নুহা ২৭
আমার সকাল বেশ দেরীতেই শুরু হয়। ঘুম ভেঙে উঠে দেখি সকাল প্রায় দশটা বাজে। মনে পড়ে যায় আইরিনকে বলেছিলাম সকালে আমার সাথে নাস্তা করতে। সারা রাত ইজি চেয়ারে শুয়ে ঘাড়, পিঠ কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। আলস্যও লাগছে খুব। কিন্তু ভদ্রতা বলেও একটা ব্যাপার আছে, একজনকে নাস্তার দাওয়াত দিয়ে আমি নিজেই উধাও। হয়ত আইরিন বা মারিয়া কেউই বাসায় নেই এখন। চকিতে রেজার কথাও মনে পড়ে। হয়ত রেজাও কাজে চলে গেছে। যাবার আগে কী এই রুমের দরজা নক করেছিলো! হয়ত করেছিলো কিংবা কে জানে করেইনি হয়ত। ইজি চেয়ার থেকে উঠে রুমের শাটার উঠিয়ে দরজা খুলে দেই। বাইরে উজ্জ্বল আকাশে চোখ ধাঁধিয়ে ওঠে আমার। রুম থেকে বের হতেই মারিয়ার সাথে দেখা হয়। ও ওয়াশ রুম থেকে বের হচ্ছিলো। আমাকে সুপ্রভাত জানালে আমি মাথা নাড়ি শুধু। ফ্রেশ হয়ে শোবার রুমে ঢুকে রুমটা গোছগাছ করি। অজানা কোনো আশংকায় মনটা কেমন তেতো হয়ে থাকে। মনে হয় আজকে কোথাও না বের হই। শুধু আজ কেন আর কোনোদিনই কোথাও না বের হই। সময়টা থমকে যাক এখানেই। কিছুই ভাবতে ভালো লাগে না আমার। জন্মের আগের কোনো দুনিয়া কী আছে যেখানে যাওয়া যেতে পারে তাহলে সেখানেই চলে যেতাম। এসব ভাবনার ফাঁকে টুক করে নুহাও এসে আমাকে সুপ্রভাত জানিয়ে তাড়া লাগায়।
- আরে মেয়ে বাংলাদেশে একটা ফোন করো। তোমার মা বাবার সাথে কথা বলো। হয়ত মনটা হাল্কা হবে আর তোমার মায়ের কথার ভঙ্গী শুনেও বুঝতে পারবে রেজার পরবর্তী গতিবিধি।
আমি জবাবে শুধু - হুমমম বলি।
এক কাপ কফি খাওয়া দরকার। শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। জ্বর জ্বর লাগছে কেন, চোখও জ্বলছে। কিচেনে যেতেই মারিয়ার সাথে আবার দেখা হয়। খাওয়া শেষ করে বোতল খুলে পানি পান করছিল ও। আমাকে দেখে বলল -
ঘুম ভালো হয়েছিল? তোমাকে একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
আমি একটু হাসি হাসি ভাব করি। ওকে জিজ্ঞেস করি - কফি খাবে?- নো। মাম্মা কয়েকটা জিনিস এনে দিতে বলেছিলো, সুপার শপে যাচ্ছি। আমি কী তোমার মোবাইল নাম্বার পেতে পারি?
ওকে নাম্বার দিলে ওর মোবাইলে নাম্বার সেভ করে ও বেরিয়ে যায়। আমিও এক মগ কফি নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। মা'কে ফোন করতে ইচ্ছে করে না তবুও অনিচ্ছায় বাংলাদেশের নাম্বার ডায়াল করি। হয়ত মা মাত্রই খাওয়া দাওয়া শেষে বিশ্রাম নিতে বিছানায় শুয়েছে। বিরক্ত হবে হয়ত। তবুও কথা বলতে হয়। কী অনীহা নিয়েই না মা প্রতিবার কথা বলে আমার সাথে। এটা কী শুধু ফোনে কথা বলতেই বিরক্তির জন্য? তা তো না। সেই ছোট বেলা থেকেই দেখছি শুধু আমার সাথেই কেমন যেন দূরত্বের একটা সম্পর্ক। আমিই একমাত্র বুঝি সেই যাতনাটা।
- কীরে নুহা কথা বলস না ক্যান? কথা না কইলে ফোন রাখ। বিল উঠাইস না।
- একটু ভালো করেও তো কথা বলতে পারো মা! এত দূরে থেকে ফোন করি। এত ধমকাও কেন
- হ তোর থেইক্যা এহন ভালো মন্দ শিখন লাগবো আমার!
- আমি কবে ভালো ছিলাম তোমার কাছে? কোনোদিন তো মনে হয় নাই আমি তোমার ভালো মেয়ে, ভালো সন্তান। তোমার বা আমার জীবদ্দশায় কোনোদিন এটা শোনার সম্ভাবনা নাই যে তুমি বলবা, নুহা তুইও অনেক ভালো। তোর বড় বোনের মত না হইলেও তুই ভালোই।
- এত বইএর মত লেকচার শোনাইস না। কালকা তোর জামাই ফোন দিছিলো বাংলাদেশ টাইম অনেক রাইতে। তোর লগে রেজার সমস্যা কী লইয়া সত্যি কইরা ক দেখি। বিদেশ যাইয়াও শান্তি দিলি না আমারে।
- ঠিক এই কথাটাই কী তুমি রেজাকে জিজ্ঞেস করছিলা নুহার সাথে আসলে কী সমস্যা তোমার রেজা? জানি জিজ্ঞেস করো নাই। উলটা রেজার সাথে কথা বলার সময় নমো নমো করছ, ঠিক না মা?
- চুপ কর। পোলাডা কানতাছিল। ওর মা- বাপ কেউ নাই। আমারেই মায়ের মত মনে করে। কইছে আমি আপনের মাইয়ারে সুখী করতে পারি নাই আম্মা। ভালো শিক্ষিত পোলা দেইখা বিয়া না দিয়া ভুল করছেন আপনেরা আর সেই ভুলের খেসারত দিতাছি আমি। এহন ক, তুই কী করছস? এত রাইতে রেজার ফোন পাইয়া তোর বাপেও ডরায় গেছে। এমনেই মানুষটার শইল ভালো না, তোর টেনশন কইরা সময়ের আগেই ব্যাটায় মরবো দেহিস।
- ধুর মা ফালতু কথা বলবা না তো! আমি কিছুই করি নাই। খালি রেজার কয়টা সত্যি কথা জেনে ফেলছি। তোমরা তো দেশি ছেলে, ইউরোপ আর টাকা পয়সা দেখে বিয়ে দিয়ে দিছ জোর করে তার শিক্ষা আর রুচিটা দেখো নাই। বাপ মা মরা ছেলে বলে কান্নাকাটি করে তোমাদের ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করছে তাই যাইই রেজা বলে সেটা বিশ্বাস করতে অন্তত তোমার বাঁধে না। সে অন্য বিদেশিনী নিয়ে মা ব্যস্ত। এর বেশি আমি বলতে পারবো না। সেটার প্রতিবাদ করতে করতে শেষ পর্যন্ত থুতু ছিটিয়ে আমি আমার ঘৃণা জানিয়েছি। ব্যস এটুকুই।
- তুই রেজার আগে থুতু দিছস? এত সাহস হইছে তোর?
- ক্যান রেজা বলে নাই? বলবে কই থেকে, থুতু ছিটিয়েছি বললেই তো জিজ্ঞেস করবা নুহা কেন তোমারে থুতু ছিটাইলো।
- দ্যাখ মাথা ঠান্ডা কর। ব্যাটা মাইনসের বিয়ার আগে পরে একটু এদিক সেদিক থাকেই। এহন বিয়া হইয়া গেছে তোর, এইসব ভাইব্যা লাভ নাই। এমন তো না তোরে খাওন পিন্দনের অভাবে রাখছে। বিদেশের সিটিজেনশীপ পাইছস। ওর কাছে মাফ চাইয়া ভুইল্যা যা সব। মাইয়া মাইনসের বিয়া একবারই হয়।
- মা, তোমার কথা শুনে আমার গায়ে আগুন ধরতেছে কিন্তু। তোমার কী অপমান লাগে না মা একটা মেয়ে হিসেবে? রেজার এসব শুনে কী নিজেকে মেয়ে হিসেবে অসম্মানিত মনে হয় না? আজকে আব্বা যদি এরকম বেলেল্লাপনা করতো, তুমি কী করতা? চুপচাপ সহ্য করতা?
- কথা ঘুরাইস না নুহা। কয়দিন পর তোর ভাই যাইবো ইতালিতে একটা কামে, লগে তোর বাসায়ও বেড়াইয়া আইবো। দেহিস ওর মান সম্মানডা খোয়াইস না।
- আমার কথাটা মা একবার ভাবো। আমার মনের অবস্থাটা ভাবো। তোমাকে সব কথা তো বলিই নাই। ওই মেয়ের সাথে... মা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে -
- তোর কথা জীবনেও শেষ হইবো না। এহন তোর কিছু করনের নাই। যেমনে আছস মানাইয়া চল। আর তোর ত্যাজ কমা। চেহারা সুরত ভালো হইলে কী হইবো, সাজগোজ করতে তো দেখলাম না। একটু সাইজা গুইজা রেজার লগে মিলামিশা কর, ঘুরতে যা। তুই বলে ওর লগে কথা কস না, সামনে যাস না? দূরে দূরে বলে থাকস?
- মা ওর কাছে যাওয়ার মত মানসিকতা আমার আর নাই। ও মন বোঝে না, আন্তরিকতা বোঝে না। ও শরীর বোঝে। ও রোজ আমাকে রেপ করে
- মানে কী? ও তোর জামাই, তোর কাছেই তো যাইবো
- ইচ্ছার বিরুদ্ধে মা ও আমাকে রোজ রাতে টানাহেচড়া করে।
- চুপ কর। মন দিয়া সংসার কর। বাচ্চাকাচ্চা নে, সব ঠিক হইয়া যাইব
- একটা ভালো কথা তুমি বললা না মা! তুমি মা কোনোদিন আমার প্রতি একটু নরম হও নাই মা। এখন অন্তত একটু বোঝো মা। আমার এখন একটাই রাস্তা খোলা আছে
- কী?
- ভাইয়ার সাথে বাংলাদেশে ব্যাক করা যদি ইতালিতে কোনো কাজ যোগাতে না পারি আর...
- তুই বাংলাদেশে আইসা কী করবি? গেলোবার না বেড়াইয়া গেলি?
- বেড়াতে আসবো না এবার। একবারে রেজার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেই আসবো
- তোর ভাই বিয়া করছে, ওর সংসার আছে। সংসার বড় হইতাছে। বেড়াইতে আইলে তোরে তোর ভাবী যত্নআত্তি করে, একটু পুছে। তাও তোর জামাইএর টেকা আছে দেইখা। তোর লাইগা কী একটা বাড়তি রুম ওরা ছাইড়া দিবো? যা কইছস অইটা এহনই ভুইল্যা যা। বিয়াডা জানি খেলাধুলা, কইলাম আর সম্পর্ক শেষ। এত পড়াশুনা কইরা একটা বেদ্দপ হইছস।
- তোমার চেয়ে ভাবী অনেক রিজেনেবল যা মা হয়ে তুমি হতে পারো নাই।
- আমি হইতেও চাই না। তুই এই বাসায় আইবি না
- ভাইয়া আর আব্বা যদি নিষেধ করে তোমাদের বাসায় আমি আসবো না। তোমার সাথে কথা বলাটাই ভুল হইছে মা। আব্বা কোনোদিন এইভাবে আমাকে দূর দূর করতো না।
ফোন রেখে দিয়ে আমার মন খারাপ হয় না। প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ লাগতে থাকে। চট করে মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হতে থাকে। মায়ের কথা শুনে দমে যাওয়া দূরের কথা আমি যেন নতুন করে শক্তি পাই ঘুরে দাঁড়াবার। বাইরে বের হবার জন্য জামাকাপড় বদলে নেই।
বাইরে রোদ থাকলেও সেই সাথে কোথা যেন হঠাত হঠাত ঠান্ডা বাতাস এসে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো শীত খুব কাছেই। এই রোদ এই বৃষ্টি! শীতের সময় আর শীত আসার আগে প্রায়ই বৃষ্টি হয়। তাই সাথে ছাতা রাখতেই হয়। মোবাইল বাজছে। মায়ের সাথে কথা বলে বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে আছে। কে ফোন করেছে কে জানে, কথা বলতে হবে ভেবেই ক্লান্তি লাগছে। ফোনটা কানে ধরতেই শুনি রেজার গলা। বলে -
- তুমি রাস্তায় নাকি? কই যাও?
- নির্দিষ্ট কোথাও যাই না। দেখি কোথাও কাজ খুঁজে পাই কিনা
- হ ইতালির সরকার তোমার লাইগা কাজ লইয়া বইয়া রইছে তো, রাস্তায় বাইর হইলেই পাইয়া যাইবা। হেহ
- তুমি এসব বলতেই ফোন দিয়েছ?
- ক্যা আমার লগে কথা কইয়া জুইত পাও না? না নতুন কাউরে পাইছ?
ওর কথার উত্তর দিতে আমার ইচ্ছা করে না। চুপ করে থাকি। বোঝার চেষ্টা করি আসলে ও কী বলতে চায়।
- তোমার ভাই এর কাছে ফোন দিছিলাম জানতে ইতালি কবে আইতাছে।
- কেন?
- তোমার ভাই যখন দেশে ব্যাক করবো, তখন যাতে তোমারেও নিয়া যায়। আর তারিখটা জাইনা নিলাম। টিকেট কাটতে হইব তো তোমার। সে তো আর তার খরচে তোমারে বাপের বাড়ি নিয়া যাইবো না। তোমার দিন ঘনায় আইতাছে। রেডি হও। বাপের বাড়ি যাইয়া যখন মা আর ভাবীর লাত্থি উষ্টা খাইবা তহন বুঝবা রেজার লগে তাফালিং করার কী মজা
- শিক্ষা দেয়ার জন্য পাঠাচ্ছো?
- হ। ওয়ান ওয়ে টিকেট কাটুম। যেদিন মনে হইবো আমারে ছাড়া চলবো না, আমারে ডাকবা, মাফ চাইবা, সেইদিন তোমারে নিতে আমি নিজে আসুম
- মাফ চাইবো কেন রেজা?
- তুমি আমার লগে অসভ্যতা করছো। থুতু মারছো আমার গায়ে
- কেন থুতু মারলাম?
- আজাইরা ঢং করবা না। বালের প্যাঁচাল মারাইতাছে
- তোমার কষ্ট করে আমাকে বাংলাদেশে গিয়ে আনতে হবে না। আমি একবারেই চলে যাচ্ছি ভাইয়া যখন আসবে, তখন।
- কী কইলা? বুইঝা কইতাছো তো?
- হুম বুঝেই বলছি। সম্পর্ক রাখার মতো আর কিছু তোমার সাথে নাই তো রেজা। তোমার কষ্ট করার দরকার নাই। আমি তো চাকুরী করি না, না হলে নিজের টাকাতেই চলে যেতে পারতাম। ভাইয়াকে বলবো টিকিট করে দিবে। আমি নিজেই আজ মালিয়ানা গিয়ে বুকিং দিয়ে আসবো এজেন্সিতে। বাসার কাছেই তো
- কী বলতাছো এইসব? তুমি সত্যি বলতাছো? নুহা আমার কথাডা শোনো।
আমি রেজার কথা শুনতে আর আগ্রহ বোধ করি না। আমার মাথা ঝা ঝা করে ব্যথা করছে। আজ আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয় না। সান পাওলোর বাস চলে আসলে বাসে উঠে পড়ি। জর্জোকে ফোন করে জানাই মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমি ওর সাথে দেখা করতে আসছি। গন্তব্যে আসার পর যখন হাঁটছিলাম, একবার মনে হয় শবনমের বাসায় যাই। অবশ্য ও বাসায় আছে কিনা জানা নেই। লাস্ট কদিন ধরে তো ওর সাথে কথাও হয় না। হাঁটতে হাঁটতে জর্জোর দোকানে চলে আসি। ও জানায় ওর এখানে বা অন্য কোথাও কাজের খোঁজ পেলে দ্রুতই জানাবে। আমি যে সত্যি খুব বিচলিত এটা বুঝতে পেরে জর্জো আমার কাঁধে হাত রাখে। বলে যাতে সহজেই হতাশ না হয়ে পড়ি। ও দীর্ঘদিন বেকার ছিল। তখন ও বাঁশী বাজানো শিখেছিল। রাস্তায় রাস্তায় বা ট্যুরিস্ট এরিয়ায় বাঁশী বাজাতো, ট্রাম বা ট্রেনেও। আমি ওর কথা শুনে হাসার চেষ্টা করি। ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগা শুরু হতে থাকে। জর্জোর দোকান থেকে রাস্তা পার হলেই দুইটা বিল্ডিং পর শবনমের বাসা। ওকে ফোন দিয়ে জানাই গেট খোলা রাখতে। আমি আসছি...
চলবে
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:২৭