somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লংকাউই থেকে সাইকেলে কুয়ালালামপুর যেতে যেতে যে অভিজ্ঞতা হলো

০১ লা জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




প্রথমে যাব লংকাউই। সেখান থেকে আমি আর চঞ্চল সাইকেলে কুয়ালালামপুর। দূরত্ব বেশি নয়। ৫৫০ কিলোমিটারের কিছু কমবেশি। হাতে ৮ দিন সময়। তাই আয়েশেই কাজটা সারা যাবে।

যেদিন লংকাউইয়ে পৌঁছালাম, তার কয়েক দিন আগে আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতা হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক অংশগ্রহণকারী ছিলেন এবার। একই হোটেলে থাকার কারণে পূর্বপরিচিত ভাই-ব্রাদারদের সঙ্গে দেখাও হলো। তাঁদেরই একজন হোমায়েদ ইসহাক আমাদের দলে ভিড়ে গেলেন। আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা সফলভাবে শেষ করে ঢাকার পথ ধরতে ও-ও যাবে কুয়ালালামপুর।

১৫ অক্টোবর সকালে তিনজন যখন সাইক্লিং শুরু করলাম, তখন আকাশ কেবল পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। সারা রাতের বৃষ্টিতে দারুণ ঘুম হলেও সকালে যেন বৃষ্টি না থাকে, তাই প্রার্থনা করছিলাম। বিধি আমাদের কথা শুনেছিলেন।

সকালের নিস্তব্ধতা ভেঙে দু-একটা গাড়ি হুসহাস করে চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। কালো পিচঢালা পথ। দারুণ মসৃণ। এই মালয়েশিয়াকে আমি কী না ভেবেছিলাম! কিন্তু আসার পর বুঝতে পারলাম, কেন কাজের জন্য বা বেড়াতে এত দেশি মানুষ এখানে আসেন।

দু-একটা চড়াই ঠেলে বেলা খুব বেশি বাড়ার আগেই কুয়ালা পার্লিস যাওয়ার ফেরিঘাটে পৌঁছে গেলাম। ১১টার ফেরি। ঝামেলা বাধল, সাইকেলের চাকা খুলে নিয়ে ফেরিতে উঠতে হবে। আরও বেশ কয়েকবার এমন ফেরিতে ওঠা হয়েছে কিন্তু সাইকেলের চাকা কোথাও খুলতে হয়নি। কেনই–বা খুলতে হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা যেমন পাওয়া গেল না, তেমনি দেওয়ার মতো কাউকে দেখা গেল না। অগত্যা ট্রলিতে বাক্সপেটরা আর সাইকেলের চাকা খুলে দৌড়াতে হলো। ফেরি প্রায় ছাড়ে ছাড়ে। আমরাই শেষ যাত্রী। তড়িঘড়ি করে উঠতে না উঠতেই ছেড়ে দিল ফেরি।

পরে বুঝতে পারলাম, এটা শুধু যাত্রী ও হালকা মালামাল (যেমন ব্যাগজাতীয় জিনিসপত্র) পরিবহনের ফেরি। গাড়ি বা মোটরযানের জন্য আলাদা ফেরি আছে। তাতে গেলে আমাদের সাইকেলের চাকা খুলতে হতো না। সময় বাঁচাতে গিয়ে আমাদের এই দশা। যাক, ৭০ মিনিট পর ফেরিঘাটে পৌঁছে সাইকেল ঠিক করে আবার চালানো শুরু।

বেশি হলে ঘণ্টাখানেক চালিয়েছি, এর মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি। থামতেই হলো। এমন সময় আরেকজন দেশি আয়রনম্যানের দেখা পেলাম। তাঁর নাম আকিক। তিনিও একই দিকে যাবেন। তবে তাঁর গন্তব্য আরও দূরে। পরিত্যক্ত এক দোকানের টিনের চালার নিচে কুশলাদি আর পরিচয় পর্ব শেষ হলো। বিকেলের দিকে সাগরের পাড় ঘেঁষে রাস্তাটা ছিল উপভোগ্য। এই সাগরেই নাকি আয়রনম্যান প্রতিযোগীদের সাঁতার কাটতে হয়েছিল। দুই সাঁতারু আমাদের সঙ্গে। সাইকেলেও তাঁরা দারুণ পটু। এদিকে আমি যখন আমার নিতম্বের ব্যথা নিয়ে কাহিল, তখন তাঁরা সেদ্ধ ডিম আর চিড়াভাজা খেতে খেতে হেসেখেলে এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু লজ্জার কী আছে, আমি তো ‘হিউম্যান’ আর তাঁরা তো আয়রনম্যান। নিজেকেই সান্ত্বনা দিলাম।

প্রথম দিনে সবাই একসঙ্গে একটা হোমস্টেতে উঠলাম। বেশ বেলা হয়ে যাচ্ছিল। প্রথম দিন হিসেবে বেশ চালিয়েছি। এখন থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। হোমস্টেটা দারুণ। তার ওপর মালিক বেশ সাহায্য করলেন রান্না করার জিনিসপত্র দিয়ে। সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। তার আগে চাল, ডিম আর তেল কেনা হলো। তেলের দাম দেখে চক্ষু চড়কগাছ। ১ লিটার তেলের দাম ২৪০ টাকার বেশি! কী করে হয়। যেখানে মালয়েশিয়ার মূল দেশীয় উপার্জনের একটা বড় অংশ আসে সয়াবিন ও পাম থেকে। দুই–ই তেলবীজ। হিসাব মেলাতে পারলাম না। চারজনের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ডিমঝুরি করে ভূরিভোজ করা হলো।

পরদিনও আমরা চারজন একসঙ্গে চালালাম। তবে আকিকের তাড়া ছিল। তাঁকে রোজ আরও বেশি পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। তাই তিনি একাই এগিয়ে যেতে থাকলেন। আর আমাদের দলে ‘হিউম্যান’রা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় হেলেদুলে, ধীরেসুস্থে চালিয়ে যেতে থাকলাম।

মালয়েশিয়াকে ঠিক বিদেশ মনে হলো। অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের মতো। হাসছেন? এই কথা শুনে হাসি আসতেই পারে। কিন্তু আমার ঠিক তা–ই মনে হলো। আরেকটা কারণ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র আর মালয়েশিয়ার পতাকার মিল। খুব কাছাকাছি। তার ওপর দুই দেশই তাদের পতাকা যেখানে-সেখানে লাগিয়ে রাখে। দূর থেকে বা রাস্তা থেকে দেখে ভুল হতে পারে, কোন দেশের পতাকা! এতে আরও যোগ করা যায় মালয়েশিয়ার রাস্তাঘাট, ট্রাফিক সিস্টেম ও যানবাহনের বহর। স্থানীয় লোকজন যে গাড়িপ্রেমী, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি বলছি বেশ অনুন্নত এলাকার কথা, যেখানকার কিছু জায়গা তামিল, চায়নিজ–অধ্যুষিত। নগরায়ণের ধাক্কা সেভাবে লাগেনি। তবে ঘরবাড়ি দেখে কী করে বুঝি, এ শহর, না গ্রাম?

রাস্তার পাশেই খাবারের দোকান থেকে রোজ সকালে দুই পরোটা আর দুই ডিমে আমাদের প্রাতরাশ করা হতো। খরচাও বেশি নয়। দেশি মানুষদের দেখা পেলাম প্রায় সব জায়গায়। কেউবা হোটেলে কাজ করছেন, কেউ খেতে আবার কেউ রাস্তায়। সাইকেল থেকে ‘বাংলাদেশ’ বলে চিৎকার করা মানুষদের শুধু চোখের দেখা হতো। আমার সাইকেলে বাংলাদেশের পতাকা দেখে অন্য কেউ তো আর হাঁক দেবে না। সত্যি বলতে কি, দেশি মানুষ ছাড়া শুধু একজন বাংলাদেশের পতাকাকে চিনতে পেরেছেন। বেশ অবাক করা ব্যাপার। এই মালয়েশিয়ায় নাকি ১৬ লাখের মতো বাংলাদেশি থাকেন। কেরালার এক হোটেলমালিকের সঙ্গে গল্পে জানতে পারলাম, আমরা, মানে বাংলাদেশিরা চীনের অভিবাসীদের চেয়েও সংখ্যায় বেশি। সত্য–মিথ্যা জানি না। কিন্তু পতাকা না চেনার কারণটা অজানাই রয়ে গেল।

আট দিন পর পৌঁছে গেলাম কুয়ালালামপুরে। ঝাঁ–চকচকে শহর। অল্প খরচায় এমন বিদেশে আগে যাওয়া হয়নি!


পূর্বে প্রকাশিত। প্রথমআলো । view this link




সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ দুপুর ১:০১

হাসনাতের বয়ানে সেনাবাহিনীর প্রস্তাব নিয়ে উত্তপ্ত রাজনীতি, সেনা সদরের অস্বীকার

ছবি: অন্তর্জাল থেকে সংগৃহিত।

জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের একটি 'সংশোধিত' অংশকে রাজনৈতিকভাবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তবু তো ফাল্গুন রাতে এ গানের বেদনাতে আঁখি তব ছলছলো....আমার দুঃখভোলা গানগুলিরে ......

লিখেছেন ইন্দ্রনীলা, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৩:০৫



মাঝে মাঝে আমার বুকের গহীনে এক ব্যথার নদী উথলে ওঠে। উথাল পাথাল ঢেউগুলো পাড়ে এসে আছড়ে পড়ে। উত্তাল বেগে ধেয়ে এসে ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ে বুকের মাঝে... ...বাকিটুকু পড়ুন

"বিস্মৃতি"

লিখেছেন দি এমপেরর, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ বিকাল ৪:৫৫


সে যে আজ কোথা হারিয়ে গিয়েছে, আঁধার ছেয়েছে ঘনঘোর কালো;
চাঁদ নেই তারকারাজিও উধাও, নেই জ্বলে কোথা টিমটিমে আলো!
সে যে জানে শত হৃদয়ের কথা, মায়াজালে ঘেরা হাজার স্মৃতি!
কত... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথা হালকা পোষ্ট!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:০৭

অবিশ্বাস্য হলেও লেকটির অবস্থান খোদ ঢাকায়; কেউ কি এর লোকেশন বলতে পারেন?



কাটা তরমুজের ছবিটা দেবার বিশেষ মাজেজা আছে;
উটিউবে একজন কামেল বুজুর্গান পাকা সূমিষ্ট তরমুজ কেনার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এলার্ট : শেখ হাসিনা আজ রাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৪ শে মার্চ, ২০২৫ রাত ৮:৪৭


বাংলাদেশের মানুষ কল্পনা করতে খুব ভালোবাসে। গুজব ও অপতথ্য শেয়ারে বাংলাদেশের মানুষ প্রথমদিকে থাকবে বলে অনেকের বিশ্বাস । দেশের মানুষের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোনো বইয়ের প্রতি আগ্রহ নেই। আত্নউন্নয়ন মূলক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×