somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনেক সমান্তরাল

০৭ ই আগস্ট, ২০১৪ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

কথা ছিল। চাঁদের আলোতে পৃথিবী নিজেকে ভালোবাসবে। পারেনি।
কথা ছিল শ্যাওড়ার সংসার নদীর বুকে গড়ে উঠবে ফের। ওঠেনি।
কথা ছিল। পৃথিবীর ধূসরতাকে অবজ্ঞা করে সে আবার ফিরে আসবে। আসেনি।

শাড়ীতে ভাঁজ পড়ার আগেই উঠে পড়লো দীপা। পৃথিবীর আস্তরণে গেথে যাওয়া স্পর্শটুকু উঠে এলো না। অভিমান নিয়ে পড়ে থাকলো নীল রুমালটার নীচে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা চলতে শুরু করলো দীপার পাশাপাশি। কৃষ্ণচূড়ার নিচের বাঁধানো লেকটা নড়ে উঠলো সামান্য। ব্যস ঐ পর্যন্ত। আর সবাই আছে সবার মতো। পৃথিবীর মতো। এখানে কেউ কাউকে ভ্রুক্ষেপ করে না। সবাই ঘর না হয় অ-ঘর বাধার স্বপ্নে বিভোর। ভূইচাপাতি গুলো প্রায় সারা সময়ই চাপা পড়ে কষ্ট পায়। তার ওপর বাদাম খোলার গুলতানি। লাজ লজ্জার বালাই নাই। লুটিয়ে পড়ে একে অপরের গায়ে। একের পর এক...।

দীপা এসেছিল। প্রতিদিনই আসে। সে আসতে চায়না। কিন্তু স্বস্তি পায় না, না আসা পর্যন্ত। একটা তাড়না তাকে তাড়িয়ে নিয়ে আসে এখানে। একটা আশা, একটা আকর্ষণ তাকে ছুটিয়ে নিয়ে আসে এখানে। সে খুঁজতে আসে কিন্তু কিছুই খোঁজে না। দেখতে আসে কিন্তু কিছুই দেখে না। প্রতিদিন কৃষ্ণচূড়া হতে তিন গজ উত্তরের সবুজ তার স্পর্শ পায়। আর পায় একটা করে ঢালাই নীল রুমাল। এখানে যাদের নিয়মিত আনাগোনা তার ইতিমধ্যে দীপাকে চিনে ফেলেছে। তার চেহারাটা মায়াবী কিন্তু সে কখনো বাদাম না নিয়ে বাচ্চা বাদামওয়ালাকে পয়সা ছুঁড়ে দেয়নি।

গেট পেরুতেই চোখের পর্দায় ট্রামের হুড়োহুড়ি। আকাশ নীল, কিন্তু দীপা দেখে না, দেখতে পায় না। এখানে কৃষ্ণচূড়া নেই। নেই সবুজ। উচু উচু বাড়ি গুলো বেহায়া যুবতীর ডবকা উরুর মতো গা ঘেষাঘেষি করে দাড়িয়ে আছে পাশাপাশি। ট্রাম থামে। ঝোলা বাদুরগুলোর সঙ্গী বাড়ে কিছু। দীপা এগিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে। তারপর হাটতে শুরু করে ট্রামকে পেরিয়ে। বিকেলের আকাশ আর দীপার পায়ের নিচে দিয়ে ধীরে গড়িয়ে যায় লেকটাউনের রাস্তাটা।

শেক্সপিয়রের বিশাল মূর্তিটার সামনে এসে একমূহুর্ত থামে দীপা। এক পলক তাকায়। আবার চলে। এটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে। সে শান্তি খোঁজে! শান্তি!! সে চেয়েছিল, কথাও ছিল। কিন্তু আর এলো না। কতোদিন হবে? মনে মনে উচ্চারণ করে, ‘দশ বছর!’ তারপর অবাক হয়। কি করে বয়ে গেল এতোটা দিন? দশ বছর! দিনে হিসার করলে... আস্থা হারিয়ে ফেলে দীপা। জটিল হিসাব সে আর করতে চায় না। সে চায়না জীবনের যোগবিয়োগ টানতে। কিন্তু এতো গুলো দিন! আবার ভাবে সে। ভাবতে পারে না। কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু হয়ে গেল! পেরিয়ে গেল! সেই যে ঘোরের রাত! সেই থেকে! তাকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, ‘কিছুই হবে না, তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে। আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি, একটু অপেক্ষা করো’। দীপা ঠিক ভালো হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে আসেনি, দীপা অপেক্ষা করছে। একটু...। দশ বছর...।

দরজাটা সৌমিত্রই খুলল। তার নিয়মিত চাহনি পেরিয়ে গোধুলীর দল ঢুকে পড়লো দীপার সাথে। দীপা একটুক্ষণ দাড়ালো, বেরিয়ে গেল সৌমিত্র। দরজা আটকে ওপরে উঠে এল দীপা। করিডোর দিয়ে বামে একপলক তাকিয়েই বুঝলো স্বারদা আজ আসেনি। প্রায়ই আসে না। তখন বেরিয়ে যায় সৌমিত্র। হঠাৎ অভিমান হয় দীপার। চাল ফুটিয়ে ভাত বানানো এমন কিছু নয়। অনায়াসেই পারে সে। কিন্তু সৌমিত্র! স্বারদা একদিন মিস করলেই রেষ্টুরেন্ট থেকে প্যাক নিয়ে আসবে তবু...।

বাইরের কাপড় ছেড়ে বাথরুমে এসে ঢুকলো দীপা। সৌমিত্র খাবারের প্যাক নিয়ে আগের জায়গাটিতেই এসে বসেছে। দীপা জানে আবার এখনি বেরিয়ে যাবে সে। তার প্রতিদিনের একটা বাধা গন্তব্য আছে।
দীপা বেরিয়ে ধোয়ার আধো কুন্ডুলীটা দেখলো। হাত রাখলো পিঠে, ‘আজ কি যাচ্ছ না’?
বাতাস কাপলো মৃদু, ‘যাবো’।

দাড়ালো না দীপা। আলতো পায়ে বাতাস মাড়িয়ে এসে পড়লো দামি চাদরের ওপর। ভেজা চুলের অশ্রু পিছু নিল তার। জানালাটা খোলাই ছিল। তবু তাকালো না। এগিয়ে আসলো পৃথিবী। সে সরিয়ে দিল। দু'হাতে জড়িয়ে ধরলো তুলোয় ভরা বালিশ। তারপর তার উনত্রিশ বছরের শরীরটা কামড়ে ধরলো ডোরাকাটা চাদর।

দুই.

বাতাসে ভর করে ভেসে আসছে জ্যোৎস্নারা। আকাশের ছায়া পড়ছে পৃথিবীতে। চিলতে চিলতে ঝি-ঝির ডাক মিশে যাচ্ছে রাত্রির সাথে। নিস্তব্ধতা জোয়ারের মতো ক্রমে গ্রাস করছে মুহুর্তকে। এ সময় পৃথিবীকে বড় কাছের মনে হয় সৌমিত্রের। ‘কাছের!’ শব্দটা দু’বার উচ্চারণ করলো সে। অন্যমনস্ক হয়ে গেল হইয়ে গেল হঠাৎ কিন্তু পৃথিবী অন্যমনস্ক হয় না, এগিয়ে চলে। একের পর ডানা মেলে জ্যোৎস্নারা। একের পর এক নিঃসাড় হয়ে যায় পাখিরা।

সৌমিত্র এগিয়ে যায়। ঢালু জমিটা এগিয়ে আসে তার দিকে। এগিয়ে আসে এক ঝাঁক দেবদারু। সে আকাশ দেখে। দেখে চাঁদ। সমস্ত আকাশ- পৃথিবী ভরে আছে বাডাবাড়ি রকমের চাঁদনীতে। চাঁদ থেকে চুইয়ে চুইয়ে জ্যোৎস্না নামছে। সৌমিত্র গা টা ধুয়ে নেয়।

নক্ষত্রগুলোকে গিলে খেয়েছে চাঁদ। তার সুবিশাল সুনশান রাজত্বে আদর পাওয়া বালুগুলাকে পদদলিত করে এগিয়ে যাচ্ছে
সৌমিত্রর বিয়াল্লিশ বছরের অভিমানী শরীর। সে তিনটে গলি পেরিয়ে চতুর্থ নম্বারে এসে থামল একটুক্ষন। তারপর হনহন করে ঢুকে গেল ভেতরে। নীল দরজাটার সামনে এসে দাড়িয়ে গেল আবার। চাঁদটা সোজা নেমে এসেছে দরজায়। সে চুপচাপ রইলো পরিচিত গন্ধটা নাকে এসে লাগা অবধি।

জ্যোৎস্নার গন্ধ পাচ্ছে সৌমিত্র। ধ্যুৎ! জ্যোৎস্নার আবার গন্ধ আসে নাকি? তবে কি আজ মাত্রা বেশী হয়ে গেল? সে কেয়ার করে না। তার চোখের নীচে এখনো ব্যাগ পড়েনি। জ্যোৎস্নায় গা এলিয়ে হাটতে থাকে সে। উল্টো দিকে। মিহি কুয়াশার ঝাক বাতাস গলে এগিয়ে আসে। হাত নেড়ে সরাতে চায় সে। যদি জীবনের জঞ্জাল গুলোকে এভাবে সরাতে পারতো! সে দেখে কুয়াশাটুকুও সরলো না।

নাহ! গুলিয়ে যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে বেশ। নয়লে এই ভরা জুনে কুয়াশা আসবে কোত্থেকে? সৌমিত্র স্থির হইয়ে দাড়াতে চেষ্টা করে। পারে না। বাতাসে উঠতে থাকে তার কাচাপাকা চুল।

সৌমিত্রর কোন দুঃখ নেই। কিন্তু দীপার আছে। সে জানে দীপা রোজ অরুণকে খুজতে যায়। যাক!! সে কখনো বাধা দেয়নি, এমনকি জানতেও চায়নি। চাইবেও না। দীপা তার সাথে আছে কিন্তু সঙ্গে নেই। সে তাকে কখনো পাশে ডাকেও নি। ডাকতে পারে না। তার মনে পড়ে যায় একটি আকুতি, ‘প্লিজ... । আমি অরুণকে ভুলতে পারবো না’। সৌমিত্রও ভুলতে পারেনি। সেই পাগলাটে ছেলেটা। যার সাথে একই ছাদে ঘুড়ি ওড়ানোর দৃশ্যগুলো সে ছুড়ে ফেলতে ছেয়েছিল, অরুন সরেছিল নিজেই, কিন্তু জিততে পারে নি সৌমিত্র। হারতে হারতেও জিতে গেল ছেলেটা।

চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৪ রাত ১১:১১
৭টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?

লিখেছেন তানভির জুমার, ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৫৩



৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×