পাক-সৈন্যরা আবার হামলা করতে আসছে। এই খবরটা পৌছে গিয়েছিল চন্দ্রগঞ্জে। সুবেদার লুৎফর রহমান এখন সেইখানে নেই, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কেউ নেই। এবার কে তাদের প্রতিরোধ করবে? ওরা সেদিন আচ্ছামত ঘা খেয়ে ঘরে ফিরে গেছে, এবার ভাল করেই তার প্রতিশোধ তুলবে। চন্দ্রগঞ্জকে এবার ওরা ধ্বংসস্তুপে পরিণত না করে ছাড়বেনা। যাকে পাবে তাকেই মারবে। ওদের হাতে কেউ কি রেহাই পাবে? সারা অঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। চন্দ্রগঞ্জের মানুষ ঘর-বাড়ী ছেড়ে পালাতে লাগল। ওরা ওদের যা করবার বিনা বাধায় করে যাবে। কিন্তু চন্দ্রগঞ্জের একটি মানুষ এই কথাটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। মাত্র সেদিন এই চন্দ্রগঞ্জের বুকে ৭ জন মুক্তযোদ্ধা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ দিয়ে দুর্দ্দান্ত পাক-সৈন্যদের দুর্দশার চূড়ান্ত করে ছেড়ে দিয়েছে। এই বীর মুক্তিযোদ্ধারা এই অঞ্চলেরই মানুষ, এই মাটিতেই মানুষ হয়ে উঠছে। এখানকার মানুষ, শুধু এখানকার নয়, সারা নোয়াখালী জিলার মানুষ তাদের জন্য গৌরববোধ করে। রাস্তার ধারে সেই ইটের স্তুপটি এখনও সেই যুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ রুপে বিরাজ করছে। এর মধ্যে তার কথা কি আমরা ভুলে যেতে পারি? আজ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কেউ এখানে নেই বলে ওরা অবাধে যা খুশি তাই করে চলে যাবে। না, কিছুতেই না, গর্জে উঠলেন তিনি, এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না। আর যদি কেউ না যায়, আমি একাই যাবো, একাই গিয়ে ওদের সঙ্গে লড়াই করবো।
কে এই লোকটি? কি তাঁর নাম? না, তার নাম আমার জানা নেই। কোন খ্যাতনামা লোক নন তিনি। একজন প্রাক্তন সৈনিক। আর দশজন বৃদ্ধের মত তিনিও তাঁর জীবনের শেষদিনগুলি ‘আল্লাহ আল্লাহ’ করে কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন সাধারণ মানুষ। কেউ কোনদিন তাঁর কোন অসাধারণত্বের পরিচয় পাননি। কিন্তু আজ দেশের এক বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ অনুকূল মুহূর্ত তাঁর ভেতরকার সুপ্ত আগুনকে জাগিয়ে তুলেছে। যেখানে হাজার হাজার মানুষ ভয়ে অস্থির, সেখানে এই একটি মানুষ দৃঢ় নিষ্কম্প কন্ঠে ঘোষণা করলেন, যদি একা যেতে হয়, আমি একাই যাবো, আমি একাই ওদের সঙ্গে লড়াই করব। মরবার আগে এই হিংস্র পশুগুলির মধ্যে একটাকেও যদি মেরে যেতে পারি, তবে আমার জীবন সার্থক হবে।
যারা তার হিতৈষী, তারা তাঁকে নিবৃত্ত করবার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল। বলেছিল. তুমি একা মানুষ, তার উপর বুড়ো হয়েছ। তুমি কি করে ওদের সঙ্গে লড়াই করবে? কিন্তু কারও কোন বাধা তিনি মানলেন না, দৃঢ়-মুষ্টিতে রাইফেলটা আঁকড়ে ধরে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। তাঁর এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর তরুণ ছেলে তাঁকে ডেকে বলল, দাঁড়াও আব্বা, আমিও তোমার সঙ্গে যাব। তোমার মত আমিও ওদের সঙ্গে লড়াই করব। ছেলের কথা শুনে বাপের মুখ আনন্দে উজ্জল হয়ে উঠল। দু’জনের হাতে দুটি রাইফেল, পিতা-পুত্র পাশাপাশি প্রতিরোধ সংগ্রামে যাত্রা করল।
আজও ওরা সেই ইটের পাঁজার পেছনে আশ্রয় নিল। ওরা পিতা-পুত্র পাশাপাশি বসে শত্রুদের আগমনের জন্য অধীর চিত্তে প্রতীক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদের দূর থেকে মোটর ভ্যানের গর্জন শোনা গেল। হ্যাঁ ওরা আসছে। দেখতে দেখতে সৈন্যবাহী গাড়ী একেবারেই কাছে এসে পড়ল। সৈন্যদের মধ্যে অনেকের কাছেই ইটের পাঁজাটি সুপরিচিত। ঐটিকে ভুলে যাওয়া তাদের পক্ষে কোন মতেই সম্ভব নয়, কিন্তু আজও যে কেউ তাদের আক্রমণ করার জন্য এর আড়ালে ওত পেতে বসে থাকতে পারে, এটা তারা ভাবতে পারেনি। ভাবতে না পারা অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু ওরা এই স্তুপটার বরাবর আসতেই পরপর তিনজন সৈন্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেল। সবাই দেখতে পেল, কে বা কারা তাদের লক্ষ্য করে স্তুপটার আড়াল থেকে গুলিবর্ষণ করে চলেছে। সঙ্গে সঙ্গেই সৈন্যরা এর পাল্টা জবাব দিল। ইটের পাঁজাটাকে লক্ষ্য করে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বর্ষণ চলল। এরপর সেই স্তুপের পেছন থেকে আর কোন গুলির শব্দ শোনা গেল না। সৈন্যরা একটু সময় অপেক্ষা করল, তারপর ছুটে গেল স্তুপটার সামনে। উদ্যত রাইফেল বাগিয়ে ধরে যখন তারা পায়ে পায়ে সেই স্তুপটার পেছনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন দেখতে পেল, সেইখানে এক বৃদ্ধের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে আছে।
কিন্তু অস্ত্র বলতে কোন কিছু সেখানে নাই, শুধু কয়েকটা কার্তুজের খোল পড়ে আছে।ওরা বুঝল, এই বৃদ্ধের সঙ্গে আরও যারা ছিল তারা অস্ত্রসহ পালিয়ে গিয়েছে। আমি ভাবছি, যেদিন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হবে, স্বাধীন হবে, সে দিন পবিত্র এই জায়গাটিতে সেই গৌরবময় প্রতিরোধ সংগ্রামের স্মারক হিসাবে একটি স্মৃতিস্তম্ভ কি গড়ে উঠবে? চন্দ্রগঞ্জের যুদ্ধের পর সুবেদার লুৎফর রহমান নোয়াখালীর বিভিন্ন অঞ্চলে শিকারের সন্ধানে ছুটে চলছিলেন। তাঁর এক মুহূর্তও বিশ্রামের অবকাশ নেই। তিনি পাক সৈন্যদের গতিবিধি সম্পর্কে দক্ষ শিকারীর মত তীক্ষ্ণ সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ফিরছিলেন। মুক্তিবাহিনীর গুপ্তচরেরা নিত্য নতুন সংবাদ নিয়ে আসছে। আর সেই সূত্র অনুসরণ করে তাদের মুক্তিবাহিনী যেখানেই সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেই শত্রুদের উপর ঘা দিয়ে চলেছে।
আঘাতের পর আঘাত হানো কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে, কখনও সামনে থেকে, কখনও বা পেছন থেকে। ওদের অস্থির আর পাগল করে তোল। ওদের কোন সময় স্বস্তিতে বা শান্তিতে থাকতে দিও না, ওদের প্রতিটি মুহূর্ত দূরভাবনায় কাটুক। ওরা যেন ঘুমের মধ্যেও দূস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠে। মুক্তিবাহিনী এই নীতি অনুসরণ করেই কাজ করে চলছিল।ওরা হামলাকারীদের নিশ্চিত মনে বিশ্রাম করতে দেবেনা, নিজেরাও বিশ্রাম নেবেনা।
এপ্রিলের শেষভাগ। খবর এল, একদল সৈন্য কুমিল্লার লাকসাম থেকে ট্রেনে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছুবে। লুতফর রহমান এই খবর পাওয়ার সাথে সাথেই তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে বসলেন। স্থির হোল, ওদের বিনা বাধায় এগোতে দেওয়া হবেনা, সোনাইমুড়ি স্টেশনেই এই হামলাকারীদের উপর হামলা করতে হবে। রেলস্টেশনে চড়াও হয়ে আক্রমণ। হয়তো সেজন্য মুক্তিবাহিনীকে বেশ কিছুটা মূল্য দিতে হবে, অনেক ক্ষয়ক্ষতি বরণ করে নিতে হবে। তা হোক, এই শিকারকে কিছুতেই ফসকে যেতে দেওয়া চলবে না।
কিন্তু এবার আর চন্দ্রগঞ্জের মত সাতজন মুক্তিযোদ্ধা দিয়ে চলবেনা। এবার আর আগেকার মত আড়াল থেকে যুদ্ধ নয়, যুদ্ধ চলবে প্রকাশ্য, মুখোমুখি। ওদের সৈন্য সংখ্যা বড় কম নয়, আক্রমণ করতে হলে বেশ কিছুটা শক্তি সংগ্রহ করে নিতে হবে। সেই অল্প সময়ের মধ্যেই পঞ্চাশজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাকে সোনাইমুড়িতে এনে জড় করা গেল। অবশ্য যতদূর জানা গিয়েছে সৈন্যদের সংখ্যা এরচেয়েও অনেকটা বেশী, তা হোক, এই শক্তি নিয়েই ওদের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।
নির্দিষ্ট সময়ে সৈন্যবাহী ট্রেনটা সোনাইমুড়ি স্টেশনে এসে পৌছল। মুক্তিবাহিনী কাছেই কোন একটা জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ট্রেনটা এসে পৌছাবার সাথে সাথেই রাইফেলধারী মুক্তিযোদ্ধারা বিদ্যূতগতিতে ছুটে এসে ট্রেনটাকে ঘেরাও করে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তারা ট্রেনের আরোহীদের লক্ষ্য করে গুলি চালাতে লাগল। ওরা গাড়ীর ইঞ্জিনটাকেও লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ছিল। ড্রাইভারহীন ট্রেনটা অচল হয়ে গেল।
প্রকাশ্য দিবালোকে এইভাবে আক্রান্ত হতে হবে, পাক সৈন্যরা তা কল্পনাও করতে পারেনি। তারপর ঘটনাটা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, একটু সময় ওরা হতভম্ব আর স্তব্ধ হয়ে রইল। পর মুহূর্তেই তারা তাদের রাইফেল বাগিয়ে ধরে হুড়মুড় করে কামরা থেকে প্লাটফর্মের উপর নেমে পড়তে লাগল। ওদের মধ্যে কয়েকজনকে কামরা থেকে নামবার আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে প্রাণ দিতে হল।
এবার দু’পক্ষে শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। এবারকার বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে রেলস্টেশনের উপর এ ধরনের লড়াই আর কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি রেলস্টেশন এজন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রায় তিনঘন্টা ধরে এ লড়াই চলল। এই যুদ্ধে পঁয়ত্রিশজনের মত পাক সৈন্য নিহত হয়েছিল।মুক্তিযোদ্ধাদের ছয়জন শহীদ হলেন। ইতিমধ্যে খবরটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। খবর পেয়ে ঘন্টাতিনেক বাদে আক্রান্ত পাক-সৈন্যদের সাহায্য করার জন্য চৌমুহনী থেকে সামরিক ভ্যানে করে একদল সৈন্য ঘটনাস্থলে এসে পৌছল। এবার পাক সৈন্যদের মোট সংখ্যা দাঁড়াল আড়াইশতের উপরে। হতাহতের বাদ দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা তখন আনুমানিক চল্লিশ এ এসে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা নির্বুদ্ধিতার নামান্তর মাত্র। মুক্তিযোদ্ধারা এমন ভুল কখনও করেনা। তারা যেমন বিদ্যূৎগতিতে এসে আক্রমণ করেছিল, তেমনিভাবেই ঘটনাস্থল থেকেই অদৃশ্য হয়ে গেল। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করে আক্রমণ করতে চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হল।
।।শেষ।।
*রবিউল হোসেন কচি সম্পাদিত নোয়াখালী পৌরসভা কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক স্মারকগ্রন্থ “নোয়াখালী” থেকে নেয়া হয়েছে। প্রকাশকালঃ ২ জুলাই ১৯৯৮।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


