somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

নস্টালজিক
পেশায় গীতিকার, লেখক। তড়িৎ কৌশল পড়া বাদ দিয়ে একদিন গীতিকার হব বলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম শব্দের তালাশে। ইদানিং আবার বেড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়। এবার এই অন্তর্জাল থেকে। নস্টালজিক এর নাম শেখ রানা। নিজেকে চেনার পর হাতে বেশী সময় থাকে না।

আমার প্রিয় ক্যাসেটঃ প্রথম পর্ব

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১২:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :





অনেক গান বারবার শুনতে ভালো লাগে।

অল্পকিছু গান স্মৃতির হাত ধরে ফিরে নিয়ে চলে পিছুহাঁটায়। তারপর ফেলা আসা কাঙ্ক্ষিত সময়ের মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। তখন যে অনুভূতির জন্ম নেয় তার কোনো সংজ্ঞা নেই, উদাহরণ নেই। শুধু অনুভূত হবার উপলক্ষ্য আছে।

দলছুটের হৃদয়পুর হলো আমার কাছে ঠিক সে রকম উপলক্ষ্যের আনন্দ। প্রিয় অ্যালবামের তালিকার শর্ট লিস্ট করে ফেললেও হৃদয়পুর থেকে যাবে। কোনোভাবেই বাদ দেয়া যাবে না।

গানে নিজে সংশ্লিষ্ট থাকলে তার ব্যবচ্ছেদে হয়তো সবসময় নির্মোহ হওয়া যায় না। তবু হৃদয়পুরের গানগুলো এখনও যখন শুনি, মনে হয় আহা! সেই সময়ের বিষাদতম প্রেক্ষাগৃহে যদি আবার ঘুরে আসা যেত খানিকটা সময়। সেই সুর-কথা আর গান বাঁধার সময়ে যদি নিজেকে দেখে আসা যেত অনুপল। সে সময়ের সঞ্জীবদা, বাপ্পা ভাই এর সাথে দেখা হত যদি। বাসুদার বাসা, মিউজিকম্যান স্টুডিও, আসিফ, মাসুম ভাই, রাসেল, চারু ভাই, জোহা ভাই, তারেক ভাই, পার্থদা আর দুপুরবেলায় খালাম্মার সুরেলা কন্ঠ যদি শুনে আসা যেত আর একবার!

বাংলা গানে আমার খুব প্রিয় ক্যাসেটগুলো নিয়ে লিখব ভাবতেই মানসপটে অজান্তেই ভেসে এল অংশু ভাইয়ের ডিজাইনে করা হৃদয়পুরের কভার। তখন আমারও মাত্র মাত্র গান লেখা শুরু। কি এক নিদাঘ কিন্তু উত্তাল দুপুর-রাত! বোহেমিয়ান এক ছন্নছাড়া যুবকের গীতিকার হতে চেয়ে সময়ে সমর্পণ। রাজশাহীর আসা যাওয়া আর ঢাকার রিকশায় ঝিম ধরা দুপুর সঙ্গী করে শব্দ তালাশ করা দিন।
এই সব ব্যক্তিগত শব্দচারণ পাশে রেখে যখন গান নিয়ে ভাবি, তখন মুঠো মুঠো হাওয়াই মিঠাই যেন ছুঁড়ে মারে কেউ।

গাড়ি চলে না ইত্যাদিতে প্রচার হয়েছে কেবল। সময়টা কী ২০০১? তখনও ইত্যাদিতে গান প্রচার মানে পরদিন ক্যাসেটের দোকানে খোঁজ খোঁজ রব।দুই-একদিন বাদে স্টুডিওতে ঢুকেই সঞ্জীবদার স্বভাবসুলভ রসিকতা-

' বাপ্পা কি হইসে জানো, আজ জ্যামে রিকশায় বসা। পাশের রিকশাওয়ালা ঘাম মুছতে মুছতে আমাকে দেখেই বলে- কি মিয়া, গাড়ি চলে না, না? '

তারপর বাজির অলংকরণ। সঞ্জীবদার লিরিক,বাপ্পা ভাইয়ের সুর আর মধুমাখা কন্ঠ। সঞ্জীবদা আর বাপ্পা ভাইয়ের একুশে টিভিতে ভালোবাসা বাজী রেখে দাবা খেলা সেই ভিডিও। দোলো ভাটিয়ালির মন উদাস করা যুগল কন্ঠ। 'ওঠো গোলাপ, জাগাও আমাকে, কাঁটার পুলকে যে উদ্ভাসিত'...

বাসুদার বাসায় লিটন ডি কস্তার রিদম প্রোগ্রামিং এর সেই রিদমিক দুপুর। 'আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল চাঁদ, আমাকে নিঃস্ব করে দিয়েছিল চাঁদ/ আমার চোখ কেন ধরেছে সুন্দর'। সঞ্জীবদার একের পর এক দূর্ধর্ষ লিরিক। বাপ্পা ভাইয়ের মোহাবিষ্ট গিটার বেজে উঠতেই জুলফিকার রাসেলের ফাইনেস্ট লিরিকের গান। 'জলের দামে দিলাম খুলে রাতেরও দূয়ার/ সস্তা ভেবে উড়াল দিল উষ্ণ হাহাকার'। আর তারপর...

যে গানটা বিষাদতম প্রেক্ষাগৃহে পিনপতন নীরবতা এনে দেয়।

' আমি তোমাকেই বলে দেব, কি যে একা দীর্ঘ রাত/ আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে '। সঞ্জীবদার বিরান পথের কথা আর বেজান শহরে বসে বাপ্পা ভাইয়ের রাত গভীরের সুর। সেই কথা-সুর সঞ্জীবদা গলায় তুলে নিতেই আমরা শুনতে পেলাম এমন এক প্রেমিকের হাহাকার যা ছোঁয়া যায় না, ধরাও যায় না।

ক্যাসেটের বি পিঠ আসতেই যেন বিরান পথ হেঁটে চলে যায় সমুদ্রে। বাপ্পা ভাইয়ের প্রিয় গানের তালিকায় সবসময় এই গানটা থাকে, আমি জানি। ' আমার সন্তান/ সেতো তোমার কাছে পাওয়া '... বাপ্পা ভাইয়ের গিটার যেমন ম্যাজিকাল, সে রকমই কী বোর্ডে হাত ছুঁয়ে দেয়া।

আমার সন্তানের কী স্ট্রিং এর মন খারাপ রেশ থাকতে থাকতেই গিটারের ব্লুজ টোন তৈরি করে এক ভিন্ন পথের আবহ। আমার পথ চলার গল্প শুরু হয় তখন।

'সবুজ যখন' ছিল হৃদয়পুরের সর্বশেষ রেকর্ড করা গান। বাপ্পা ভাই-সঞ্জীবদার আর এক যুগলবন্দী। তখন ডাইরীতে লিখি। আর বাপ্পা ভাইয়ের কাছে থাকে এক লিরিক ফাইল, তাতে বড় করে লেখা থাকে- রানা। সেই ডাইরীতে লেখা 'সবুজ যখন' গান হয়ে গেল একদিন। সেই সময়ে যা লিখেছি, তার সব শব্দচয়নের রূপকার আমি, কেন্দ্রিয় চরিত্রও আমি। এই যে নিজস্ব অনুভূতি অনেক শ্রোতার আপন হয়ে গেল , এ আসলেই বিস্ময়কর। এই বিস্ময় এতদিন পরে এসেও আমাকে আলোড়িত করে।
আমার লেখা সবুজ যখন গানের সবচেয়ে প্রিয় ভার্স হলো- 'চাঁদকে যখন দেখি অনেক/ আলো দিয়ে ঘেরা/ আমার কেনো হয়না তবু/ আলোর পথে ফেরা'।

আলোর পথে ফিরে আসি, আসতেই হয় আমাকে।

তারপর 'গাছ'। আমার সবচেয়ে প্রিয় লিরিক। যে কোনো লিরিক বা গানের চেয়ে গাছ গানটাই আমাকে আলিঙ্গনে বাঁধে। ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের প্রিয় সময় আর অলক্ষ্যে বন্ধুতা বাঁধা সেই কড়ই গাছের কথা মনে করিয়ে দেয় আমাকে। আমি একটা সময় ভাবতাম, আমার এপিটাফে গাছ গানের এই চরণগুলো লেখা থাকুক- 'ভালোবাসা দাও, সবুজ বৃক্ষ/ দুঃখে মাতাও, ক্লান্ত বৃক্ষ'। গীতিকার হবার রুক্ষ বাস্তবতা, আমার বোহেমিয়ান জীবন- এক প্রবল অস্থিরতা আমাকে গ্রাস করেছিল মুহূর্তদিন। এখন এই আপনকালে এসে মনে হয়, এত বছর পরেও সঞ্জীবদার গাওয়া, বাপ্পা ভাইয়ের সুরে আমার লেখা গাছ গানটাই আমার প্রিয়তম হয়ে থেকে গেছে।

গাছ এর ইন্টারলুডে একটা একোর্ডিয়ান পিস আছে। এই পিসটুকু বাজিয়েছিলেন আমাদের স্বনামধন্য সংগীত ব্যাক্তিত্ব প্রয়াত লাকী আখান্দ। প্রথমবার বাপ্পা ভাইয়ের কাছে এই তথ্য জেনে আমি খানিক বাক্যহারা হয়েছিলাম, মনে আছে।

' বৃষ্টি পড়ে/ অঝোর ধারায়। বৃষ্টি পরে লজ্জা হারায় '। বাপ্পা ভাই এর কম্পোজিশনে এই লিরিক এমন একটা সুন্দর গান হয়ে শ্রোতার হৃদয়ে থেকে যাবে- প্রথমবার শুনে আমি কল্পনাও করিনি। বৃষ্টি আমার লিরিকে ঘুরেফিরেই এসেছে, আসবেও। তবু হৃদয়পুরের বৃষ্টি গানটা আমার সবসময়ের প্রিয়। এখন টের পাই, বহু শ্রোতারও তাই। শুনতে ক্লিশে লাগবে হয়তো, তবু এত বছর পর নিজের লেখার বাইরে গিয়েও গান নিয়ে আমি স্বচ্ছন্দে ভালো-মন্দ বলতে পারি। শ্রোতা হিসেবে আমার মনে হয়, বৃষ্টি নিয়ে করা বাংলা গানের তালিকায় 'বৃষ্টি পড়ে' স্থান করে নিয়েছে।

চল বুবাইজান আর আন্তর্জাতিক ভিক্ষা সংগীত হলো হৃদয়পুরের শেষ দুই গান। চল বুবাইজান কি একটু র‍্যাগে স্টাইলের গান না? এই গানটা শুনতে আর গাইতে দারুণ লাগে। দলছুট যখন স্টেজে গানটা পারফর্ম করতো, আমি খুব উপভোগ করতাম। দলছুটের সেই সময়ের সারথিদের কথা মনে পড়ে গেল। পারকাশনে রোজ, ড্রামসে রুমি, বেজ গিটারে রাতুল। আর ব্যান্ডের মূল দুই কান্ডারী সঞ্জীব চৌধুরী- শুভাশিষ মজুমদার বাপ্পা।

দলছুটের প্রথম ক্যাসেট 'আহ' শুনে দলছুটের ভক্ত হয়েছিলাম। নির্দিষ্ট করে বললে সঞ্জীবদার লিরিক আর বাপ্পা ভাইয়ের কম্পোজিশনের। লিরিকে স্বার্থক মেটাফোর আর ভণিতা ঝেড়ে সরাসরি বলে ফেলা দ্রোহের। সঞ্জীবদার ভরাট কন্ঠ আর বাপ্পা ভাইয়ের সঙ্গীত আয়োজনের অনন্যসুন্দর যুগলবন্দীর।

হৃদয়পুরের এসে দলছুট বাঁকবদল করে। শ্রোতাদের নিয়ে যায় কথা-সুর-সংগীতের এক মায়াময় সুররিয়াল পথে। সেই পথ যাত্রার আমিও একজন সঙ্গী ছিলাম, এতদিন পরেও এই ভাবনা আমাকে আচ্ছন্ন করে। আনন্দ দেয়।

বাংলা গানের অ্যালবাম তালিকায় আমার সবসময়ের প্রিয় দলছুটের হৃদয়পুর। আমি জানি, হৃদয়পুর আরো বহু শ্রোতার হৃদয়পুরে থেকে গেছে।

থাকবেও।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১২:৪০
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×