somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃহত্তর রংপুরের লোকসঙ্গীত

০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“বৃহত্তর রংপুরের লোকসঙ্গীত”

ভূমিকা:
রংপুর জেলার লোকসংস্কৃতির মূল প্রবাহ রাজবংশী সংস্কৃতি। এই জনপদের বিপুল জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনে আছে বর্ণময় ও বৈচিত্র্যময় রুপ। রংপুর জেলার লোকনাটক, লোকসঙ্গীত, লোকছড়া, লোকপ্রবাদ-প্রবচন, লোকধাঁধা, লোকাচার, লোকদেবতা, লোকপোষাক, লোকখাদ্য, লোকপুরাণ, লোকধর্ম, লোকনৃত্যসহ লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় স্থান পেয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের যুগযুগান্তরের ভাবনা ও আবেগ। রংপুর জেলার লোকসাহিত্যের এইসব বৈচিত্রময় উপাদপান যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে পারলে উঠে আসবে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও লোকসংস্কৃতির বর্ণময় রুপ। লোকসাহিত্য লোকায়ত জীবন ও মানসেরই প্রতিচ্ছবি।যে কোন ভাষার প্রবহমান প্রাণশক্তিকে ধারণ করতে পারে কেবল সিলেবলিক ছন্দ, সুর, তাল, লয় সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীতগুলো। কেননা সাধারণের প্রয়োজনে স্বতস্ফূর্ত এক ছন্দে রচিত হয়েছিল এ লোকসঙ্গীত গুলো। ছন্দের এই স্বতস্ফূর্ততাই লোকসঙ্গীতগুলোকে করেছে যুগোত্তীর্ণ। তাছাড়া গভীর কোন ভাবার্থ নয়, লোকসঙ্গীতের বিষয় হচ্ছে জীবনের আনন্দ। জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে এ আনন্দ পরিবেশিত হয়। আনন্দের এই সার্বজনীনতা রংপুরের লোকসঙ্গীতকে ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র এবং এর মধ্যে প্রবেশ করেছে বর্ণিল বৈচিত্র্য্য। লোকসঙ্গীত একটা স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে লোকসাহিত্যে। এ অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে কৃষিক্ষেত্রে লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া আর কিষাণি গানে প্রভাব পড়েছে বেশি। এ অঞ্চলের অনেক মানুষের একদিকে নদনদী জীবিকার উৎস হলেও অপরদিকে নদী তীরবর্তী সিংহভাগ মানুষের জীবনে তা মূর্তিমান অভিশাপ। লোকসঙ্গীতে নদনদীর এই অভিশাপের প্রভাব লক্ষণীয়। এ ছাড়া এ অঞ্চলের ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া প্রধান আকর্ষণ ও আনন্দ হলেও এর পিছনে উঠে এসেছে স্বপ্ন ভঙ্গ ও বেদনার কথা। সেই বেদনা অন্তরের গভীরে গোপন রেখে এই অঞ্চলের মানুষ লোকসঙ্গীত, ভাওয়াইয়া, রাখালী আর কিষাণি গান গায় অবলীলায়। খেতে খামারে কৃষি কাজে এবং অবসরে উঠানে বসে লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া, রাখালী আর কিষাণি গানের আসর জমিয়ে তোলে গায়কেরা। এ অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গান ছাড়াও পালা গান, কেচ্ছা বন্দি গান, রাজা মানিক চাঁদ, গুপিচাঁদ. রাজমাতা ময়নামতির স্মৃতিমাখা গানেও তারা জমিয়ে তোলে খেত খামার কিংবা উঠানের আসর। বর্ষাকালে নদনদীতে পানি ভরে উঠলে নৌকা বাইচে সারি গান আর জারি গান তাদের মহাবিষ্ট করে। এমনো এক সময় ছিল সারা রাত জেগে শুনতো জাগের গান, পালাগান, যোগীর গান, মোনাই যাত্রা, ভাসান যাত্রা, কৃষ্ণলীলা, বেহুলা ও বালা লক্ষ্মীন্দরের গান, মলিশী, ও ছোকরা নাচের গান। এ অঞ্চলের সেই সব সংস্কৃতি আজ কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত প্রায়।

রংপুরের ভৌগলিক পরিস্থিতি ও অবস্থান:
স্থানাঙ্ক: ২৫.৬০ক্ক উত্তর ৮৯.২৫ক্ক পূর্বস্থানাঙ্ক: ২৫.৬০ক্ক উত্তর ৮৯.২৫ক্ক পূর্ব । বিভাগ: রংপুর বিভাগ, আয়তন: মোট ২৩০৭.৭৮ কিমি২ (৮৯১.০৪ বর্গমাইল), জনসংখ্যা: (২০১৪) মোট ৪৫,৩৪,৩৬৫, ঘনত্ব: ২১০০কিমি (২৮০০ বর্গমাইল), স্বাক্ষরতার হার: মোট ২৬.৭%, পোস্ট কোড: ৫৪০০। রংপুর জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল ও বিভাগীয় শহর। রংপুর জেলা ২৫০০৩˝থেকে ২৯০৩২˝ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ পর্যন্ত বিস্তৃত। মোট আয়তন ২৩০৮ বর্গ কিমি। আটটি উপজেলা, ইউনিয়ন ৩৮টি, ১৪৫৫টি মৌজা এবং ১ টি সিটি কর্পোরেশন ৩টি পৌরসভা নিয়ে রংপুর জেলা গঠিত। রংপুর জেলার উত্তরে লালমনিরহাট ও তিস্তা নদী, দক্ষিণে গাইবান্ধা ও দিনাজপুর জেলা, পূর্বে গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট এবং পশ্চিমে দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলা অবস্থিত। তিস্তা নদী উত্তর ও উত্তর পূর্ব সীমা পর্যন্তকে লালমনির হাট এবং কুড়িগ্রাম জেলা থেকে আলাদা করেছে। রংপুর জেলাকে বৃহত্তর বঙ্গপ্লাবন ভূমির অংশ মনে করা হয়। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর গঠন দেশের অন্যান্য জেলা থেকে আলাদা। এ জেলার ভূগঠন অতীতে উত্তরাঞ্চল প্রবাহমান কয়েকটি নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং ভূকম্পনজনিত ভুমি উত্তোলনের সাথে জড়িত। তিস্তা নদীর আদি গতিপথ পরিবর্তন ছিল রংপুর জেলার ভূমি গঠনের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তিস্তা নদী ১৭৮৭ সালের পূর্বে গঙ্গানদীর একটি উপনদী ছিল। তিস্তা সিকিম বা হিমালয়ে পরিচিত রাংগু ১৭৮৭ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর জেলার নিকট আত্রাই এর সাথে মিলিত হয় নিম্ন গঙ্গা নদীতে পতিত হতো। ১৮শ শতকে তিস্তা, আত্রাই নদীর পথ ধরে গঙ্গা ও বিছিন্ন কিছু খাল বিলের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র, উভয়কিছু নদীর সাথে ঋতু ভিত্তিক সংযোগ করত। অপর নদী ধরলা তিস্তা থেকে নিম্ন হিমালয় অঞ্চল বৃহত্তর রংপুর জেলার পূর্ব দিক দিয়ে (বর্তমান কুড়িগ্রাম) ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে। ঘাঘট এ জেলার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ নদ। ঘাঘট তিস্তার গর্ভ থেকে উৎপন্ন হয় রংপুর জেলার মধ্য দিয়ে দক্ষিণে গাইবান্ধা জেলা অতিক্রম করে করতোয়া নদীতে পতিত হয়। আত্রাই নদী এ সময়করতোয়া ও গঙ্গার মধ্যে সংযোগ রক্ষা করত।

রংপুরের লোকসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি:
‘লোক’ কোন ব্যাক্তি মানুষ নয়, গোষ্ঠী মানুষ। পল্লীর সহজ, সরল, সাধারণ মানুষের সাহিত্যই লোকসাহিত্য। লোকসাহিত্য মৌখিক সাহিত্য। এখানে ¯্রষ্টার পরিচয় একেবারেই গৌণ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ¯্রষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় না। প্রথমে ¯্রষ্টার দ্বারা কোন কিছু রচিত হলেও পরে তা হয়ে ওঠে সকলের সম্পদ। রংপুরের পল্লীর সহজ, সরল, সাধারণ মানুষের মতোই লোকসাহিত্য সহজ, সরল, অনাড়ম্বর ও আধুনিক হেঁয়ালি বর্জিত। রংপুরের বিপুল জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনে আছে বর্ণময় ও বৈচিত্র্যময় রুপ। রংপুর জেলার লোকনাটক, লোকসঙ্গীত, লোকলোকসঙ্গীত, লোকপ্রবাদন্ডপ্রবচন, লোকধাঁধা, লোকাচার, লোকদেবতা, লোকপোষাক, লোকখাদ্য, লোকপুরাণ, লোকধর্ম, লোকনৃত্যসহ লোকসাহিত্যের বিভিন্ন উপাদানে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনায় স্থান পেয়েছে এই অঞ্চলের মানুষের যুগযুগান্তরের ভাবনা ও আবেগ। রংপুর জেলার লোকসাহিত্যের এইসব বৈচিত্রময় উপাদপান যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে পারলে উঠে আসবে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয় ও লোকসংস্কৃতির বর্ণময় রুপ। লোকসাহিত্য লোকায়ত জীবন ও মানসেরই প্রতিচ্ছবি।

লোকসংস্কৃতির একটি বিশিষ্ট ও সবচেয়ে সমৃদ্ধ ধারা হচ্ছে লোকসাহিত্য। আমাদের লোকসাহিত্য তথা সামগ্রিকভাবে লোক-ঐতিহ্যের ভান্ডার অত্যন্ত ঋদ্ধ। লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে ফুটে ওঠে জাতির সামগ্রিক আত্মপরিচয়। জাতীয় জীবনের ইচ্ছা ও প্রত্যাশাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতি। জাতির সমগ্র মানসন্ডপ্রবণতা, জীবনধারা, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের জন্যে তাই লোকসাহিত্যের চর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। রংপুরের লোকসাহিত্যে শিল্পসৌন্দর্য, রস ও আনন্দবোধের ঘাটতি নেইা। লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্তধারা, এর মধ্য দিয়ে জাতির হৃদয়ন্ডস্পন্দন শোনা যায়। অসাম্প্রদায়িক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রেরণা বাঙালি লোকসাহিত্যের মর্মদর্শন থেকে পেয়েছে। রংপুরের লোকসাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের সৃষ্টি নয়, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের মিলিত সাধনা ও কর্মপ্রয়াসের সোনালি ফসল। রংপুরের অতুল বৈভবমন্ডিত লোকসাহিত্যের দিকে তাকালে মুগ্ধ ও বিস্মিত হতে হয়। লোকসঙ্গীত, লোকলোকসঙ্গীত, গীতিকা, লোকাহিনী, লোকনাট্য, প্রবাদন্ডপ্রবচন, ধাঁধাঁ প্রভৃতি শাখায় বিভক্ত রংপুরের লোকসাহিত্য।

লোকসঙ্গীত কী?
লোকসঙ্গীত লোকমানস থেকে উদ্ভূত সঙ্গীত, যা সাধারণত শ্রুতি ও স্মৃতিকে নির্ভর করে বহমান থাকে। প্রাচীন নাথগীতিকা থেকে শুরু করে বর্তমান কালের বাউল, মরমিয়া ও দেহতত্ত্ব গানের রচয়িতাদের নাম-ভণিতায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ভাটিয়ালি ব্যক্তিচেতনাজাত একক কণ্ঠের গান হলেও ক্রমে তা লোকমুখে প্রচারিত হয়ে সমাজমানসে উত্তীর্ণ হয়। গীত, বাদ্য ও নৃত্য এই তিনের সমন্বিত রূপই হচ্ছে সঙ্গীত। এদিক থেকে লোকগীতি, লোকবাদ্য ও লোকনৃত্য এই তিনের সমন্বিত রূপকেই লোকসঙ্গীত বলা যায়। বাউল সঙ্গীত লোকসঙ্গীতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ, কারণ তা গীত, বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে পরিবেশিত হয়। বাংলা লোকসঙ্গীত বৈচিত্র্যময়। পল্লীর শ্রমজীবী জনমানসের সংস্কারগত চিন্তা-ভাবনা, বারোমাসে তেরো পার্বণের উৎসব-অনুষ্ঠান, জগৎ ও জীবন সম্পর্কে ঔৎসুক্য, বাংলার নিসর্গশোভা, নদী ও নৌকার রূপকাশ্রয়ী চিন্তা-চেতনা, দারিদ্র্য, সমাজের অন্যায়-অবিচার, নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রের অগ্নিমূল্য প্রভৃতি বিষয়গত বোধ ও অলৌকিক বিশ্বাসকে অবলম্বন করে গ্রামবাংলার মানুষ এ গান বেঁধেছে। তবে বাংলা লোকসঙ্গীতে লোকসংস্কারগত আচার-অনুষ্ঠানই প্রাধান্য পেয়েছে; সেই সঙ্গে নদী ও নৌকাকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে জগৎ ও জীবনের রূপকাশ্রয়ী অধ্যাত্মলোকের মরমি গান।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক বলে বাংলা লোকসঙ্গীতে ভাটিয়ালি সুরের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। প্রত্যেক দেশের জাতীয় চরিত্র যেমন প্রধানত তার নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠে, তেমনি লোকসঙ্গীতও প্রধানত দেশের প্রকৃতিকে অবলম্বন করে বিকাশ লাভ করে। বাংলাদেশের প্রকৃতি সকল অঞ্চলে এক নয় কোথাও নদীবিধৌত, কোথাও অরণ্যাকীর্ণ; আবার কোথাও নিরস প্রস্তরভূমি, কোথাও বা তরাই অঞ্চল। এসব কারণে লোকসঙ্গীতের সুর সর্বজনীন আবেদন সৃষ্টি করলেও তা মুখ্যত আঞ্চলিক; যেমন উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া, পূর্বাঞ্চলের ভাটিয়ালি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাউল-মারফতি ইত্যাদি। আবার বাংলাদেশ নদীমাতৃক হলেও বিভিন্ন অঞ্চলের নদ-নদীর প্রকৃতিতে পার্থক্য আছে; পদ্মা, মেঘনা, সুরমা ও ধলেশ্বরীর যে রূপ, মধুমতি, ইছামতি, ভৈরব প্রভৃতির রূপ তা থেকে ভিন্ন। সুতরাং নদ-নদীর সঙ্গে নানাভাবে জনসমাজের যে যোগসূত্র স্থাপিত হয়, তা বাংলাদেশের সর্বত্র এক রকম নয়। এ কারণে যে অঞ্চলের জীবনধারা যেভাবে গড়ে উঠেছে, সে অঞ্চলের লোকসঙ্গীতও সেভাবেই সৃষ্টি ও বিকশিত হয়েছে।

লোকসঙ্গীতের বৈশিষ্ট্য:
বাংলা লোকসঙ্গীতের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো:
ক. জনমানস থেকে এর উদ্ভব ও মৌখিকভাবে লোকসমাজে প্রচারিত;
খ. সম্মিলিত বা একক কণ্ঠে গীত হতে পারে;
গ. এর চর্চার জন্য নিয়মিত অনুশীলনের প্রয়োজন হয় না;
ঘ. সাধারণত নিরক্ষর মানুষ এর রচয়িতা বা সুরকার এবং সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই অকৃত্রিম হূদয়ের প্রকাশ ঘটে;
ঙ. সহজ ভাষা, আঞ্চলিক উচ্চারণ ও সুরের স্বতঃস্ফূর্ততা;
চ. কথা ও সুরের সম্মিলনে হূদয়গ্রাহী আবেদন;
ছ. সুরের আবেদন সর্বজনীন হলেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার স্বস্ব অঞ্চলকে চিহ্নিত করে;
জ. প্রকৃতি-নির্ভরতা নিসর্গ, প্রান্তর, নদী, নৌকা প্রভৃতি গ্রামীণ পরিবেশের বহুল ব্যবহার;
ঝ. দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, ব্যথা-বেদনার নিরাভরণ প্রকাশ;
ঞ. সহজ-স্বাভাবিক ছন্দের ব্যবহার এবং
ট. মানবিক প্রেমের বিরহ-মিলনজাত ভাবাবেগের প্রাবল্য।
লোকসঙ্গীতের সুরেও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। অধিকাংশ লোকসঙ্গীতের গঠনরীতির মূল ভঙ্গিমাটুকু থাকে পূর্বাঙ্গে। এদিক থেকে লোকসঙ্গীতকে মোটামুটিভাবে চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। প্রথম শ্রেণির সুর ‘সা রা মা পা’, দ্বিতীয় শ্রেণির ‘সা গা মা পা’, তৃতীয় শ্রেণির ‘সা রা গা পা’ এমনিভাবে আরোহণ করে এবং চতুর্থ শ্রেণির সুর ‘সা রা গা মা পা’ এমনিভাবে পঞ্চম পর্যন্ত সরলভাবে আরোহণ করে। সুরের এ বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, লোকসঙ্গীতে তা কঠোরভাবে পালন করা হয়। লোকসঙ্গীতের আরও দুটি দিক হলো: ক. সত্যিকার লিরিকধর্মী গান সুর ছাড়া শুধু কথায় যার গতি পঙ্গু, যেমন ভাটিয়ালি, বাউল ইত্যাদি এবং খ. এমন সব গান, যেগুলিকে সুর ছাড়া কেবল গানই নয়, কবিতা বলাও দুষ্কর, যেমন ভাটের গান।

বিশ্বের যাবতীয় লোকসঙ্গীতের মতো বাংলা লোকসঙ্গীতেও পাঁচ স্বরের (ঢ়বহঃধঃড়হরপ ংপধষব) ব্যবহার দেখা যায়; যেমন সীমান্ত প্রদেশের গারো, সাঁওতাল ও হাজংদের গান। তবে বাংলা লোকসঙ্গীতের স্বাতন্ত্র্য এর বিশিষ্ট রূপভঙ্গি ও সাত স্বরের বিশেষ ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কেবল সুরের দিক দিয়ে নয়, ছন্দের দিক দিয়েও এর মধ্যে নানা বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয় যে, রাগসঙ্গীতের উদ্ভবের পশ্চাতে রয়েছে এই লোকসঙ্গীত; আজও বহু রাগ-রাগিণীর নামকরণে এর সাক্ষ্য মেলে। আভের, সাবেরী, মালবী, কানাড়ী, পাহাড়ী, মাঢ়, বঙ্গাল প্রভৃতি জাতির নামের সঙ্গে বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর নামকরণ এই সত্যকেই পরিস্ফুট করে। অন্যদিকে বাংলা লোকসঙ্গীতে কোনো কোনো রাগসঙ্গীতেরও প্রভাব দেখা যায়। ঝিঁঝিট, দেশ, ভৈরবী, ভূপালি, বিভাস প্রভৃতি রাগের স্পর্শ বাংলার লোকসঙ্গীতকে মাধুর্যমন্ডিত করেছে। তবে বাংলা লোকসঙ্গীতে ভাটিয়ালি সুরেরই একচ্ছত্র আধিপত্য। ভাটিয়ালি সুরে যে স্বরের প্রয়োগ হয়, তা রাগসঙ্গীতের খাম্বাজ ও পিলু সুরের সমগোত্রীয়। কখনো কখনো ভীমপলশ্রী ও পটদীপ রাগের সঙ্গেও এর মিল লক্ষ করা যায়। ঠাট বিচারে খাম্বাজ ও কাফী ঠাটের সঙ্গে ভাটিয়ালির নিকট সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। ঝুমুরের সুরভঙ্গির মধ্যেও খাম্বাজ তথা পিলুর আমেজ আছে। বাউলের মধ্যে আছে বেহাগ, খাম্বাজ, ভৈরবী, বিলাবল প্রভৃতি রাগ-রাগিণীর প্রভাব। খাম্বাজ ও কাফী ঠাটের রাগ-রাগিণীর সঙ্গে বাংলা লোকসঙ্গীতের সুর-নৈকট্য রয়েছে।

বাংলা লোকসঙ্গীতে ঝিঁঝিট রাগের প্রভাব অনেকখানি। প্রায় সব লোকসঙ্গীত (বাউল, ভাটিয়ালি, সারি, মারফতি, মরমি প্রভৃতিতে), এমনকি কীর্তনেও এই রাগের স্বরগ্রাম বহুলভাবে ব্যবহূত হয়। ঝিঁঝিট রাগের দুটি রূপ: প্রথমটি মন্দ্র সপ্তকের ধৈবত পর্যন্ত গিয়ে থেমে যায় এবং তার স্বররূপ এরকম: সা রা মা/ পা মা গা রা সা ণ্ াধ্ াপ্/া প্ াধ্ াসা রা গা মা গা/ ধ্ াসা; আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে কশৌলি ঝিঁঝিট বা লোকগীতির ঝিঁঝিট, যার স্বররূপ: সা রা মা/ পা মা গা রা সা ণ্ াধ্/া ধ্ াসা সা রা গা, রা গা মা। উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ লোকসঙ্গীতেই স্থায়ী ও বাকি অন্তরাগুলির সুর একই রকম হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ গগন হরকরা রচিত একটি বিখ্যাত গানের উল্লেখ করা যায়। গানটির প্রথম পংক্তি হলো: ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।’ গানটির সুররূপে সাতটি শুদ্ধ স্বর এবং মাঝে মাঝে কোমল নিখাদের ব্যবহার হয়েছে। এ গানটিতে কশৌল ঝিঁঝিটের স্বরবিন্যাস ব্যবহূত হয়েছে। ভাটিয়ালিতে খুব বেশি প্রচলিত কশৌলি ঝিঁঝিটের সুররূপটি এরকম: সা রা মা, পা মা গা ধ্ াসা ণ্ াধ্,া ধ্ াসা সা রা গা, রা গা সা। এটি কেবল ভাটিয়ালিতেই নয়, লোকসঙ্গীতের সব ধারায়ই ব্যবহূত হয়।

লোকসুর বিশ্লেষণে স্বাভাবিকভাবেই তাল-লয় এবং ছন্দোবৈচিত্র্যের প্রসঙ্গ আসে। তাল-লয়ের দিক দিয়ে লোকসঙ্গীতকে দুভাগে ভাগ করা যায়: দ্রুত লয়ের, যেমন সারি ও ঝুমুর এবং বিলম্বিত লয়ের ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গের লোকসঙ্গীত, বিশেষ করে ভাওয়াইয়া বা চটকা কোনো বিষয়বস্ত্তকে নির্দেশ করে না, কেবল সুরের লয়কেই নির্দেশ করে। চটকা দ্রুত লয়ের, যাকে ঝুমুরের সঙ্গে তুলনা করা যায়; আর ভাওয়াইয়া বিলম্বিত লয়ের, যা ভাটিয়ালির সঙ্গে তুলনীয়। কখনও কখনও অবশ্য ভাটিয়ালি তালবিহীনভাবে অর্থাৎ বৈতালিকেও গাওয়া হয়।

বাংলা লোকসঙ্গীতের সুরগত বৈশিষ্ট্য অন্যান্য দেশের লোকসঙ্গীতের তুলনায় স্বতন্ত্র। অন্যান্য দেশের লোকসঙ্গীত দুই, তিন, চার বা পাঁচ স্বরের সমন্বয়ে গঠিত; কিন্তু বাংলা লোকসঙ্গীত এসব স্বরে গঠিত হলেও তাতে সাতটি স্বরের প্রাধান্য থাকে। সুরবৈচিত্র্যেও বাংলা লোকসঙ্গীত অনেক সমৃদ্ধ এবং একে আরও ঐশ্বর্যমন্ডিত করেছে রাগসঙ্গীত ও লোকসঙ্গীতের মিশ্রণ।

রংপুরের লোকসাহিত্যে লোকসঙ্গীতের অবস্থান:
রংপুরের লোকসাহিত্যে লোকসঙ্গীত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রংপুরের প্রচলিত লোকসঙ্গীতগুলোর মধ্যে আবহমান কালের প্রাঞ্জল সাহিত্যরূপ তাল, লয় ও সুর খুঁজে পাওয়া যায়। এ থেকে রংপুরের লোকসঙ্গীত প্রাচীনত্ব, গুরুত্ব ও মর্যাদা অনুধাবন করা যায়। যে কোন ভাষার প্রবহমান প্রাণশক্তিকে ধারণ করতে পারে কেবল সিলেবলিক ছন্দ, সুর, তাল, লয় সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীতগুলো। কেননা সাধারণের প্রয়োজনে স্বতস্ফূর্ত এক ছন্দে রচিত হয়েছিল এ লোকসঙ্গীত গুলো। ছন্দের এই স্বতস্ফূর্ততাই লোকসঙ্গীতগুলোকে করেছে যুগোত্তীর্ণ। তাছাড়া গভীর কোন ভাবার্থ নয়, লোকসঙ্গীতের বিষয় হচ্ছে জীবনের আনন্দ। জীবনের বিভিন্ন প্রয়োজনে এ আনন্দ পরিবেশিত হয়। আনন্দের এই সার্বজনীনতা রংপুরের লোকসঙ্গীতকে ছড়িয়ে দিয়েছে সর্বত্র এবং এর মধ্যে প্রবেশ করেছে বর্ণিল বৈচিত্র্য্য। লোকসঙ্গীত একটা স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে লোকসাহিত্যে।

ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়া কোনো এক সময় উত্তর বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়ে আজ দেশের শহর বন্দরেও পরিবেশিত হচ্ছে, হাজারো দর্শক শ্রোতার মাঝে করতালে। শুধু দেশে শহর বন্দরে নামি-দামি মঞ্চে নয়, বিদেশের মাটিতেও পরিবেশিত হচ্ছে ঢাক-ঢোল, বাঁশি আর দোতরার বোলে। শুধু তাই নয় আসামের গোয়ালপাড়া থেকে লন্ডনে বিবিসি'র বিশেষ অনুষ্ঠানমালায় মোহনীয় সুর ঐশ্বর্যে ভাওয়াইয়া পরিবেশিত হচ্ছে। সারা বিশ্বে শুনছে লাখ কোটি ভাওয়াইয়া দর্শক শ্রোতা। হিমালয়ের পাদদেশীয় তরাই অঞ্চল থেকে হাঁকাও গাড়ি চিলমারী বন্দর পর্যন্ত ভাওয়াইয়ার শেকড় শুধু বিস্তৃত থাকলেও এখন এর শেকড় চারিদিকে দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। 'ওকি গাড়ীয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ী তুমি চিলমারীর বন্দরে', কিংবা 'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে' ভাওয়াইয়া গানের এই সুরলীলা ভাওয়াইয়া প্রেমিক মানুষের মাঝে ক্ষণে ক্ষণে দোলা দেয়। গরুর গাড়ি কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলা থেকে প্রায় হারিয়ে গেলেও চিলমারী বন্দরে সেই গরুর গাড়ি আজ দেখা না মিললেও ভাওয়াইয়া গানে সেকালের আবহমান গ্রাম বাংলার সেই চিরায়ত লোকসংস্কৃতি বহমান। সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ, রূপ ঐশ্বর্য আর এ অঞ্চলের মানুষের সহজ-সরল জীবনযাত্রার নানা অনুষঙ্গ বাঙালি জাতিকে করে তুলেছে সংগীতপ্রবণ। আর তেমনি করে ভাওয়াইয়া সংগীতের মধ্যদিয়েই বাঙালির উত্তর বাংলার মানুষের আত্মপ্রকাশ। অনেকের মতে এ কথা সত্য যে, বাঙালির গান গাওয়ার শুরু ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত ভাওয়াইয়ার যাত্রা আদিকাল থেকে। শ্যামল সবুজ উত্তর বাংলার জনপদে বন বাগানে দোয়েল শ্যামা আর কোকিলের কুহু-কুহু ডাক। নদনদীতে মাঝির পাল তোলা নৌকা উজান টানে কিংবা দাঁড় টেনে পারাপার করে দুই পাড়ের মানুষ। যদিও এখন সেই সব পাল তোলা আর দাঁড় টানা নৌকা নেই, কালের বিবর্তনে এসব হারিয়ে গিয়ে যন্ত্রচালিত নৌকার পরিবর্তন হয়েছে। তারপরও নৌকায় করে জেলেদের জাল নিয়ে মাছ ধরা, দোতরা হাতে নিয়ে কৃষক আর রাখালদের ভাওয়াইয়া গান- ওকি গাড়িয়াল ভাই হাঁকাও গাড়ি তুমি চিলমারীর বন্দরে। এক সময়ের দুঃখ বেদনা ভরা আজ পরিবর্তনে আনন্দ আর হাসির মাঝে উত্তর বাংলার মানুষের হাসি কান্নার সাথে এ দুটিই বাঁধা। হাসির তুলনায় কান্না ভরা বেদনা উত্তর বাংলার মানুষের সেই যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুর অঞ্চলের মানুষের লোকজ সংস্কৃতি আজ বিলুপ্তির পথে। মানুষের জীবন চেতনা ও লোকজ সংস্কৃতি একই সূত্রে গাঁথা। তারপরেও প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণে এ অঞ্চলের মানুষের প্রকাশ ভঙ্গিতে কিছুটা হলেও লক্ষ্য করা যায়। বন্যা, খরা আর নদনদী ভাঙনে বিশেষ করে কুড়িগ্রাম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষ আজ বিপর্যস্ত। দারিদ্র্যতা আর হতাশা এ অঞ্চলের মানুষের নিত্যসঙ্গী। সর্বনাশা করালগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র নদ, তিস্তা ও ধরলা নদী গ্রাস করছে এ জেলার বৃহৎ এক জনপদ। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর নদনদী ভাঙনে দিশাহারা নীড় হারা এ এলাকার মানুষগুলো বর্তমানে জীবন সংগ্রামে ছুটছে রাজধানী ঢাকা বা তার পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে কলকারখানায় শ্রমিকের সেজে। মাসের পর মাস কাজ করে অর্থ উপার্জন করে নিজ ঠিকানার ফেরে নীড়ে।
এসব দুঃখ-বেদনা ভরা এ অঞ্চলের মানুষগুলোর মাঝে বিরাজিত থাকলেও অনেক আগ থেকেই লক্ষ্য করা গেছে কোথাও কোনো গায়ক কিংবা শিল্পীর ভাওয়াইয়া গানের আসর জমলে তা হয়ে ওঠে মানুষের অন্তরে এক আনন্দ। এ অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ার কারণে কৃষিক্ষেত্রে লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া আর কিষাণি গানে প্রভাব পড়েছে বেশি। এ অঞ্চলের অনেক মানুষের একদিকে নদনদী জীবিকার উৎস হলেও অপরদিকে নদী তীরবর্তী সিংহভাগ মানুষের জীবনে তা মূর্তিমান অভিশাপ। লোকসঙ্গীতে নদনদীর এই অভিশাপের প্রভাব লক্ষণীয়। এ ছাড়া এ অঞ্চলের ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া প্রধান আকর্ষণ ও আনন্দ হলেও এর পিছনে উঠে এসেছে স্বপ্ন ভঙ্গ ও বেদনার কথা। সেই বেদনা অন্তরের গভীরে গোপন রেখে এই অঞ্চলের মানুষ লোকসঙ্গীত, ভাওয়াইয়া, রাখালী আর কিষাণি গান গায় অবলীলায়। খেতে খামারে কৃষি কাজে এবং অবসরে উঠানে বসে লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া, রাখালী আর কিষাণি গানের আসর জমিয়ে তোলে গায়কেরা। এ অঞ্চলে ভাওয়াইয়া গান ছাড়াও পালা গান, কেচ্ছা বন্দি গান, রাজা মানিক চাঁদ, গুপিচাঁদ. রাজমাতা ময়নামতির স্মৃতিমাখা গানেও তারা জমিয়ে তোলে খেত খামার কিংবা উঠানের আসর। বর্ষাকালে নদনদীতে পানি ভরে উঠলে নৌকা বাইচে সারি গান আর জারি গান তাদের মহাবিষ্ট করে। এমনো এক সময় ছিল সারা রাত জেগে শুনতো জাগের গান, পালাগান, যোগীর গান, মোনাই যাত্রা, ভাসান যাত্রা, কৃষ্ণলীলা, বেহুলা ও বালা লক্ষ্মীন্দরের গান, মলিশী, ও ছোকরা নাচের গান। এ অঞ্চলের সেই সব সংস্কৃতি আজ কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত প্রায়।

উওর বাংলার প্রাচীন জনপদগুলোতে এখনো খুঁজে পাওয়া যায় প্রকৃতিভিত্তিক আঞ্চলিক বারো মাসি গান, নদনদীভিত্তিক ভাটিয়ালি, আর পালা গান। আরও পাওয়া যায় বাউল গান, কীর্ত্তন বন্দি, শ্যামা সংগীত গান, জারি ও সারি গান, মুর্শিদি, মারফতি, লালনগীতি, কবিগান, পল্লীগীতি, যাত্রাপালা, বিয়েরগীত, লাঠিখেলা, পুঁথিপাঠ, লোকনৃত্য, বৌ বস করা গান ও ধুয়া গান। এ ছাড়াও রয়েছে নিজস্ব ঘরনার গান, ছোকড়া নাচার গান, উদাসীনি গান এ অঞ্চলের মানুষকে আজও প্রবলভাবে উদ্ভাসিত করে। উত্তর বাংলা বিশেষ করে রংপুর অঞ্চল মূলত ভাওয়াইয়া প্রভাবিত অঞ্চল। যদিও গাড়িয়াল ভাই ও মইষাল বন্ধু আমাদের চারপাশের চেনা জানা কোনো কেউ নয়। তারপরেও ভাওয়াইয়া গানে উজ্জীবিত করে গাড়িয়াল ভাই ও মইষাল বন্ধু কাছের কোনো আপনজনকেই টেনে আনে। তাই ভাওয়াইয়া আমাদের ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এ ছাড়া ভাওয়াইয়ার কাছাকাছি 'উদাসিনী বলে দীর্ঘ সুরের এক ধরনের গান এ অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতি বলে মনে করা হয়। উওর বাংলার লোকসঙ্গীতের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নারীত্বের অবদমিত কামনার রূপ পুরুষ কণ্ঠে গীত হওয়া। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মতো উত্তর বাংলার প্রেমের গানেও রয়েছে বিরহ বেদনা। বহুল প্রচলিত ভাওয়াইয়া গানে তাই প্রকাশিত হয়, তিস্তা নদী উথাল পাতালরে ও মোর ভয়ে কান্দে হিয়া/ওরে আসিবার কথা দয়ার দাদা ও মোক নাইওর যাইবেরে নিয়া/ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে/ওরে গাড়িয়াল বন্ধুরে, বন্ধু ছাড়িয়া রইতে পারিনারে/পতিধন একনা কথা কবার চাউও, ভাইয়ের বাড়ি যাবার চাউও/ওরে পারা সীতা মোর আউলেল বাতাসে, ওরে বান্ধা সীতা মোর আউলেল বাতাসে/ থাক থাক থাক দেরারে তুই ভাবনা করিসনা তোর বাদে মুই জুড়িয়া থুইছো সুন্দরী কন্যা/ওরে কুতিবা যান মোর প্রাণের কালারে, ও কালা আসিবেন কোন বেলা। অপরদিকে বারো মাসি প্রকাশিত গানেও প্রস্ফুটিত 'বসন্তে বয়রে দক্ষিণা বাও/মিঠা মিঠা লাগে যুবতীর বয়সকালের আও/ একে তো বৈশাখ মাস জমিতে নালিতা শাক/ সব সখি খায় মোর মোখে তিতা/ এই মাস গেল সাধু না পুরালেন আঁশ/যুবতীর জীবন ধরি নামিল জ্যৈষ্ঠ মাস/ আইল আষাঢ় মাস গাঙ্গে ভরা পানি/ বাণিজ্য করবার গেলেন সাধু খবর নাইরে জানি'।

রংপুর জেলার লোকসঙ্গীতে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ:
লোক সাহিত্য ও লোক সংস্কৃতিতে রংপুরের অবদান অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আর এসব কর্মকান্ড সম্পাদিত হয়েছে রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায়। আঞ্চলিকতার দিক দিয়ে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালীর বিপরীত প্রান্তের লোকসঙ্গীত। ভাওয়াইয়া রংপুরের লোকসঙ্গীত ধারায় সর্বাপেক্ষা উজ্জবল ও সমৃদ্ধ শাখা। ভাওয়াইয়া সম্রাট আববাস উদ্দীন ১৯৫৪ সালে ভাওয়াইয়াকে বিশ্বদরবারে উপস্থাপিত করেন। ভাওয়াইয়া লোকসঙ্গীতের ধারায় এই অঞ্চলের গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন পেশার মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, প্রেম-ভালোবাসা, বিরহ-বেদনাকে আশ্রয় করে লোকের মুখে মুখে রচিত এবং বিপুল আবেদনময় সুরে বাঁশি ও দোতরার মতো বাদ্যযন্ত্র যোগে গীত হয়ে আসছে।

আঞ্চলিক নামানুসারে ভাওয়াইয়া ৫টি ধারায় বিভক্ত, ‘ভাব’ ‘ভাওয়া’, ‘বাওয়া’, ‘বাউদিয়া’ প্রভৃতি শব্দ হতে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি বলে গবেষকরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। উল্লেখ্যযোগ্য জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া-
১.ওকি গাড়িয়াল ভাই
২.কি ও কাজল ভোমরা
৩.তোরসা নদীর ধারে ধারে
৪.নাইওর ছাড়িয়া যেও মোর বন্ধু
৫.নদী না যাই ওরে বৈদ
৬.ফাঁন্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।

রংপুরের মেয়েলী গীত/বিয়ের গীত:
রংপুরের লোক সংস্কৃতি ও সঙ্গীতের ধারায় মেয়েলী গীত- বিয়ের গীত একটি উল্লেখযোগ্য । রংপুরের মেয়েলী গীত মেয়েলী আচার অনুষ্ঠানের অনেক বিষয় নিয়ে রচিত ও গীত। যেমন বিয়ে, সাধভক্ষন, অন্নপ্রাসন, নবজাতকের ক্ষ্রৌ কাজসহ বিয়ের বিভিন্ন পর্বকে ঘিরে এই গীতগুলো রচিত এবং নৃত্যযোগে আনন্দমুখরতার মধ্যদিয়ে গীত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।

রংপুরের লোক সঙ্গীতের ধারায় আরো আছে হুদমার গান, জগেরগান, যোগীর গান, গোয়ালীর গান, ক্ষ্যাপাগান, জারীগান, মালশা গান, পালাগান, বা কাহিনীগান লোকসঙ্গীত রংপুরের উল্লেখযোগ্য সঙ্গীত ধারা। এ ধারায় রয়েছে অসংখ্য পালাগান। যেমন, নসিমন সুন্দরীর পালা, গুনাইবিবি, অমমূলা কন্যা, নেকোবিবি, কলিরাজা, চিনুবিনু, আরো অনেক।

রংপুরের লোকসঙ্গীতের ধারায় আছে, রংপুরের ভাষায় ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন, ধাঁধা (শিল্কা) এই সঙ্গে আছে লোক বিশ্বাস রংপুরের কারু শিল্প-চারুশিল্প প্রশংসিত অবস্থায় ছিল, আর এগুলো হলোঃ শতরঞ্চি, পাটশিল্প, রেশম, তাঁত, মৃতশিল্প, নকশীকাথা, বাঁশশিল্প, কাঠশিল্প, কাসা-পিতল, লোহা শিল্প, ঢেঁকি শিল্প ইত্যাদি।

ভাওয়াইয়া:
ভাওয়াইয়া মূলত বাংলাদেশের রংপুর এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে ও আসামের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত এক প্রকার পল্লীগীতি। এসকল গানের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ গানগুলোতে স্থানীয় সংস্কৃতি, জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনাবলী ইত্যাদির সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে।

যেমনঃ গরুর গাড়ি চালক বা গাড়িয়ালকে উদ্দেশ্য করে বলছে -
ওকি গাড়িয়াল ভাই,
কত রব আমি পন্থের দিকে চাঞা রে।
যেদিন গাড়িয়া উজান যায়।
ভাবার্থ: প্রেমিকা ভাবালুতা ও প্রেম, প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা, বিরহ।
আবার রংপুরের ঐতিহ্যবাহী চিড়িয়াখানা নিয়েঃ
নিয়া ভাই একনা কতা কবার চাও,
অংপুর মুই যাবার চাও,
চিড়িয়াখানা দেখিয়া আনু হয়।

ভাওয়াইয়া কথার উৎপত্তি:
ভাওয়াইয়া কথাটির উৎপত্তি সম্পর্কে অনেক মতবাদ রয়েছে। ভাব(মনের অনুভূতি)>ভাও+ইয়া। অর্থাৎ, যে সমস্ত গানের মধ্য দিয়ে মনের অনুভূতি প্রকাশ করা হয়। ভাওয়াইয়া গানের আকরভূমি রংপুর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নদী-নালা কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন ছিল। আর গরুর গাড়ির গাড়োয়ান রাত্রে গাড়ি চলাবস্থায় বিরহ ভাবাবেগে কাতর হয়ে আপন মনে গান ধরে। উঁচু-নিচু রাস্তায় গাড়ির চাকা পড়লে তার গানের সুরে আধো-ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়ে। এই রকম সুরে ভাঙ্গা বা ভাঁজ পড়া গীতরীতিই 'ভাওয়াইয়া' গানে লক্ষণীয়। প্রেম-বিয়োয়োগে উদ্বেলিত গলার স্বর জড়িয়ে যেরকম হয়, সেরকম একটা সুরের ভাঁজ উঁচু স্বর হতে ক্রমশঃ নীচের দিকে নেমে আসে। সুরে ভাঁজ পড়া ভাওয়াইয়া গানের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। আব্বাসউদ্দিনকে 'ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট' বলা হয়। মাটির গান হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে ভাওয়াইয়া গানের। সেখানেও পিঠে-পুলির উৎসবেও এ গানের প্রভাব পড়েছে। তেমনি একটি হলোঃ- মনটাই মোর পিঠা খাবার চাই

নদীর পাড়ের লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া:
সুদুর অনুজ্জ্বল কুয়াশাচ্ছন অতীতে, যখন পৌরাণিক কাহিনী ও ইতিহাস হয়েছে একীভূত তখন থেকেই রঙ্গপুর অঞ্চল তথা এই কুড়িগ্রাম মহাভারত কালের প্রাচীন প্রাগজ্যোতিষ রাজ্য ও কালিকা পুরাণ এবং যোগিনীতন্ত্র কালের কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজা মহীরঙ্গ দানব শাসিত সেই কামরূপের অন্তর্ভুক্ত রঙ্গপুর, আজকের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চল। সুপ্রসন্ন ভাগ্যের সন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হতে ঢল নেমেছিল এ অঞ্চলে, অনেক জনগোষ্ঠী ও ভাষাভাষীদের। কালের প্রবাহে স্বাভাবিক নিয়মেই সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যময় লোককৃষ্টির। কর্ম ও পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে লোকমনে জন্ম নিয়েছে "ইচ্ছে ও স্বপ্নেরা"। কর্ম অবসরে সেই স্বপ্ন, ইচ্ছে আর অনুভূতিরা একাত্ম হয়ে এক সময়ে সুরের ডানায় ভর করে রূপলাভ করেছে লোকসঙ্গীতের।

নদী ও নারী হচ্ছে লোককৃষ্টির তথা লোকসঙ্গীতের অন্যতম প্রধান প্রদায়ক। নদী বা জলধারা হচ্ছে জীবনের প্রধান সঞ্চালক, আর নারী হচ্ছে জন জন্মদাত্রী প্রসূতি। খাদ্য ও জল এর কারণেই প্রাচীন জনপদ বা জনসভ্যতাগুলি গড়ে উঠতো নদ-নদী সমূহের অববাহিকার উর্বর অঞ্চলগুলিকে কেন্দ করে। আর সেই জনসভ্যতা লালনে প্রধান ভূমিকা ছিল নারীর। হয়তো সে কারণেই বিশ্বজুড়ে সকল লোককৃষ্টিতে পরিলক্ষিত হয় নদী ও নারীর এক অনস্বীকার্য সম্পৃক্ততা। নদী ও নারী ব্যতিরেকে জন গোষ্ঠীর বা অঞ্চলের কর্মজীবন বা শ্রমজীবিকার এবং পরিবেশের এক বিশাল প্রতিফলন রয়েছে লোককৃষ্টির গঠন শৈলীতে। সেজন্যই সম্ভবতঃ জীবিকার প্রকৃতি, ছন্দ, গতি, সঞ্চালিত হয় এতে। পরিবেশের রূপ, রং, রঙ্গ, গন্ধ, স্বাদ, লালিত্য, কাঠিন্য, বিষন্নতা, আশা, হতাশা, ইত্যাদি রঙ্গীন তুলির শেষ আঁচড় টানে লোককৃষ্টির কাঠামোতে। বাংলাদেশের উত্তর জনপদের বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের লোককৃষ্টির প্রাচীনতম ঐতিহ্যের অন্যতম একটি হচ্ছে লোকসঙ্গীত যা ভাওয়াইয়া নামে পরিচিত ও প্রশিদ্ধ। এতে মাটির গন্ধ ও হূদয়ের অনুভূতির এক অপূর্ব সংমিশ্রণ বিদ্যমান।

সুদূর অতীত হতেই গরু, মহিষ, হস্তীর লালন পালন ছিল (বৃটিশ গ্যাজেটিয়ার) এ অঞ্চলের অন্যতম পেশা। হস্তীর ব্যবহার হতো যুদ্ধে, ভারি বস্তু উত্তলন ও শিকার কার্যে। গরু-মহিষ ব্যবহূত হতো কৃষিকর্মে, দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যের উত্স হিসেবে। নিম্নভূমি ও চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ তৃণভূমি ছিল গবাদিপশুর চারণভূমি, নদী তীরবর্তী অঞ্চলে হাতী চরানো হত। এসব চারণভূমিই ছিলো বাত্সরিক চুক্তিবদ্ধ রাখাল, মৈশাল, মাহুতদের কর্মস্থল ও কর্মকালীন সাময়িক আবাস। লোকসঙ্গীত-ভাওয়াইয়ার বহুলাংশ জুড়ে রয়েছে এই কর্মজীবীদের হূদয়ের আবেগমথিত কাহিনী, বিরহ, ভালোলাগার কথা। বাদ যায়নি গৃহে ফেলে আসা তাদের অসহায় বিরহী নারীদের আর্তিকথা। এদের হূদয় ও কণ্ঠজুড়ে ছিল সেই "মুঁই নারী"দের অব্যক্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়া, সুখ-দুঃখ এর মর্মকথা। সে বিচারে সুদূর অতীতের নিরক্ষর এই লোকেরা ছিল আজকের নারী স্বার্থরক্ষকদের পথিকৃত্। প্রাচীন ভাওয়াইয়াগুলির অধিকাংশই নারী জীবনের পটভূমিতে রচিত, যদি'বা এগুলি পুরুষ লোকশিল্পীদের সৃষ্ট ও গীত। যাইহোক, কঠোর পরিশ্রমান্তে আকারী চাউলের ভাত ও বাথানের সহজলভ্য বকনা গরু-মহিষের দুধ খেয়ে ক্লান্ত বিরহী অবসরে এই রাখাল মৈশাল মাহুতদের কণ্ঠে একদা গুঞ্জরিত সুর ও বাণীই আজকের ভাওয়াইয়া তা নি:সন্দেহে বলা যায়। ভাওয়াইয়ার আদি বা অবিভক্ত অঞ্চল বলতে বলা যায় যে অঞ্চলগুলিতে রংপুরী বা রাজবংশী ফরধষবপঃ এ কথা বলা হতো সেগুলিকে। যেমন-রংপুর জেলা, নেটিভ স্টেট কুচবিহার, জলপাইগুড়ি জেলা, আসামের গোয়ালপাড়া জেলা ও দার্জিলিং তরাই অঞ্চল। বাংলাদেশের ভাওয়াইয়া অঞ্চল বলতে ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্যসমূহ বিচার্যে এনে বলা যায়Íবৃহত্তর রংপুর জেলা ও এর সংলগ্ন পার্শবর্তী জেলাসমূহের ততটুকু অঞ্চল যেখান পর্যন্ত রংপুরী উচ্চারণের প্রচলন আছে ও লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া ড়ৎধষষু ঃৎধহংসরঃঃবফ হয়েছে।

ভাওয়াইয়ার জন্মলগ্ন:
বিভিন্ন গবেষকদের কঠিন যুক্তিতর্ক সাপেক্ষে ১৩শ, হ'তে ১৫শ খৃষ্টাব্দের দিকে, ও অপেক্ষাকৃত সন্দেহাতীতভাবে ১৬শ খৃষ্টাব্দে। অনেকে মনে করেন চর্যাপদ কাল থেকেই ভাওয়াইয়ার জন্ম। কিন্তু এটাকে অকাট প্রমাণিত করা বোধ হয় কারো পক্ষে সম্ভব হয় নাই। প্রথমটি যে পদটির সঙ্গে অনেকেই ভাওয়াইয়ার ভাষার সঙ্গে মিল খোঁজে সেটি হলো "টালত মোর ঘর নাহি পড়বেসী । হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী" তিব্বতিতে টাল মানে শহর। আর যে সুরে এই পদটি গাওয়া হতো তাতে যে রাগের মিল আছে তা হলোÍপটমঞ্জরী। পটমঞ্জরীর স্বরবিন্যাস হচ্ছেÍবিলাবল ঠাটেÍসুদ্ধ নিখাদ এবং কাফি ঠাটেÍউভয় গান্ধার ও উভয় নিখাদ বিদ্যমান। প্রশ্ন হলো জীবিকাযুদ্ধে ক্লান্ত ভাওয়াইয়ার লোকশিল্পী কষ্ট করে কেন সুদ্ধ নিখাদ লাগাতে যাবে? তবে চর্যার ঞবীঃ-৬ এর "ÍÍÍ আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরীÍÍ।" র সঙ্গে অধুনালুপ্ত একটি প্রাচীন ভাওয়াইয়া যা পরবর্তীতে পদ্মপুরাণ লোকনাট্যের বিখ্যাত পয়ার এ পরিণত হয় "ÍÍÍ ধলা কৈতরের বাঁজরে বৈরী।" আর্তি উপস্থাপনার একটা মিল রয়েই যায়। একদা প্রাগজ্যোতিষের এ অঞ্চলটিতে যে নামেই হোক লোকসঙ্গীত ভাওয়াইয়া ছিল লোক-বসতি-লগ্ন থেকেই বলে আমার বিশ্বাস। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই লোকবসতি যেখানে থাকবে সঙ্গীত সেখানে জন্মলাভ করবেই, অন্তত মনোরঞ্জনের জন্য তো বটে। তখন এ অঞ্চলে সেই গান যে নামেই থাকুক না কেন, এ অঞ্চলের লোকদের জীবিকা, প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক পরিবেশ, আবহাওয়া, পশুপাখি, নদী, নারী, মন-মানসিকতা, ভাষা, উচ্চারণ ইত্যাদি সেই গানকে শুধুমাত্র এক কাঠামোতেই চালিত করতে পারে- তা হ'ল এই ভাওয়াইয়া। তবে হ্যাঁ, কালপ্রবাহে সকলকিছুর যেমন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় তেমনি হয়তো সেই লোকসঙ্গীত আর আজকের ভাওয়াইয়ার বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে কিছুটা হলেও পার্থক্য থাকতে পারে। মহাভারত-উত্তর কালপ্রবাহে ধীরে ধীরে ক্ষীরপাখ্যা হল দুধকুমার, লৌহিত্য ব্রহ্মপুত্র হল, ত্রিস্রোতা হল তিস্তা, সিতপ্রভা ধরলা হল, এ অঞ্চলের লোকসঙ্গীতের নামকরণ হলো-ভাওয়াইয়া। সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে হয়, ভাওয়াইয়া লোকসঙ্গীতটির জন্মলগ্ন আজ আর সঠিকভাবে উদঘাটন সম্ভবপর নয়।

ভাওয়াইয়া নামের উৎপত্তি?
(ক) ভাওয়াইয়া এসেছে ভাওয়া শব্দ থেকে। ভাওয়া মানে সেখানে বলা হয়েছে মহিষের নিচু চারণভূমি।
(খ) বাও (বাতাস) থেকে বা ভাও (ভাব) থেকে এসেছে ভাওয়াইয়া (ভাব>ভাও)।
(গ) বাউদিয়া বা বাউড়া থেকে এসেছে ভাওয়াইয়া।
(ঘ) বাওয়াইয়ার বিবর্তিত রূপ ভাওয়াইয়া।
(ঙ) উদাস হাওয়ার মতো এই সুরের মতো গতি, তাই এর এর নাম ভাওয়াইয়া।
(চ) যে গান মনকে উদাস করে বা মনকে ঘর ছাড়া করে সেই গানকে ভাওয়াইয়া বলে।
(ছ) ভাবে বিভোর প্রাণের স্বতস্ফূর্ত অভিব্যক্তি বলে এই গানগুলি ভাওয়াইয়া নামে খ্যাত।
(জ) ভাটির সঙ্গে সম্পর্কিত বা সম্বন্ধযুক্ত ভাটিয়ালি আর ভাওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত বা সম্বন্ধযুক্ত হচ্ছে ভাওয়াইয়া।

এ প্রসঙ্গে একটি প্রশ্নে উদয় হয় যে, "ভাওয়া" শব্দটি কোন গানে নেই কেন? 'বাথান' আছে 'নিধুয়া পাথার' আছে, আছে 'বিন্নাটারী', 'এলুয়া', 'কাশিয়া', 'দোলা', 'নলখাগড়া', 'বাওকুম্টা'ও বাদ যায় নাই। তবে কি 'ভাওয়া' নামক কথিত শব্দটি সেই সব লোকশিল্পীদের অশ্রুত ছিল, যেমন আমাদের অনেকের আছে। উল্লেখ্য: ভাওয়া শব্দটি আমার অশ্রুত, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, রতœাই, জালছিড়া, হলহলিয়া, ভাঙ্গামোড় ইত্যাদি নদী তীরের অনেক প্রবীণ লোকের নিকট হতেও এসম্পর্কে জানতে পারিনি। শব্দটি সেই আমার মতো তাদেরও অশ্রুত। যাই হোক গবেষকরা ভাওয়াইয়া নামকরণের উৎপত্তি কোথা থেকে সে বিষয়ে নিশ্চিত ও একমত হতে পারেন নাই কখনো। আর আমার মনে হয় এটা খুব বড় একটা ব্যাপার নয়।

''ভাওয়াইয়া" শব্দ তল্লাশ প্রাপ্ত তথ্যাদি:
ক) ১৯০৩ সালের পূর্ববর্তী সময়ে কোথাও ভাওয়াইয়া নামক শব্দটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় না; ১৯০৩ সালে গ্রীয়ারসনের লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়াতে প্রথম দুটি দৃশ্যত: ভাওয়াইয়া গানের বাণী, অঞ্চলের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত নামে প্রকাশিত হয়। এর পরবর্তী সময়ে এই লোকসঙ্গীতটি রঙ্গপুরের অন্য লোকসঙ্গীতগুলির প্রতি রঙ্গপুরসহ বাঙ্গালার তত্কালীন সাহিত্য প্রেমিকদের আগ্রহ জন্মায়। " ভাওয়াইয়া গান সর্বপ্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করে জর্জ গ্রীয়ার্সনের। তিনি ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তার গ্রন্থে স্থান দেন। এরপর ১৩১৫ বঙ্গাব্দে হরলাল দাস কুন্ড ও ১৩১৬ বঙ্গাব্দে যাদবেশ্বর তর্করতœ "রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষদ" পত্রিকায় ভাওয়াইয়া সম্পর্কে আলোচনা করেন"। বস্তুতঃ, প্রথম মুদ্রিত-প্রকাশিত ভাওয়াইয়াটি স্যার আব্রাহাম জর্জ গ্রীয়ার্সন ১৮৯৮ খৃ: এ সংগ্রহ করেন বলে ১৯০৩ সালে প্রকাশিত লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ভালউম-৫, খন্ড-১ এর পৃ: ১৮৫ তে উল্লেখ আছে। যাহা হউক, উপরোক্ত তথ্যসমূহ হতে প্রতীয়মান হয় যে, ভাঐয়া বা ভাওয়াইয়া শব্দটি বা নামকরণটি বঙ্গাব্দ ১৩১৫ সন (১৯০৮ খৃ:) এর পরবর্তীকালে উৎপত্তি বা ব্যাবহার হয়, এবং সম্ভবত: নামকরণটি আঞ্চলিক লোকসমাজ প্রদত্ত নয়। খ) বঙ্গাব্দ ১৩১৬ সনে, রঙ্গপুর সাহিত্য পরিষত্ পত্রিকায় (দ্বিতীয় সংখ্যা), শ্রী পঞ্চানন সরকার তাঁর "রঙ্গপুরের পুরাতন গ্রাম্য সঙ্গীত" নামীয় প্রবন্ধে উল্লেখ করেন ।

বৃহত্তর রংপুরের লোকসঙ্গীতের ভাবার্থ:
ভাওয়াইয়া গানের উৎপত্তির সময় নিয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ত্রয়োদশ অথবা চতুর্দশ শতকে ভাওয়াইয়া গানের জন্ম। এ গানের সমসাময়িক অন্যান্য সংগীত গবেষকরা সংগীত ও সাহিত্য বিশ্লেষণ শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, ভাওয়াইয়া গানের উদ্ভবকাল পঞ্চদশ থেকে ষোড়শ শতকে। ভাওয়াইয়া গানে আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী, ময়মনসিংহ গীতিকার প্রভাব দেখতে পাই এবং সে কারণেই আমরা ধারণা করি ভাওয়াইয়া সংগীত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বৈষ্ণব পদাবলী ও ময়মনসিংহ গীতিকার সমসাময়িক অথবা পরবর্তী রচনা। ভাওয়াইয়ার প্রধান সহযোগী বাদ্যযন্ত্র হচ্ছে- দোতরা ও বাঁশি। এছাড়া আরও ১৯ ধরনের লোকবাদ্যযন্ত্র আছে উত্তরাঞ্চলে। যেগুলো ভাওয়াইয়া সংগীতকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। যেমন- একতারা, করতাল, খাপী, মন্দিরা, সানাই, কাঁশি, ঢাক, ঝড়কা, কড়কা, খোল, ঢোল, আখরাই, খমক, মুখবাঁশি, বমবাঁশি, আড়বাঁশি, সারিন্দা, ব্যানা ও ঘুঙুর। কিছু বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান আছে। তাতে ভাবের কি উপকরণ আছে তা আমরা জানবো।

১. ওকি গাড়িয়াল ভাই.....
কত রব আমি পন্থের দিকে চায়ারে
যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়
নারীর মন মোর ঝইরা রয়রে
ওকি গাড়িয়াল ভাই
হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দরে

২. যেজন প্রেমের ভাব জানে না
তার সঙ্গে নাই লেনা দেনা
খাঁটি সোনা ছাড়িয়া যে নেয় নকল সোনা
সে জন সোনা চেনে না
ভাবার্থ: প্রেম-ভালোবাসাতেও লেনদেন সম্পর্কিত।

৩. বাওকুমটা বাতাস য্যামন ঘরিয়া ঘুরিয়া মরে
ওরে ওই মতন মোর গাড়ির চাকা পন্থে পন্থে ঘোরেরে
ওকি গাড়িয়াল মুই চলোং রাজপন্থে

৪. ওকি ও কাজল ভ্রমরারে
কোনদিন আসিবেন বন্ধু
কয়া যাও কয়া যাওরে
ভাবার্থ: প্রেমিকের প্রতি প্রশ্ন কবে ফিরে আসবেন? প্রেম, বিরহ ও আকুলতা।

৫. আজি ধীরে বোলাও গাড়িরে গাড়িয়াল
আস্তে বোলাও গাড়ি
আর এক নজর দেখিয়া ন্যাও মুঁই
দয়ার বাপের বাড়িরে
গাড়িয়াল আস্তে বোলাও গাড়ি।
বাপ ছাড়িনু, মাও ছাড়িনু, ছাড়নু ঘর ও বাড়ি
অল্প বয়সে ও মোর গাড়িয়াল
যাওঁছি শ্বশুরবাড়ি-
গাড়িয়াল আস্তে বোলাও গাড়ি।
ভাবার্থ : বাল্যবিবাহর ফলে বাবা মা ও পুরোনো বাড়ি-ঘর ছেড়ে যাওয়ার আকুলতা।



সার্বিক ভাবার্থ:
এ গানগুলোতে একজন বিরোহিনী নারীর প্রেমিক স্বামীর অপেক্ষায় কাতর হৃদয়ের আর্তি যেন গরুর গাড়ির চাকার শব্দে সৃষ্টি হয় এক করুণ আর্তনাদ। ঠিক প্রিয়ার আর্তচিৎকার যেন। মনের এ নিদারুণ ব্যথা গরুর গাড়ির চাকার শব্দে মিশে একাকার হয়ে বাতাস ভারী হয়ে আসে। আবার কখনও পাই উদাসী গাড়িয়ালের মানসিক অবস্থার বর্ণনা। সে বিচ্ছেদের হৃদয়স্পর্শী প্রকাশ এই ভাওয়াইয়া গানে। আঞ্চলিক শব্দের সফল ব্যবহারে যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য হতে পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ উত্তর জনপদের আঞ্চলিক ভাওয়াইয়া সংগীত। যা দেশ-কাল-পাত্র উত্তীর্ণ হয়ে আজ আমাদের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের একার নয়। তাই আমাদের দেশের সাহিত্যিক, গবেষক ও সংগীতজ্ঞ সমাজ এগিয়ে আসবেন এ ভাবসম্পদ সংরক্ষণ, সংগ্রহ, গবেষণা ও সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য। আজ ভাওয়াইয়া সংগীতের যে উত্তরণ ঘটেছে তার পেছনে রয়েছে অনেক জ্ঞানী, গুণী ও সংগীতজ্ঞের আপ্রাণ প্রচেষ্টা। যার দরুণ ভাওয়াইয়া গান আজ নদীকূলের দু’পাড়ের জনগণের মধ্যে থেকে এসে স্থান করে নিয়েছে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত শিক্ষিত মানুষের ড্রয়িংরুমে। আধুনিক মানুষের চেতনায় রোপণ করেছে লোকসংস্কৃতির বীজকে। আশার কথা, আধুনিক রুচিবোধসম্পন্ন মানুষের কাছেও আজ তুমুল জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া সংগীত। ভাওয়াইয়া গানকে জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ করতে মরহুম আব্বাস উদ্দিন ছাড়াও যে গুণী শিল্পীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন, তারা হলেন- মরহুম আব্দুল করিম, স্বর্গীয় হরলাল রায়, স্বর্গীয় মহেশ চন্দ্র রায়, মরহুম মকবুল আলী, মরহুম নমরুদ্দিন, মরহুম একেএম আব্দুল আজিজসহ আরও অনেকে। সেই ধারাবাহিকতায় দেশবরেণ্য কালজয়ী শিল্পী ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দিন আহমদ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে দরদি কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন ভাওয়াইয়া গান। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হলো, তিনিই প্রথম গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের খেটে খাওয়া অশিক্ষিত মানুষের মুখ থেকে তুলে এনে আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ভা-ারকে সমৃদ্ধ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

চট্কা গান
চট্কা গান উত্তরবঙ্গে প্রচলিত এক ধরণের লোকগীতি যা আসলে ভাটিয়ালি না ভাওয়াইয়া গানের অধপতিত বা অপভ্রংস রূপ। ভারতের কোচবিহার জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর জেলায় এই গানের জন্ম।চট্কা মূলত তাল প্রধান সুরে রচিত। হালকা তাল ও ছন্দে পরিবেশন করা হয়। এই গানে লঘু তাল এবং জলদ লয় ব্যবহার করা হয়। সেই কারণে দরিয়া গানের মতো প্রলম্বিত সুরের বিন্যাসের ধীরস্থির ভাব পাওয়া যায় না। চটকা ভাওয়াইয়াতে বিশেষ ঢং-এর দোতরার বাদনশৈলী পাওয়া যায়। দৈনন্দিন জীবনের নিতান্ত সাধারণ বিষয় এই গানের উপজীব্য। এই গানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগত কারণে সাধারণত উত্তর বাংলার শিল্পী ছাড়া এ গানের সুরসংযোজনা সম্ভব হয় না।
নামকরণ
গ্রাম্য কথায় চট শব্দের অর্থ তাড়াতাড়ি। এই চট শব্দটির স্ত্রীলিঙ্গান্তর করে ‘চটকা’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে।

চটকা ও ভাটিয়ালি
ভাওয়াইয়া গান দুই প্রকারের হয়ে থাকে।
দীর্ঘ সুরবিশিষ্ট
চটকা সুরবিশিষ্ট

দীর্ঘ সুর বিশিষ্ঠ গানে নর-নারীর, বিশেষত নবযৌবনাদের অনুরাগ, প্রেমপ্রীতি ও ভালোবাসার আবেদনই মূল উপজীব্য।অন্যদিকে চটকা এক প্রকার রঙ্গগীতি।এই গান চটুল ও দ্রুত তালের হয়ে থাকে। এই শ্রেণীর গানে যথেষ্ট হাস্যরসের উপাদান থাকে।

চটকা গানের উপজীব্য
চটকা গানের সংগীত রচনাকারেরা এই গানের মধ্য দিয়ে সাংসারিক জীবনে স্বামী-স্ত্রীর আশা-আকাক্সক্ষা, মনোমালিন্য, সন্তান-সন্ততি কামনা, সংসার জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত ইত্যাদি বিষয় ব্যক্ত করেন।

প্রকারভেদ:
মূলত এই গান দোতারা ভিত্তিক তাল অর্থাৎ বদন শৈলীকে বাজানো হয়। একে বিশুদ্ধ চটকা বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও আরো দুই ভাবে চটকা পরিবেশিত হয়।

খ্যামটা অঙ্গের চটকা:
এই অঙ্গের চটকা গানে নাগরিক গান অর্থাৎ জনজীবনের সাধারণ বিষয়ই হলো মূল উপজীব্য। অনেক সময় শাস্ত্রীয় ত্রিতাল ব্যবহার করা হয়। এই গানের চটুল দুলুনী অনুভব করা যায়, যার সাথে খ্যামটা গানের মিল পাওয়া যায়।
বাপুই চ্যাঙেরারে গাচোত চড়িয়া
দুইটা জলপই পাড়িয়া দে।


ঝুমুর চটকা:
দ্রুত ঝুমুর তালও অনেক সময় চটকায় ব্যবহার করা হয়। যেহুতু ঝুমুরটির প্রকৃতি দ্রুত দাদরার মতো। তাই এই ধরণের চটকা অতি দ্রুত তালে গাওয়া হয়। এই ধরণের গানের বাণীও চটুল।

ক্ষীরোল গান
দীর্ঘ সুর ও চটকা সুরের মিশ্রণে অপর এক শ্রেণীর গানও প্রচলিত, এটি ক্ষীরোল গান নামে পরিচিত।

উদাহরণ
ওরে পতিধন বাড়ি ছাড়িয়া না যান
পানিয়া মরা মোক মারিলু রে
ওরে কাইনের ম্যায়ার ঠসক বেশি
ব্যাড়ায় শালী টাড়ি টাড়ি
রংপুর জেলার আদিবাসী লোকসাহিত্য (পর্ব-চার)

আদিবাসী- লোকসঙ্গীত :
আদিবাসী লোকসাহিত্যের বিস্তৃত অংশ জুড়ে রয়েছে বৈচিত্রময় লোকসঙ্গীত। আদিবাসী সমাজ জীবনে চিরস্থায়ী সাংস্কৃতিক ঐত্যিহের নিদর্শন বিচিত্রধারার এসব লোকসঙ্গীতকে গবেষকরা লোকসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলে উলে¬খ করেছেন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নানা উৎসব-অনুষ্ঠান, পার্বণসহ প্রেম, প্রকৃতি, জীবন, জীবিকা ধর্ম-কর্ম, ইতিহাস-ঐতিহ্য সব কিছুই স্থান পেয়েছে আদিবাসী লোকসঙ্গীতের বিষয় ভাবনায়।

বৃহত্তর রংপুরের উৎসব অনুষ্ঠান কেন্দ্রিক লোকসঙ্গীত :
আদিবাসীরা স্বভাবগতভাবেই উৎসব-অনুষ্ঠান পাগল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে আদিম সমাজে নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে আনন্দ উৎসব করার রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে। একটি প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। আর এসব উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ বাদ্য-বাজনাসহ নাচ ও গান। রংপুরের আদিবাসীদের দৈনন্দিন ও সামাজিক জীবনের বিভিন্ন উৎসব- অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণকে ঘিরে এমন ধারা আজও প্রবহমান। মূলত: এদের সমাজে প্রচলিত নাচ-গানের মধ্য দিয়েই নিবেদিত হয় তাদের সকল প্রার্থনা, পূজা-অর্চ্চনা ইত্যাদি।আদিবাসী ওরাওঁ সমাজে প্রধান ৪টি পার্বণিক উৎসব পালিত হয়। ফাল্গুনে-ফাগুয়া, চৈত্রে সারহুল, ভাদ্রে-কারাম এবং কার্তিকে সোহরাই উৎসব। ফাগুয়া শুরু হয় ফাল্গুনী পূর্ণিমার রাত থেকে গায়ে আবীর মেখে। ফাল্গুনের পূর্ণ চন্দ্র ওরাওঁ নারী পুরুষদের মনে যে আনন্দ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে তার প্রকাশ ঘটে ফাগুয়ার দলবদ্ধ নাচ ও গানে-
‘খাদ্দি চান্দো হিওরে লাদনা
ফাগুন চান্দো হিওরে লাদনা
ভার চান্দো, চান্দোরে লাদনা
বিরিম চান্দো, হোড়স্ঃলেনা
খাঁহয়ান এরঃঅর হিওরে লাদনা
খেড়ঃ অন এরঃঅর হিত্তরে লাদনা
ভার চান্দো চান্দোরে লাদনা
বিরিম চান্দো হোড়সঃলেনা।’

ভাবার্থ : পূর্ণ চন্দ্রের আলোয় হৃদয় নৃত্য করছে। ফাল্গুনের চন্দ্রোদয়ে হৃদয় নৃত্য করছে। পূর্ণিমার চন্দ্রোদয়ে হৃদয় নৃত্য করছে। চন্দ্রের ক্ষীয়মানতায় হৃদয় ব্যাথাহত হচ্ছে। নববধূর আগমনে হৃদয় নৃত্য করছে। দেবর দর্শনে বধূর হৃদয় নৃত্য করছে। পূর্ণিমার চন্দ্রোদয় হৃদয় নৃত্য করছে; চন্দ্রের ক্ষীয়মানতায় হৃদয় ব্যাথাহত হচ্ছে।

চৈত্রে শুরু হয় ‘সারহুল’ উৎসব। কৃষিজীবি ওরাওঁ সমাজে এ উৎসবের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মূল উদ্দেশ্য বৃষ্টির আবাহন। বৃষ্টি না হলে ফসল উৎপাদন হয় না। চরম খাদ্যাভাবে অনেক মানুষ মারাও যায়। এজন্য পুরোহিত সমাজের কল্যাণ কামনা করে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা জানায়। খরা প্রপীড়িত গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার আহ্বান জানায়।

সারহুলের এমনি একটি গান-
‘কেতরনু তিখি ট্যাট্টিঃনু বিলি¬
একা দেওড়াস্ গুড়ঁমাঃ লাগদাস
জোঁখ দেওরাস তেলা বিসাহী
বলাবারী জিয়া কালঃই
বলবারী কাবা কালঃই
কিচরিন চাঁড়-অনঃ ভান্ডান সাজঃ অন্ঃ
ভোঙ্গায় পেলে¬া পারেতা মাঁইয়া
আনারি রাঃ আতনার তেঙ্গোর চিরঃ অবঃ।’

ভাবার্থ : কুলোতে চাল বেড়াতে আলো, কোন্ পুরোহিতের সোচ্চার আর্তি, যুবক পুরোহিতের সোচ্চার আর্তি যুবক পুরোহিতের হৃদয় কায় অকল্যাণের মুক্তি চায়; বলতে বলতে চলে যায়, বলতে বলতে বিদায় নেয়, পুটলি বহনে দ্বিধা নেই। কলস বাজানোর বাঁধা নেই, যুবতী তুমি পালিয়ে যাও। অন্য পারে চলে যাও, তোমরা যা গোপন করছো, অন্যরা তা প্রকাশ করছে।

কারাম উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ভাদ্র সংক্রান্তিতে, ভরা বর্ষাকালে। একে ভাদাই পরবও বলে। বর্ষার অবিশ্রান্ত ধারা ওরাওঁ রমনীদের কারাম উৎসবে যোগদানের জন্য উতলা করে তোলে। গানে ব্যক্ত হয় সেই অভিব্যক্তি-
‘কারামকা দিনে পানিকা বারিসায়
পানি ছোনে মোন পানি
নুঠ নুঠ ভাওয়াজি দিয়ানা বারু
নুঠ নুঠ ভাওয়াজি বাতি না বারু
চালা যাই কারামকা সেওয়া
খোচা ভোরকে চিরওয়া
মুঠা ভোরকে খিরওয়া
চালা যাই কারামকা সেওয়া
ডানা হাতে লোটা, বাওয়া হাতে চালন
চালা যাই কারামকা সেওয়া।’

ভাবার্থ : কারামের দিন মুষলধারায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিধারা চাঁদের আলোয় সোনার মত ঝিকমিক করছে। ওগো ভাবী, প্রদীপ জ্বালাও, ওগো ভাবী আলো জ্বালাও, চলো যাই কারাম পূজায়। কোছা ভরে চিড়া, মুষ্ঠি ভরে খিড়া নিয়ে চলো যাই কারাম পূজায়। ডান হাতে লোটা, বাম হাতে চালন নিয়া চলো যাই কারাম পূজায়।

কারাম মূলতঃ বৃক্ষপূজার উৎসব। বৃক্ষপূজার নানা আনুষ্ঠানিকতার এক পর্যায়ে সমবেত রমনীরা গান করে-
‘বুদুরাইয়া কাটালা কোটালা
নাওয়া কারামভারি
বাইনিগে চারিয়া বাইনি
ঝোকালা লোকালা
নাওয়া কারামভারি।’

ভাবার্থ : নতুন কারাম বৃক্ষের ডাল অতি পুলকের সঙ্গে কর্তন করে বোন চারিয়াকে বলেছে, এই নতুন কারাম ডালটাকে গ্রহণ কর।

কারাম উৎসবের শেষে ব্যথাভারাক্রান্ত হৃদয়ে ওরাওঁ সম্প্রদায়ের লোকেরা এ পূজায় ব্যবহৃত কারাম বৃক্ষের ডালগুলো নদীতে বিসর্জন দেয়। এসময় তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় করুণ ব্যথতুর সঙ্গীত :
‘এলুনা রাজাইকা কারাম
জোখার পেল¬ারিন্
কারারিজা বাইজকি
ইন্নাগা কালিয় কারাম
সাত সামুদ্দর গাঙ্গানু পারে কালয়।’

ভাবার্থ : হে কারাম! এতদিন তোমার আরাধনা উপলক্ষে নারী-পুরুষ সবাই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। আজ তোমাকে গঙ্গা বেয়ে সাত সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে হচ্ছে। আমরা তাই বিষাদ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছি।

কার্তিকের অমবস্যা উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় তিনদিন ব্যাপী ‘সোহরাই’ উৎসব। এজন্যে ওরাওঁ সমাজে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে সোহরাইকে স্বাগত জানাতে। গানে সেই প্রতীক্ষার পরিচয় পাওয়া যায়-
‘বুড়িয়া পুছে বুড়হাকে
বুড়হা পুছে বুড়িয়াকে
কাদিয়া বুড়িয়া হতেই সোহরাইরে।
ভাদো গেলেই আশ্বিন গেলেই
পারালেই কার্তিক মাস
আজকে বুড়িয়া লিপালে পাতালে
কাইলকে বুড়িয়া সোহরাই রে।
সেহে রাতি বামন রাজা
পূজা কারে সোহরাইরে।
ভাবার্থ : বুড়ি বুড়াকে জিজ্ঞাসা করছে, কোনদিন থেকে সোহরাই। ভাদ্র গেল আশ্বিন গেল কার্তিক মাস পরে গেল, কার্তিক মাস থেকেই সোহরাই। আজকে বুড়ি লেপা মোছা করছে, কালকে বুড়ি সোহরাই হবে, সেরাতে বামন রাজা সোহরাই পূজা সম্পন্ন করবে।

সোহরাই এর অর্থ গোয়াল পূজা গবাদি পশুর কল্যাণ কামনা এর উদ্দেশ্য। এজন্যে পূর্বদিন থেকেই গবাদি পশুর বিশেষ যতœ-পরিচর্যা ও সাজসজ্জা করা হয়। একটি গানে সে কথা বলা হয়েছে ঃ
‘কোন শিংয়ে লেবে বারদা তেলা সিদুঁরা
বায়া শিংয়ে লেবউ কিয়া ভরায়ারে।’
ভাবার্থ : (গরুকে জিজ্ঞেস করছে) কোন শিংয়ে তেল সিদুঁর নেবে। (উত্তরে বলছে) বাঁ শিংয়ে তেল সিদুঁর নেব।

গবাদিপশুর কল্যাণার্থে সবাই সাধ্যানুযায়ী আচার অনুষ্ঠান পালন করে। দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই ঘটা করে উৎসবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এই ব্যর্থতার বেদনা ধ্বনিত হয় তাদের প্রার্থনা সঙ্গীতে ঃ
‘ছোট সে সিমের গাড় লো
সে-ও সিমের বাড়লো আকাশে
দোনো মা আসি
দোনো মা লোচুমান
পাঁচো পুত্র বিষে ধনু গায় ওরে।’
ভাবার্থ : ছোট বেলায় যে শিমূল লাগালাম, সে শিমূল গাছও আকাশ ছুইলো, মা আমাদের বিদায় দাও, গরু মোষের কল্যাণ চাইছি মা, আমাদের তুমি বিদায় দাও।

আদিবাসী সমাজের যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যগত মাদক ‘হাড়িয়া’ পান থাকবেই। সোহরাই উৎসব শেষে চলে দলবদ্ধ হাড়িয়া পান, আর নাচ-গান। এই গানের মধ্যে ব্যক্ত হয় সেরা পানীয় পান করে রাজহাঁসের মত ডানা মেলে উড়বার বাসনা-
‘খোঁজতে খোঁজতে আলি
পুছতে পুছতে আলি
ফালনা কার ঘার কতই দূররে
ফালনা কার ঘার কতই দূররে
ফালনা কার ঘার
চল শিঠা পিয়াহো
উপরে যে ঘুরে রাজহাঁস।’
ভাবার্থ :
আমরা খুঁজতে খুঁজতে এলাম, পুছতে পুছতে এলাম, অমুকের বাড়ী কত দূর, চল অমুকের বাড়ী, সেখানে মদের সেরা অংশ (শিঠা) পান করি, উপরে রাজহাঁস ডানা মেলে উড়ছে।

সাঁওতাল সমাজে বছরে ৫টি বিশেষ পর্ব বা উৎসব পালিত হয়। এগুলো হচ্ছে ১. সোহরাই-পৌষে প্রধান ফসল ঘরে তোলার উৎসব, ২. মাঘসিম-ঘর ছাওয়ার জন্য মাঘ মাসে বন থেকে খড় সংগ্রহ করতে যাওয়ার উৎসব ৩. বসন্তোৎসব-ফাল্গুনে অমবস্যায় বসন্তউৎসব ৪. এরকঃ সিম-আষাঢ় মাসে দেবতার উদ্দেশ্যে মুরগি বলি দানের উৎসব এবং ৫. হাড়িয়ার সিম-ভাদ্রমাসে ফসলের দেবতার উদ্দেশ্যে বারোয়ারি ভোগ দেয়ার উৎসব। এসব উৎসবকে ঘিরে সাঁওতাল সমাজেও প্রচলিত রয়েছে অসংখ্য লোকসঙ্গীত।

মুন্ডাদেরও মাসে মাসে পূজা-পার্বণ ও উৎসবাদি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রধান উৎসব ৫টি যথাঃ ১. শাখি পরব বা নামকরণের উৎসব, ২. মেহইজ পরব-পৌষমাসে এই উৎসব হয়, ৩. বা-পরব-চৈত্রমাসে ফুল উৎসব, ৪. কারাম পরব-ভাদ্রমাসে এই উৎসব হয় এবং ৫. সোহরাই-কার্তিক মাসে এই উৎসব পালন করা হয়। মুন্ডাদের এই উৎসবগুলোকে ঘিরেও রয়েছে লোকসঙ্গীতের ছড়াছড়ি।



উপসংহার:
উত্তরবাংলার একটি সুপ্রাচীন ভূখন্ড এবং সামজিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ-‘রঙ্গপুর’ যার আজকের পরিচয় রংপুর। এই রংপুর হামার দ্যাশ, ভাওয়াইয়ার দ্যাশ নামে খ্যাত এই রংপুরের আরেক পরিচয় ‘বাহের দ্যাশ’। রংপুরের লোকসাহিত্যে লোকসঙ্গীত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। রংপুরের প্রচলিত লোকসঙ্গীতগুলো বিশেষ করে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতের মধ্যে আবহমান কালের প্রাঞ্জল সাহিত্যরূপ খুঁজে পাওয়া যায় এবং এ অঞ্চলের মানুষের সরলতা, সহজ-সরল জীবন যাপনের চিত্রও এর ভাবর্থে ফুটে ওঠে। যে কোন ভাষার প্রবহমান প্রাণশক্তিকে ধারণ করতে পারে কেবল লোক সঙ্গীতগুলো। কেননা সাধারণের প্রয়োজনে স্বতস্ফূর্ত এক ছন্দে রচিত হয়েছিল রংপুরের এ লোকসঙ্গীতগুলো। তাল, লয় ও সুরের এই স্বতস্ফূর্ততাই লোকসঙ্গীতগুলোকে করেছে যুগোত্তীর্ণ। ‘রঙ্গ রসে ভরপুর গরিয়সী রংপুর’- লোকসংস্কৃতি অর্থাৎ লোক সাহিত্যে অর্থাৎ লোকসঙ্গীতে সমৃদ্ধ এ অঞ্চল এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অত্যন্ত প্রাচীন এবং হিরন্ময় ঐতিহ্যমন্ডিত ও সমৃদ্ধ লোকসঙ্গীত বিশেষ করে ভাওয়াইয়া প্রচলিত এ অঞ্চলে। ভাব-সম্পদের ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ আমাদের ঐতিহ্যবাহী আঞ্চলিক ভাওয়াইয়া গান। ভাওয়াইয়া গান বাঙালি হৃদয়ে সার্বজনীন বহিপ্রকাশ হলেও উৎপত্তিস্থল হিসেবে তা আঞ্চলিক গান বলেই স্বীকৃত। এর উপৎত্তি বাংলাদেশের বৃহত্তর রংপুর দিনাজপুর অঞ্চল, ভারতের কোচবিহার, আসাম ও জলপাইগুড়ি অঞ্চলের আশিক্ষিত অর্ধশিক্ষিত মানুষের মুখে মুখে। বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতি অন্যতম ধারা ও লোকসংগীতের ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ধারক ও বাহক। লোকসংগীতে আছে জারিসারি, মারফতি, মুর্শিদি, ভাটিয়ালি, লালন, হাসন, গম্ভীরা ইত্যাদি। তবে লোকসংগীতের উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে এই ভাওয়াইয়া। সংগীতের নামকরণেও রয়েছে সুস্পষ্ট অর্থবোধক দ্যোতনা। বৃহত্তর রংপুরের লোকসঙ্গীতগুলোর ভাবার্থে একজন বিরোহিনী নারীর প্রেমিক স্বামীর অপেক্ষায় কাতর হৃদয়ের আর্তি যেন গরুর গাড়ির চাকার শব্দে সৃষ্টি হয় এক করুণ আর্তনাদ। ঠিক প্রিয়ার আর্তচিৎকার যেন। মনের এ নিদারুণ ব্যথা গরুর গাড়ির চাকার শব্দে মিশে একাকার হয়ে বাতাস ভারী হয়ে আসে। আবার কখনও পাই উদাসী গাড়িয়ালের মানসিক অবস্থার বর্ণনা। সে বিচ্ছেদের হৃদয়স্পর্শী প্রকাশ এই ভাওয়াইয়া গানে।

তথ্যসূত্র ও গ্রন্থপঞ্জী:
১. ১৯০৩ সালে প্রকাশিত লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ভালউম-৫, খন্ড-১ এর পৃ: ১৮৫
২. ভট্টাচার্য, আশুতোষ (১৯৫৪)। বাংলার লোক সাহিত্য।তৃতীয় খ-। কলকাতা: ক্যালকাটা বুক হাউস। পৃষ্ঠা ২৮১।
৩. "ভাওয়াইয়া - বাংলাপিডিয়া"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০১-০৫।
৪. "ভাওয়াইয়া গান"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০১-০৫।
৫. দৈনিক ইত্তেফাক, বিনোদন প্রতিদিন, মুদ্রিত সংস্করণ, ২৩ জানুয়ারি, ২০১২ইং, পৃষ্ঠা নং-১৩
৬. দৈনিক ইত্তেফাক, মুদ্রিত সংস্করণ, পৌষ এলো গো পৌষ, নগর সংস্কৃতি, ৭ জানুয়ারী, ২০১২ইং, পৃষ্ঠা-২৪
৭. রংপুরের ইতিহাস: আব্দুল আলীম
৮. রংপুরের লোকসঙ্গীত- আহমেদ মওদুদ
৯. রংপুরের লোকসাহিত্য ও লোকঐতিহ্য 'ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী', প্রাকাশক - সাঈদ বারী প্রধান নির্বাহী, সুচিপত্র ঢাকা, প্রকাশকাল ২০০৫ ইংরেজী।
১০. দৈনিক ইত্তেফাক, বিনোদন প্রতিদিন, মুদ্রিত সংস্করণ, ২৩ জানুয়ারি, ২০১২ইং, পৃষ্ঠা নং-১৩
১১. রংপুরের স্থানীয় মানুষের সাক্ষাৎকার

এছাড়া যাদের লেখনিতে ভাওয়াইয়া গান ও রংপুরের লোকসঙ্গীত সম্পর্কে আমরা বিস্তারিত পাই, তারা হলেন- হরিষ চন্দ্র পাল, শ্রী সতীন্দ্র দে সরকার, শ্রী শিবেন্দ্র নারায়ণ ম-ল, শ্রী অধ্যাপক হিতেন নাগ ও ড. সুখবিলাস বর্মা প্রমুখ।

সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৯ দুপুর ২:৩২
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×