(পড়ে ভালো লাগলো সেয়ার করলাম। repeate Blog হলে ক্ষমা করবেন)
মেজর (অব.) মোঃ আলী আশরাফ, বীরপ্রতীক- যুদ্ধাহত এক বীর মুক্তিযোদ্ধা। একাত্তরে তিনি ছিলেন বিমান বাহিনীর নন-কমিশন্ড অফিসার। তিনি ছিলেন ইলেক্ট্রনিক্সে ডিপ্লোমাধারী। পোস্টিং ছিল
ঢাকায়। মার্চ মাসে তিনি বিমান বাহিনীর মধুপুর ফায়ারিং রেঞ্জের দায়িত্বে ছিলেন। অবস্থান করছিলেন মধুপুরেই। ১৪ মার্চ জরুরিভাবে তলব করে তাকে ঢাকায় আনা হয়।
২৫ মার্চের ’ক্র্যাক ডাউনের’ সময় তিনি ছিলেন কুর্মিটোলায়। সেখান থেকেই দেখতে পান, মিরপুর বাজারে আগুন জ্বলছে। তখনই সিদ্ধান্ত নিলেন কিছু একটা করতে হবে। ২৬ মার্চ আরো ৪/৫ জন
অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে তার কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান। আশ্রয় নেন ঢাকা শহরেরই এক পরিচিতজনের বাসায়। ২৭ মার্চ কার্ফু প্রত্যাহার করা হলে এই সুযোগে পালিয়ে যান গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে।
যোগ দেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। কিছুদিন পর পাকিস্তানি সেনারা ময়মনসিংহের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে পালিয়ে যান ভারতে।
ভারতে গিয়ে যোগ দেন ঢালু মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন সাদেক বকশী তাকেসহ আরো কয়েকজনকে জেড ফোর্সের হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যান। সে সময় আলী আশরাফের সঙ্গে ছিলেন
তার ভাই বর্তমানে মেজর জেনারেল আলী আকবরও। জেড ফোর্সে বিমান বাহিনীর আরো কয়েকজন টেকনিশিয়ান এবং অফিসারও ছিলেন। তাদেরকে বলা হলো ’তোমরা যেহেতু বিমান বাহিনীর লোক।
বিমান বাহিনী গঠন করা হলে তোমাদের সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ততোদিন অপেক্ষা করো।
আলী আশরাফ জাত যোদ্ধা। তিনি যুদ্ধে গেছেন মাতৃভূমির ওপর হায়েনাদের বর্বর হামলার প্রতিশোধ নিতে; ছিনিয়ে আনতে স্বাধীনতা। বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গুনতে রাজি হলেন না। অলি আহমদ
(বর্তমানে কর্নেল অব.), আমিন আহমদ চৌধুরীসহ (বর্তমানে মেজর জেনারেল অব.) অন্য অফিসারদের বারবার অনুরোধ করতে থাকলেন যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করে দিতে। অনেক অনুরোধের পর
আলী আশরাফসহ বিমান বাহিনীর ৮/৯ জন সদস্যকে ১১ নং সেক্টরের মাইনকার চর সাব সেক্টরে পাঠানো হয়। এই সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল তাহের। সাব সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ফ্লাইট
লেঃ হামিদুল্লাহ খান। এখানে আলী আশরাফ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিয়ে দুঃসাহসিক বীরত্বের পরিচয় দেন।
৬ অক্টোবর ১৯৭১। এরকমই একটি অপারেশন শেষে ফেরার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর অ্যাম্বুশের মুখে পড়েন। তুমুল যুদ্ধ হয় এখানে। এক পর্যায়ে আলী আশরাফসহ ৩ জন মুক্তিযোদ্ধাদের মূল দল
থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। একটা গ্রামে ঢুকে আত্মগোপন করেন তারা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। পাকিস্তানিরা সন্ধান পেয়ে যায় তাদের। হত্যা করে তার দু’সহযোদ্ধাকে। যাদের কবর রয়েছে গাইবান্ধার
অদূরে বল্লমজার গ্রামে। গুরুতর আহত হন আলী আশরাফ নিজে। আহত অবস্থায় ধরা পড়েন হানাদার সৈন্যদের হাতে।
পাকিস্তানি সেনারা আলী আশরাফকে আটক করলে তিনি তাদের সঙ্গে উর্দুতে কথা বলেন। ওরা তাকে নিয়ে যায় পাকিস্তানি অফিসার ক্যাপ্টেন খোকারের কাছে। এই খোকার এক সময় বিমান বাহিনীতে
আলী আশরাফের বন্ধু ছিলেন। তাই খোকার বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে তাকে হত্যা না করে যুদ্ধবন্দীর মর্যাদা দেন। চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেন গাইবান্ধা সিভিল হাসপাতালে। পরের দিন খোকার নিজে
ট্রাক চালিয়ে আলী আশরাফকে নিয়ে যান বগুড়ায় তাদের মেইন ড্রেসিং স্টেশনে (যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী চিকিৎসা কেন্দ্র)। যেখানে চিকিৎসা হয় আলী আশরাফের। একই সঙ্গে চলে
জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতনও।
নভেম্বর মাসের ১৫-১৬ তারিখ নাগাদ আলী আশরাফকে স্থানান্তর করা হয় নাটোর জেলে। সেখানে আরো ৪০-৫০ জন যুদ্ধবন্দী ছিলেন। প্রতিদিন তাদের ওপর চলতো অমানবিক নির্যাতন ও
জিজ্ঞাসাবাদ। ভয়াবহ সে নির্যাতনের অভিজ্ঞতা। বৈদ্যুতিক শক, পায়ে বেঁধে গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে বাঁশ দিয়ে পেটানো কিছুই বাদ যায়নি।
ডিসেম্বরের ৩ কি ৪ তারিখ ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স নাটোরে বোমাবর্ষণ করে। তখন নাটোর জেলে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত মিলিটারি পুলিশ প্রত্যাহার করে সিভিল পুলিশ নিয়োগ করা হয়। এ
অবস্থায় ২১ ডিসেম্বর নাটোর জেলের বন্দীরা পুলিশদের হত্যা করে দেওয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসেন। মুক্ত হন আলী আশরাফ। যোগ দেন দয়ারামপুরে একটি মুক্তিযোদ্ধা দলের সঙ্গে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ
শত্রুমুক্ত হলে সবার সঙ্গে বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠেন আলী আশরাফও। বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে দেওয়া হয় বীরপ্রতীক খেতাব।
স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে কমিশন লাভ করেন আলী আশরাফ। এক পর্যায়ে উন্নীত হন মেজর পদে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একটা সময় আলী আশরাফ বুঝতে পারেন তার আর প্রমোশন হবে
না। কারণ তিনি মুক্তিযোদ্ধা। আর দেশে ততোদিনে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দোর্দণ্ড প্রতাপ। ক্ষোভে-দুঃখে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফের বুক ভরা আজ ক্ষোভ, ক্রোধ আর হতাশা। বললেন, স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা দেখে আমি মর্মাহত, ক্ষুব্ধ। তারা আজ অবহেলিত, লাঞ্ছিত, পদদলিত।
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন আজ রাজাকার কর্তৃক পদদলিত। লুণ্ঠিত, ধর্ষিত হচ্ছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন আলী আশরাফ বীরপ্রতীক। তার বুকের ভেতর জমে থাকা
ক্ষোভ আর হতাশা নামতে থাকে অশ্রুধারা হয়ে।
পরক্ষণে আলী আশরাফের মনে পড়ে যায় একাত্তরের এক দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা তিনি। অশ্রু তাকে মানায় না। দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ’আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, আমরা যে
দেশকে রক্ত দিয়ে স্বাধীন করেছি- সে দেশকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদেরই। আসুন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর সম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে নির্মূল করতে এবং সর্বস্তরে মুক্তিযোদ্ধের
চেতনা ও মুল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজনে আবার ’৭১-এর মতোই আরেকটি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি’।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




