somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ জালালী ফায়েজ

২৯ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১.

সময়টা আজ-কালকার মত ছিল না। মানুষজন তখন প্রেম করত লাইলী-মজনুকে গুরু মেনে। প্রেম তখন ছিল স্বর্গীয়। আলু-পটলের মত সস্তাও ছিল না।

সেটা আশির দশকের কথা। আমরা তিন বন্ধু- রাশেদ, কাশেম আর আমি। আমরা পড়তাম ভার্সিটিতে। সেকালে ভার্সিটি মানে অনেক কিছু, এখন তো প্রায় সব পোলা-পানই ভার্সিটিতে পড়ে। সে সময় পুরো শহর ঘুরে একজনকে খুঁজে পাওয়াও দায় ছিল।

সে যাই হোক, আমাদের তিনজনের ভিতর ছিল গলায় গলায় ভাব। আমরা যেখানে যেতাম সেখানেই তিনজন একসাথে। কোন কোন সময় মনে হত আমাদের মরণও যেন এক সাথে হয়।

কিন্তু পৃথিবীর মানুষেরা নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তাই আমিও নিষ্ঠুর হয়ে গেছি। আজ কে কোথায় থাকে তাও ঠিকমত জানা নেই।

তবে আমার স্পষ্ট মনে আছে সেইবারের কথা, যে বছর আমাদের জীবনে নেমে আসল শোকের ছায়া। না, কোন মানুষ মারা যাবার ফলে এই শোকপক্ষ এসেছিল তা নয়। সেবার মারা গিয়েছিল তিনটি হৃদয়, তিনটি তরতাজা হৃদয়।

২.

গ্রামের পথ পায়ে হেঁটে আমি আর রাশেদ চলছি হরিপুরের দিকে। হরিপুরে রাশেদের প্রেমিকা রাশেদাদের বাড়ি। একই ডিপার্টমেন্টে পড়ত রাশেদ আর রাশেদা। এক বসন্তের দিনে হঠাৎ দেখায় রাশেদাকে ভালো লেগে যায় রাশেদের। এরপর কত কি! রাশেদাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত রাশেদ। মাঝে মাঝে দু’জন সিনেমাতে যেত। আমাকেও দু’একদিন ডেকে নিত।

আমরা সবাই রাশেদের প্রেম দেখে প্রেম করার জন্য উৎসাহিত হতাম। রাশেদকে বলতাম, আল্লাহই জুটি বানিয়ে পাঠিয়েছে, তা না হলে নামেও এত মিল!

ধূলা-কাঁদা মেখে বিশ ক্রোশ পথ পাড়ি দিয়ে হরিপুরে পৌঁছালাম আমরা। হরিপুর নিভৃত এক গ্রামপল্লী। সবুজে ঘেরা হরিপুরে আছে শস্য-শ্যামলা মাঠ, বড় বড় পুকুর-ঘাট আর মাটির বাড়ি। অনেক কষ্টে রাশেদাদের বাড়ি যখন খুঁজে পেলাম তখন সন্ধ্যা লেগে গেছে।

আমরা রাশেদার ভার্সিটির বন্ধু তাই রাশেদার মা আমাদের সমাদর করলেন। আমাদেরকে একটা ঘরে থাকার ব্যবস্থাও করে দিলেন। তবে রাশেদার কোন উপস্থিতি টের না পেয়ে আমরা ইতস্ততঃ হলাম। রাতে খাবার সময় রাশেদ রাশেদার মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চাচী, রাশেদা কোথায় গেছে? ওকে তো দেখছি না।’

চাচীও কেমন জানি ইতস্ততঃ হয়ে বললেন, ‘ও তো চলে গেছে।’

চাচীকে দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস রাশেদের হল না। তাই সারা রাত আমরা ‘ও তো চলে গেছে’ বাক্যটা নিয়েই থাকলাম। ও মানে রাশেদা কোথায় গেছে? ওর কি বিয়ে হয়ে গেছে? নাকি আবার ভার্সিটিতে চলে গেছে? কোন সমীকরণই মিলাতে পারলাম না আমরা। মেয়েরা যে সাধারণত শ্বশুর বাড়িতেই যায়, এটা আমরা জানতাম। কিন্তু সেটা যেন না হয়, এ জন্য দোয়া করতে লাগলাম সারারাত।

সকালে চাচা পুকুর থেকে খ্যাপলা জাল দিয়ে বড় রুই মাছ ধরে নিয়ে আসলেন। চাচী তার পাকা হাতে তা পাক করে খাওয়ালেন। ফেরার সময় আমি চাচাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘চাচা, রাশেদা কোথায় গেছে?’

চাচা বললেন, ‘সে কথা আর বলো না বাপু। সে কথা কি বলা যায়! মান-সম্মানের ব্যাপার। দু’দিন হল গ্রামের এক ছেলের সাথে পালিয়েছে।’

আমরা তো স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চাচার কথায় যা বোঝার বুঝে ফেললাম, আর কোন কথা না বলে আমরা বাড়ির পথে হাটা দিলাম। পরো পথে রাশেদ সেদিন একটা কথাও বলে নি। আমি শুধু তাকে মেয়েদের কুটিল ছলনা তত্ত্ব বুঝাতে লাগলাম।

৩.

‘কতটা কাঁদায় তুমি পুতেছ... যে ভালোবাসবে...

কতটা কাঁদায় তুমি পুতেছ... যে ভালোবাসবে...’

আমি ভেড়ে গলায় গানটা গাচ্ছি আর আমার সাথে সাথে কাঁদা মাখা ফনিক্স সাইকেল কাঁধে নিয়ে কাশেম হাঁটছে। ফনিক্স সাইকেল মানে তখনকার দিনে এপাসি অথবা ডিসকভারি। এলাকায় কারো ফনিক্স সাইকেল থাকলে সারা তল্লাটের মানুষ তা জানতো।

আমরা চলছিলাম কাশেমের এক খালার বাসায়। কাশেম তার দূর সম্পর্কের এক খালাতো বোনকে অনেক ভালোবাসে। এক বছর হল কাশেম দেখে নি তার প্রেমিকাকে। তবে নিয়মিত চিঠি পাঠাত প্রেমিকাকে। সাথে পাঠাত চুড়ি কিংবা স্নো-পাওডার। কাশেম তার বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে সাইকেল চুরি করে এনেছিল শুধু প্রেমিকাকে একবার দেখার জন্য।

কাশেমের খালার বাসা বেশ দূরে। যাবার রাস্তাটা ছিল ধূলায় ভরা। তার উপর যেতে যেতে শুরু হল মুষল ধারে বৃষ্টি। আমরা কোনমতে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি থামলে আমরা যখন আবার রাস্তায় ফিরলাম তখন রাস্তার অবস্থা কাহিল। সাইকেলে উঠে দু’পেডেল মারতেই কাঁদাতে জ্যাম হয়ে গেল সাইকেলের চাকা। আমরা অর্ধেক পথের বেশী চলে এসেছিলাম ততক্ষণে। তাই ঠিক করলাম যে করেই হোক কাশেমের সেই খালার বাসাতেই যাবো।

সেজন্য আমাদের আর কোন পথ ছিল না। কখনো কাশেম কাঁধে কাঁদা মাখা সাইকেল নিয়ে হাঁটল, কখনো আমি।

আর আমি গাইলাম,

‘কতটা কাঁদায় তুমি পুতেছ... যে ভালোবাসবে...

কতটা কাঁদায় তুমি পুতেছ... যে ভালোবাসবে...’

অবশেষে পৌঁছে দেখি এক আজব কাণ্ড-কারখানা। কাশেমের প্রেমিকার বিয়ে হচ্ছে। কাশেমের খালা তো আমাদের এই শুভদিনে দেখে বেজায় খুশি। আমাদের মিষ্টি মুখ করালো, এছাড়াও কত কি! সুবোধ বালকের মত নিজের প্রেমিকার বিয়ে খেয়ে কাশেম আমাকে নিয়ে ছন্নছাড়ার মত বাড়ি ফিরল। কাশেমের দুঃখ তার খালাতো বোন একবারও বিয়ের আগে চিঠিতে কিছু জানায় নি তাকে।

৪.

‘আমি করিয়াছি যে আমার সর্বনাশ,

আমি হইয়া গিয়াছি দেবদাস।’

কাশেম রাশেদের করুণ অবস্থার কথা মনে পড়লেই মনে হত আমিও দেবদাস হয়ে যাব একদিন। তাই সবকিছু পাকাপাকি করার জন্যই আমি খুঁজে নিলাম উস্তাদকে। একদম কামেল উস্তাদ। কোন কাজ তার কাছে কাজই নয়। পানির মত সহজ। আমি হলাম তার শিস্য।

প্রতিদিন উস্তাদের কাছে যেতাম তার নানান কেরামতি দেখতে। কেউ একদিন হয়তো উস্তাদের কাছে এসে বলত, ‘আমার বউ গেছে ভেগে। বউ এখন কোথায় আছে খুঁজে দিন না উস্তাদ!’

উস্তাদ দু’চার ধামকি দিয়ে বলত, ‘কি এমন পুরুষ হইছিস বউ ঘরে থাকে না। দোষ খালি বউয়ের তাই না?’

তখন লোকটি উস্তাদের হাত-পা ধরে নানা অনুনয়-বিনয় করত। তারপর উস্তাদ কোন মতে রাজি হত কাজটা নিতে।

উস্তাদ লোকটিকে কোনদিন তেল পড়া দিত, কোনদিন কি সব পড়ে লোকটার বুকে ফু দিত। এভাবে চলে যেত অনেকদিন। একদিন হয়তো লোকটি এসে উস্তাদের উপর রাগ দেখাত তার বউকে খুঁজে না পাবার জন্য। আড়ালে আবডালে উস্তাদের দুর্নামও করত। সেই দিনই উস্তাদ লোকটিকে ডেকে ধমক-ধামক দিয়ে চুপ করে বসে থাকত। কিছুক্ষণ পর লোকটির কানে কানে কি যেন বলে দিত।

পরদিন দেখা যেত পুটলা ভর্তি করে বাজার নিয়ে লোকটি হাজির। পুটলা ভর্তি বাজার মানেই মুশকিল আহসান তা সবার জানা।

এভাবেই চলছিল আমার দিনকাল। হঠাৎ উস্তাদ এক আমাবস্যার আগে আমায় ডেকে বলে, ‘বাছা! অনেকদিন ধরেই ঘুর ঘুর করছো, ব্যাপার কি! মামাতো বোন!’

উস্তাদের কথায় আমিতো লজ্জায় আটখানা। হ্যাঁ, সে অচিনপুরের কোন রাজকুমারী ছিল না, সে ছিল আমার মামাতো বোন। ওর সামনে গেলেই আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যেতাম, এতেই বুঝলাম- পড়েছি আমি, পড়েছি গ্যাঁড়াকলে, প্রেমের গ্যাঁড়াকলে।

উস্তাদ কয়, ‘বুঝি রে আমি বুঝি, তোর মনের আহাজারি। তুই এক কাজ কর কালকে চারহাতি দুইটা নয়া গামছা আর দুইটা কচি ডাব নিয়ে রাতে চলে আয়। জানিস তো কাল আমাবস্যা, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

আমি আর কি করব! উস্তাদ নমঃ নমঃ। বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঝালের ভুঁইয়ে গিয়ে ব্যাগ ভর্তি করলাম ঝালে। বাজারে ঝাল বেঁচে তারপর হল গামছার ব্যবস্তা। রহিম মুন্সীর বাড়ি থেকে বন্ধুরা মিলে চুরি করলাম দুইটি কচি ডাব।

তার পরের দিন সন্ধ্যায় তল্পি-তল্পাসহ উস্তাদের দরবারে হাজির।

৫.

সময়টা শীতকাল, অন্ধকার আমাবস্যার রাত! আলো বলতে উস্তাদের হাতের টর্চ। উস্তাদ আমাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল পাশের কুমার নদে। পৌঁছে উস্তাদ আমাকে বলে, গামছা দুটো দে!

কোন কথা না বলে গামছা দুটো উস্তাদের হাতে দিলাম। ভয়ে আমার হাত কাঁপছে। এই শীতেও লক্ষ করলাম আমি ঘামছি।

উস্তাদের পরের কথায় ঘাম শুকাতেও দেরি হল না। উস্তাদ বলল, ‘নে, সব কিছু ছেঁড়ে গামছাটা পরে নে।’

আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম, বললাম, ‘এই শীতে! কি যে বলেন উস্তাদ!’

উস্তাদ বলে, ‘তোকে পারতেই হবে। তা না হলে তো শাহানাকে পাবি না।’

একি! উস্তাদ শাহানার নাম জানলো কিভাবে? উস্তাদকে মনে মনে নমঃ নমঃ করে কোন কথা না বলে কাঁপতে কাঁপতে গামছাটা পরে নিলাম। উস্তাদও আরেকটা গামছা মাজায় পেঁচিয়ে পরে নিল তবে একটুও কাঁপল না। উস্তাদের মনের শক্তি দেখে আমি অবাক হলাম।

তারপর উস্তাদ বলে, ‘ডাব মাথায় নিয়ে সোজা নদের ওপাড়ে চল। আমি তোর সাথে আছি, কোন ভয় নেই। তবে সাবধান! অনেক শব্দ আসতে পারে পিছন থেকে। ভুলেও পিছে ফিরে তাকাবি না। তাকালেই মারা যাবি।’

আমিতো শীত আর ভয় দুটোতেই একসাথে কাঁপতে থাকলাম। তাতে কি! শীত বর্ষার বিনিময়েও যদি শাহানাকে বশ করা যায়, তাহলে তা করতে আমি এক পায়ে খাড়া। তাই মনকে শক্ত করে উস্তাদের সাথে নেমে পড়লাম বরফের মত ঠাণ্ডা জলে।

একপা দুপা করে নির্জন আমাবস্যা রাতে আমি আর উস্তাদ নদ পাড়ি দিতে কাঁপতে কাঁপতে জলের মাঝে হাঁটছি। পায়ের সাথে যেন চুম্বক লেগে গেছে, পা উঠতেই চাই না। উস্তাদ প্রথমে শীতে না কাঁপলেও আমি স্পষ্ট টের পেলাম উস্তাদও কাঁপছে।

আমরা যখন নদের মাঝে তখন উস্তাদ আমাকে ফিস ফিস করে বলে, ‘কি রে? কিছু শুনতে পাইস?’

সত্যি বলছি! তার আগে কিছু শুনি নি। কিন্তু উস্তাদের কথা শোনার সাথে সাথে মনে হল চারিদিকে শত রকমের শব্দ ভেসে আসছে। পানির শব্দের সাথে ঝিঝি পোকার শব্দে এক বিদঘুটে শব্দের সৃষ্টি করেছিল সেদিন। কিন্তু আমার কাছে তখন সেই শব্দ ছিল ভয়ঙ্কর শব্দ। আমি কাঁপা গলায় উস্তাদকে বললাম, ‘জি উস্তাদ! ভয়ঙ্কর শব্দ!’

উস্তাদ বলে, ‘এই সেরেছে। আজকে বুঝি আমি আর তুই কেউ বাঁচতে পারব না। পিছনে ফিরে পালা।’

আমি বললাম, ‘কেন উস্তাদ?’

উস্তাদ ‘তবে রে! ঐ এলো!’ বলেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে নদের ধারে নিয়ে গেল। হাঁপাতে হাঁপাতে নদের ধারে উস্তাদ আর আমি বসলাম। তারপর উস্তাদ ডাব দুটো কেটে একটা আমাকে দিল, আর একটা নিজে খেল।

আর আমাকে বলল, ‘জব্বর বাঁচা বেঁচে গেছি আজ।’

তারপর উস্তাদ বলল, গামছা দুটো অভিশাপে ভরে গেছে। তাই গামছা দুটো মাঠের মাঝখানে পুতে রাখতে হবে। আমাকে বাড়ি পাঠিয়ে উস্তাদ গামছা দু’টো মাঠে পুততে গেল। আমি ভাবলাম, আসলেই বড্ড বাঁচা বেঁচে গেছি, হাফ ছেঁড়ে বাড়ির পথ ধরলাম।

৬.

একমাস যায়! দু’মাস যায় তবু কোন ফল নেই। মামাতো বোনের পানে তাকাতে তাকাতেই আমার দিন যায়। মামাতো বোন আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। এরি মাঝে উস্তাদ আমাকে দুইটা তাবিজ দিয়ে বলে, একটা তুই বাঁধবি আরেকটা শাহানার হাতে বেঁধে দিবি, তাহলেই শাহানা বশ।

শাহানার হাতে বাঁধার সাহসে কুলোয় নি, তাই তাবিজ দু’টির স্থান আমার বালিশের নিচেই হল।

উস্তাদ দেখে কিছুতেই কিছু হয় না। শাহানাকে পানি পড়া খাওয়েও কোন লাভ হল না। তাই উস্তাদ ঠিক করল তার শেষ বিদ্যা দিয়ে শেষ চেষ্টা করবে। আমাকে সেই দিনের অপেক্ষা থাকতে বলল উস্তাদ।

একদিন আমাকে হঠাৎ ডেকে উস্তাদ বলে, ‘কাল ভোরে উঠে চলে যাবি কাশীপুর। ওখানে আছে একটা মসজিদ, সেই মসজিদে দেখবি আছে তিনটা গোলাপ গাছ, সেই তিনটা গোলাপ গাছে দেখবি একটা নাবালক ফুটন্ত লাল গোলাপ, সেই ফুলটা সূর্য ওঠার আগে ছিঁড়ে আনবি। আসরের আজানের পর কিন্তু মাগরিবের আগে শাহানাকে ফুলটা দিবি। তবে সাবধান, সেই ফুল শাহানা দেখার আগে যেন কেউ না দেখে।’

আমি পরদিন ভোরে ফজরের আজানের আগে বড় ভাইয়ের সাইকেল নিয়ে ছুটলাম কাশীপুর। মসজিদটাও খুঁজে পেলাম। দেখি মসজিদের আঙিনায় সত্যিই তিনটি গোলাপ গাছ। তার একটিতে একটি লাল গোলাপ প্রস্ফুটিত হবার পথে। অনেক কষ্টে মসজিদের মুয়াজ্জিনের চোখ ফাঁকি দিয়ে সূর্য ওঠার আগে গোলাপ ফুলটা ছিঁড়ে নিয়ে আসলাম। সেটা আবার নানান কায়দায় সবার চোখের আড়ালে রাখলাম।

আর দুপুরেই ছুটলাম মামার বাসায়। পৌঁছে মামাতো বোনকে চোখে চোখে রাখলাম, যাতে সঠিক সময়ে সঠিক সুযোগ পায়। আসরের আজানের পর শাহানাকে একা পেয়েও গেলাম। শাহানাকে বললাম, ‘শাহানা, এদিকে শোন।’

তারপর সেই লাল গোলাপটি বের করে শাহানাকে দিলাম। শাহানা গোলাপটির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। আমি শাহানার হাতের ভিতর গোলাপটি গুঁজে দিলাম। শাহানা ফুলটা নিতে অস্বীকার করল না বুঝলাম।

আনন্দে যে মানুষের দমও বন্ধ হয়ে যায় আমি তা সেদিন বুঝলাম। তার সাথে এতটা আত্মহারা হয়ে গেলাম যে, উস্তাদের শেষ কথাটা মন থেকে হারিয়ে গেল।

উস্তাদের শেষ কথা ছিল, ‘ফুল দেবার পর শাহানাকে আবেগ দিয়ে নিজের মনের সব কথা খুলে বলবি। কিছু লুকাবি না।’

ফুল দেবার কিছুক্ষণ আগেও আমি শাহানাকে কি বলব সাজাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম বলব, ‘শাহানা, আমি তোমাকে অনেক দিন যাবত পছন্দ করি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

তারপর হাত ধরে বলব, ‘তুমি আমাকে ফিরিও না, তুমি বলে দাও, তুমিও আমাকে ভালোবাসো।’

তারপর উস্তাদের আশীর্বাদেই শাহানা হ্যাঁ বলে দেবে নিশ্চিত।

কিন্তু না, আমি সব কথাই বেমালুম ভুলে গেলাম। অকপটে শাহানার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। শাহানাও আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে মুচকি হাসতে লাগল। তারপর কতক্ষণ হয়েছে জানি না, হঠাৎ দেখলাম শাহানা এক ছুটে পালাল।

আমি উস্তাদের কাছে ব্যর্থ সৈনিকের মত ফিরে গিয়ে সব খুলে বললাম। উস্তাদ বলল, ‘তবে রে! এতদিন তোরে কি শিখাইছি। যেখানে খাটাবি জালালী ফায়েজ সেখানে লাগাইছিস নফিয়েজবাদ। তাহলে ক্যামনে হবে রে হতচ্ছাড়া?’

আসলে নফিয়েজবাদ হচ্ছে কোন কাজ উদ্ধারের ধীর গতির পথ। আর জালালী ফায়েজ হচ্ছে সেই পথ, যে পথে দ্রুত উদ্ধার পাওয়া যায়। উস্তাদ জালালী ফায়েজ আর নফিয়েজবাদের কথা মাঝে মাঝেই আমাকে ছবক দিত।

মানে, আমার করার দরকার ছিল মনের সংকীর্ণতা দূরে ঠেলে শাহানাকে আবেগের সাথে প্রেম নিবেদন করা। এটাই জালালী ফায়েজ।

আর আমি যেটা করেছিলাম, মানে ইশারা ইঙ্গিতে প্রেম নিবেদন সেটা ছিল এক ধরনের নফিয়েজবাদ।

৭.

প্রেমিকটির সেই দু’টি গামছা উস্তাদ কি করেছিল সেটা জানা নেই কারো। অথবা প্রেমিক কোনদিন জালালী ফায়েজ বিদ্যা রপ্ত করে তার মামাতো বোনকে তার মনের কথা বলেছিল কিনা জানা নেই। জানা নেই, প্রেমিক তার বন্ধুদের মত দেবদাস হয়েছিল কিনা। তবে প্রেমিকের কাছে আজো অজানা, কি করে উস্তাদ শাহানার নাম জেনেছিল অথবা কি করে উস্তাদ জেনেছিল তিনটি গোলাপগাছে একটি ফুটন্ত লাল গোলাপই থাকবে।

সুতরাং অতপরঃ সেদিন প্রেমিককে কিরূপে দেখলাম তা আর নাই বললাম।

***সমাপ্ত***
১০টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×