somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নবনীতার ডায়েরি- ৫

২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নবনীতার ডায়েরি - ৪

কিন্তু সহজে আমার ঘুম আসে না। নানান উদ্ভট উদ্ভট চিন্তা মাথায় আসে। ঠিক উদ্ভট না, যা ভাবার দরকার নাই তাই আসে চিন্তায়। ঘুরে ফিরে আসে। একটু কনফিউজড লাগে। বুঝে উঠতে পারি না জীবনের মানে কি। সে কি পুলক মারা গেছে বলে আমি এমন বিষণ্ণ টাইপের চিন্তা শুরু করলাম শ্রাবণের পাশে শুয়ে। শ্রাবণ মাঝে মাঝে একটু উদাসীন বটে কিন্তু আমার আর শ্রাবণের চলার পথটা তো এতো মসৃণ ছিল না একে অপরকে পাওয়ার জন্য। অনেক কষ্ট সহ্য করে দুজনে দুজনকে পেয়েছি। তাহলে এখন পুলকের কথা ভেবে মন খারাপ হচ্ছে কেন? পুলক যখন বেঁচে ছিলো তখন তো ওর কথা মনেও ছিল না। তাহলে এখন মারা যাওয়াতেই কি এমন লাগছে! কি জানি হবে হয়তো বা! রাতে একা একা জেগে থাকাটা আসলেই খারাপ। ভূতে ঢিল ছোঁড়ে মনে হয়।


ঐ তো আমার পাশে শ্রাবণ শুয়ে আছে, নিশ্চিন্তে হাল্কা হাল্কা নাকও ডেকে যাচ্ছে। ভেবেছিলাম কাল অফিস ফাঁকি দিবো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আবেগে পড়ে এই কথা ভেবেছিলাম। অফিস আমি ফাঁকি দিলেও শ্রাবণ দেখা যাবে এই ক্লায়েন্ট সেই ক্লায়েন্ট, মেইল চেকিং অমুক তমুক রাজ্যের কাজের কথা বলে এক পর্যায়ে বলবে ও অফিস যাবে। আমার সারাটাদিন তারপর খারাপ যাবে। তারচেয়ে এক কাজ করি শ্রাবণ মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলো, এলার্মটা বন্ধ করে দেই। তাহলে ও আর সকালে উঠতে পারবে না। ঘুম ভেঙে হয়তো একটু রাগের ভাব দেখাবে, সেটা পাত্তা না দিলেও চলবে। তারপর ওকে দেরি করে নাস্তা খেতে দিবো না হলে ওকে দিয়ে সকালের নাস্তা বানাবো। অবশ্য ওকে নাস্তা বানাতে বললে আমারই শিখিয়ে দেয়া লাগবে। আর সেটা করতে করতে দুপুরের খাবার টাইম হয়ে যাবে। ক্ষতি কি! ব্যাপারটা ভাবতেই আনন্দ লাগছে। খুব সিম্পল কিছু ওকে দিয়ে করাতে হবে। ডিম পোচ তো জীবনেও পারবে না। কুসুম ভেঙে টেঙে একাকার করবে, পাউরুটি সেঁকতে বললে সেটাও পারবে না। আমি ঠিক করেছি আমার ছেলে মেয়ে যাইই হোক ওদেরকে মিনিমাম নিজের খাবার যাতে নিজে বানাতে পারে অমন করে বড় করতে হবে। এটা ভেবেও হাসি পায়। তবে সন্তানের কথা ভেবে তীব্র এক হাহাকার কাজ করে । আমি তো কলেজে উঠেও মায়ের হাতে খেয়েছি। একবার ক্লাস সেভেনে থাকতে হোম ইকোনমিকস ক্লাশে প্র্যাক্টিক্যাল ছিলো পোলাও রান্না। বইয়ের উপকরণ আর রেসিপি পড়ে পড়ে সব যোগাড় করে রান্নার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পানি দেয়ার সময় মনে হয় উল্টা পাল্টা করেছিলাম। তবুও অনেকদিন অনেকের কাছে গর্ব করে বলেছি সে সময় আমি পোলাও রান্না করতে পারি।


আজকে আমার ছোট বেলার অনেক কিছু মনে পড়ছে। আমার ইচ্ছে করে শ্রাবণকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। ওর নাক ডাকার ভলিউম বাড়লে দুই একবার গায়ে ধাক্কা দিয়েছি। কিন্তু ওর ঘুম তো ভাঙে না। আমার মায়ের কথা, বাবার কথা, আপা-ভাইয়ার সবার কথা মনে পড়ছে খুব। ইচ্ছে করছে আবার আমি আমাদের বাসায় যাই, ওদের দেখে আসি। কিন্তু আমার তো ঐ বাসায় যাওয়া বারণ। শ্রাবণ অনেকদিন বলেছে -

আরে তুমি সবার অমতে আমাকে বিয়ে করছ,আব্বা- আম্মা তো একটু রাগ করবেই। যাও গিয়ে দেখা করে আসো। আগে বকাটা তুমি খেয়ে আসো। আমি না হয় পরে খাবো নে।

কিন্তু শ্রাবণ যেতে বললেই কি আর যাওয়া যায়! আমি ওখানে গেলে মা আমার সাথে কথাই বলবে না। আব্বাও সেইম। কয়দিন আগেই আপার সাথে গুলশানের বাটার দোকানে দেখা হলো। আমাকে দেখে যেনো আঁতকে উঠলো। অন্তত আমার এমন মনে হয়েছে। আপা একটু কৃপন স্বভাবের কিন্তু তাকে আমি এখনো খুব পছন্দ করি। শ্রাবণকে বিয়ে করা নিয়ে ও তেমন একটা ভেটো দেয়নি আবার সাপোর্টও দেয়নি। সুবিধাবাদী পার্টি আর কি! তবুও তাকে আমি ভালবাসি কারণ উপরে উপরে ও যথেষ্ট চালাক ভাব দেখালেও ওর জন্য প্রবল এক মায়াবোধ কাজ করে। ও স্টুডেন্ট লাইফেই পড়াশুনার প্রতি ছিল ফাঁকিবাজ টাইপের। তাই হয়তো মুরুব্বীদের কথা মতো অল্প বয়সেই বিয়ে করে ফেলেছিল। বিয়ের পর পর যখন জামাই নিয়ে গদগদ অবস্থার ভেতর যাচ্ছিলো তখন আমাকে বলেছিলো ,

বিরাট বাঁচা বাঁচছিরে। ম্যাথ যে কঠিন ,পরীক্ষায় তো ফেল করতাম। তখন আমি জামাই পাইতাম কোথায়! বলে সে কি খিক খিক হাসি দুলাভাইয়ের গা ঘেঁসে ঘেঁসে। ফেল করা মেয়েকে কেউ বিয়ে করে নাকি!

পড়াশুনা না করতে পেরে কেউ যে এতো খুশি হতে পেরে আমার আপাকে না দেখলে বুঝতাম না।

দুলাভাই এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব বিব্রত হতো। আরও পরে বলেছিলো

তোমার বোনকে উপরে উপরে যতই চালাক মনে করো না ক্যান নিবেদিতা আস্তো বোকার হদ্দ।

অবশ্য দুলাভাইয়ের এই ধারণা পরবর্তীতে বদলে গিয়েছিলো। আসলে একটা পর্যায়ে গিয়ে মনে হয়েছিলো আমাদের ফ্যামিলিতে বোকা কেউ থাকলে সে হলাম আমি। আপা আর ভাইয়া দুজনেই যথেষ্ট বুদ্ধিমান আর আমি হলাম ইমোশনাল ফুল। বুদ্ধিমান হওয়াটা ওদের অপরাধ না অবশ্য। শ্রাবণের মতে আমার এ টু জেড হার্ট, ব্রেইন নাকি নাই।

আমার বড় আপা খুব সংসারি টাইপের মেয়ে। ওর স্বপ্ন ও অনেক টাকা জমাবে আর তার দুই ছেলের জন্য সব খরচ করবে। ওর জামাই ব্যাংকার। ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। দুলাভাই ওকে ওর জন্য পর্যাপ্ত হাত খরচ দেয় ছেলেদের পড়াশোনার খরচ ছাড়াও । ও সে টাকা নিজের জন্য কোনো দিন খরচ করে না। জমায়। ওর ছোট বেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল সংসারি হবে, বিয়ে করবে। ওর যাবতীয় চিন্তা টাকা জমানো আর ছেলেদের ক্যারিয়ার নিয়ে। সুন্দর কোনো শাড়ি, ড্রেস বা জুয়েলারি দেখলে বলে, ইশ যদি কিনতে পারতাম! আমি বলি, কিনেন।

না থাক। তুই তো তোর বেতনের পয়সা এইটা সেইটা কিনা উড়াইয়া দেস। টাকা জমাইস।বিপদে পড়লে কেউ টাকা দিবে না কিন্তু।

আমার এক বন্ধু আমাকে একবার বলেছিল, কারো কে ভাল মত চিনতে হলে তার কাছে টাকা ধার চাও। হোক সে বন্ধু বা ঘরের লোক। মাঝে মাঝে ফান করে আপার কাছে টাকা লোন চাইতাম কিন্তু তার সাধের জমানো টাকা থেকে চাইলে দেখা যেতো চেহারা শুকিয়ে আমসী হয়ে গেছে। একবার মা হজ্জ্বে গিয়ে আমাদের দু'বোনের জন্য গোল্ডের এয়ার রিং এনেছিল। গ্রামের বাড়িতে এক বর্ষায় বেড়াতে গিয়ে ,নতুন বর্ষার পানিতে দাপাদাপি করে যখন আপার খেয়াল হলো ওর এক কানের জিনিস হারিয়ে গেছে, সেদিন হয়েছিলো দেখার মতো সীন। কান্নাকাটি শেষ হবার পর শুরু হলো কন্টিনিউয়াস প্যানপ্যানানি। শুধুমাত্র ওর জন্য আমাদের ট্রিপটা সেবার নষ্ট হয়েছিলো।

ওর যাবতীয় আলোচনার বিষয় দুই ছেলে, কোন সব্জির দাম কত, তেলের দাম বাড়লো না কমলো, মাছের দাম, রিকশা ভাড়া বেড়ে গেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। তাকে যদি বলি, এসসব ছাড়াও তো কথা বলার বিষয় আছে। টিভির নিউজ দেখসেন, পেপার পড়সেন? এক কাজ করেন, উন্মুক্ত বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষা দেন। এইচ এস সি টা পাশ করেন। আপনি তো সেলাইএর কাজ ভাল জানেন। বুটিকের বিজনেস করেন। অনেক পরিচিত মহিলা আছে আপনার। নিজের আইডেন্টি বানান।

বলে, থাক ভাই, বিজনেসে অনেক রিস্ক। ঘরের রান্ধন কে রানবো! অন্য কথা ক। দেশ বিদেশ নিয়া আমি ভাইব্যা কি করুম! সরকার ক্যান কোনো দলই ভালো না। সেনাবাহিনী নামাইয়া সবগুলিরে জেলে ঢুকাইলে ভাল হইব।

সেনাবাহিনি কার লোক জানেন?

আমার জাইন্যা কাজ নাই। তুই প্যাঁচাল কম পার।

আমি হাসতে হাসতে বলি, ফোন তো আমিই করসি।

তোর বিল উঠতাসে।পয়সা খরচ করন লাগব না।

আই লাভ মাই আপা। খুব সাধারণ চিন্তার মানুষ। তাই বিছানায় শুলেই ঘুমাতে পারে। এসব আমার পালিয়ে বিয়ে করার আগের কথা সব। তবুও মনে হয় কতটা জীবন্ত। আপা সেদিন আমাকে সামনাসামনি দেখে এমন ভয় পাবার মতো ব্যবহার করলো বলে কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে ভেবে নিলাম ও তো এমনই। বাসায় ফিরে শ্রাবণকে বলেছিলাম আপার সাথে দেখা হবার কথা। ও সব শুনে বললো 'মন খারাপ করো না। নিবেদিতা আপা তো এমনই। সহজ সরল।'

আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি আপা কেমন করে মায়ের সাথে আমার ব্যাপার নিয়ে গল্প করছিলো। ওর হাত আর মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস।

আমার মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয় নিজের পরিবারের সাথে বিচ্ছেদ। তখন শ্রাবণকে সব বলে বলে হাল্কা হই। কিন্তু আমার মতো শ্রাবণও তো ওর ফ্যামিলি থেকে দূরে সে কথাটা আমি যে কী করে প্রায়ই ভুলে যাই! ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগে ওর জন্য। আমি ওর চুলটা আমার হাত দিয়ে একটু নেড়ে দেই। ও ঘুমের ঘোরেই আমাকে ওর একটু কাছে টেনে নেয়। বলে " ঘুমাও না ক্যানো " । মুহূর্তেই ও আবার ঘুমিয়ে পরে। আর আমি একলা জেগে রই। ওকে ইচ্ছে করে জোরে জোরে কিলিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে দেই। আমি ঘুমাতে পারছি না আর ও কেন এমন নির্বিকার হয়ে ঘুমাবে! আমার মাঝে একই সাথে রাগ ,অভিমান,মায়া কাজ করে ওর জন্য। মনে হতে থাকে ও খুব সুখী!

চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৮
২৬টি মন্তব্য ২৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লুঙ্গিসুট

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:২৪



ছোটবেলায় হরেক রঙের খেলা খেলেছি। লাটিম,চেঙ্গু পান্টি, ঘুড়ি,মার্বেল,আরো কত কি। আমার মতো আপনারাও খেলেছেন এগুলো।রোদ ঝড় বৃষ্টি কোনো বাধাই মানতাম না। আগে খেলা তারপর সব কিছু।
ছোটবেলায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

লিখেছেন নতুন নকিব, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:২৫

স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত মুফতি তাকি উসমানী সাহেবের কিছু কথা

ছবি কৃতজ্ঞতা: অন্তর্জাল।

একবার শাইখুল হাদিস মুফতি তাকি উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হল, জীবনের সারকথা কী? উত্তরে তিনি এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

=মৃত্যু কাছে, অথবা দূরেও নয়=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



©কাজী ফাতেমা ছবি
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলি, আমারও সময় হবে যাবার
কি করে চলে যায় মানুষ হুটহাট, না বলে কয়ে,
মৃত্যু কী খুব কাছে নয়, অথবা খুব দূরে!
দূরে তবু ধরে নেই... ...বাকিটুকু পড়ুন

সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা

লিখেছেন করুণাধারা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৯



এই ধাঁধার নাম সবুজ চোখের মানুষের ধাঁধা; নিচের লিংকে এটার ভিডিও আছে।

স্বৈরশাসকের বন্দী

এই ধাঁধাটি আমার ভালো লেগেছিল, তাই অনেক আগে আমার একটা পোস্টে এই ধাঁধাটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই পোস্টে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের চার খলিফার ধারাবাহিকতা কে নির্ধারণ করেছেন?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:৩৭




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ২৬ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৬। বল হে সার্বভৈৗম শক্তির (রাজত্বের) মালিক আল্লাহ! তুমি যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব) প্রদান কর এবং যার থেকে ইচ্ছা ক্ষমতা (রাজত্ব)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×