somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দুঃসময়ে শামসুল হক

০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শামসুল হক মধ্যপাড়ার শহিদুল হকের একমাত্র ছেলে। শহিদুল হক মরার আগে অনেক সহায় সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন একমাত্র ছেলে শামসুল হকের জন্য। বড় কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে শহিদুল হক নিজের সম্পত্তি জড়ো করেছিলেন একমাত্র ছেলের ভবিষ্যত চিন্তাভাবনা করে। কিন্তু ছেলেটা কলেজ পর্যন্ত লেখা পড়া করলেও আসল মানুষ হতে পারেননি, নানা ধরনের নেশার মোহে পড়ে ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। তাই বাবা চিন্তায় থাকতেন সবসময় ছেলের ভবিষ্যত চিন্তা করে। জেলা শহরে বড় বড় লোকের সাথে ছিল শহিদুল হকের উঠাবসা। সেই সুবাদে নিজের একমাত্র ছেলেটার একটা ব্যবস্থাও করেছিলেন। ছোট হলেও একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করে দিতে পেরেছিলেন ছেলের জন্য। কিন্তু চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী, ছন্নছাড়া শামসুল হক সেই চাকরিটাও ছেড়েছে বাবা বেঁচে থাকতেই।

বাপের কষ্ট করে বাড়ানো সম্পত্তি বিক্রি করে করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের ব্যবসা শুরু করে কিছুদিন যেতে না যেতেই ব্যবসার মূল ধন সহ হাওয়া করতে করতে এখন একেবারেই নিঃস্ব বলা চলে শামসুল হক। একে তো বাড়তি কোন আয় নেই, তারউপর জমিজমা যেটুকু অবশিষ্ট আছে সবই হাওড়ের মাঝে। বছরে একবার ধানের চাষ করতে পারে, তাতে যে ধান পায় তাতে বেঁচে খেয়ে কোনরকম বছর পার করতে পারে শামসুল হক।

চার সদস্যের পরিবার তার, তাতেই হিমশিম খেতে হয় তাকে। এবছর ধানের ফলন খুব ভালো হয়েছে, তাতেও শামসুল হকের কপালের বাজ দূর হয়নি। হবেই বা কেমনে, গতবছর ধারদেনা করে ধানের চাষ করে ভালো ফলন হওয়ার পরও একমন ধানও ঘরে তুলতে পারেনি। আধাপাকা ধানের জমি ভেসে গিয়েছিল হঠাৎ বন্যার পানিতে। সেই ধারদেনা তারপর দুই ছেলের লেখা পড়ার খরচসহ সারাবছর নিজের সংসার চালিয়ে আরও অনেক দেনার মুখে পড়েছে শামসুল হক।

এবার প্রচুর ধানের ফলন হয়েছে, প্রচুর ধান পেয়েছে শামসুল হক, কিন্তু গতবছরের দেনা মিটিয়ে ঘরে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বছর কেমনে চলবে সেই চিন্তায় তার ঘুম হারাম। পুরনো বদ অভ্যাস ছাড়তে পারলেও অভাবটাকে কোনভাবেই দূর করতে পারছেনা শামসুল হক। চক্ষুলজ্জায় মানুষের বাড়িতে কাজও করতে পারেনা। শহরে গিয়ে অটো চালিয়ে কোনরকম পার করছে বর্তমান সময়। বেশকিছুদিন যাবৎ অটোও পাচ্ছে না, সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন বড়জোর অটো ভাগে পায়। তাতে যে টাকা আয় হয় তাতেই চলছে শামসুল হকের সংসার জীবন।

গতবছর থেকে হাওড় অঞ্চলের জন্য প্রচুর রিলিফ দিচ্ছে সরকার। কিন্তু চক্ষুলজ্জার কারণে চেয়ারম্যানের কাছে একটা রিলিফের কার্ডের জন্যও যাইতে পারেনা। পাশের বাড়ির কুদ্দুস প্রতিমাসে রিলিফ পাচ্ছে। ভালোই দিচ্ছে সরকার হাওড় অঞ্চলের গরীব দুঃখী মানুষদের। সয়াবিন তৈল পর্যন্তও রিলিফ কার্ডের মাধ্যমে পাচ্ছে তারা। কুদ্দুসের ছেলেমেয়ে নাই, তাই তার কাছ থেকে দশ কেজি চাউল কিনতে পারে অল্প দামে, বাকি চাউল তার নিজের জন্য রাখে কুদ্দুস। চাউল ডাল তৈলসহ নগদ পাঁচশত টাকা দেয় প্রতিবার। আবার নিজেও কাজবাজ করে কাজের সময় মানুষের বাড়ি, তাতে ভালই চলে কুদ্দুসের সংসার। ঘরে চাউল থাকলে হাওড় নদীর মাছ ধরেও বাজার খরচ চলে যায় তার। কিন্তু শামসুল হকের তো তাও চলছে না।

গতবছর সরকার দশ টাকা কেজি চাউল খোলা বাজারে বিক্রি করেছে পরিবার প্রতি ত্রিশ কেজি মাসিক হারে। সেই চাউল কিনে ভালোই চলছিল শামসুল হক। ঘরে চাউল থাকলে তরকারি কোনরকম জোগাড় হয়েই যায়। সেটাও বন্ধ হয়েছে অনেকদিন, বড়ই দুঃসময়ে শামসুল হক। দশটাকা কেজি চাউল বন্ধ হওয়ায় বড়ই বিপদের মধ্যে আছে শামসুল হকের মতো আরো অনেকেই।

বিকেল বেলা বাড়ির পাশের বাজারে যাওয়ার জন্য পা চালাচ্ছে শামসুল হক। সংসার চিন্তায় পা যেন তার চলতেই চাচ্ছে না সামনের দিকে। পকেটে মাত্র দেড়শ টাকা নিয়ে শামসুল হক বাজারে রওয়ানা দিয়েছে। দুই কেজি চাউল কিনলেই একশো টাকা গায়েব, বাকি টাকায় লবন মরিচ তেল পেঁয়াজ কিনবে কি করে সেই চিন্তায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে যেন সে।

কিরে শামসুল এত কি চিন্তা করছিস? গায়ে ঝাকুনি দিয়ে করিম শেখের বলা কথায় চমকে উঠে শামসুল। কিরে কি হয়েছে তোর? আমার উপরেই তো উঠে পড়েছিস তুই।
ও ও চাচা আপনাকে দেখতে পাইনি, দুঃখিত চাচা কিছু মনে করবেননা প্লিজ।
আরে না না আমি কিছু মনে করবো না, তার আগে বল কিসের এত চিন্তা তোর মাথায়? এই চিন্তা যদি বাবা বেঁচে থাকতে করতে পারতিস তবে তোর আর এমন করুন দশা হইতো না, দুঃসময় গ্রাস করতে পারতোনা তোকে। যাক সেসব কথা, এখন বল কোথায় যাচ্ছিস?
বাজারে যাচ্ছি চাচা।
তবে কি এতসব ভাবছিস তুই?
কই না তো চাচা। করিম শেখের কাছে নিজের চিন্তা লুকানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল শামসুল হক। করিম চাচা অনেক সহযোগিতা করে শামসুল'কে, কখনো টাকা দিয়ে কখনওবা পরামর্শ দিয়ে। শামসুল যে শহরে গিয়ে অটো চালায় সেই ব্যবস্থাও করিম চাচাই করে দিয়েছিল, তাই বর্তমান দুঃসময়ের কথা চাচার কাছে লুকাতে চেয়েছিল শামসুল। কিন্তু, শেষমেশ বলতেই হলো তার চিন্তার বিষয় খোলে।
সবকিছু শুনে করিম চাচা বললো আরে বেটা এটা নিয়ে আর এত চিন্তার কি আছে, এভাবে চিন্তা করলে তো তুই অসুস্থ হয়ে পড়বি! আর তুই অসুস্থ হলে তোর সংসার কেমনে চলবে একবার ভেবে দেখেছিস? কথাগুলো শুনতে শুনতে শামসুল হকের চোখের কোণায় জল এসে গেল অতীতে তার ভুলগুলো ভেবে।
করিম চাচা এবারে একটু ধমকের সুরেই বললো, শুন, যে সময় হারিয়েছিস হেয়ালী করে তা আর ফিরে আসবে না শত চেষ্টা করলেও। তবে নিজের ভুলগুলোকে স্মরণে রেখে নিজেকে বদলে নিতে পারবি। এবার আমি কি বলি তা মনোযোগ দিয়ে শুন।
পকেটে কত টাকা আছে?
দেড়শ।
জহরুলের দোকানে যাবি, গিয়ে বলবি আমি পাঠিয়েছি তোকে। সরকার দশটাকা কেজি চাউলের কর্মসূচী আবারো চালু করেছে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে হাওড় অঞ্চলের জন্য। এই কর্মসূচী যতোদিন এইসব অঞ্চলে কাজ করার সময় না আসবে ততদিন পর্যন্ত চলবে।
করিম চাচার কথা শুনে শামসুল হকের চোখ মুখে খুশির রেশ ফুটে উঠলো, মুহূর্তে চকচকে হয়ে উঠলো শামসুলের মুখচ্ছবি।
জ্বি চাচা বলে শামসুল হক বাজারের দিকে হাটতে লাগলো। মনে মনে ভাবছে যাক বাঁচা গেলো তবে। চাউল গুলো দশটাকা কেজি হলেও তেমন খারাপ না, ভালোই লাগে ভাত খেতে। ভাবছে আটচল্লিশ টাকায় চার কেজি চাল কিনে বাকি টাকায় কিছু কাঁচা বাজার করা যাবে আজ। শামসুল হক একটু দ্রুতই হেটে যেতে লাগলো বাজারের দিকে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলছে- হে আল্লাহ তুমি রহম করেছো আমাদের মতো গরীব মানুষদের প্রতি....।

[গল্পটি আমার মনগড়া কল্পনায় সাজানো সকল চরিত্র নামকরণ, যদি কোথাও কারো সাথে মিলে যায় তা হবে কাকতালীয় ব্যাপার, কারো মনে কষ্ট দেয়ার কোন উদ্দেশ্য আমার নেই, তবুও অজান্তেই কারো কষ্টের কারণ হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন নিজগুণে।]
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:১১
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×