somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবনের ধ্বংসস্তুপেও স্বপ্নের বীজ বুনে যাই

২২ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:০১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




টুপি-পাঞ্জাবী পরা ছেলেটার নাম সিয়াম, মাদ্রাসায় পড়ে, মাধ্যমিক স্কুলেও ভর্তি আছে। বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়ার দত্তপাড়ায় সাতআনী জমিদারবাড়ির কাছেই। সুনসান একটা গ্রাম, জমিদারবাড়ির পাশের রাস্তায় দাঁড়ালে কোনো বাড়ি দেখা যায় না, কেবল সবুজ মাঠ আর গাছপালা। মনে হয় যেন সেই কোন মহাভারতের যুগে আছি! এইসব গ্রাম পৌরাণিক উপন্যাস লেখার সময় আমার খুব কাজে লাগে। এইসব গ্রামের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি পৌঁছে যাই সূদূর অতীতের পথে, হাজার হাজার বছর আগের সভ্যতায়। দূরত্ব দূরীভূত হয়, আমি সেই সভ্যতার মানুষের সঙ্গে মিশে যাই, তাদের একজন হয়ে যাই। লিখি তাদের যাপিত জীবনের কর্ম, ধর্ম, লড়াই, সুখ-দুঃখের কথা।

সাতআনী জমিদারবাড়ির ভবনগুলো গাছপালায় জঙ্গলাকীর্ণ, রাস্তায় দাঁড়িয়ে রাতুল আর আমি জমিদারবাড়ির মূল ভবনগুলোর অবস্থান নিয়ে কথা বলতে বলতেই তিন রাস্তার মোড়ে সিয়ামকে পেয়ে যাই, তাকে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিই। সেও আমাদের সঙ্গে জমিদারবাড়িতে যায়। জমিদারবাড়ি সম্পর্কে নানারকম লোকগাঁথা, অন্ধবিশ্বাসের গল্প বলে। রাতুল ততক্ষণে জমিদারবাড়ির গহীনে হারিয়ে গেছে। আমি সামনের ভবন ও মন্দিরের ছবি তুলি, ভিডিও করি, আর সিয়ামের গল্প শুনি। ওর হাতে ক্যামেরা দিয়ে আমি সামনে দাঁড়িয়ে যাই। ওর ছবি তুলতে চাইলে বলে, ‘আমার ছবি তুলতে ভালো লাগে না।’

এই ভালো না লাগাটা যে ওর মাদ্রাসা শিক্ষার কারণে তা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। সিয়াম অতি ভদ্র এবং বিনয়ী ছেলে। পূর্বে যত মাদ্রাসার শিশুদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি, তারা ভদ্র এবং বিনয়ী। জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত, ছবি, ভাস্কর্য ইত্যাদি সিনেমা এসব বিষয়ে যখন নানা প্রশ্ন করেছি; তারা সরলতামাখা সত্য কথা বলেছে। জানিয়েছে এসব তারা পছন্দ করে না, হুজুররা নিষেধ করেছে। জিজ্ঞেস করেছি যে- ‘তোমাদের সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেটার হতে ইচ্ছে করে না?’ কিংবা ‘অমুকের মতো সিনেমার নায়ক হতে ইচ্ছে করে না?’

তারা লাজুক হাসি দিয়ে একে-অন্যের দিকে তাকিয়েছে। আমি তাদের মাঝে স্বপ্ন বুনে দেবার চেষ্টা করেছি- তারা যে চাইলেই খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক, লেখক হতে পারবে সেই স্বপ্ন। তাদেরকে মাদ্রাসা ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হবার পরামর্শও দিয়েছি।

সিয়ামের ক্ষেত্রেও তাই করি, অনেক কথা বলি। মাদ্রাসা ছেড়ে কেবল স্কুলে পড়ার পরামর্শ দিই। মুফতি মাসুদকে চেনে কি না জানতে চাই, চেনে না। বলি- ‘মুফতি মাসুদ মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন, তার ভিডিও দেখবা ইউটিউবে-ফেসবুকে।’

সে জানায় যে তার বাটন ফোন। অনেক কথার শেষে কিছু কথা আবারও ‍পুনরাবৃত্তি করি, ‘শোনো, তোমার নিজের মনে যা ভালো লাগে তাই করবে, যা হতে ইচ্ছে করবে তাই হবে। শুধু অন্যের ক্ষতিসাধান করবে না, অপরাধমুলক কাজ করবে না। জীবন তোমার, কোনো ধর্মগুরু বা ধর্মীয় পুস্তক নয়, তোমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করবে না। এই যে তুমি ছবি তুলতে চাইছো না, তোমার এই ইনোসেন্ট বয়সটা কিন্তু আগামীতে থাকবে না। প্রতিদিন তোমার চেহারা একটু একটু করে বদলে যাবে। তাই ছবি তুলবে, জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি তুলে রাখবে, স্মৃতি ধরে রাখবে, বৃদ্ধ বয়সে এসব দেখবে আর স্মৃতিচারণ করবে।’

রাতুল এসে আমার আর ওর কথপোকথন শুনে একটা জটিল বাক্য বলে যাতে সিয়ামের বুঝতে অসুবিধা হয়, বাক্যের অর্থ এই দাঁড়ায় যে- ‘ভাই, আপনি মরুভূমিতে জলসিঞ্চনের বৃথা চেষ্টা করছেন!’

রাতুলকে বলি, ‘শোনো, আমি সবকিছুর মধ্যে সম্ভাবনা দেখি, সুপ্ত সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। জীবনের ধ্বংসস্তুপেও স্বপ্নের বীজ বুনে যাই। তাতে যদি একজনও আলোর পথে আসে, সেখানেই সার্থকতা।’

ভাবুন তো-এককোটির উপরে মাদ্রাসা শিক্ষার্থী, কী বিপুল অপচয়, কত সম্ভাবনার অপমৃত্যু! স্কুলে পড়লে আর ধর্মের বিষ গ্রাস না করলে এদের কারো হাতেই হয়ত বেজে উঠত- সারোদ, সেতার, দোতারা, বাঁশির সুমধুর সুর! কেউ হয়ত লেখক হতো, কেউ বিজ্ঞানী, কেউবা গবেষক, কেউবা অভিনেতা বা খেলোয়াড়!

অথচ প্রতিভার কী অপমৃত্যু, জীবনের কী অপচয়। আজকের এই কোমলমতি শিশুরাই একদিন ভয়ংকর হায়েনা হয়ে উঠবে, কেউ কেউ শিশু বালাৎকার করবে, কেউ নারীদের পোশাক ও কর্মময় জীবন নিয়ে কটুক্তি করবে, কেউ চাপাতি হাতে তুলে নেবে, মানুষ হত্যা করতে একটুও হাত কাঁপবে না!

তারপরও সিয়াম নিজের ছবি তোলে না। আমাকে জমিদারবাড়িগুলো ঘুরে ঘুরে দেখায়, জঙ্গলাকীর্ণ হওয়ায় আমার একটু ভয় ভয় লাগলেও সে আমাকে সাহস দিয়ে কয়েকটি ভবনের ছাদে নিয়ে যায়। ভিডিও ধারণ ও ছবি তুলে দেয়। আমার ভয় বলতে সাপের ভয়! শুনে ও বলে, ‘কিছু হবে না। আমি একা কত আসি। আমার আব্বা এই রাস্তা দিয়ে যাইতেই ভয় পায়, কিন্তু আমি একাই আসি, ভয় পাই না।’

ঘুরতে ঘুরতে একটা ভবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন নিচতলায় বিশাল এক গোখরা সাপের খোসা দেখতে পাই, আমি এগোতে সাহস না পেলে সে অভয় দিয়ে বলে, ‘কিচ্ছু হবে না, আসেন।’

বলি, ‘তুমি একা এই বাড়ির ভেতরের দিকে আর এসো না।’

সে বলে, ‘আমার কিছু হবে না। সাপ আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’

সে জ্বীনে বিশ্বাস করে, তাবি-কবজে বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাসের জোরেই তার এত সাহস। বলি, ‘শোনো, জ্বীন বলে কিছু নেই, তাবিজ-কবজেও কোনো কাজ হবে না। সাপ কামড়ালে এখান থেকে হাসপাতালে নেবারও সময় পাওয়া যাবে না।’

একফাঁকে সে নামাজ পড়ে আবার ফিরে আসে, জমিদারবাড়ি থেকে বের হবার আগ মুহূর্তে যখন ড্রোন শট নিচ্ছি, গ্রামের একদল ছেলে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল, তারা এসে ভিড় জমায়। ড্রোন নামানোর সময় সবাইকে বলি, ‘আসো আমরা সবাই মিলে একটা ছবি তুলি।’

আগে ছবি তুলতে না চাইলেও ফ্রেমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সিয়াম এবার নিজে থেকে এসেই আমার পাশে দাঁড়ায়। এই জন্যই আমি সম্ভাবনা দেখি, ওদের কাঁদামাটির মতো মনে স্বপ্নের বীজ বুনে দেই।


২২ আগস্ট, ২০২৫
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:০১
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×