somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জোনাকির আগুন

১৪ ই জুন, ২০১৪ রাত ১১:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হঠাৎ করেই বুঝতে পারলাম প্রৌঢ়া নারীটি আমার প্রেমে পড়েছে। যদিও সে বলে - " এটা প্রেম নয় । বলতে পারো বিশেষ কারো জন্য এক ধরনের বিশেষ এক অমূল্য অনুভূতি "। ঠিক আছে ধরে নিলাম ঐ পৌঢ়ার আমার প্রতি এক অমূল্য অনুভূতির জন্ম নিয়েছে।যদিও নারীটি মুখে কখনো এ ব্যাপারে কোন স্বীকারোক্তি সরাসরি দেয় নি ; না কোন চিঠি লিখে কিংবা তার কোন লেখনীতে। লেখনী বললাম এজন্য যে , এক সময় সে লেখালেখিও করত। সে যাই হোক, ইদানিং তার গলার ভারী স্বরে মনে হচ্ছিল , সে ভালো সময় কাটাচ্ছে না। আসলে কিছু কিছু অনুভূতি থাকে যা স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন পড়ে না সবসময়। বলা যায় সেই নারীটির ম্লান, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বরে আমি বেশ কিছুদিন ধরেই একটা উত্তুরে হাওয়ার গন্ধ পাচ্ছিলাম, যা আমাকে ক্রমশ ভীত করে তুলছিল।

তার সাথে কোন তারিখে প্রথম বা কি প্রেক্ষিতে পরিচয় হয়েছিল বা কি কথাবার্তার রেশ ধরে কাছাকাছি এসেছিলাম এই মুহূর্তে সেটা মনে করাটা খুব জরুরী নয় । তবে আমি বরাবরই একঘেয়েমিতে ভুগতাম। তার আগমনে আমি বিশেষ কৃতজ্ঞতা অনুভব করছিলাম তার প্রতি ভেতরে ভেতরে যা প্রকাশ পেত আমার নিঃস্পৃহতার খোলসে। আর আমার এই নিঃস্পৃহতার ভাবটিই তাকে আন্দোলিত করেছিল। সে উজ্জীবিত হত আমাকে সজীব করতে প্রতিনিয়ত। তার সাথে আমার পরিচয়টা ঠিক সে সময়ে , যখন আমি স্বপ্ন দেখতে চেষ্টা করছিলাম অবাস্তব জলে ভ্রাম্যমাণ কোনো পানসিতে। যখন আমি ডায়েরীর পাতায় লিখে রাখতাম আমার বিচ্ছিন্ন অনুভবগুলো যেখানে আঁকা হত একটা রোদ পাখির উড়ে চলার দৃশ্য কিংবা ক্ষণস্থায়ী এপারওপার জলফোয়ারা যেখানে হয়ত জেগে উঠতে পারত কোনো মায়াবী দ্বীপ। নারীর আদলে। যার চোখের নরম পাতায় আঁকা আছে গভীর নিঃস্পৃহতা যেন রহস্য ফোকর, বিভ্রম মোহ। প্রত্যেক সন্ধ্যায় আমি আগুনরঙা হাহাকার নিয়ে উদাসীন বটপত্রে নিজেকে ভাসিয়ে দিতাম । নির্জন করোটিতে যেখানে লেগে থাকতো বিস্মৃতির ছোপ ছোপ নীলাভ্র পরাগ। আমার বুকের ফাঁপা অংশটায় ধীরে ঢুকে যেত ছাইচাপা আলো, পাথরের রেখাঙ্কিত মুখ। মোমের মত বিষণ্ণ কিছু জোনাকি যেন ঝিকিমিকি জ্যোৎস্নার ফুল হয়ে উড়ে যেত তখন । হয়ত আমার ভাবনার সব অসত্য নয়। গাঢ় মেঘে নুয়ে পড়া কেয়ার গন্ধ আষ্টেপৃষ্ঠে নিয়ে জড়িয়ে কেটে যেত সকালের শুরুটা কিংবা সন্ধ্যা নামার পর । তখন তীব্র ভাবে বুঝতাম দাবানলও কোমল হয়ে জ্বলতে পারে সুরের পাঁজরে ।

সে যাই হোক , আমি তার কাছ থেকে প্রায়শই লোভনীয় প্রস্তাব পেতাম। মাস্টার্সের ক্লাস সাসপেন্ড হবার পর যখন আসন্ন পরীক্ষার প্রস্তুতিতে রাত জেগে পড়াশুনা করে ভোরের দিকে একজোড়া ঢুলু ঢুলু চোখ নিয়ে বিছানায় শুয়ে মিশে যেতে চাইতাম ঘুমের অতল রাজ্যে, পরীদের সাথে স্বপ্নে ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম, বাইরে ততক্ষণে ধবধবে আলোর ফোয়ারায় উজ্জ্বল হয়ে উঠত রাতের আঁধার কেটে। তখনই মোবাইলের ভাইব্রেটে পর্দা ঘেরা আমার আলো- আঁধারি রুমে কোনমতে চোখ খুলে দেখতাম সেই নারীটির মেসেজ-

“ আজ সারাদিন বইয়ের দোকানে দোকানে ঘুরব। লিস্ট করব কোন কোন বই কেনা যায়। বাবু, তুমি কি যেতে চাও আমার সাথে ?”

নারীটি আমাকে আদর করে ‘বাবু’ বলে ডাকতো আর আমি সে ডাকে স্বস্তির পাশাপাশি বলা যায় কিছুটা অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছিলাম। কেননা বাবুদের সবকিছুতেই ছাড়! বিশেষ বিশেষ অবস্থায় তাদের সাতখুনও মাফ হয়ে যায় শুনেছি! তাই একটা স্পেশাল নাম পেয়ে আমি খুশী হলেও সেটা প্রকাশ না করে বরং তাকে বলতাম “ আমাকে বাবু বলবা না ।”

যে কথা বলছিলাম, তার মেসেজ পেয়ে আলসেমী আর চোখে গতরাতের অসমাপ্ত একরাশ ঘুম নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে বিছানা ছাড়তাম বাইরের আলো- হাওয়ায় লম্বা করে বুক ভরে শ্বাস নেবো বলে। যদিও নারীটি ভেবে নিত শুধুমাত্র তার জন্যই আমি আমার সব কাজ ফেলে বের হচ্ছি তাকে সাথে নিয়ে। কিন্তু তাকে বলা হত না ঘুম ভেঙে সেই একঘেয়ে পাউরুটি, ডিম কখনোবা মধুর ক্যান্টিনের ভুনা খিচুড়ি, সমুচা – সবই আমার কাছে প্লাস্টিক মনে হত, আমার রুমমেটদের বোরিং কথাবার্তা আর রঙিন সিনেমার ভিড়ে হারিয়ে যেত আমার প্রাণের সঞ্জীবের সুর। তাই হয়ত আমিও গেয়ে উঠতাম গুণগুনিয়ে
“ এই মরে মরে বেঁচে থাকা আমার ভালো লাগে না ।”

আমি বেরিয়ে পড়ি সেই নারীটির সাথে। সারাদিন এদিক সেদিক হাঁটি তার পছন্দের বই কিনতে। ঘুরে ঘুরে বই কিনি। তারপর আমরা ক্লান্ত হই। কার্জন হলের বাউন্ডারি জুড়ে যে শিরীষ গাছ তার ছায়ায় বসি দেয়ালে হেলান দিয়ে। এক সাথে পড়তে শুরু করি সদ্য কেনা বইগুলো থেকে সন্দীপনের একটা বই টেনে নিয়ে। বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে আমার সকালের অসমাপ্ত ঘুম ফিরে এলে আমি হাই তুলতে থাকলে নারীটি দু’কাপ চা নিয়ে আসে আমাদের জন্য। আমি একটা কাপ সরিয়ে রেখে কী বুঝে আমি যেন তাকে বলে ফেলি “ তোমার কাপ থেকে আমার জন্য দু’চুমুক চা রেখ ।” আমার কথা শুনে সে তার ঝকঝকে ফ্রেমের চশমার ভেতর দিকে তাকিয়ে থাকে আর আমি আমার দৃষ্টি নিবদ্ধ করি গল্পের বইয়ের পাতায়। যদিও আমি পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারছিলাম না বইতে কেননা আমরা বেশ কাছাকাছি বসেছিলাম। আমি তার গায়ের নিজস্ব গন্ধ পাচ্ছিলাম তীব্রভাবে। সেই একদিনই পেয়েছিলাম সে গন্ধ যা আমার মাথায় বিঁধে গিয়েছিল।

মাঝে মাঝে তার উদ্দেশ্যবিহীন দূরপাল্লা ভ্রমণের যাত্রা – সঙ্গী হতাম আমি। যদিও নারীটি তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল এবং প্রবলভাবে বিরোধিতা করে জানাতো এভাবে বাসে করে মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, সাভার কিংবা বিভিন্ন জায়গায় সে এমনি এমনিই যায় না ।

তাহলে কেন যাও ?

গল্প খুঁজতে যাই , বাবু !

সে আর আমি যে তুখোড় আড্ডায় মেতে থাকতাম দেখা হলে তা নয়। আমি বেশীরভাগ সময়েই ব্যস্ত থাকতাম মোবাইলে ফেসবুকে। যেদিন রাতে আমি আর সে ফুলার রোডে রিকশায় ঘুরছিলাম, হঠাৎ করেই চোখে পড়ল তার ডান হাতের পাথরের চুড়িটি অন্ধকারে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোতেও ভীষণ চমকাচ্ছে। আমি চুড়িটি স্পর্শ করলে সে তার হাতের মুঠোয় আমাকে বন্দী করে। আমার সে সময় মনে পড়ে যায় আরও বছরখানেক আগের এক সন্ধ্যার কথা। এরকম করেই কেউ একজন শুধু আমার হাতই নয় , আমার ঠোঁটও গ্রাস করেছিল। আমি যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলাম সেদিন। এ কথা তাকে জানাতেই তার হাতের বাঁধন কিছুটা নমনীয় হলে সেখান থেকে এক খণ্ড ভারী মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। বলি “ তোমার চুড়িটা খুব সুন্দর !” সে একটু হাসে এ কথা শুনে ।

অতি সুসম্পর্কের মাঝেও কখনও কখনও ক্লান্তি ভর করতে পারে। এজন্যই আমি সেই আবেগপ্রবণ নারীটিকে সাবধান করতে একদিন বললাম –

“ ভাল্লাগে না কিছু আমার !”

আমার এ কথা শুনে সে অপেক্ষা করতে থাকে আমার পরবর্তী ভাষ্য শোনার জন্য। হেমন্তের সেই প্রশান্ত বিকেলে আমরা হাঁটছিলাম পাশাপাশি। প্রসঙ্গত বলে রাখি আমরা প্রচুর হাঁটতাম। আরও স্পষ্ট ভাবে বললে বলা যায় , সেই নারীর কারণে আমাকে অনেক হাঁটতে হত। তাই প্রিয় নগরীর বেশ কিছু রাস্তা ছিল আমাদের অনেক আপন, পরিচিত এবং সেই সাথে জমছিল টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি। সেই বিকেলে তার চোখ রাস্তার দু’পাশে সমানভাবেই নজর রাখছিল কোথাও চায়ের দোকান দেখা যায় নাকি এই ভেবে। তার ছিল নিদারুণ চায়ের নেশা , সে নেশা আমাকেও আক্রান্ত করেছিল পরবর্তীতে।

“ তুমি জানো আমার যে হারিয়ে যাবার রোগ আছে ?”

চায়ের দোকান খোঁজা বাদ দিয়ে এ কথা শুনে সে আমার দিকে কৌতূহলী হয়ে তাকাল।

“ কোথায় হারাবে ?”

“ দেখা যাক কোথায় হারাতে পারি !”

আমার অসমাপ্ত কথা শুনে নারীটি চিন্তিত হয়। ভুলে যায় চায়ের দোকান খোঁজার কথা। জানতে চায় আমি যখন হারিয়ে যাবো সে সময় আমার সাথে মোবাইল থাকবে কি না কিংবা আমার সাথে আবার কবে দেখা হতে পারে ইত্যাদি। আগাম বিচ্ছেদের কথা ভেবে সে ঝরে পড়া মৃত বকুলের গন্ধকে সে সন্ধ্যায় তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে। আমি নীরবে অনুভব করতে থাকি তার হৃদয়ের বিচ্ছেদ যাতনার হাহাকার। অবাক হই এই ভেবে যে যা ঘটেনি অথচ যা ঘটতে পারে এমন সম্ভাব্য একটা পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে নারীটির ব্যাকুল হবার মত এমন কী হল ! আমরা নিশ্চুপ হাঁটতে থাকি। আমার অস্থিরতার কারণ তাকে বোঝাতে পারি না। বলতে পারি না “ আমার এত বাঁধন ভালো লাগে না । আমাকে একটু একলা থাকতে দাও। তারচেয়ে বরং চুপ কর, শব্দহীন হও।”

যদিও কখনও সেই সে আমার উপর কিছু চাপিয়ে দেয় নি । কিন্তু আমাকে ঘিরে এত যে তার চাপা উদ্বেগ , হাহাকার , অপেক্ষা করা – সে এসব প্রকাশ না করলেও আমি টের পেতাম এবং বিরক্ত হতাম। কারো মনোযোগ পেয়ে আমি অভ্যস্তও নই বলেই হয়ত আমার এমন লাগত। আমি যখন সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুদিনের জন্য তাকে উপেক্ষা করে চলবো ঠিক তখনই দু’ জন হারানো মানুষ আমার সাথে নতুন করে যোগাযোগ শুরু করল যারা বেশ কয়েক বছর আগে ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। নারীটি এসব শুনে কিছুটা সংশয় প্রকাশ করে বলেছিল অবশ্য –

“ তুমি নিশ্চয়ই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলে কিংবা অমনোযোগী ছিলে তাদের প্রতি । জানো তো , মেয়েরা অবহেলা সহ্য করতে পারে না !”

সে ভুল কিছু বলে নি, যদিও আমি খুব প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলাম –
“ আমি কখনোই কাউকে ছেড়ে চলে যাই নি যদি না কেউ আমাকে নিজ থেকে ছেড়ে চলে যায় !”

সে পাল্টা বলেছিল –

“ তুমি নিশ্চয়ই তোমাকে ছেড়ে যাবার মত আচরণ কর যে কারণে সুকন্যা কিংবা অর্থি চলে গিয়েছিল ”

“ তাদের কাছে ডাকার মত কোন আচরণও কিন্তু করি নি , তাহলে এত বছর পর কেন তারা আবার ফিরে আসতে চাইছে ” – আমার এ কথা শুনে এক ভয়াবহ নিস্তব্ধতা নেমে আসে ঐ মুহূর্তে তার মাঝে। নীরবতা ভাঙতে আমি একবারও তাকে বলি না যে আসলেই আমার কোন ব্যাপার বেশিদিন ভালো লাগে না । খুব দ্রুতই আমি বোর ফিল করি সবকিছুতেই ! এ কথা একবার তাকে বলেছিলাম আর তা শুনে সে বলেছিল তাহলে আমার কাউকে বিয়ে করাই উচিত না ।

আমার আসলে সুনির্দিষ্ট কোন দুঃখবোধ নেই। অনেক ভেবে দেখেছি , খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছি ছোটবেলা থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত আমার কোন গভীর ক্ষত বা অপ্রাপ্তি আছে কি না ! কিন্তু কোন গভীর ক্ষত বা বেদনা কিছুই আমার নেই । আমি যে মাঝে মাঝে হল থেকে বাড়ি যেতাম সে শুধুমাত্র ছুটির দিন গুলোতে খাবার কষ্ট হবে, হলে একা একা থাকতে হবে এই ভেবেই চলে যেতাম বাড়িতে মা-বাবার কাছে। আমি তাদের কাছে গেলেই শুধুমাত্র তাদের ফিল করতাম, আমার ভাই- বোনদের দেখলেই মনে পড়তো তাদের কথা। কী বিচিত্র এক ফ্ল্যাট অনুভূতি নিজের মাঝে ধারণ করে আমার সময়গুলো কেটে যেত বা এখনো কাটছে !

দুনিয়াতে জন্মেছি তাই বাঁচতে হবে, খেতে হবে, জীবিকা, বিয়ে বা বাচ্চার বাবা হব নিয়ম অনুযায়ী এমনভাবেই দেখতাম জীবনটা কে। নিয়ম ! এই নিয়মটা কে বানিয়েছে কিংবা কীভাবে হাড়ে- মজ্জায় ঢুকে গেছে আমার, আমাদের কে জানে ! আমার কখনও জীবন নিয়ে কোন ছকে আঁকা পরিকল্পনা কখনও ছিল না বা এখনো নেই। যদিও নারীটি প্রায়ই জানতে চাইত পড়াশুনা শেষ করে আমি কোন সেক্টরে কাজ করতে আগ্রহী। আমার তার এই কথার উত্তর দিতে ভালো লাগে না । তাকে বলতে ইচ্ছে করে না যে কাজ করা তো অনেক পরের ব্যাপার আমার তো পড়তেই ইচ্ছে করে না ! কিন্তু তাকে আমি এসবের কিছুই বলি না। ক্যাফেটারিয়ার সিমেন্টের ঠাণ্ডা দেয়ালে গা এলিয়ে দিয়ে বসি।কল্পনা করতে থাকি কোন এক অলীক অরণ্যে আছি আমি।সেখানে আমি আবিষ্কার করে ফেলি বিভিন্ন উজ্জ্বল বর্ণের কিছু গোপন কুঠুরি। এর মাঝে লাল বর্ণের কুঠুরির প্রতি আমি বিশেষভাবে আগ্রহ অনুভব করি। প্রত্যাশা করতে থাকি চমকপ্রদ কিছুর অপেক্ষায় কিংবা ভাবতে থাকি হিংস্র কিছু ছুটে বের হয়ে আসবে সেই কুঠুরি থেকে, আমাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে ছড়িয়ে দিবে এই মায়াবন অলীক অরণ্যে।
“ বললে না তো বাবু , কোথায় কাজ করতে আগ্রহী তুমি পড়াশুনা শেষ হবার পর !”

আমি দেখতে পাই সে তার চশমার ভেতর দিয়ে সবুজ সারল্যমাখা দু’চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

“ Why so serious lady !”

আমার এ আচরণে নারীটি ব্যথিত হয়। তাকে বলি আমার একটা নিভৃত সময়ের প্রয়োজন যাতে আমি আমার হাতের মুঠোয় মন ভরে কিছু জোনাকি চাষ করতে পারি।

আমি প্রায়শই নানারকম এলোমেলো ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকতাম। ক্রমশ বুঝতে পারছিলাম আমার নিজেকেই ইদানীং আমার ভালো লাগছে না। নিজের ভেতরে ঘুম পারিয়ে রাখা সেই বিশেষ ভাবটা খুব মৃদু ভাবে ডানা মেলছিল টের পেতে শুরু করেছি আমি। বুঝতে পারছি নিজেকে শান্ত করতে হয়ত আবার আমাকে কিছুদিনের জন্য ডুব দিতে হবে।

একটা সময় আমি হারিয়ে গেলাম আমার পরিচিত মানুষদের মাঝ থেকে হঠাৎ করেই। প্রিয় শহরের জনারণ্যের ভিড়ে থেকেও গোপনে যাতায়াত করি পরিচিত সড়কগুলোতে; তবে ভয়ে ভয়ে ভয়ে। কারো সাথে না আবার দেখা হয়ে যায়! নিজেকে শৃঙ্খলিত লাগতে থাকে খুব। অনেকদিন পর এক শীতের সন্ধ্যায় সেই তাকে দেখি ফুটপাত ধরে হেঁটে আসতে। হাতে বেশ কিছু বই নিয়ে। কাঁধে বরাবরের এক ঢাউস ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে এত কি রাখে সে জানতে চাইলে একবার বলেছিল হাসতে হাসতে – “ অনেক কিছু রাখি ।”

একবার ইচ্ছে করে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তাকে চমকে দেই। এতদিন পর আমাকে দেখে নারীটি কেন চমকাবে এ প্রশ্ন নিজেকে করে কোন উত্তর না পেয়ে তার সামনে আর যাওয়া হয় না। তাকে বেশ সুখী মনে হচ্ছিল দেখে। আমি কি ঈর্ষান্বিত হচ্ছি তাকে সুখী দেখে ! এই মুহূর্তে আমাকে ঈর্ষাকাতর বলা যায়। নারীটির কোন সীমানা ছিল না। কোন ঘর বা সংসার ছিল না। বাঁধনশূন্য এক মানুষ ! মনে পড়ে অনেকদিন আগে তাকে আমার শৈশবে প্রায়ই ইচ্ছেকৃতভাবে হারিয়ে যাবার গল্প শোনাতে শোনাতে জিজ্ঞেস করেছিলাম –

“ আমাকে কখনও খুঁজে না পেলে কি তুমি আমার জন্য বেদনার্ত হবে ?”

নারীটি সে কথার উত্তর না দিলে বলে – “ চলো আমরা বরং কিছুটা পথ হেঁটে আসি !”

হাঁটতে হাঁটতে সে বলেছিল – জোনাকিদের নাকি অনেক কষ্ট ! ছোট একটা শরীরের পুরোটা জুড়েই তারা আগুন ধারণ করে রেখেছে তাই ।

এ কথাগুলো মনে পড়তেই আমি এ মুহূর্তে বুঝে যাই পৌঢ়া নারীটি মূলত আগুন ধারণ করা একটা জোনাক!

আমার বুক ছলকে একটা ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে আমার ব্যক্তিগত খতিয়ানে চোখ বুলাতে গিয়ে। কেননা আমি একজন ফেলো-ডি-সি !

( সমাপ্ত )

সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০১৪ দুপুর ১:০৫
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×