somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আধুনিক যুগে পুরুষত্বের সংজ্ঞা ও কিছু কথা

২১ শে নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রাচীন সভ্যতার প্রায় সবগুলো গোত্রেই পুরুষকে জীবনের এক অধ্যায় থেকে অন্য অধ্যায়ে প্রবেশের জন্য কিছু কঠোর পরীক্ষা এবং রিচুয়ালের মধ্যে দিয়ে যেতে হতো। হয়ত সেটা ৩/৪ দিন জোরপূর্বক উপবাসের মধ্য দিয়ে অথবা মরুভূমিতে কঠিন অবস্থায় টিকে থাকার পরীক্ষা দিয়ে, ভয়ঙ্কর কোন জন্তুর শিকারের পরীক্ষা দিয়ে, আর নয়ত ১০০/২০০ মাইলেরদুর্গম পথ পাড়ি দেবার মাধ্যমে তাদের এই পরীক্ষাগুলো পাশ করতে হতো।মূলত এভাবেই সে তার পুরুষ হবার জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক এবং শারীরিক শক্তির পরীক্ষা দিত গোত্রের গুরুজনদের কাছে।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এই নতুন অধ্যায়ে প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতা এবং পুরোনো অধ্যায় পার করবার উদযাপন করবার অনুশীলনগুলো আধুনিক সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। জীবনের এক অধ্যায় থেকে অন্য অধ্যায়ের মাঝের লাইনগুলো ঝাপসা হয়ে গেছে আর খুব কম সংখ্যক পুরুষই জানে যে তার অবস্থান ঠিক কোথায়। ঠিক কতদিন কৈশোর থাকে? একজন সত্যিকারের পুরুষ হবার জন্য কি থাকা লাগে? গাড়ি, বাড়ি ও ব্যাংকব্যাল্যান্স? নাকি বিলবোর্ডের মডেলটার মত আকর্ষণীয় পেশীবহুল শরীর? ভাল রেসাল্ট, ভাল চাকরি আর সুন্দরী স্ত্রীই কি তবে সফল পুরুষের পরিচয়!! পুরুষ হিসাবে আমরা আসলে কি চাই? নারীই বা পুরুষের কাছে কি আশা করে? নারীর মনের গভীরে পুরুষের কোন গুনগুলো তাকে নারীর কাছে একজন সম্মানজনক ব্যক্তিত্ব হিসাবে তুলে ধরে?

এ যুগের পুরুষ জানেনা যে একজন সুযোগ্য নেতা এবং স্বৈরাচারীর মাঝে পার্থক্য ঠিক কোথায়। নিয়ন্ত্রণ করবার চাহিদা কোন মুহুর্তে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, অথবা সহানুভূতিশীল হতে গিয়ে কখন নিজের আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দেয়া হয়ে যায়- নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষোভ আর সময়ের প্রয়োজনে নেয়া দুঃসাহসিক আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের পার্থক্য-এই সবগুলো ব্যপারেই আমাদের বিভ্রান্তির শেষ নেই।

আধুনিক সমাজে পুরুষের সংজ্ঞা তাহলে কি? আপনার কি তবে যুদ্ধ করতে হবে অথবা শিকারে অংশগ্রহণ করতে হবে? নির্দিষ্ট ব্যাংক ব্যাল্যান্স লাগবে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হতে হবে? নাকি নিজের পুরুষত্ব প্রমাণ করতে বিপুল সংখ্যক নারীর সাথে মিলিত হতে হবে? কিংবা শারীরিক শক্তিতে দুর্বল অন্য নারী অথবা পুরুষকে আতঙ্কিত করতে পারাটাই কি তবে সত্যিকারের পুরুষত্বের প্রতীক?

পুরুষকে নিয়ে বর্তমানে তেমনভাবে চিন্তা করার কেউ নেই বললেই চলে, অথচ নারী জাগরণ পরবর্তী সময়ে নারীকে নিয়ে হাজার হাজার বই লেখা হয়েছে, ছাপা হয়েছে, আলোচনা হয়েছে। নারী দিবসে যেখানে ফেসবুকে স্ট্যাটাস আর অভিনন্দনের ছড়াছড়ি সেখানে দু-দিন আগে বিশ্ব পুরুষ দিবসের ব্যাপারে কারোর কোন মাথাব্যাথা আসলে থাকার কথাও নয়।

সমাজের ত্রুটি হোক অথবা অন্য কোন সমস্যাই হোক, পুরুষের সবচাইতে সুন্দর বৈশিষ্ট্যগুলোই কালের বিবর্তনে বর্তমানে তার দুর্বলতা হিসাবে ধরা হয়, এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে তার জন্য তাকে শাস্তিও পেতে হয়। নারী জাগরণের সাইড এফেক্ট হিসাবে পুরুষের বেশ বড় অংশ ভুগতে থাকে অপরাধবোধে আর আরও বড় একটা অংশ হয়ে ওঠে নারীবিদ্বেষী। অথচ নারী জাগরণের পাশাপাশি পুরুষকেও যে তার ভেতরের সবচাইতে সুন্দর বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরে অনুপ্রাণিত করা সম্ভব তা যেন কিভাবে সবার চোখ এড়িয়ে চলে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারী পুরুষ দুজনেই। নারী ধীরে ধীরে আবিস্কার করতে শুরু করেছে যে তারা শক্ত হয়ে উঠলেও তার এই শক্ত দিকটি সম্পূর্ণ সততা ও সরলতার সাথে গ্রহণ করার মত পুরুষ খুব কমই আছে। শক্ত নারীর জন্য শক্ত পুরুষ কি তবে কমে যাচ্ছে সমাজ থেকে? তবে কি শক্ত নারী হলে তাকে নরম মনের পুরুষ খুঁজে নিতে হবে? দুজনে একই সাথে শক্ত হওয়া কি তবে অসম্ভব?

নারী-পুরুষ সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা থেকে আমি এটুক উপসংহারে পৌছাই যে আমাদের আধুনিক সমাজে পুরুষত্বের সংজ্ঞা প্রথমত নেই আর যদি থাকেও তবে তাকে পুরোপুরি ভুল বলা যায়। নয়ত এই জেনারেশনের ছেলেদের জীবনে টাকা-পয়সা, স্ট্যাটাস, সুন্দরী স্ত্রী/গার্লফ্রেন্ড কিংবা অর্থহীন সাফল্য মূল লক্ষ্য না হয়ে অন্য কিছু হতো। নারীকে যেমন যৌনতার প্রতীক হিসাবে অব্জেক্টিফাই করা হয়েছে, তেমনিভাবে পুরুষকেও তো সাকসেস অব্জেক্ট হিসাবে অ্যাবিউজ করা হয়েছে। কেউ কি দ্বিমত পোষণ করতে পারবে ? এজন্যই আধুনিক চেতনার দৃষ্টিকোণ থেকে পুরুষত্বের সঠিক সংজ্ঞা বা অর্থ খোঁজার এই অন্বেষণ। আশা করি জীবনের সত্য খোঁজার সফরে অনেকেরই কাজে লাগবে লেখাটি। কাজটা কঠিন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই, তবে অসম্ভব নয় আর কঠিন মিশনের পিছে ছোটাও যে পুরুষের অন্যতম চাহিদা সে ব্যাপারে আর নাই বা বললাম। নিজের ব্যাপারে বলতে পারি এর অর্ধেক যেদিন অর্জন করবো সেদিনও আমার জন্য অনেক বড় একটা দিন হবে।


একজন পুরুষ সবার প্রথমে তার নিজের সাথে তীব্রভাবে সৎ। সে তার জীবনের প্রতিটা কাজে প্রচন্ড আশাবাদী। নবীনদের কাছে সে একজন রোল মডেল।

নিজের কাছে সে দায়বদ্ধ। নিজের অনুভুতির ব্যাপারে সে সৎ এবং আত্মসচেতন। সে জানে কিভাবে কাঁদতে হয়, কষ্ট উপেক্ষা না করে বরং তা সততার সাথে উপলব্ধি করতে জানে সে। কষ্ট থেকে না পালিয়ে মাথা উঁচু করে তার সামনে দাড়াতে ভয় পায় না সে। ভয়কে উপলব্ধি করেও সামনে এগিয়ে যেতে শিখেছে সে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখা তার সারা জীবনের ধ্যান।

তার শিশুসুলভ লজ্জাগুলো সে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। অন্যায় কিছু করলে সে অপরাধবোধে ভুগে, সে আত্ম-সমালোচনা করে শেখবার জন্য। অন্য পুরুষ, নারী, শিশু এবং দুর্বলের প্রতি সে সহানুভূতিশীল, নিজে দয়ালু এবং অন্যকেউ দয়াবান হতে উদ্বুদ্ধ করে। সে ক্ষমা চাইতে লজ্জাবোধ করে না। অন্যকে ক্ষতি না করে সে তার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করতে জানে। তার সবচাইতে বড় ভয় থেমে যাওয়া।

নিজের অসফলতার জন্য সে তার পরিবার কিংবা তার জীবনের নারীকে দোষারোপ করা ছেড়ে দিয়েছে। তার ব্যর্থ সম্পর্কেরগুলোর মাঝে নিজের ভুল আবিস্কার করতে শিখেছে সে। কামনা অথবা প্রবৃত্তি তার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে না। সত্য বলবার মত আত্ম-সম্মানবোধ তার আছে। নিজের সততাপূর্ণ আচরণ দিয়েই সে তার জীবনে ঘনিষ্টতা, অন্তরঙ্গতা ও বিশ্বাস আদায় করে নেয়। তার জীবনে অন্য বিশ্বাসযোগ্য পুরুষ বন্ধু বিদ্যমান যারা যে কোন বিপদে একে অন্যকে সহায়তা করতে প্রস্তুত। তার জীবনে নিয়মানুবর্তিতা যেমন আছে তেমনি প্রয়োজনের সময় সে নমনীয় হতে শিখেছে। সে তার ব্যক্তিত্বের গভীর থেকে যে কোন কিছু দেখতে ও শুনতে সক্ষম। সে যেমন বাস্তববাদী তেমনি আধ্যাত্মিক।

নিজের স্বাচ্ছন্দ্যের বলয় থেকে বের হয়ে আসাটাই তার কাছে সফলতা। নিজের কাছে তার প্রত্যাশা অনেক, নিজের কাছের লোকের সামর্থ্যের ওপরও তার প্রত্যাশা অনেক, সে জানে কিভাবে নিজ জীবনের নারীকে ও অন্যকে অনুপ্রাণিত করতে হয়। নিজস্ব সীমাবদ্ধতাকে সে নিয়মিত চ্যালেঞ্জ করে। সমাজকে কিভাবে উন্নত করা যায় সে ব্যাপারে সে সৃষ্টিশীল। সে জানে সে স্বতন্ত্র। সে এও জানে সে সমাজেরও অংশ।একইসাথে সে প্রকৃতির অংশ, প্রকৃতিরক্ষায় তাই সে সোচ্চার, নিজের গভীরে আত্মার সাথে সে যেমন সংযোগ অনুভব করে তেমনি সবকিছু হতে বড় কোন শক্তির সাথেও সে তার সংলগ্নতা সদা উপলব্ধি করতে সক্ষম।

সে বুঝতে পারে যে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার কার্যকলাপ উদাহরণস্বরূপ। সে এমন সমাজ গড়ে তোলে যেখানে ব্যক্তিকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা প্রদান করা হয়। সে তার নিজের দায়বদ্ধতা যেমন গ্রহণ করে তেমনি তার প্রিয়জনকে রক্ষায়ও সে এগিয়ে আসে। সময়ের প্রয়োজনে ও ভালোবাসার মানুষকে রক্ষার্থে সে ভয়ানক রূপও ধারণ করতে পারে।

তার জীবনের চরম উদ্দেশ্য তার কাছে পরিস্কার। সে তাই তীব্রভাবে বাঁচতে ও গভীরভাবে ভালোবাসতে জানে। সে ভালোবাসার কাঙাল নয়, বরং ভালোবাসা দেয়ার জন্য সকল কষ্ট ও ভয়কে স্বীকার করতে প্রস্তুত। নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে সে সচেতন, তাই অন্যের শক্তি এবং দুর্বলতা উভয়কেই সম্মান করতে জানে সে। তার জীবনের প্রতিটা কাজ তাৎপর্যপূর্ণ। সে মন খুলে হাসে, কেননা সে জীবনের কৌতুক উপলব্ধি করতে সক্ষম। তার বিকাশ সদা চলন্ত।

https://www.facebook.com/DoctorXBD
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে নভেম্বর, ২০১৪ সকাল ৮:৫৭
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×