somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্মৃতির ফ্রেমে জড়িয়ে রাখা পহেলা বৈশাখের অকৃত্রিম অনুভূতি

১৩ ই এপ্রিল, ২০১৪ বিকাল ৪:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দিনটাকে ঠিক পহেলা বৈশাখ নামে জানতাম না, জানতাম "গলিয়া" নামে। গলিয়া ছিল পহেলা বৈশাখের একটি গ্রাম্য মেলার নাম। অর্থাৎ বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনটিই ছিল বহু কাংখিত গলিয়ার দিন। এই দিনটির জন্য আমাদের সকলের প্রস্তুতি ছিল ৪/৫ মাস পূর্ব থেকেই। আমরা বলতে - আমি, আমার বড় আপু, আমার ভাই, আমার মেঝ চাচার তিন ছেলে অর্থাৎ কাশিম ভাই, হাশিম ভাই এবং জাফর ভাই। উক্ত ৬ জনের মধ্যে আমার বড় আপু ছিল সবার বড় এবং আমি ছিলাম সবার ছোট। আমাদের পরিবার, চাচার পরিবার তখন দাদার সাথেই ছিল। আমাদের ৬ জনের টাকা-পয়সা জমা করার একটা মাটির ব্যাংক ছিল। সারা বছর বড়দের কাছ থেকে যে যা টাকা-পয়সা সংগ্রহ করতে পারতাম তা মাটির ব্যাংটিতে রেখে দিতাম। ব্যাংকের মধ্যে বড় অংশের টাকা আসতো আপু এবং কাশিম ভাইয়ের মাধ্যমে। বাকীরা যখন ই যা পেতাম তা দিয়ে টুকটাক কিনে খেয়ে ফেলতাম। তারপরও কখনো সখনো আমরা ছোটরা ও কিছু পয়মা রেখে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতাম। তবে গলিয়া নিকটবর্তী হলেই নিজেদের টুকটাক খাওয়ার লোভ সংবরন করে ব্যাংকে পয়সাপাতি চালান করে দিতাম।

পহেলা বৈশাখের সকাল:
পহেলা বৈশাখের দিন খুব ভোরে ই ঘুম থেকে উঠে সবাই আমাদের মাটির ব্যাংকটি নিয়ে বসতাম। মাটির ব্যাংকটি ভেঙ্গে যতো টাকা পাওয়া যেত তা গননা করে আপুর কাছে রাখতাম। তারপর আমরা এবং প্রতিবেশী সঙ্গি-সাথীরা একসাথে নদীতে গোসল করতে যেতাম। গোসল করতে যাওয়ার পূর্বে আমরা সবাই একটা মিশন সম্পন্ন করতাম। কাপিলা গাছের বীজ সংগ্রহ করতাম এবং কিছু বীজ মুখে নিয়ে পানিতে ডুব দিয়েই নদীর কিছু পানির সাথে টুপ করে গিলে ফেলতাম। আমাদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল - এই দিনটিতে পানির নিচে গিয়ে কপিলার বীজ খেতে পারলে সারা বছর কোন রোগ-বালাই থাকবে না। তবে শর্ত থাকে যে, পানির উপরে তা খাওয়া যাবে না কারন গিলে ফেলার দৃশ্য কেউ দেখে ফেললে কপিলার বীজ তার কার্যকারিতা হারাবে।

মা, চাচী ভোর সকালে উঠেই ভালো খাবারের আয়োজন করতেন। আমরা সবাই মিলে গোসল সেরে আসতেই খাবার রেডী। তারপর তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে সুন্দর পোশাক পরে গলিয়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতাম। এরই ফাকে আমরা সবাই বাবা, চাচা আর দাদার কাছ থেকে পছন্দের জিনিস পত্তর কেনার জন্য অতি সামান্য পরিমানে টাকা পেয়ে যেতাম। যার বয়স যতো বেশি তার প্রাপ্ত টাকার পরিমান ততো বেশি। সেই হিসেবে আপুর টাকার অংক থাকতো বড়। তবে হিংসা করার কিছু ছিল না। কেননা ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত টাকা এবং মুরুব্বিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সকল টাকা এক সাথে জড়ো করে কেনাকাটার জন্য মৌখিক ভাবেই বাজেট ঘোষনা করা হতো। আপু আর কাশিম ভাই বাজেট তৈরি করতো আর আমরা ছোটরা তা সানন্দে সায় দিতাম। বাজেটের জন্য বরাদ্ধকৃত খাতগুলো ছিল - মেয়েদের সাজগোজ সামগ্রী, মেয়েদের গৃহকর্ম ও খেলনা সামগ্রী, ছেলেদের খেলনা সামগ্রী এবং টুকটাক মজাদার খাবার সামগ্রী।

মেলায় গমন:
আমাদের গ্রামের প্রতিটি ঘর থেকেই আলাদা আলাদা গ্রুপ করে ছেলেমেয়েরা গলিয়ায় যেত। কারন ছিল একটা ই - প্রতিযোগীতা। এক ঘরের মানুষেরা অন্য ঘরের সদস্যদের জানতে দিতাম না কার কত বাজেট, কি কি কেনাকাটার প্লান। সন্ধ্যায় এসে অন্য ঘরের ছেলেমেয়েদের দেখাতাম কে কি পরিমান কিনতে পেরেছি। যেহেতু আমরা সংখ্যায় অনেক ছিলাম, আমাদের মেলার সামগ্রী ও অন্য সব ঘর থেকে বেশি হতো। নৌকা করে ছোট্ট নদীটি পার হয়েই আমরা হাটা ধরতাম এবং প্রায় ২৫/৩০ মিনিট হাটার পরই গলিয়ায় পৌছে যেতাম।

মেলার কেনাকাটা:
মেলায় পৌছে ই তো চোখ ছানাবড়া। এটা সেটা দেখে দেখে মনের মধ্যে তখন শুধু লোভ আর লোভ। এটা কিনবো, ওটা কিনবো, এটা পছন্দ, ওটা পছন্দ - পছন্দের যেন কোন সীমা নেই। আপু ঠিকই মাথা ঠান্ডা রেখে বাজেট অনুযায়ী কেনাকাটা শুরু করতো। আমি যেহেতু সব থেকে ছোট ছিলাম তাই আপু আমার হাত ধরেই মেলার সমগ্র মাঠ ঘুরে আমার জন্য সাজগোজ সামগ্রী কেনা শুরু করতো। আমার ভাইটি তখন থেকেই বদমেজাজী, তাই সে চাইতো সবার আগে যেন তার খেলনাগুলো কিনে দেওয়া হয়। ওই বদমেজাজীকে না চটিয়ে সবার প্রথমে ওর পছন্দের খেলনা কিনে দিত। তারপর আমার জন্য কেনা হতো হরেক রকম চুড়ি, নেইল পলিশ, লিপিস্টিক, কপালের টিপ, নূপুর, মাটির টেপা পুতুল, হাড়ি-পাতিল, ঢেকি ও আরো অনেক কিছু। একটা কিছু কিনে দিলে আরো হাজারটা কিনিবার লোভ জাগতো মনের মধ্যে। তারপর একে একে বাকিদের জন্য লাঠিম, বাঁশি, ঢোল,লাঠিতে লাগানো হেলিকপ্টার, মাটির ব্যাংক, বেলুন, বিভিন্ন রকম মাটির ও প্লাস্টিকের প্রানী সামগ্রী। আপু খুব স্থিরতার সাথেই বাজেটের মধ্যে ভারসাম্য রেখে সবার ইচ্চা পূরনে ব্যস্ত থাকতেন। আপু তার শৌখিন জিনিসটি কিনেছে কি না অথবা তা কেনার স্বচ্ছলতাটুকু অবশিষ্ট আছে কি না সে ব্যাপারগুলো আমাদের কারো মাথায় ই আসতো না। সে ব্যাপারে আপুর মধ্যে মন খারাপের অভিব্যাক্তিটি ও ছিল না। এখন বুঝি, বড় আপু আসলেই বড় আপু। মায়ের মতো অসীম ভালোবাসা, সহনশীলতা আর ধৈর্য্য নিয়ে একজন ই পৃথিবীতে আসতে পারে - সে হলো ঘরের বড় মেয়েটি।
তারপর কেনাকাটা যখন প্রায় শেষ হয়ে আসতো , অল্প বিস্তর টাকা দিয়েই কিনে নিতাম বাতাশা, মুড়ির মোয়া, লাড্ডু, মুরালী ও নাম না জানা আরো কিছু। মেলার কোন এক পাশ ঘেষে বড়রা নানা ধরনের খেলার আয়োজন করতো। আমি অবশ্য নগরদোলাতে চড়তে খুব ভয় পেতাম। তাই আমার আপু তার ইচ্ছা সত্ত্বেও ওটাতে চড়তো না। ছেলেগুলো তো নগরদোলায় একাধিকবার চড়েও তৃপ্ত হতো না।
এদিকে মেলায় ঘুর ঘুর করতে করতে কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যেত তা বুঝতে পারতাম না। আকাশের কালো মেঘ দেখেই আমাদের চৈতন্য ফিরতো বাড়িতে পৌছার। যে যার মতো হাতে পলি ব্যাগ নিয়ে বাড়ির জন্য প্রানপনে দৌড়াতে থাকতাম। একটা ব্যাপার আজ ও বুঝলাম না, পহেলা বৈশাখে ই কেন ঝড় হবে। অন্য দিন হলে ক্ষতি কি।








































সন্ধ্যার আধাঁরে উপচে পড়া আনন্দ:
গলিয়ার সব চেয়ে আনন্দের সময়টা ছিল সন্ধ্যার দিকে। দাদা-দাদী, মা, চাচীকে সামনে রেখে আমরা সবাই আমাদের ক্রয়কৃত সামগ্রী একে একে ব্যাগ থেকে বের করতাম। কাপড় ও বাশেঁর পাখা, দাদার জন্য লাঠি আর দাদীর জন্য পানের খুপরি যে আপু কখন কিনেছে তা মেলাতে বুঝতে পারতাম না। সব কিছু সামনে নিয়ে বসে থাকার মধ্যে কি যে অপার্থিব আনন্দ ছিল তা লিখে প্রকাশ করার মতো না। এখন ও যদি এই মুহুর্তগুলোর কথা মনে পড় তবে শৈশবে ফেলে আসা আনন্দটুকু ঠিকই সময়ের ব্যবধান কাটিয়ে মনের মধ্যে অদ্ভূত রকম দোলা দিয়ে যায়।

পহেলা বৈশাখের সেই গলিয়ার দিনগুলো যদি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকতো তবে সব কিছুর বিনিময়ে হয়তো তা ফিরে পেতে চাইতাম। শুধু আমি ই নই, মানুষ মাত্রই তার শৈশবকে জড়িয়ে ধরতে চায়। এটাই হয়তো প্রকৃতি প্রদত্ত ভালোলাগার অনুভূতি। এই অনুভূতিতে এতটুকুও খাঁদ নাই, এতটুকু ও ভনিতা নেই।।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৯:০৯
৫৭টি মন্তব্য ৫৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×