নব্বইয়ে চিকা মারার ব্যাপক প্রসার ছিল। চিকার ভাষা উঠে আসতো নেতাদের বক্তৃতায়। আবার মিছিলের শ্লোগান উঠে আসতো চিকায়। যেসব রাজনৈতিক সংগঠন চিকা মারার বিষয়টিকে তাদের মূল কার্যসূচিতে গুরুত্বের সঙ্গে রাখতো তারা পার্টি অফিসে বসে দিনের পর দিন অনেক মেধা খরচ করে কাটাছেঁড়া করে চূড়ান্ত করতো চিকার ভাষা। কুষ্টিয়া ফিসারিজ অফিসের দেয়ালে প্রায় অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া একটি অসমাপ্ত কিংবা খণ্ডিত পংক্তির কথা আজো মনে পড়ে। ‘.......দাসোচিত জীবনের প্রতি তীব্র আঘাত হানো’। ব্যাপারটি ছিল এমন যে ‘ আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’ । আমাদের খুব মনে ধরতো। আমি ওই অসমাপ্ত লাইনটিই কলেজের খাতার ওপর লিখে রেখেছিলাম। যা হোক, সেটি আমার এক খণ্ড ব্যক্তিগত স্মৃতিমাত্র। যা আলোচনা করা উদ্দেশ্য নয়। সেসময়ের পরিবর্তন পিয়াসী রাজনৈতিক চেতনা মনে আসল, তাই তুলে ধরা।
বাংলাদেশে পরিবর্তন নিয়ে কথাবার্তা আজ শুরু হয়নি। আশির দশকেই মানুষ পরিবর্তনের জন্য পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিল। পরিবর্তনের জন্য গণজাগরণও তৈরি হয়েছিল। তখন পাল্টানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল সবকিছু। এমনকি মানুষের চেতনাও। পরিবর্তনের নেশায় প্রগতিমণা সংগঠনগুলোর শ্লোগান অল্পতেই চাউর হয়ে যেত দেশব্যাপী। দেশের একেবারে প্রান্তে তেঁতুলিয়া কিংবা পাবর্ত্য বান্দরবানের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্রনেতাদের মুখ থেকে আগুণ ঝরতো প্রচলিত ব্যবস্থা আর দুঃশাসনের অবসান প্রার্থনায়। এই চেতনার স্বপ্ন কিন্তু রোপিত হয়ে গিয়েছিল গ্রামের একজন গৃহিনী, আশিতীপর বৃদ্ধা থেকে শুরু করে স্কুলগামী ক্ষুদে শিক্ষার্থীর মনেও। আর দেশের সব মানুষের মধ্যে এমন অদম্য পরিবর্তন চেতনা ঢুকেছিল বলেই নব্বই এসেছিল। গণতন্ত্রের চিন্তা এসেছিল। মানুষ গণতন্ত্রের জন্য উন্মুখ হয়েছিল বলেই অভুত্থান ঘটেছিল। স্বৈরশাসনের অবসান ঘটার পরের প্রেক্ষাপট কি হলো, গণতন্ত্র কতটা মুক্তি পেল তার উত্তর খোঁজাটাও আপেক্ষিক বিষয়। কারণ, দার্শনিকরা বলে থাকেন, পরিবর্তন এই সমাজের চিরাচরিত একটি নিয়ম। আজ যা আছে কাল তা থাকবে না। গতকাল ক্ষমতা একজনের ছিল, আজ আরেকজনের, আর পরশু চলে যাবে আরেকজনের হাতে। শোষণ, বঞ্চনার হিসাব গুলোও একই রকম। আজ একজন শোষন করছে, কাল করবে আরেকজন। দেখা গেছে এই শোষন যে শুধু স্বৈরাচারের হাত দিয়েই ঘটেছে তা নয়, গণতন্ত্রের আওয়াজধারীরাও এক পর্যায়ে এসে পরিবর্তিত কায়দায় শোষন করেছে। এখানে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সে পরিবর্তন ঘটেছে অন্যভাবে। অর্থাৎ চোরের রকম পাল্টেছে, ডাকাতির ভিন্নতা এসেছে। মানুষের বাক স্বাধীনতা হরনের নতুন নতুন রূপ এসেছে। ক্ষমতাহরণকারী ও ক্ষমতা লিপ্সুদের পদলেহনকারীর সংখ্যা বেড়েছে। দেশ ভরে গেছে অন্যায়ে, অপরাধে। কিন্তু এর মধ্যে যে পরিবর্তনটি সবচেয়ে কষ্টের, তা হচ্ছে স্বৈরাচারের নয় বছরে মানুষের চেতনায় পরিবর্তনের যে তীব্র আকাঙক্ষা জন্ম নিয়েছিল পরবর্তী পনের বছরে তা যেন গোপনে গোপনেই মারা গেছে। মানুষের আগ্নেয়গিরি শীতল হয়ে গেছে। যে কারণে, তথাকথিত গণতন্ত্রের সময়গুলোতে মানুষ যা দেখেছে, যা সয়েছে তা কস্মিনকালেও কারো স্বপ্নে ছিল না। চিন্তায় ছিল না, চেতনা তে তো নয়ই।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় বারাক ওবামার পরিবর্তনের সুর যেন বিশ্বব্যাপী সবার কণ্ঠেই দোলা দিয়ে গেছে। মার্কিনীরা যতই দুঃশাসক হোক, তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণা যে পর্যায়েই যাক তারা কিন্তু পৃথিবীর সব জাতির সামনে সমানে বিলিয়ে চলেছে গণতন্ত্রের ব্যবস্থাপত্র। তার থেকে কে কতটা গ্রহণ করলো তাতে তাদের কিছুই এসে যায় না। তাদের স্বার্থটুকু, চাওয়াটুকু পূরণ করাটা যেহেতু তাদের মিশন, সেহেতু সেই টুকু তারা উদ্ধার করে নিতে পারে। সেখানে কারো আপত্তিই চলে না, প্রতিবাদও নস্বি হয়ে ওঠে। বিষয়টি সবাই সমানভাবে বিশ্বাস করলেও ওবামার পরিবর্তনের সুর নিয়ে গোপনে কিংবা প্রকাশ্যে গলা ভাজতে জুড়ি নেই আমাদের দেশের রাজনীতি, সামাজিক ক্ষেত্র, সংবাদমাধ্যম কোনখানেই। যা হোক পরিবর্তন আমরা চাইছি, নিজেদের চেতনাগত পরিবর্তনের স্বপ্নও দেখতে চাইছি, চাইছি মানুষের মধ্যে পরিবর্তনের তৃষ্ণা আবারো নব্বই পূর্ববর্তী সময়ের মতোই জেগে উঠুক। কিন্তু ওয়ান ইলেভেন আমাদের মধ্যে যে স্বপ্নের বীজ রোপে দিয়েছিল, তার দুই বছর পর চূড়ান্ত পরিবর্তনের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এ প্রশ্ন কি অত্যক্তি হবে, নিষ্ফল ছিল আমাদের সব পরিবর্তনের তৃষ্ণা ? কি পরিবর্তন আসবে আমাদের জাতীয় জীবনে Ñ এই প্রশ্ন যেন নিকটতম কোন দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে নিজের কাছেই ফিরে আসছে এখন।
আমাদের দেশে বরাবরই পরিবর্তন নিয়ে যারা রাজনীতিক অংগণে কথা বলে আসছেন তারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। তাদের রাজনৈতিক ক্যারিশমাও বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগের মতো নয়। জনগণকে জিম্মি করার কোন কৌশল তাদের কাছে নেই। জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে জানেন না। অথচ তারা সারাটি বছরই কালো টাকা, সন্ত্রাস ও পেশীশক্তির রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন। অপশক্তির বিরুদ্ধে তাদের কঠিন কঠিন উচ্চারণ শক্তি জাগানোর কথা, কিন্তু এই ইস্যুগুলো, এই শ্লোগানগুলো সত্যিই এদেশের আকাশে অলীক এক স্বপ্ন হয়েই ঘুরে বেড়ায়। যা কোনদিন এই জমিনে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কিন্তু তা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাতে এগিয়ে এসেছিল প্রলম্বিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তাদের লক্ষ্য, যাত্রাপথ, এজেণ্ডা সবই ছিল মানুষের খুব গভীরতর স্বপ্ন আর প্রত্যাশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সরকারের একেকটি কাজ যেভাবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে প্রশংসিত হয়েছে তা বোধ করি যে কোন সরকারের কর্মসূচি ও তৎপরতার কাছেই ঈর্ষণীয় একটি ব্যাপার। কিন্তু এই দুই বছরেই বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়ার মতোই রাজনৈতিক অপশক্তি নিধনে সরকারের দুর্বলতা দেশ প্রেমিক নাগরিকদের ভেতরে ভেতরে খুব বেশি আহত করছে। একথা সত্য যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল এজেণ্ডা একটি অর্থবহ জাতীয় নির্বাচন। কিন্তু অর্থবহ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে সরকারের সুবিন্যস্ত রোড ম্যাপ যেন মাঝপথে এসে সরু গলি হয়ে গেল। যার পেছনে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতোই নির্বাচন দাঁড়িয়ে, আর সামনে সেই সব রাজনৈতিক নেতারা যারা দেশকে পেছনে ঠেলতে ঠেলতে এক কৃষ্ণ গহ্বরের সামনে এনে দাঁড় করেছিল। এখন যেন আবার সেখানেই বশ্যতা স্বীকারের জন্য এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।
দেশে নির্বাচনের আওয়াজ জেগেছে। অন্যান্য সময়ের মতোই বলা হচ্ছে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। এই তো কয়েক মাস আগেও মানুষ এই নির্বাচনটি নিয়ে যা ভেবেছে, তা ঠিক এখনকার মতো কিছু নয়। কারণ, বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশকে যেখানেই নিয়ে যাক, অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ধারারই সূচনা করুক, এসবের কোনকিছুই ধর্তব্যের মধ্যে না আনা হলেও স্বীকার করতেই হবে যে মানুষের মধ্যে দারুণ এক স্বপ্নের জন্ম দিয়েছিল। সরকারের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার তৎপর প্রক্রিয়াগুলো সত্যিই ছিল দারুণ স্বস্তিদায়ক। যদিও সরকারের একসময়ে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানগুলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যতটা প্রয়োগ হয়েছে, প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তার ছিটেফোটাও হয়নি, অর্থাৎ দীর্ঘদিনের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও অব্যবস্থার কোন খুঁটিও সামান্যতম নড়েনি। যা একসময় পরিবর্তন প্রত্যাশীদের এজেণ্ডাভুক্ত ছিল। আর অনেক আগেই এ সত্য উন্মোচিত যে, আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিটি শাখা প্রশাখায়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির শেকড় প্রোথিত। এদিকে সরকার না এগোলেও যেদিকে এগিয়েছিল সে দিকেও তো কার্যকর শক্তিমত্তার প্রমাণ রাখতে পারেনি। যে কারণে, ঠিক নির্বাচনকে সামনে রেখে সেই পুরনো বাক্যই আওড়াতে হচ্ছে ‘থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। অর্থাৎ, নব্বই পরবর্তী পনের বছরের মতোই হয়তো গণতান্ত্রিক (?) পরিবেশ আসবে দেশে। আর প্রথম দিন থেকেই চলবে দেশকে অস্থির করে তোলার প্রক্রিয়া। একথা শুনে কারো কারো প্রতিক্রিয়াও হতে পারে। কিন্তু শহীদ ডাঃ মিলন দিবসে যখন এই লেখাটি লিখছি ঠিক তখন ভাবছি যে স্বৈরাচার হটানোর জন্য ডাঃ মিলনের মতো অনেককেই জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল, সেই স্বৈরাচার তো ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়নি, বরং সগৌরবে উঠে এসেছেন রাজনৈতিক মহাসড়কে, এখন বৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা বৃহৎ জোটের জন্যও তিনি বড় বেশি গ্রহণযোগ্য। আবারও তার প্রেসিডেন্ট হবার শর্ত নিয়ে বারবার বিবেচনা চলছে রাজনৈতিক টেবিলে। অন্যদিকে, গত পনের বছরে পাকাপোক্তভাবে পূনর্বাসিত একাত্তরের ঘাতক শ্রেনী তো আছেই। প্রকাশ্যে ও সগৌরবেই বিস্তার করে চলেছে তাদের জাল। এখন ‘বিশ্ব বেহায়া’ আর ‘রাজাকার’ই রাজনীতিতে আদরনীয়। নির্বাচনে বিশেষ গুরুত্ব তাদের। এই হলো আমাদের পরিবর্তনের স্বপ্নের হাল !
‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ কিংবা ‘সমাজ পরিবর্তনশীল’ এমন প্রচলিত বাক্য বিশ্বাসে নিশ্চিত করেই বলা যায়, দেশে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু সেই পরিবর্তন ঠিকই একদিন জনগণকে আবারও বলতে বাধ্য করবে ‘এই পরিবর্তন কি চেয়েছিলাম ?’

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



