি দূর্যোগ প্রকৃতির আপন খেয়ালেই হয়; এসবের ওপরে কারো হাত নেই। একারণে দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের অনুশাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে তিনি তাঁর ‘ব্রহ্মাবর্ত’ নামক সাম্রাজ্য শাসন করতে চেয়েছিলেন। আর এজন্য তিনি ব্রহ্মাবর্তের মানুষের জন্য ক্ষতিকর মনুর বিধানসমূহ, বেদ, যজ্ঞ ইত্যাদি নিষিদ্ধ করেছিলেন; যা ছিল দেবতা ও ব্রাহ্মণদের জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেবতাদের নির্দেশে এবং ব্রাহ্মণদের তত্ত্বাবধানে সারা বৎসর ব্রহ্মাবর্তে অশ্বমেধ, কারীরী ইষ্টি, পুণ্ডরীক, সর্প ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার যজ্ঞ করা হতো; এসব যজ্ঞের হব্যি পেতেন দেবতা এবং ব্রাহ্মণগণ। এছাড়াও দেবতা এবং ব্রাহ্মণদেরকে সাধারণ মানুষের নিকট থেকে প্রাপ্ত করের ভাগ দিতে হতো। ফলে বেণ বিদ্রোহ করে মানুষের স্বার্থবিরোধী মনুর বিধানসমূহ এবং সকল প্রকার যজ্ঞ নিষিদ্ধ করায় ক্ষতিগ্রস্ত হন দেবতা ও ব্রাহ্মণরা। তারা বেণকে বিদ্রোহের পথ থেকে সরে আসার নির্দেশ দিলেও বেণ তা মান্য করেননি। ফলে দেবতা এবং ব্রাহ্মণরা নৃপতির পদ থেকে বেণকে উৎখাত করার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। সেই সমাজে দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নৃপতি হিসেবে দীর্ঘদিন টিকে থাকার মতো যথেষ্ট শক্তি হয়ত বেণের ছিল না; এছাড়া দেবতা এবং ব্রাহ্মণরা ঈশ্বর, পরকাল, শাস্ত্র ইত্যাদির ভয় দেখিয়ে কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করে বেণের বিরুদ্ধে খেপিয়েও তোলে। ফলে স্বাধীনভাবে সাম্রাজ্য শাসন করা বেণের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে।
কালের আবর্তে নৃপতি বেণের শাসনকালের অনেক অনেক শতাব্দী পরে মানুষ যখন উপলব্ধি করে যে, এইসব বৃহৎ যজ্ঞ করে সত্যিই কোনো ফল লাভ হয় না, তখন ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকে যজ্ঞ। মনুর বিধানেও আজকের সমাজ-দেশ পরিচালিত হয় না। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে- নৃপতি বেণ তাঁর সমকালের চেয়ে চিন্তায়, দর্শনে ও কর্মে অনেক এগিয়ে ছিলেন; তিনি কোনো ভুল কিংবা অপরাধ করেননি। তারপরও বেণ পুরাণে প্রতিনায়ক হয়েই আছেন এবং আজকের সমাজের মানুষ পুরাণ পড়ে তাঁকে ঘৃণা করে। সুদীর্ঘকাল যাবৎ বেণের নামটি ঘৃণিতভাবে বন্দী হয়ে আছে শাস্ত্রের কারাগারে, বন্দী করেছেন তৎকালীন শাস্ত্রকারগণ। বেণের সম্পর্কে জানার পর অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমার এই উপলব্ধি হয়েছে যে- বেণ নিরপরাধ, সাহসী, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এক চরিত্র। প্রতিনায়ক নয়, বেণ তাঁর সময়ের নায়ক। বর্তমান কালের একজন লেখক হিসেবে আমি দায়বোধ করেছি শাস্ত্রের কারাগার থেকে বেণকে মুক্তি দেবার জন্য; সেই দায়বোধ থেকেই লিখেছি উপন্যাস-‘দেবদ্রোহ।’
এই আখ্যান ইতিহাস নয়; পুরাণ থেকে কেবল বীজটি নিয়ে বেণকে কাণ্ডারী করে তৎকালীন সময়ের মানুষ, প্রকৃতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি, রাজনীতি, সমাজনীতি, দণ্ডনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়সমূহ নিয়ে আমি ভাসিয়েছি আমার কল্পনার ভেলা।
এই ২০২২ সালে বসে আমি আর্য-অনার্য বিতর্ক উসকে দিতে চাইনি, জাতিগত বিভাজন করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। কেননা হাজার হাজার বছর ধরে আর্য-অনার্য রক্তের সংমিশ্রণ যেমনি হয়েছে, তেমনি হয়েছে ধর্ম ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বর্তমানে যে ধর্ম ও সংস্কৃতি পালন করে তা নিখাঁদ আর্য কিংবা নিখাঁদ অনার্য ধর্ম ও সংস্কৃতি নয়, অনেক জাতি-গোষ্ঠীর মিলিত ধর্ম ও সংস্কৃতি। আমি কেবল শাস্ত্রের কারাগার থেকে নৃপতি বেণকে মুক্তি দিতে চেয়েছি, এবার পাঠকের পালা।
বইটি পাওয়া যাবে বইমেলায় পেন্ডুলামের স্টলে, অথবা পেন্ডুলামের ফেসবুক পেইজে অর্ডার করে।
পেন্ডুলাম পাবলিশার্স
স্টল: ৫৪২-৫৪৩
প্রচ্ছদশিল্পী: মিথুন রশীদ
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ দুপুর ১:১৬