somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাম্প্রদায়িকতা একটা মানসিক ব্যাধী আর অসাম্প্রদায়িকতা হলো মানবিক গুন; দুঃখজনক হলেও সত্য যে উপরোক্ত দুটি গুণাবলি মানুষ অর্জন করে তার পরিবার ও পরিবেশ থেকে।

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাম্প্রদায়িকতা একটা মানসিক ব্যাধি আর অসাম্প্রদায়িকতা হলো মানবিক গুন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে মানব চরিত্রের উপরোক্ত দুটি মানবিক গুণাবলি মানুষ অর্জন করে শৈশব ও কৈশোরে তার পরিবার থেকে বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্নীয়-স্বজন দের কাজ-কর্ম দেখে আর যৌবন বয়সে এসে তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে।

আমার শৈশবে আমি যা দেখেছি বা করেছি।

পরিপ্রেক্ষিত ১:
========
সেই ১৯৮৭ সালে (আমি যখন বুঝতে শিখলাম, ক্লাস থ্রি এর পরের ঘটনা মনে করতে পারি) আমার দাদা হজ্ব করতে যাবার পূর্বে ১৭ ইন্বিচি সাদা-কালো নিক্কন টিভি কিনলেন। এর পর দাদা হজ্ব পালন করে ফিরলেন। আমাদের নীলফামারী জেলা হতে স্যাটেলাইট ক্যবল ছাড়াই ভারতের দূরদর্শন ও নেপালের টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান দেখা যায়। ১৯৮৮-৮৯ সালের দিকে ভারতের দূরদর্শন চ্যানেলে রামায়ণ ও মহাভারত নামক দুইটি হিন্দি সিরিয়াল চলছিল যা হিন্দু ধর্মের কাহিনী অবলম্বনে চিত্রিত ছিল। ঐ সময় আমাদের বাড়ির ১০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে অন্য কারো বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। আমাদের বাড়ির ৫০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ৩ দিকে ৩ টি গ্রামে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের বসবাস। আমার দাদার প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছিল না। উনি ছিলেন প্রচণ্ড ধর্ম ভীরু মানুষ। সেই ৭০ দশকে আমাদের বাড়ির উঠানে উনি একটি কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন যা আজও চলছে। যেই মাদ্রাসায় প্রায় ৩০০ ছেলে পড়া-লেখা করে যাদের মধ্যে প্রায় ৫০ জনই এতিম ছেলে।
যে করণে উপরোক্ত কথা বলা: সেই ১৯৮৮-৮৯ সালে প্রত্যেক রবি বার আমাদের বাড়িতে প্রায় ১০০-২০০ হিন্দু ধর্মালম্বি মানুষ হাজির হতো "রামায়ণ" ও "মহাভারত" দেখার জন্য। আমার পরিবার টিভি আমাদের উঠানে স্থাপন করত তাদেকে দেখার সুযোগ করে দেবার জন্য। এখানে বলে রাখি সেই সময় আমাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ ছিল না। ব্যাটারি দিয়ে টেলিভিশন দেখতাম। আমাদের বাড়ি ছিল জেলা শহর থেক অনেক দূরে প্রত্যন্ত গ্রামে।

পরিপ্রেক্ষিত ২:
==========
আমি বুঝতে শেখার পরে সবচেয়ে বড় বন্যটি হয় ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের শেষের দিকে। টিভিতে রাত ৮ টার খবরে দেখতাম এরশাদ কোমর সমান পানিতে হেটে দেশের বিভিন্ন বন্যার্ত অঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ করছেন। আমাদের বাড়িটি ছিল আমাদের গ্রামের সবচেয়ে উঁচু স্থানে; এছাড়া আমার দাদা ছিল নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি (মেম্বার)। সেই সময় দেশের গ্রাম অঞ্চলে প্রচণ্ড চোরা-চালানী হতো; যার বেশি ভাগই ছিল গরু চুরি। দুর্ভাগ্য ক্রমে যে গরু ছিল গ্রামের কৃষকদের উপার্জনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। বন্যার সময় দারিদ্র্যতার কারণে হউক বা অন্য কোন কারণে গ্রাম অঞ্চলে গরু চুরির প্রকোপ বেড়ে যেত। ৩ টা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামের ১টি ছিল গ্রামের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট নদী এর পাশে। বন্যার পুরোটা সময় সেই গ্রামটির মানুষেরা সন্ধ্যা হবার পূর্বে তাদের গরু গুলো আমাদের বাসায় রেখে যেত ও সকাল বেলা সূর্য উঠার সাথে সাথে তা নিয়ে যেত।

পরিপ্রেক্ষিত ৩:
========
পূর্বে উল্লেখ করেছি আমার দাদা ছিল প্রচণ্ড ধর্ম ভীরু, ও হাজি মানুষ। আমার দাদা একটা কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যা এখনও আমরা চালাই। কিন্তু আপনি শুনলে আশ্চর্যিত হবেন এটা শুনে যে আমার দাদার একটা ধর্ম পুত্র ও মেয়ে ছিল যারা ছিল হিন্দু। তারা আমার দাদাকে বাবা বলে ডাকত সব সময় আমাদের বাড়িতে আসত। আমার শৈশব থেকে দেখেছি আমাদের বাড়িতে একজন বয়স্ক হিন্দু মানুষ কাজ করত যার নাম ছিল "গুলা"। আমি তাকে দাদা বলে ডাকতাম, ঐ দাদা আমাকে ঘড়ে ও পিঠে চড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। সেই দাদা আমার আম্মাকে সবসময় "মা" বলে ডাকত।

পরিপ্রেক্ষিত ৪:
========
আমার বাবার অধিকাংশ জমি যারা বর্গা চাষ করেন তারা হলেন হিন্দু ধর্মালম্বি মানুষ। বর্গা চাষের নিয়ম হলে আউশ বা আমন ধানের সিজন শেষে উৎপন্ন ধানের একটা অংশ আমাদের দেওয়া। কিন্তু বেশিভাগ ক্ষেত্রে আমি দেখেছি তারা তা দিতে পারত না কারণ কোন কোন বছর উৎপাদন ভাল হত না। ফলে উৎপন্ন ফসল তাদের নিজেদের পরিবার চালাতে লাগত। আমি একাধিক বার দেখেছি সেই সকল হিন্দু বর্গা চাষি ৩/৪ বছর পরে সেই ঋণ শোধ করেছে। কিন্তু আমি কোনদিন দেখি না যে আমার বাবা তাদেরকে চাপ দিয়ে সেই ঋণ আদায় করেছে।

পরিপ্রেক্ষিত ৫:
========
আমার হাই-স্কুল বন্ধুদের অধিকাংশ ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। হাইস্কুল জীবনে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী, নাম জয়ন্ত পোদ্দার (বর্তমানে দিনাজপুর জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট)। ক্লাস সিক্স থেকে এসএসসি পাশ করার পূর্ব পর্যন্ত এমন একটা দিনও ছিল না মনে হয় যেদিন আমি তার মায়ের হাতের চা খাই নাই)। আমরা পুরো অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণী একই স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়েছি। স্কুলে তার রোল ছিল ১ আর আমার ছিল ৩। স্কুল ছেড়ে আবারও একই কলেজে (রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজ) গিয়ে ভর্তি হলাম। কলেজে আমার রোল হলো ৩১৩ আর তার রোল ৩১৪। কলেজে গিয়ে সে শুধু আমার সহপাঠীই রইল না আমরা একই ম্যাচে একই রুমে থাকলাম।

দুর্গা পূজার সময় আমরা দাওয়াত ভাগ করে নিতাম। আমাদের এত বেশি বন্ধু হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল যে পুরো ৩ দিন ধরে (নবমী, দশমী ও দশমীর পরের দিন) সকালের নাস্তা, দুপুরের লাঞ্চ ও রাতের ডিনার করতাম তাদের বাসায় পর্যায়ক্রমে। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ঐ রুটিন চালু ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্ব পর্যন্ত। এর পরে সবাই ছড়িয়ে পড়ি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। পূজার দিনে ধর্মীয় কারণে আমি হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধুদের বাসায় বলি দেওয়া পশুর মাংস খেতাম না একই ভাবে সেই সকল হিন্দু ধর্মাবলম্বী বন্ধু কুরবানির ঈদে আমার বাসায় এসে হালুয়া ও পায়েস দিয়ে পিঠা খেত মাংস বাদ দিয়ে। পুরো স্কুল জীবনে এমন একটাই পূজা ছিল না যেই পূজায় নবমীর রাতে আরতি দেখি নাই। আমাদের এই বন্ধুত্ব আজও টিকে আছে একই রকম আন্তরিকতায়।

আমি সব সময়ই গর্ব করে সকলকে বলি আমার শৈশবে আমি ঐ ভাবেই বেড়ে উঠেছি; ধর্ম ভীরু কিন্তু অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মা-বাবা, দাদা-নানাকে দেখে শিখেছি।

যখন পত্রিকার পাতা খুলে দেখি শুধু মাত্র হিন্দু ধর্মাবলম্বী হবার কারণে বাড়ি-ঘড় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তখন ভাবি কারা মানসিক ভাবে অসুস্থ সেই মানুষ? কোন পরিবেশে তারা বেড়ে উঠেছে? তাদের বাবা-মারাই বা কোন শিক্ষা তাদের দিয়েছেন?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:৫৭
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×