ছবিঃ হর্সহেড নীহারিকা
নীহারিকাঃ নীহারিকা বা নেবুলা হচ্ছে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, এবং অন্যান্য ধূলিকণাবিশিষ্ট একধরণের মেঘ! এই মেঘমালাগুলোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে নক্ষত্রদের জন্মদাত্রী হিসেবে আখ্যায়িত। মানে, নীহারিকার গর্ভেই জন্ম নেয় নক্ষত্রদের দল। আমার চোখে নীহারিকা হল মহাবিশ্বের সুন্দরতম জ্যোতিষ্ক! চাঁদের আলোয় মায়াবী মেঘ যতটা সুন্দর, নীল আকাশের বুকে এক টুকরো শুভ্র মেঘ কিংবা গোধূলি বেলায় কমলা রঙের অতিপ্রাকৃত মেঘ যতখানি অপূর্ব, তার চেয়েও অনেক বেশি অপূর্ব হতে পারে মহাকাশের বুকে সহস্র আলোকবর্ষ ব্যাপ্তি ছড়ানো একটি নীহারিকা! উপরের হর্সহেড নীহারিকাটিই তার প্রমাণ! ভালো করে লক্ষ্য করুন তো, মনে হচ্ছে না এটা একটি ঘোড়ার মাথার ছবি? কি চমৎকারভাবে প্রকৃতি মহাজাগতিক মেঘমালা দিয়ে সুবিশাল একটি ঘোড়ার মুখ এঁকে ফেলেছে! এরকম আরো একটি অসম্ভব সুন্দর নীহারিকা আছে। সেটির নাম 'ঈগল' নীহারিকা। ঈগলের মত দেখতে হওয়ার কারণেই এই নামকরণ। নীহারিকাটির অবস্থান পৃথিবী থেকে প্রায় ৭০০০ আলোকবর্ষ দূরে। সুবিশাল এই নীহারিকার বৈচিত্রময় একটি অংশের নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন 'পিলারস অফ ক্রিয়েশন' (সৃষ্টির স্তম্ভ)। নিচের ছবিটি দেখুন। আমি যখন প্রথম এটি দেখি, মুগ্ধ হয়েছিলাম খুব। মুগ্ধ হবার মতই তো, তাই না?
ছবিঃ ঈগল নেবুলার সেই বিখ্যাত 'পিলারস্ অফ ক্রিয়েশন'
ছবিঃ কোয়াসার
কোয়াসারঃ কোয়াসারকে বলা হয়ে থাকে মহাবিশ্বের সবচাইতে উজ্জ্বল এবং শক্তিশালী জ্যোতিষ্ক। একেকটি কোয়াসার অকল্পনীয় পরিমাণ দূরত্বে অবস্থিত যার ফলে এদের রঙ কিছুটা লালচে দেখা যায়। আসলে কোন একটি পদার্থ পৃথিবী থেকে যত বেশি দূরে অবস্থান করবে, তার আলোর রঙটি ততবেশি লালের দিকে ধাবিত হবে। যেহেতু কোয়াসারগুলো লাল আলো নিঃসরণ করছে, সেহেতু বোঝাই যাচ্ছে যে সেগুলো পৃথিবী থেকে কতখানি দূরে হতে পারে! একটি কোয়াসার থেকে নিসৃত শক্তির পরিমাণ আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চাইতেও ১০০ গুণ বেশি হতে পারে! কিংবা হতে পারে কয়েক হাজার গুণ বেশি! বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে, কোয়াসারগুলো অবস্থান করে মহাবিশ্বের দূরবর্তীতম সুবিশাল গ্যালাক্সিগুলোর একেবারে কেন্দ্রে। এরকম একটি কোয়াসারের উদাহরণ আমরা দিতে পারি যেটির নাম হল ULAS J1120+0641, এবং এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ২৯ হাজার কোটি আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত! অন্যভাবে বলা যায়, ওই কোয়াসারটি থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লেগেছে প্রায় ২৯ হাজার কোটি বছর।
নিউট্রন নক্ষত্রঃ একটি বড়সড় নক্ষত্র যখন মহাকর্ষবলজনিত কারণে নিজেই নিজের ভেতরে পড়ে যায়, সংকুচিত এবং ঘনীভূত একটি জ্যোতিষ্কে পরিণত হয় তখন তাকে বিজ্ঞানীরা ডাকেন নিউট্রন তারা বা নিউট্রন নক্ষত্র। এগুলো হল মহাবিশ্বের সবচেয়ে ক্ষুদ্রাকৃতির এবং ঘনত্বসম্পন্ন নক্ষত্র। উচ্চ ভরবিশিষ্ট নক্ষত্ররা জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছুলে নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হয়। এরা প্রায় পুরোপুরি নিউট্রনদ্বারাই গঠিত বলে এদেরকে নিউট্রন নক্ষত্র বলে। জানলে অবাক হবেন যে, এদের ব্যাস হয়ে থাকে মাত্র ১০ থেকে ১২ কিলোমিটারের মত!
ছবিঃ ধূসর বামন
ধূসর বামনঃ যেসব নক্ষত্র জীবনের শেষ পর্যায়ে নিউট্রন নক্ষত্রে পরিণত হবার মত ভর রাখে না, সেগুলো নিজেদের মৃত্যুকালে ধূসর বামনে পরিণত হয়। মূলতঃ অধিকাংশ নক্ষত্রেরই অন্তিম দশা হচ্ছে ধূসর বামন। আমাদের সূর্যটিও আগামী পাঁচশো কোটি বছর পরে জ্বালানি ফুরিয়ে ধূসর বামনে পরিণত হবে। ধূসর বামনরা Electron-degenerate পদার্থ দ্বারা গঠিত হয়। এদের ঘনত্ব খুবই বেশি। ধূসর বামনদের কোন শক্তির উৎস নেই। কাজেই এরা ক্রমে ক্রমে তাপ হারাতে শুরু করে এবং শীতল হতে শুরু করে। একপর্যায়ে এরা ঠান্ডা হতে হতে পরিণত হয় কৃষ্ণ বামনে (black dwarf)।
পালসারঃ পালসারের বৈশিষ্ট্যটি খুব মজার। এরা হচ্ছে ঘূর্নায়মান নিউট্রন নক্ষত্র যা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন বিকিরণ করে। এটিকে তুলনা করা চলে একটি লাইটহাউজের সাথে। রাতের আঁধারে বহু দূর থেকে একটি লাইটহাউজকে আমরা তখনই দেখতে পাই, যখন এর বিশালাকার টর্চলাইটের মত আলোর রেখাটি ঘুরতে ঘুরতে আমাদের দিকে আসে। পালসারটিও একইভাবে আমাদের কাছে তখনই দৃশ্যমান হয়, যখন এটির ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিম ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর দিকে মুখ করে ফেলে। পালসারের ঘনত্ব খুব বেশি। এদের একটি সংক্ষিপ্ত এবং নির্দিষ্ট আবর্তনকাল আছে, যে সময়ের মধ্যে এদের ওই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিমটি একবার ঘুরে আসে।
ছবিঃ একটি ব্ল্যাকহোলের কল্পিত রূপ
ব্ল্যাকহোলঃ কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাকহোল হচ্ছে মহাকাশের সবচেয়ে রহস্যময়, কৌতুহলউদ্দীপক, চমকপ্রদ বস্তু! কৃষ্ণগহ্বর হল স্থান-কালের এমন একটি জায়গা যার মহাকর্ষ বল এতই বেশি যে সেখান থেকে কোন কিছুই বেরুতে পারে না। এমনকি আলোও না! এটির ভয়ানক মহাকর্ষ বল আলোকেও পর্যন্ত বাধাগ্রস্থ করে, বেরুতে দেয় না, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের কাছে ব্ল্যাকহোল অদৃশ্য! কোন কিছু থেকে আলো নির্গত হলেই কেবল আমরা সেটি দেখতে পাই। কিন্তু ব্ল্যাকহোল থেকে কোন আলোই বিকিরিত হয় না, কি করে দেখবো বলেন? কোন পদার্থ কৃষ্ণগহবরের কাছাকাছি আসা মাত্রই এটি সেই পদার্থকে নিজের ভেতর নিয়ে নেয়। কৃষ্ণগহবরের ঘনত্ব প্রায় অসীম। এবং এর ফলেই এর ভেতরে এত তেজ, এত মহাকর্ষ বল! সূর্যের চাইতেও দেড়গুণ বেশি ভরসম্পন্ন নক্ষত্ররা নিজেদের অন্তিম দশায় কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হবার ক্ষমতা রাখে। ব্ল্যাক হোল হয়ে যাবার পর এটি আশে-পাশের সবকিছুকে খেয়ে ফেলতে শুরু করে, ফলে এর ঘনত্ব বাড়তে শুরু করে, হয়ে উঠতে থাকে অনেক বেশি বিপজ্জনক। একটি ব্ল্যাকহোল এমনকি একটা আস্ত নক্ষত্রকেও গিলে ফেলতে পারে! নক্ষত্রের পর নক্ষত্র গিলতে গিলতে, এবং আরো অন্যান্য ব্ল্যাকহোলের সাথে মিলিত হতে হতে এরা হয়ে ওঠে super massive black hole! ধারণা করে হয়, এধরণের সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল খুঁজে পাওয়া যায় গ্যালাক্সির কেন্দ্রে!
[চলবে]
পরের পর্বটি এই লিংকেঃ আমাদের মহাবিশ্ব- তৃতীয় পর্বঃ যেভাবে সবকিছু শুরু হয়েছিলো
আগের পর্বটি পড়ুন এই লিংকেঃ
আমাদের মহাবিশ্বঃ মহাজাগতিক মহাসমুদ্রের গল্প!
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৮

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




