somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পর মতোঃ পিতাকন্যা কিংবা মাতাপুত্র

১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৩:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শান্তার আব্বা শিশুদের মতো হয়ে গেছেন। সত্তুর উর্ধ্ব বছরের মানুষটা হঠাৎ করেই যেন একেবারেই ছোট্ট একটা শিশুতে বিবর্তিত হয়ে গেছেন।

কাল বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে আইসিইউর ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মিলেছিল। একটা পুরো রাত আর দিন অপেক্ষায় প্রতিক্ষায় শান্তা বাবাকে দেখতে চেয়ে প্রচণ্ড অস্থিরতায় ছটফট করেছে। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হতেই ছটফট করতে থাকা শান্তা সঙ্গে সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই ছুটে গেছে বাবাকে দেখতে।

শান্তার বাবা আইসিইউর বিছানায় শুয়ে আছেন। সংজ্ঞাহীন নন। উল্টো বরং সংজ্ঞা খুব বেশি টনটনে তাঁর। হাত দুটা বিছানার দু পাশে ব্যান্ডেজ পাকিয়ে দড়ির মতো বানিয়ে সেটা দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

জানা গেল, শুয়ে থাকতে তাঁর প্রবল অনীহা। একটু পরপরই বিছানা থেকে উঠে বসেন। তারপর নাকের তরল খাদ্যর পাইপ, কব্জির স্যালাইন, মূত্রথলির ক্যাথেটার- সকলই খুলে ফেলে উঠে দাঁড়াতে চান। তখন ছুটে আসেন নার্সেরা। কি হয়েছে জানতে চান। শান্তার বাবা খুব নির্বিকার আর আলাপী ভঙ্গীতে নিতান্ত পরিচিতের মতো বলেন, ‘এগুলা খুলে দেন তো।’

‘কেন!’ বিস্মিত নার্সেরা বলেন।

‘দোকানে যামু। চা খামু।’ ভাবলেশহীন বলেন তিনি।

তাঁর চায়ের তৃষ্ণা পেয়েছে। তাঁর পান খাওয়া অভ্যাস। তাঁকে পান খেতে হবে। পান না খেলে তাঁর নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসে। সে কারণেই তিনি ঝামেলা ছিঁড়েখুলে ফেলে দোকানে রওনা করেছেন।

এখন আইসিইউর রোগী যদি স্যালাইন-ট্যালাইন টেনে খুলে ফেলে দোকানে গিয়ে সুরুত সুরুত করে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে, তর্জনীর ডগায় চুন নিয়ে যদি আয়েশ করে পান চিবাতে থাকে, তাহলে নার্সদের চাকরি থাকার কথা না। চাকরি তো হারাবেই, সেইসঙ্গে নার্সদের অস্তিত্বও সংকটের মুখে পড়বে। এদেশে রোগীর স্বজনদের রোষ তো বেশ জনপ্রিয়। ফলে, নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই নার্সেরা শান্তার বাবার হাত দুটা বিছানার দুপাশে ব্যান্ডেজ পাকিয়ে সেটা দিয়ে বেঁধে রেখেছেন।

শান্তা দ্রুত এগিয়ে বাবার বিছানার পাশে দাঁড়ায়। এরপর কাঁদতে শুরু করে দেয়। কাঁদতে কাঁদতেই বাবার সারা গায়ে মাথায় হাত বোলাতে থাকে। আর কাঁদে। আর কথা বলে। বাবার খোঁজখবর জানতে চায়।

কান্না করতে ব্যস্ত কন্ঠকে সংবরণ করার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘আব্বা কেমন আছেন?’

সে প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারও বলে, ‘আব্বা আপনের ব্যথা আছে?’

‘আব্বা ডাক্তার বলছে আপনে সুস্থ হয়ে যাবেন।’

‘আব্বা আপনে একটু ভালো হইলেই আপনেরে আমরা বাড়ি নিয়া যাব।’

কথা বলতে বলতে শান্তার কন্ঠ বুঁজে আসে। নিঃশব্দ কান্নায় শান্তার চোখ দুটা বেয়ে অশ্রু ঝরতে থাকে। খুব ঘনঘন চোখ মুছতে মুছতে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুদের পুরো মুখটায় লেপ্টে দেয় শান্তা। আর কথা বলতে থাকে বাবার সঙ্গে। কথা শান্তা একাই বলে না, ওর বাবাও বলেন। বলতেই থাকেন অনবরত।

‘ফোরকানের দোকান থেকে আমারে একটা পান আইনা দিবি?’

‘দিব আব্বা।’

টকটকে লাল চোখে ফোঁপানো কান্নায় ভেজা শান্তার মুখটা হেসে ওঠে। ওর চোখে তখন প্রশ্রয় ঝিলিক মারে। ফোরকানের দোকান থেকে কত কত মাইল দূরে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকা বাবা সেটা বুঝতে পারেন না। শান্তাও সেটাকে এড়িয়ে গিয়ে শিশুকে প্রবোধ দেওয়ার মতো করে কথা দেয়, ফোরকানের দোকান থেকেই পান এনে দেবে।

‘আমার শার্টের পকেটে পঞ্চাশ টেকা আছে, দেখ।’ বলেন বাবা পরম নির্ভরতায়।

‘আমার কাছে টাকা আছে আব্বা।’ আরও প্রবলভাবে বাবার নির্ভরতা হয়ে উঠতে চায় কন্যা।

একটু পরেই বলে, ‘ আব্বা, ডাক্তার পান আনতে দেয় না।’

মুহূর্তে রেগে ওঠেন পিতা। রাগ কন্যাকে পাশ কাটিয়ে চিকিৎসকের দিকে ধাবমান হয়। বলে ওঠেন, ‘শয়তান ডাক্তার।’

তারপর তাদের কথা চলতেই থাকে। ইস্! কতরকমের কথা যে বলতে থাকে তাঁরা! কথাদের সঙ্গে বিরামহীন কান্নায় ভেসে যেতে চায় শান্তার চোখ দুটো। কিন্তু ঠোঁটে মুখে থেকে থেকেই হাসি। উচ্চারণে ছেলেভোলানো কথারা ভীড় করে আসে শান্তার মুখে। তারপর আবারও কান্নারা এসে ভীড় করে। আমি বাধা দেই না কান্নায়। কাঁদতে দেই। বলি না, অসুস্থ পিতার সঙ্গে এত এত কথা বলতে নেই।

সামান্য ব্যবধানে দাঁড়িয়ে আগলভাঙা প্রবল মুগ্ধতায় পুত্র আর মাতার কথোপকথন দেখতে থাকি। মা তার ছেলের বায়নার কোনকিছুইকেই ‘না’ বলেন না। কথা দেন, আকাশ থেকে শুকতারাটাও এনে দেবেন ছেলেকে। শুধু একটু সবুর করতে বলেন। পুত্র সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলে তখন সকলই এনে দেবেন।

গোঁয়ার আর জেদী পুত্র শুনবে না সে কথা। তাঁর চাওয়াগুলো এক্ষুণি চাই। মা তখন খুব করে কৌতুক অনুভব করেন। কৌতুকে হাসেন। এ হাসির নাম প্রশ্রয়ের হাসি।

পিতা-কন্যার দৃশ্যপটের অবস্থান কখন উল্টেপাল্টে গেছে, আমি বুঝতে পারি না। শুধু দেখি প্রবল পুত্রস্নেহ উপচে পড়া মা কাঁদছেন। এ কান্না অসহায় মানুষের কান্না। এ কান্নাকে চেনাজানা মানুষেরা জানে- এ কান্না কাঁদতে পারা মানুষেরা কতটা ক্ষমতাহীন।

আমি এগিয়ে দিয়ে শান্তার পাশে দাঁড়াই। ওর পিঠে হাত রাখি। চুপ করে থাকি। কথা বলি না। এসময় এখানে কথাদের কোনও কাজ থাকে না। কথারা এখানে পঙ্গু, মূক ও বধির।

কথারা এখানে মাতা কিংবা কন্যার চেয়েও অসহায়।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৩:৩৫
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×