somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিপন্ন বনের বিপন্ন মানুষদের উষ্ণতায় (তৃতীয় কিস্তি)

০৭ ই নভেম্বর, ২০০৭ বিকাল ৫:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বচনদার সাথে আমাদের সর্ম্পক অনেকদিনের। কবিতা, কেবল কবিতার জন্য এই লোকটা তার জীবনকে বদলে নিয়েছে। বা বলা চলে কবিতার প্রতি নিখাত প্রেমই তাকে বদলে দিয়েছে। এলাকার সবাই জানে বচন সারাদিন চু এর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে আর কি সব লেখালেখি করে। কবিতা লেখার জন্য কতবার যে মিশন ফাদারের বিরাগভাজন হতে হয়েছে তাকে, আত্মীয়-স্বজনের কাছে লাঞ্চনা-গঞ্জনাও সইতে হয়েছে। কারণ তার কবিতায় নাকি যিশু বন্দনার বদলে তাতারা, গুয়েরা, সালজংদের স্তুতি থাকে। কিন্তু কবিতো মিথ্যা বলতে শিখেননি, ভণিতা করতে শিখেননি। দেবতা গুয়েরা যেই মান্দিদেরকে লড়াই শিখিয়ে গেছেন, সেই মান্দিদের রক্ত যে তার শরীরে! তাদের রক্তইতো তাকে আপস করতে দেয় না। বরং অভিমানী সংস্রেক দেব-দেবতাদের মান ভাঙাতে নিজের বড় মেয়ের নাম রাখেন সুসিমি ওয়ানগালা আর ছোটটার রিম্মত আমুয়া।

বচনদাকে যতটুকু জানি তিনি আগাগোড়াই একজন প্রেমিক মানুষ। তার এই প্রেম কবিতার প্রতি-মানুষের প্রতি-চারপাশের প্রতি-আপন বিশ্বাসের প্রতি-সংস্কৃতির প্রতি। প্রথম পরিচয় থেকেই কেন জানি বচনদা আমাদের সকলের ভালবাসার জন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছেন। ভালবাসার বেহিসেবে আচরণের কাছে নত হয়ে কত রাত যে আমরা পাগলামো করেছি তা গুণে রাখিনি। মনে আছে এক জ্যোৎস্না রাতে বচনদার বাড়িতে পরাগ, আমি আর দুপুর মিত্র গিয়েছিলাম । গিয়ে দেখি আরো অনেক লোকজন সেখানে ভর্তি। চু এর নেশা যতই বাড়তে ছিল বিপরীত ভাবে লোকজনও কমতে ছিল। শেষ পর্যন্ত আমরা চারজন। চারজনের মধ্যে তিনজনই আবার কবি। সেই রাতে বচনদার মাটির ঘরের বারান্দা বানে ভেসে যাচ্ছিল, জ্যোৎস্নার বানে। বচনদা গলা ছেড়ে গান ধরেছিলেন। ভূপেন হাজারিকার গান বেশ পছন্দ তার। বচনদা বলল-না এভাবে চেয়ারে বসে বসে ভাল লাগছে না, আমাদেরও লাগছিল না। চাঁদের আলো যদি এত দূর থেকে ভালবাসার টানে আছরে পড়তে পাড়ে, তাহলে আমরা মাটির এত কাছে থেকেও কেন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না। শেষে সবারই মনে হলো আমরাও মাটির আরো কাছে যেতে চাই, তার বুকে নিজেকে সঁপে দিতে চাই। শুয়ে পড়লাম বারান্দায়। চাঁদের আলোয় চোখ জ্বলজ্বল করছে আমাদের। কবিতা হলো, কবিতা, অনেক... অনেক কবিতা। কবিতার একেকটি শব্দ, ছন্দ যেন আমাদের ভেতরের কোন কিছুকে বারবার নাড়া দিয়ে যাচ্ছিল। চু এর চাইতেই আরো বেশি নেশাসক্ত হচ্ছিলাম আমরা। অনেকক্ষণ এভাবে কাটানোর পর বচনদা আমাদের নিয়ে গেলেন তার প্রিয় সেই চুনিয়া ব্রিজে। একটু আবেগ প্রবণ হয়ে গেলেই বচনদা চলে আসেন এই ব্রিজে, ব্রিজের রেলিংয়ে শুয়ে শুয়ে কবিতা-গানে রাত কাবার করে দেন। অনেক সুন্দর সুন্দর কবিতাও লিখেছেন এই চুনিয়া ব্রিজকে নিয়ে। চুনিয়া, হ্যাঁ, বর্তমানে সংস্রেক মান্দিদের প্রাণকেন্দ্র, পরেশ মৃ'র (হা.বিমানি মান্দি রাজা,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠজন) চুনিয়া, কবি রফিক আজাদের আর্কেডিয়া। বাংলাদেশে এত মান্দি এলাকা থাকতে কবি রফিক আজাদ কেন চুনিয়াকেই তার আর্কেডিয়া বলেছিলেন তা চুনিয়া আসার আগে আমি নিজেও বুঝিনি। আমার দেখা মান্দি সং (গ্রাম) গুলোর মধ্যে চুনিয়াকে আলাদা করেই দেখি। এখানকার সবকিছুইতেই যেন একটু বিশেষত্বের ছোঁয়া। কেন এমন মনে হয় তা হয়ত ব্যাখ্যা করে বুঝাতে পারব না। এ একান্তই আমার অনুভবের কথা।

বচনদার মায়ের বাড়িতে চু পান শেষে তিরেশ নকরেকম অলিশন মৃ সবাই সেখানেই রাতের খাবার সেরে নিলাম। আমার অনিচ্ছা সত্বেও সেখানে খেতে হল। কেননা আমি জানি বাইরে যত জায়গায় যত কিছুই খাই না কেন, চুনিয়াতে বিজন্তীদি ভাত নিয়ে বসে থাকবেন আমার জন্য; যত রাত করেই ফিরি না কেন। আমাকে একমুঠো হলেও সেই ভাত খেয়ে তারপর শুতে হবে। এ যেন ভালবাসার এক চিরন্তন নিয়ম। আমি বা আমরা কেউই এই নিয়মের বরখেলাপ করার দু:সাহস কখনো দেখাই না। যাক, গপ্যা (মান্দিদের নিজস্ব অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার, সাধারণত মুরগীর নাড়ি-ভুড়ি, মাংস অথবা মাছ পেয়াজ-কাঁচা মরিচ দিয়ে কলাপাতায় রেখে বাষ্পরোধী অবস্থায় সেদ্ধ করে তৈরি করা হয়) দিয়ে ভাত খেয়ে বাকি দু'জনকে বিদায় করে আমরা দু'জন চলে এলাম চুনিয়া ব্রিজে। অনেককথা হল সেদিন আমাদের। কবি শুনালেন তার প্রেমের কথা, তার বেদনার কথা। যে বেদনাকে তিনি স্বেচ্ছায় বরণ করেছেন বারেবার। গলা ছেড়ে লক্ষ্মীপূর্ণিমার সামান্য ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের পানে তাকিয়ে কবি বলছেন-"দু:খ দাও, আমাকে দু:খ দাও। আমি দু:খের সাথেই বাঁধব আমার সারথি। দুনিয়ার যত দু:খ আছে, সব...সব আমাকে দাও। আমি তোমাদের দেব আমার হৃদয় নিঙড়ানো ভালবাসা, আমার কবিতার প্রতিটি শব্দে-বাক্যে-ছন্দে।" কবি বলে চলেছেন প্রেমের কথা, বেদনার কথা, ভালবাসার কথা। আজকেই কবি বললেন তার প্রথমার কথা। তাকে সেদিন সে নিজেই দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন, কেননা কবির দরকার দু:খ... দু:খ... কেবলি দু:খ। ঝর্ণা চিরানের সাথে তার বিয়েটা ভালবাসারই পরিণতি, এখনো সেই ভালবাসা দিনে দিনে আরো মজবুত হচ্ছে। কিন্তু তারপরও প্রথমার প্রেম আজও তাকে কাঁদায়-ভালবাসায় কবিতার গোপন কুঠুরিতে। চু এর নেশায় আমি শরীরের তাল সামলাতে পারছিলাম না। কয়েকঘন্টা কবির সাথে কাটানোর পর বিজন্তীদির কথা বলে স্বার্থপরের ন্যায় আমি চলে এলাম চুনিয়াতে জনিক আচ্চুর বাড়িতে। দিদির দেয়া ভাত আজ রাতেও একমুঠো খেতে হলো। চু খেয়ে শেষ অবস্থায় আছি দেখার পরও দিদি আরো একগ্লাস বিচ্চি (চু পাত্রে জমে থাকা প্রথম পর্যারের রস-বেশ কড়া) রেখে গেলেন ঘরে আমার থাকার ঘরে। আমি আপন মনে হেসেই এক চুমুক দিয়ে গ্লাস রেখে ঝাপিয়ে পড়লাম বিছানায়।

সকালে জনিক আচ্চু ঘুম থেকে জাগালেন। নাস্তা সারার পর আচ্চুর সাথে আলাপ করতে বসলাম তাঁর নকমান্দিতে। দু'জনের পারিবারিক নানান বিষয়াদি শেষে ওয়ান্না নিয়ে কথাবার্তা শুরু হল। ২০০৩ সাল থেকে চুনিয়াতে জনিক নকরেক এর উদ্যোগে সংস্রেক মান্দিরা বছর বছর তিনদিন ব্যাপী ওয়ান্না পালন করে যাচ্ছেন। প্রথম ওয়ান্না থেকেই মিসি-সালজংদের প্রতিনিধি (সংস্রেক মান্দিরা বিশ্বাস করেন, ওয়ান্নাতে আগত সকল অতিথিরাই মিদ্দি মিসি-সালজংদের প্রতিনিধি) হিসেবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে। তো, এবার কীভাবে, কী করা যায় সে নিয়ে বিভিন্ন পরামর্শ করলেন। মিশন যেহেতু করছে না তাই আচ্চুর ওয়ান্নার দিকেই এবার সবার দৃষ্টি। আমি জানি যত কষ্টই হোক, ৯৮ বছর বয়সী জনিক নকরেক সহজে ভেঙ্গে পড়ার পাত্র নন। এই বয়সেও সে সংস্রেক বৃদ্ধ তাঁর আপন বিশ্বাসের দ্রোহী চর্চাকে জারি রাখতে পারেন পারিপার্শ্বিক চাপকে মোকাবেলা করে, এবারও তার ব্যতয় তিনি হতে দেবেন না। নতুন প্রজন্মের কাছে এ নাকি তাঁর দায়বদ্ধতা! আমি অবাক বিষ্ময়ে চেয়ে থাকি আচ্চুর ভাঁজপরা স্নিগ্ধ-তেজস্বী মুখপানে। এমন দৃঢ় মনোবলের মানুষের সাথে কথা বলে প্রতিনিয়ত আমি যেন নিজের ভেতরই সচল থাকার একটা প্রেরণা খুঁজে পাই। হার না মানার সাহস পাই।(অসমাপ্ত)
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×