(কুরআন ও সুন্নাহ এর দৃষ্টিতে সাহাবীগণের মর্যাদা সম্পর্কে অনেক আগেই এটি লিখে রেখেছিলাম, কিন্তু ব্লগে কপি করার উপায় জানা না থাকায় সম্ভব হয়নি, পড়ার জন্য অনুরোধ করছি)
আক্বাইদ শাস্ত্রের প্রসিদ্ধ “শারহে আকাইদুন নাসাফিইয়্যাহ” গ্রন্থে আছে-
অশালীনভাবে সাহাবীগণকে স্মরণ না করা ওয়াজীব।
শারহে মুসামেরাহ ইবনি হুমাম এ আছে-
আহলে সুন্নাহ এর আকীদা হচ্ছে সাহাবীগণ সকলকেই নির্ভরযোগ্য মনে করতে হবে এবং প্রশংসার সাথে তাদের উল্লেখ করতে হবে।
ইমাম ইবনি তাইমিয়া রাহ. আকীদায়ে ওয়াস্তিয়া গ্রন্থে লিখেছেন-
আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআত এর আকীদা হচ্ছে সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে যেসব মতবিরোধ এবং যুদ্ধ- বিগ্রহ ঘটেছে সে সম্পর্কে কারো প্রতি কোন আপত্তি উত্থাপন কিংবা প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকা। কারন ইতিহাসে যেসব রিওয়ায়েতে তাদের ত্রুটি- বিচ্যুতি তুলে ধরা হয়েছে সেগুলোর অধিকাংশই মিথ্যা ও ভ্রান্ত যা শত্রুরা রটিয়েছে। আর কোন কোন ব্যাপার রয়েছে যেগুলোতে কম- বেশি করে মূল বিষয়ের বিস্তারিত বর্নণা সংযুক্ত করা হয়েছে। আর যেগুলো প্রকৃতই শুদ্ধ সেগুলোও নিতান্তই সাহাবীদের স্ব- স্ব ইজতিহাদ এর ভিত্তিতে সংঘটিত হয়েছে বিধায় তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করা সমীচীন নয় (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলীম, আবু দাঊদ, তিরমিজী, ইবনি মাজাহ)।
বস্তুত ঘটনা বিশেষের মধ্যে যদি তারা সীমালংঘণ করেও থাকেন, তবুও আল্লাহর রীতি হল- সৎ কর্মের মাধ্যমে অসৎ কর্মের কাফফারা হয়ে যায় (সুরা হুদ ১১৪, সহীহ বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, দারাকুত্বনী)। বলা বাহুল্য সাহাবায়ে কিরামের সৎকর্মের সমান অন্য কারো কর্মই হতে পারে না। কাজেই তারা আল্লাহ তাআলার ক্ষমার যতটুকু যোগ্য, তেমন অন্য কেউ নয়। সে জন্যই তাদের আমাল সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার অন্য কারো নেই। তাদের ব্যাপারে কটুক্তি বা অশালীন মন্তব্য করার অধিকারও অন্য কারো নেই।
সুরা হুদ এর আয়াত ১১৪-
এবং নামাযের পাবন্দী কর দিবসের দু প্রান্তে ও রাত্রির কিছু অংশে; নিঃসন্দেহে সৎকর্ম দুর করে দেয় অসৎকর্মকে, এ হচ্ছে নসীহত, যারা মান্য করে তাদের জন্য।
সুরা তাওবাহ এর আয়াত ১০০-
আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী আর আনসারদের মাঝে পুরাতন এবং যারা তাদের অনুসরন করেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন কানন- কুঞ্জ, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত প্রস্রবনসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান কৃতকার্যতা।
তিরমিজী শরীফে আছে-
জাহান্নামের আগুণ সে মুসলমানকে স্পর্শ করতে পারে না যে আমাকে দেখেছে কিংবা আমাকে যারা দেখেছে তাদের দেখেছে।
সুরা আনফাল এর আয়াত ৭৫-
আর যারা পরবর্তীকালে ইমান এনেছে, হিজরত করেছে এবং তোমাদের সাথে একত্রে জিহাদ করেছে বস্তুত তারা তোমাদেরই অন্তর্ভুক্ত।
তাফসীরে ইবনি কাসীরে ইমাম ইবনি কাসীর রাহ. সুরা তাওবাহ এর আয়াত ১০০ এর ব্যাখ্যায় বলেন-
আফসোস ঐ হতভাগ্যদের প্রতি যারা এই সাহাবীদের প্রতি হিংসা পোষণ করে থাকে, তাদের গালি দেয়। অথবা কোন কোন সাহাবীকে গালি দিয়ে থাকে, বিশেষ করে ঐ সাহাবীকে যিনি সকল সাহাবীর নেতা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর স্থলাভিষিক্ত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পরেই যার মর্যাদা, যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবী হওয়ার মর্যাদা অর্জন করেছেন অর্থাৎ মহান খলীফা আবু বাকর ইবনি আবী কুহাফা রাদ্বি.। এরা হচ্ছে রাফেজী স¤প্রদায়ের বিভ্রান্ত দল। তারা সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করে। তাকে তারা গালি- গালাজ করে। আমরা তাদের এই দুষ্কার্য থেকে মহান আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থণা করি। এটা এ কথাই প্রমাণ করে যে এদের বুদ্ধি- বিবেক লোপ পেয়েছে এবং অন্তর বিগড়ে গেছে। যদি এই দুর্বৃত্তের দল এমন লোকদেরকে গালি দেয় যাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং পবিত্র কুরআনে তাদের প্রতি সন্তুষ্টির সনদ দিয়েছেন তবে কোন মুখে তারা কুরআনের প্রতি ইমান আনয়নের দাবী করে। এখন কুরআনের উপর ইমানই আর কি করে থাকল। আর আহলে সুন্নাহ ঐ লোকদেরকে সম্মান করেন এবং ঐ লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকেন যাদের প্রতি আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট রয়েছেন। এই আহলে সুন্নাত ঐ লোকদেরকে মন্দ বলেন যাদেরকে আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মন্দ বলেছেন। আর তারা ঐ লোকদেরকে ভালবাসেন যাদেরকে আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন। তারা ঐ লোকদের বিরুদ্ধাচরন করেন স্বয়ং আল্লাহ যাদের বিরূদ্ধাচরন করেছেন। তারা হিদায়াতের অনুসারী, বিদআতী নন। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর অনুসরন করে থাকেন। তারাই হচ্ছেন আল্লাহর দল এবং তারাই সফলকাম। তারাই হচ্ছেন মুমিন বান্দা।
সুরাহ ফাতহ এর আয়াত ২৯-
মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল এবং যারা তার সাথে রয়েছেন তারা কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং তাদের পরষ্পরের মধ্যে সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদেরকে রুকু ও সিজদাহরত অবস্থায় দেখতে পাবেন। তাদের মুখমন্ডলে রয়েছে সিজদাহ’র চিহ্ন। তাওরাতে তাদের অবস্থা এরূপই এবং ইঞ্জিলে তাদের অবস্থা যেমন একটি চারাগাছ যা থেকে নির্গত হয় গুল্ম আর একে দৃঢ়, পুষ্ট করে এবং যার ফলে তার মূলের উপর দন্ডায়মান হয়, চাষীকে আনন্দিত করে, যেমন আল্লাহ তাআলা তাদের দ্বারা কাফিরদের অন্তর্জ্বালা সৃষ্টি করেন। তাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎ কর্ম করে আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা ও মহাপুরষ্কার ওয়াদা করেছেন।
সহীহ মুসলীমে আছে-
আমার সাহাবীগণকে মন্দ বলো না, যার হাতে আমার প্রাণ তার শপথ, তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও ব্যয় কর, তা তাদের অর্ধমুদের সমপরিমাণও কখনও হবে না।
তিরমিজী শরীফে আছে-
আমার সাহাবীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহকে ভয় কর। আমার পর তাদেরকে নিন্দা ও দোষারোপের লক্ষবস্তুতে পরিণত করো না। কেননা যে ব্যক্তি তাদেরকে ভালবাসে সে আমাকে ভালবাসার কারনে তাদেরকে ভালবাসে এবং যে তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে সে আমার প্রতি বিদ্বেষের কারনে তাদের প্রতি বিদ্বেষ রাখে। যে তাদেরক কষ্ট দেয় সে আমাকে কষ্ট দেয়, যে আমাকে কষ্ট দেয় সে আল্লাহকে কষ্ট দেয়। যে আল্লাহকে কষ্ট দেয় তাকে অচিরেই আল্লাহ আজাবে গ্রেফতার করবেন।
সুরা হুজুরাত এর ৬ নং আয়াতে খালিদ ইবনি ওয়ালীদ রাদ্বি. কে বাহ্যত ফাসিক বলার দ্বারা বোঝা যায় সাহাবীদের দ্বারাও পাপ সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু কুরআনের অন্যান্য আয়াতে শর্তহীনভাবে সাহাবীদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি ঘোষণার দ্বারা বোঝা যায় এ ধরনের কোন ঘটনা ঘটলেও আল্লাহ পাক তা ক্ষমা করে দিয়েছেন, কারন পাপীর উপর সন্তুষ্ট হওয়ার কোন কারন নেই। আর এজন্যই আব্দুল্লাহ ইবনি উমার রাদ্বি. বলেছেন- আল্লাহ পাক যাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তাদের সমালোচনা করার অধিকার কারও নেই (সহীহ বুখারী)।
উপরন্তু সুরা হুদ এর আয়াত ১১৪, সহীহ বুখারী, মুসনাদে আহমাদ, দারাকুত্বনী তে বর্নিত হাদীস অনুযায়ী অসৎকর্ম সৎকর্ম দ্বারা দুর হয়ে যায়।
সাহাবীদের মধ্যে যেসব যুদ্ধ- বিগ্রহের ঘটনা পাওয়া যায় সেগুলো তাদের ইজতিহাদগত বিশুদ্ধ অন্তকরনেরই ফলাফল, স্বার্থসিদ্ধি নয় এবং এ ব্যাপারে হাদীসের ফয়সালা হল-
যদি কোন বিচারক সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হয় তবে তাকে দুটি পুরষ্কার দেয়া হবে। আর যদি ভুল বিচার করে থাকে তবে সে একটি সাওয়াবের অধিকারী হবে (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী, মুসলীম, আবু দাঊদ, তিরমিজী, ইবনি মাজাহ)।
কুরআন- হাদীসের উপর ইজতিহাদ এর বৈধতার প্রমান পাওয়া যায় আহমাদ, আবু দাঊদ এবং তিরমিজী শরীফে বর্ণিত মুআজ বিন জাবাল রাদ্বি. এর দ্ব্যর্থহীনভাবে ইজতিহাদ এর ঘোষণা এবং এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সন্তুষ্টি প্রকাশের মাধ্যমে। এখানে ইজতিহাদ এর যোগ্যতা থাকাও একটি শর্ত এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সান্নিধ্যপ্রাপ্ত সাহাবীগণ এর ব্যাপারে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
আবু দাউদ ও তিরমিজী শরীফে সাঈদ ইবনি যায়িদ রাদ্বি. থেকে বর্ণিত আছে-
আল্লাহর কসম তাদের মধ্যে থেকে কোন ব্যক্তির নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাথে জিহাদে শরীক হওয়া- যাতে তার মুখমন্ডল ধুলি ধুসরিত হয়ে যায়, তোমাদের সারা জীবনের ইবাদাত থেকে উত্তম, যদিও তোমাদেরকে নূহ আলাইহিস সালাম এর আয়ূ দেয়া হয়।
অর্থাৎ নিজের দ্বীন ও ইমান এর হিফাজাত এর স্বার্থে বড় থেকে শুরু করে ছোট থেকে ছোট সাহাবীদের দোষ বা গীবত, এমনকি সমালোচনাও পরিহার করা কুরআন- হাদীস অনুযায়ী প্রতিটি মুসলীমের একান্ত কর্তব্য।
আল্লাহ পাক এই অবিচার থেকে বেঁচে থাকার তৌর্ফিক দান করুন, আমীন।