আজ কী ফুল ফুটিয়েছো, অরণ্য?
(ওয়েব সংস্করণ)
১.
আতাগাছ
মাঝরাতে সবকিছু ডুবে যায়।
নিয়নের আলো শুষে জেগে থাকে শুধু
তরফদারের আতাগাছ।
২.
তাতারদস্যু ও ফুলগাছচোর ইতিবৃত্ত
[একেকদিন তাতারদস্যুদের কথা শুনতে শুনতে আমি বিহ্বল
হয়ে যাই। তারা গরিব আকন্দফুলের শাড়ি খুলতো না, চন্দ্রমল্লিকা
মাড়িয়ে যেত না─ তবু তারা দস্যু ছিল!]
আমাদের ভৃত্যটির গায়ে উত্তপ্ত কড়াই থেকে তেলের ছিটে
এসে লাগে। পার্শ্ববর্তী নার্সারি থেকে শেকড়সহ অনেক ফুলের
গাছ চুরি হয়ে যায়, নিয়মিত।
বিকেলের হীরে-হীরে রোদে সেদিন লাল-শাদা দু’টি হাঁস
চরছে নদীতে, চোরেদের জড়ো করা হলো।
শিশু থেকে শুরু করে অনেক প্রেমযুগল, নীল একটি
সালোয়ার-কামিজ, এসে বসলো।
খাকি-পরা মোটাসোটা অফিসার আর ভ্যাবলাকান্ত কনস্টেবল।
অফিসার খুব তৎপর হয়ে উঠলেন। কিন্তু তার সামনেই কক্ষের
ভেতর বিদ্রূপস্রোত ভেসে যেতে লাগলো।
৩.
ভোর
ভোর দেখি লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে।
থ্যাতলানো ফুল, কাদায় লুটোপুটি।
চাকাচিহ্ন চলে গেছে দূরে, অন্ধকারে।
ওড়ে উড়ুক্কু মাছ, একটি... দু’টি...
৪.
তাবরেজীর সাথে একটি বিকেল
বেলতলার রাস্তায় বেরিয়েই তাবরেজীর সাথে দেখা। গাঢ় হলদে
ছাপা শার্ট গায়ে তাবরেজীও দেখি বিকেলে হাঁটতে বেরিয়েছেন।
আমি তাঁকে ধরে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসি। আমাদের বাড়িটা
অন্ধকার-অন্ধকার, খাট-টেবিল বাচ্চা-কাচ্চা কাপড়-চোপড় হৈচৈ’এ
ঠাসা। তাবরেজী অর্ধেক-করে-কাটা মিষ্টির একটা মুখে দেন।
স্বপ্নাকে বলি তাবরেজীকে সে চেনে কিনা। স্বপ্না ঠোঁট টিপে একটু
মুখ বাঁকায়। আমি একটু হতচকিত হয়ে তাবরেজীর দিকে তাকাই।
তাবরেজীও দেখি তাই করেন। তখন আমি স্বস্তি পাই। চা-টা খেয়ে
আমরা আবার বাইরে বেরুই। দেখি সেটা আমাদের বাড়ি ছিলো না।
সেটা ছিলো খুকুদের বাড়ি। আমার বোন খুকু। যে এখন হসপিটালে।
কয়েকদিন আগে যার স্ট্রোক করেছে।
আমি আর তাবরেজী বড় রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটি। আমার পরনে
নতুন কেনা লুঙ্গিটা। এখনো অনেকখানি ফুলে আছে। আমি বলি,
কবে এসেছেন যশোরে? তাবরেজী বলেন, পরশু। ক’দিন থাকবেন?
আরো তিনদিন। বুঝি তিনি অফিসের কাজে এসেছেন। তাবরেজী
সন্ধ্যায় মদ্যপান করবেন কিনা ভাবি। একটু পরেই তাবরেজী পকেট
থেকে কিছু একটা বার করে আমার হাতে দেন। দেখি ছোট-বড়
চারটা কয়েন। তামাটে, রুপালি, সোনালি, হালকা সোনালি। আমি
বলি এগুলো আমার ছেলেকেই দিতে পারতেন। ও খুব খুশি হতো।
তবে এই কয়েনগুলো সবই তার আছে। সেকথা তাবরেজীকে বলিনা।
আমরা একটা রিকশা নিয়ে নিউমার্কেট রোড হয়ে ঢাকা রোডের ব্রিজের
ওপরে আসি। এই ব্রিজটা দেখি সমুদ্রের ওপর দিয়ে চলে গেছে। তবে
সমুদ্রটা একটা বড় নদীর মতোই। আমরা রেলিঙ ধরে ঝুঁকে দাঁড়াই।
ব্রিজের নিচ দিয়ে অসংখ্য বিশাল বিশাল সব মৎস্য চলে যাচ্ছে। আরো
বহু জিনিস ভেসে যাচ্ছে। কিছু বিশাল মাছের শরীরের অল্প-অল্প দেখা
যাচ্ছে। একখণ্ড হালকা জলজ মাঠ আড়াআড়ি ভেসে যাচ্ছে। তাতে ফুল
আছে। কিছুটা লাল শাপলার মতো, তবে তাকে সিঙ্গল শাপলা বলা যায়।
আমি অথইকে ডেকে দেখাই। অথই (আমার বালক ছেলে) তার এক
ন্যাংটো বন্ধুর সাথে ন্যাংটো হয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। ওই দু’জনও কখন
জানি আমাদের পেছন পেছন চলে এসেছে। ব্রিজের ওপর, এদিক-ওদিক,
আরো লোকজন আছে। কলেজ পড়ুয়া ছেলেরাই বেশি। তারা ভালো।
মাছের সাথে সাথে দেখি একটা অদৃশ্য পাটাতনের ওপর বিরাট বিরাট
শাদা শাদা আকৃতির হাত-পা-মুণ্ডু-কেডস ভেসে যাচ্ছে। তাবরেজী বলেন,
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি বানাইছে। বুঝি এইটা কোনো বিজ্ঞাপন।
আমরা ফেরার জন্যে রিকশাটা খুঁজি। সেটাকে কোথাও দেখা যায় না।
তবে সেটা তেমন কোনো অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
তাবরেজী দেখি ব্রিজের পাশ দিয়ে নেমে সমুদ্রের পানিতে নেমে গেছেন।
ব্রিজের নিচে ইটবাঁধানো পাড়ের দিকে যে মাছগুলো চলে আসছে
সেগুলোর বেশিরভাগই বিশাল বিশাল বোয়ালের মতো। সেখানেও
দেখি একটা অদৃশ্য পাটাতনের ওপর রাখা বিশাল বিশাল সব
মৎস্যআকৃতি ভেসে যাচ্ছে। তার সাথে হাত-পা ইত্যাদির মিল
আছে। তবে এগুলো একটু লালচে ধরনের। আমিও তাবরেজীর
সাথে পানিতে নেমে পড়বো কিনা ভাবছি। মাছগুলো কামড়ে দেবে
কিনা ভাবতে ভাবতেই দেখি তাবরেজী একটা পাঁচ ফুট বোয়ালের
মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে যুদ্ধ করছেন। অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পর
তাবরেজী বোয়ালটার মুখটা দু’হাত দিয়ে বিরাট হাঁ করে ধরেন।
ভেতরে বৃত্তাকার দুইসারি ক্ষুদে ক্ষুদে কালো কালো দাঁত দেখা যাচ্ছে।
তাবরেজী বলেন, এই দাঁতগুলোই সমস্যা। তারপর একটা দা দিয়ে
মাছটার পিঠে একটা কোপ দিয়ে সেটাকে গেঁথে ফেলেন। আমাকে
বলেন, অথইকে বলুন মাছটাকে বাড়ি নিয়ে যেতে। স্বপ্নার যদিও
রাতে মাংস রাঁধার কথা কিন্তু আজ বোয়ালটাও সে রাঁধতে পারবে
ভেবে আমার একটু খুশিই লাগে।
তবে আমি মনে মনে এও ভাবতে থাকি, মাছটা এভাবে নেওয়াটা বৈধ
হবে কিনা। কারণ মাছটা তো সরকারি। এরকম হলে তো এই সমুদ্রে
আর কোনো মাছই থাকার কথা নয়। মুহূর্তেই সব সাফা হয়ে যাবার কথা।
৫.
হামাম
তারা বললেন, ‘জলপরীদের সাথেও স্নান করা যায়,
তবে সেইক্ষেত্রে দুই টঙ্কা বেশি লাগবে।’
টঙ্কার গায়ে বাদশা সলোমনের মোহর। মোহরের
ভেতর ভগ্ন প্রাসাদের একফালি। এই প্রাসাদের গায়ে
হেলান দিয়ে সাইকেল রেখে বাদশা সলোমন হাওয়া
হয়ে গেলেন।
শিশুদের সাথেও জলকেলি করা যায়। সেইক্ষেত্রে
একটা করে নরবলি দিতে হয়।
তবে সবচে’ সহজ উদ্বিড়ালদের সাথে জলকেলি।
পশ্চিম উপকূলে এখন শুধুই উদ্বিড়াল আর উদ্বিড়াল।
কোস্টগার্ডরা ছাড়া আজকাল সেখানে আর কেউই
যায় না।
৬.
আগুন
বুঝছি যে ম্যাজিক, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছি না।
প্রথমে ধোঁয়া উড়তে শুরু করছে, তারপর সেই ধোঁয়া গাঢ়
আর দ্রুত হয়ে উঠছে।
বুককেসের পাটাতনে তো হলুদ আগুনই জ্বলে উঠলো!
ঠিক যেরকম ভয় পাচ্ছিলাম। তারপর অবশ্য নিভেও গেল,
পুরোপুরি।
সবচেয়ে সুন্দরী আর লাস্যময়ী যে মেয়েটা বসে ছিলো, সেই
দেখাচ্ছিলো খেলাটা। আরো দু’টি মেয়ে ছিলো ঘরে। তারা অবশ্য
মোটেও অবাক হচ্ছিলো না।
লাইব্রেরির মতো বড় ঘরটার যেখানেই মেয়েটা তাকাচ্ছিলো
সেখানেই ধোঁয়া উড়তে শুরু করছিলো। স্যান্ডেলের পেছনে,
পিরিচের পাশে, টেবিলের ওপর, সর্বত্র।
বুঝছিলাম যে ম্যাজিক, কিন্তু কিছুতেই ধরতে পারছিলাম না।
৭.
পদ্ম
এসব কথার কোনো অর্থ নেই, তবু আমরা গুপ্তধন
চাইলাম। নীল জামের অন্তর্শাঁস চুইয়ে যেতে
চাইলাম গোলাপি মায়ার দেশে।
মানুষের এতো মোহ!
আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে ট্রেনলাইন গেল,
গুপ্ত কলাবতীর কয়লাপাহাড়ের পাশ দিয়ে কাশফুলের
দিগন্ত দেখা গেল। তবু আমাদের দুঃখ গেল না।
লাল-হলুদ মরিচের মতো লক্ষ বৃষ্টিদানায় ভরে গেল
উঠোন, ক্ষেত, প্রান্তর।
সেই থইথই প্রান্তরে একদিন এক অলৌকিক পদ্ম
ফুটবে বলে আমরা আশায় আশায় রইলাম।
লাল মোরগের মতো গলা ফুলিয়ে আমাদের প্রতিবেশীরা
সেই থইথই প্রান্তরের দিকে আড়ে আড়ে চাইতো।
অন্ধসাপের মতো কোনো এক পদ্মকুঁড়ি একদিন হঠাৎ
সেই জলরাশি ফুঁড়ে উদয় হবে, উদয় হবে বলে।
৮.
মুস্তফা
(কবি মুস্তফা আনোয়ার, শ্রদ্ধাস্পদেষু)
হঠাৎই মনে হয়, আরে, এটা তো তুমিই! সকলের মাথা ছাড়িয়ে,
ধূসর বেগুনি ওভারকোটের ভেতরে, অন্ধচশমায় ঈষৎ কৌতুক তুলে,
তুমিই তো বার দুই হেঁটে গেলে বূলেভাড দিয়ে।
একবার ওদিক থেকে এদিকে, একবার এদিক থেকে ওদিকে।
কৃষ্ণচূড়ার অন্ধকারে একাকী রিক্সায় আমি ধীরে ধীরে সেলফোন
ঢুকিয়ে দেই তোমার পাঁজর বরাবর। দোতলায় মেহগনি কাঠের
চেয়ারের ওপর থেকে তোমার উল্ল¬সিত কণ্ঠ শোনা যায়, ‘এই, আমি
বাসায়, কী করবো?’
আশ্চর্য, তবে সেই বেগুনি ওভারকোটের অন্ধচশমা লোকটা? তার
ভেতরে বসে বসে তুমি কেন হেঁটে গেলে বার দুই বূলেভাড দিয়ে?
৯.
দোয়াত
আমরা বস্তুতে বিশ্বাস করি না।
ইদানিং বস্তুহীনতাতেও বিশ্বাস নেই আর।
তবুও টেবিলটা রয়েছে।
টেবিলের ওপর রয়েছে ফুলদানিটা।
একটা দোয়াত যদি থাকতো টেবিলটার ওপর!
কাচের দোয়াত।
বিশাল পুরু তার কাচের মধ্যে দিয়ে দেখা যেত
উঠোনে হেঁটে যাওয়া বৃদ্ধের শাদা দাড়ির আভাস।
চকিতে চলে-যাওয়া লালশাড়ি বউয়ের লালের আভাস।
১০.
গুহা
যখন আকাশ ভেঙে পড়ছিল আর মাঝে মাঝে
জলপ্রপাতের আয়না এসে ঝিলিক দিচ্ছিল
আমাদের বদ্ধ চোখে, নৈরাজ্যের শব্দে এফোঁড়-ওফোঁড়
হয়ে বহু ওপরে উথলে উঠছিল সমুদ্র...,
তখন আমরা বসেছিলাম গুহার ভেতর এলোমেলো
পাথরের ওপর, শ্বাপদ ও সরীসৃপ, স্থির আর জড়সড়।
একটি মথ শুধু একবার উড়ে গিয়েছিল এদিক থেকে
ওদিক আর আমরা সকলেই ছিলাম অপেক্ষমাণ,
চিত্রতারকাময়, অন্ধকার গুহায়।
১১.
বৃষ্টির কবিতা
এশিয়াদেশীয় বর্ষণে আমি আন্ধার আন্ধার রেস্তোরাঁর
বেঞ্চে বসে আছি দেওয়াল ঘেঁষে। হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটার
মতো দু’টি শব্দ মগজে ঢুকে যায়, ‘করো অশ্রুপাত’,
‘ক.রো অ.শ্রু.পা.ত’। আমি ভাবি ‘অসীম ক্রন্দনকাল’টা
লেখা হলে কেমন মিলটা হতো!
একটু উঠে হাঁটতে হাঁটতে এগুই। দেখি রফিক আজাদ।
প্রথমে ভাবি এক বয়স্থা মারমা মহিলা, রফিক আজাদ
আরো একটু পক্ক হয়েছেন। সামান্য লটবহর। হাইওয়ের
ওপর। কোথায় যাচ্ছেন? ইণ্ডিয়ায় যাইতেছি।
আবৃত্তিলোকে পাল তুলে দেয় কোলকাতা, মহাদেব সুনীলের
পরিবর্তমান মেঘের চেহারাটা একবার দেখতে চেষ্টা করি।
পৃথিবীর ভ্রমণের কথা ভেবে ভেবে ব্যথা পাই।
তাড়াতাড়ি ছ’টা গোল্ডলিফ আনিয়ে আমি রফিকের পাশে
রাস্তায় বসি। একটা সিগারেট হাতে নিতেই তামাক সব
ঝুরঝুর করে খসে পড়ে রাস্তায়। রফিক ফিরেও তাকায় না।
এমনকি যখন তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আচ্ছন্ন
বৃষ্টিজনপদে মিলিয়ে যাচ্ছি আবার, তখনো সে শুধু এক
মারমা বুড়ির মতো নিথর বসে থাকে।
১২.
গ্রহ
এখন আর বেণুবাসিনীর রাস্তায় যাই না।
ভীরু রাস্তাটি তেমনই আছে, খসে পড়ছে ভেজা
বাবলার ফুল কালো নদীর ওপর। কাচপোকা উড়ে
এসে চুমু খেয়ে যাচ্ছে বন্দরে বন্দরে। সবুজ চশমাপরা
খালাসিরা ঢু মারছে বেশ্যাপাড়ায়। জেটির ওপর সবুজ
পতপত করে উড়ছে সোনালি পতাকা।
এখন আর নদের রাস্তাতেও যাই না।
মনে আছে বিদ্যুৎ হাতড়ে যখন উঠে আসছি চাঁদের
গর্ত থেকে, ‘হরিণাকুণ্ডু কোথায়?’
এক চক্ষুষ্মান পাটখড়ির আগুনে দেখায় দূরের মক্তব।
ভাঙে ভুল।
পাশেই ওসমানের ঘর।
কলার সবুজ ভেলা পড়ে আছে জলার ওপর।
১৩.
অপহরণের দিন
কার্তিকের এক কাপ্তাইয়ের রাতে তারা আমাকে হাঁটিয়ে নিয়ে
যায় মাটির গভীর দিয়ে অবিকল অন্ধকার পিঁপড়ের মতো।
বড় হিম হয় গা, ঘেমে-নেয়ে, ছড়ে-যাওয়া পায়ে রাত্রির
মাটিতে আমি অদৃশ্য রক্তআলপনা আঁকতে আঁকতে হাঁটতে
হাঁটতে দেখি এক গোলাপি গিরগিটির বেশে ভোর আসছে
উড়ে, প্রসন্ন হলুদ হয়ে উঠছে চন্দনের অরণ্য, দু’দিক থেকে
বুনো হাতির দল সরে যাচ্ছে ধূমল মেঘের মতো।
পাথরের ওপর বৃষ্টিফোঁটার মতো দানা দানা পোখরাজ, আর
ঘাসের ওপরে নিরিবিলি পান্নার পাশে আমাকে মৃত ভেবে ফেলে
রেখে তারা দিব্যরথে পালিয়ে গেলে আমি হামাগুড়ি দিয়ে
হাসতে হাসতে ঢুকে পড়ি এক গুহামলিন ধাতুর কন্দরে।
অজস্র অযুত কালো পিঁপড়েরা ঢেকে দেয় আমার রক্তাক্ত ঘুমশরীর
আর অপহরণের দিন কেটে যায় অগোচরে, কৃষ্ণকায় এক সূর্যের
আড়ালে।
১৪.
লীলা আমার বোন
সেদিন হঠাৎ এক সবুজ কুকুর হয়ে ‘কিঁউ’ বলে বিদ্যুৎগতিতে
পিছিয়ে আসি তোমাদের মিষ্টির দোকানের সামনে থেকে।
চোখের সামনে ভাসতে থাকে উল্কার মতো উড়ে যাওয়া চ্যালাকাঠ,
কালো, অঙ্গার-অঙ্গার। তাই দেখে ছাদসমান উঁচু-উঁচু মিষ্টির
আলমিরার আড়াল থেকে এক রুটিরঙ ধেড়ে টিকটিকি হেসে ওঠে
যেন কিছুই দেখেনি। পাশেই বনখেসারির হালকাসবুজ বনের মধ্যে
দিয়ে ভোঁতা এক রেলগাড়ি চলে যায় আর আমার পাশের রেলরাস্তা
ঘেঁষে-ওঠা বোকা এক পলাশের মাথা থেকে হাজার হাজার
কমলাপাখি আকাশে ওড়ার জন্য একসাথে ঝাপটে ওঠে।
হিরিঝিরি বৃষ্টিবাতাসে নদীর ধার ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে একবার
ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের হাঁটন্ত দেহটাকে দেখি। সবুজ চকচকে ধাতব
আঁশে সমস্ত দেহ ঢেকে আছে। একটু ঝনঝন শব্দ হচ্ছে নাকি?
আর্মাডিলো বা ওইরকম প্রাণীদের মতো! একটু গর্ব হয়। কতক্ষণ
এরকম থাকি কে জানে!
শাদা একটা বলের মতো কিছু পড়ে আছে দেখে মাটি শুঁকতে
শুঁকতে এগিয়ে যাই। কুৎসিত ন্যাকড়াকাণ্ড ছাড়া কিছু নয়। মুহূর্তে
মনের মধ্যে এই নদীটির শৈশব ভেসে ওঠে। ন্যাকড়া জড়ানো
মানুষের ভ্রূণ পড়ে থাকতে দেখতাম প্রায়শই। দু’এক ছোপলা
রক্ত-রক্ত দাগ। সাড়ে পয়তাল্লিশ লক্ষ মানবভ্রূণ এই নদীতে
ফেলা হয়। তাদের গর্ভনিশ্বাসে শুকিয়ে যায় এই একদা স্রোতস্বিনী
নদী। খুন আর খুন। মাঝরাতে কোন গোস্তের দোকানের পচন্ত
আড়ালে শুয়ে শুয়ে আমি এই নদীটির মাটি-চাপা বীভৎস গোঙানি
শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাই। আর স্বপ্ন দেখি।
স্বপ্ন দেখি বাতাসকে স্তব্ধ করে সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় মেহগনি বনের
ওপরে এক সবুজ থালার মতো চাঁদ। সেই চাঁদের শরীর জুড়ে
পুরাণের জলছবি, জীবন্ত, বুঝা যায়। বনের উল্টোদিকে একরাশ
ভেজা সোনা ছড়িয়ে সূর্য নরম লাল মাখনের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে।
আর আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেছে এক অনন্তের ঘাসপথ।
সে পথের শেষপ্রান্তে স্ফটিকোজ্জ্বল আকাশনীল দরোজা। আরো
গভীরে তার লোকালয়। মানুষের পৃথিবীর ছবি। তোমার বাবা,
তোমাদের বাগান, তোমাদের ঈষৎ জংধরা লোহার গেট। তার
ওপর ঝাপড়ে-আসা তাজা বাগানবিলাসের ঝাঁক ঝাঁক কুঁড়ি।
তুমি যেদিন সেই বেবুনটার বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে
হসপিটালের ছাদ থেকে উড়ে গেলে গ্রানাডায়, মক্কার প্রপাত যেন
ডুবিয়ে দিল আমাকে, সেই থেকে আমি রোজ রাতে স্বপ্ন দেখি
তোমাকে। প্রপাতের নীচে শুয়ে শুয়ে ওপরে তাকিয়ে যা যা দেখি─
তোমার বাবার মুখ, তোমাদের বন্ধ গেটে লেপ্টে আছি শাদা
কাগজের মতো আর দেখতে পাচ্ছি দূরে ঘর জুড়ে হলুদ আলোতে
তোমার বাবার দেহ দীর্ঘ হতে হতে আকাশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে আর
মেঝেতে শুয়ে-থাকা সবুজ নার্সের ছোট আলপনা। তারপর উঠে
আসছে নার্স তোমার বাবার দেহের ওপরে। সবুজ নার্সের দেহ
বড় হতে হতে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বন প্রান্তর আকাশ। তোমার বাবা
তখন ন্যাতানো খবরের কাগজের মতো মিশে যেতে চাইছেন
মেঝেতে। এইসব দৃশ্য চলে অনন্ত ব্রডওয়ে, চলে দীর্ঘ দিবস,
দীর্ঘ রজনী জুড়ে। আর আলোয় ফালি-ফালি হয়ে নিজের
টুকরোগুলো জোড়া লাগিয়ে আমি আবার গন্ধ শুঁকে শুঁকে হেঁটে
যাই, আন্ধার-আন্ধার গলি, জবজবে শেয়াকুল বন, বৃষ্টি-লেপ্টানো
কদমপ্রান্তর, তারপর আড়াল হতে হতে আবার সেই নদীপথ,
নদীর ধার ঘেঁষে এখন যেখানে বসে আছি।
একা আমি বসে আছি সবুজ বর্ম পরে, মৃত নদীটির ধারে,
একদা স্রোতস্বিনী নদীটির ধারে।
১৫.
মন্দ্রপুরাণ
শিশুটি লাফ দিয়া রাজার কোল হইতে আমার কোলে চলিয়া
আসিল। আমি একটু সরিয়া দাঁড়াইলাম। পুরোহিত হাসিলেন,
কহিলেন, ‘অভিজ্ঞতা কি পাথর যে উহা লাভ করিবেন?’
তখন চারিদিক হইতে ইস্টক নিক্ষেপ শুরু হইলো। তবে ইস্টকগুলি
কাছে আসিবামাত্র তুষারের মণ্ডের ন্যায় বিদীর্ণ হইয়া পেঁজা তুলার
ন্যায় উড়িতে লাগিল। ভারি ভারি বর্শার আঘাতে মৃত্তিকা মুহুর্মুহু
দুলিয়া উঠিল। রাজা পুনর্বার ক্রুদ্ধ হইলেন। তাহার রাজ্যের
অনাচারে তিনি নিজেই বিস্মিত হইলেন।
পুরোহিত ঠা ঠা করিয়া হাসিয়া বলিলেন, ‘ঈশ্বরের বিধান কখনো
লঙ্ঘন করা যায় না। ইহাই ঈশ্বরের বিধান।’
শিশুটি একবার আমার দিকে, একবার আর-সকলের দিকে
তাকাইল। তাহার দুইচোখে একঝলক প্রবল কৌতুক খেলিয়া
গেল।
১৬.
দর্শনা
মৌবনে নামতেই মধুসূদন।
সে খুব আক্ষেপ করে, ভালবাসে, গলা জড়িয়ে ধরে।
রাত্রি থাকতেই ফিরে যেতে হবে তারানগর। সেইখানে
আমাদের বাড়ি আর বউ।
সোনালি বিক্ষোভে ঝড় বইছে মাঠে।
ফেলে যাওয়া বৃটিশদের ছোট ছোট ঘরবাড়ি, মেঘলা
ছায়ায় শুকোচ্ছে আর ঘেমে উঠছে বার বার রোদ্দুরে।
তবু যতটা ভেবেছিলাম ততটা ছুটোছুটি ছিল না স্টেশনে।
শুধু কালো ছায়া, মৃদুমন্থর, হাতড়ানো লাউডগা,
পানপাতার ভরা ছাউনি দূরে দূরে, স্থির, মৃত কংক্রিট
শুধু জীবন্ত ধাবমান।
মধুসূদনের হাত ধরে খুব বলতে ইচ্ছে করে, চলো,
যেইখানে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো না, সেই রেলসমুদ্দুরে
তরি ভাসাই, গগনবাবুর নীল ফতুয়ার নিচে দাঁড়াই
একবার আর প্রাণভরে শ্বাস নিই দীর্ঘ ঝালর দেওয়া
রেলরাস্তার বুনো ফুলে।
১৭.
জাতিস্মর
আজ আর অবকাশ নেই।
হাতে রামধনু নিয়ে তুমি শিকারে গিয়েছো।
ষাঁড়ের হৃদয় নিয়ে ছুটে গেছো নীল পক্ষিণীর কাছে!
আমি শুধু জানালায় দূরবীন।
জঙ্গলবাঁধাল মাঠ, পানকৌড়ি বিল, লতাগুল্মময় রান্নাঘর।
আজ আর অবকাশ নেই।
দূরবীন ফেলে আমি নিজেই বেরিয়ে পড়েছি শিকারে।
পূর্বজন্ম, বসে আছে দূরে, ছায়াময়।
১৮.
বিড়াল
আর আমি সূর্যের কাছাকাছি রৌদ্র থেকে গলে গলে
রাজকুমারীর পাত্রে মিশে যাই। তার সখের বিড়াল,
আহ্লাদী থাবা, ঝকঝকে রেশমের মতো বিচ্ছুরিত
দুপুর, সেই এক দুপুর যার বাতাবিসবুজ গর্ভ থেকে
রাশি রাশি তাজমহল আর গওহরজানের হ্রদ, হ্রদ আর
আয়নাগুলি, ঝিঁকিয়ে-ওঠা পানকৌড়ির চোখ আর পদ্মফুল।
অসীম পদ্মফুল এই হ্রদে, পদ্মের সোনালি আভায় জ্বলজ্বলে
মায়াবী দুপুর আর রাজকুমারীর বারবার হারিয়ে যাওয়া
ক্ষণিক বিড়াল।
হ্রদের পানিতে এক হলুদ জলযান, নিস্তরঙ্গ, দোল খায়,
দোলে।
১৯.
পথ
তরমুজের ফালির মতো আমরা দিন ও রাত্রির নমুনা
সংগ্রহ করলাম।
আমাদের দিনের নমুনায় ছিল─ পথিপার্শ্বে মাটির দোতলা
বাড়ির জানালায় গিটারবাদক নেপালি বালক, যেন মহারাজার
সদ্য-ছেঁড়া মুক্তোর মালা টুংটাং খসে পড়ছে বহুতল কাচের
প্রাসাদে। সেইসাথে এসে মিশছে আধাগৃহস্থ মোরগের
দীর্ঘপ্রলম্বিত লাল সংগীত।
রাত্রির নমুনায় আমরা নিলাম সেই একই পথের রেখা।
কংক্রিটের উজ্জ্বল নদীতে তারকাচূর্ণ ও অভ্রের সংকেতে যে
পথ আমাদের হাঁটিয়ে নিয়ে যায়।
অথচ যে গ্রহে আমাদের যাবার কথা ছিল তার মহাঘনায়মান
মেঘের গভীরে কুলের শাঁসের মতো পৃষ্ঠ এখনো লাভায় লাল।
সেখানে সূর্য ছয়মাস হেঁটে যায়, ছয়মাস দীর্ঘ রাত্রি তার
পিছু পিছু হাঁটে।
২০.
অন্তরীক্ষ
অন্তরীক্ষে যাবে বলে দ্রোহ।
মুক্তার পৃথিবী থেকে তাই আমি নায়কের কাছে
ফিরে আসি। নায়কের কাছে অভিমান বলে কিছু
নেই, ক্রোধ কিছু আছে─ গোলাপি শরবতের মতো।
সরিষা ফুলের ’পরে পত্র-পুষ্প-পত্রালী বিছিয়েছো।
তালকানা রৌদ্রে রাস্তা দু’খানা করে মাখনের মতো
গাড়ি চলে গেলো। এই পথে একদিন নিথর চোখের
কথা মনে পড়ে। কাঠবিড়ালী একছুটে শিরীষের স্তন
বেয়ে উঠে যায় মগডালে, সেখানে একটুকরো নীলে
লালফুল গুটিকয় জ্বলজ্বলে আর
দূর বনের তামারঙ চন্দ্র নিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যায়
বিবিধ শকট। ভাটার চিমনি থেকে খুব ধীরে পাইথন
উড়ে যায়। ঘাসেরা সবুজ বলে প্রান্তর, ধানক্ষেত,
বাঁশবৃক্ষবন সকলি সবুজ দেখায়।
২১.
টেলিফোন
ফুটিফাটা নক্ষত্র দিয়ে একটি রাত সাজিয়েছি কালো স্লেটের ওপর।
হাসনুহানার গন্ধে সুগন্ধি সন্ধ্যা ভেসে বেড়াচ্ছে চারদিকে, উপচানো
হলুদ গাঁদায় ভরে উঠছে উঠোন। নিরিহ চন্দ্রবোড়াকে পিটিয়ে
মারলো কারা?
পুঁইবিচির তরল পটাশ ঢুকে যাচ্ছে নখের গভীরে। থোপা থোপা
শিমের ডগায় মৌমাছি আসছে বারবার উড়ে উড়ে, ঠিক তক্ষুণি
বেজে উঠলো তোর টেলিফোন...একবার...দু’বার...
যে ভুতুড়ে চুম্বন নেমে আসছে এখন মাঝরাতে তোর ঠোঁটে তাকে
বলিস, একজন অপেক্ষায় আছে মস্কো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে স্লট
মেশিনের ধারে, সময়হীন, বাইরে কাচের ওপাশে বিশাল হিমেল
কুয়াশায় উইলো বনের নিচ দিয়ে হেঁটে আসছেন খর্বকায় টলস্টয়,
হ্যাটপরা মাথা নুইয়ে, ধীরে ধীরে...
২২.
পাঠশালা ও পাখনায় ঘুম
১.
মক্তবের করিডোর ধরে হাঁটি,
পাশাপাশি হেঁটে আসে টিকটিকি এক।
রৌদ্রে দু’টি কুমিরের ছানা।
আরো ছানা মিশে আছে জলে, স্থলে।
২.
ঘাটের বেদিতে বসে আছি।
দূরে ভাসে রঙধনু।
উত্তমর্ণ রয়েছেন জলে।
মাথায় ভেজা অরণ্য।
বহুক্ষণ ধরে জল সরিয়ে সরিয়ে তিনি
অদৃশ্য বাউশের সাথে সংকেতলীলায়
মগ্ন রয়েছেন।
ঘাসের ওপরে হাঁটি, একা।
২৩.
নৌকা
বায়ু এসে ভরিয়ে দিচ্ছিলো ঘাট,
আমার নৌকা দুলে উঠছিলো কাকতাড়ুয়ার মতো।
উজ্জ্বল গম্বুজের মতো কাকতাড়ুয়া, কালো টুপি,
দুলন্ত বাতাসে এসে দাঁড়িয়েছে নির্জন ফণা,
কোথাকার, কে জানে, হয়তো ঐ পানসুপুরির ধারে
পোড়োবাড়িটাতে থাকে, লাল, খসে-পড়া।
রাশি রাশি শিমফুলের বিছানা পাতা চৌহদ্দিতে,
থোকা থোকা ঘুম, হিরন্ময় টুকরো পাথর থেকে
চুইয়ে পড়েছে শিশির, জলকণা।
২৪.
রেফ্রিজারেটর
কুলুকুলু স্বরে বাজে বিষণ্ণ মাদল।
ঝরনার মতন সে ধারা বয়ে যায় মেলায়। রঙিন পতাকার মেলায়।
বয়ে যায় জল।
পাতালপুরী নদীর তীরে তীরে দক্ষিণেশ্বরের ঠাঁই। উল্লাস।
বেনোবটের পাতায় লালকুঁড়ি সিঁদুর।
দোদুল্যমান পাটাতনে খসে পড়ছে লাল লাল ফল। বটের পাতায়।
২৫.
হ্রদ
দিন যায়,
মেঘ ও হ্রদের যৌনদৃশ্য দেখে দেখে।
তিনটি বৃদ্ধ শুধু ডুবে যায়, মধ্য জলাশয়ে।
ঊর্ধ্বমুখি দু’হাত তুলে নৈঃশব্দ্যে তোলে ঢেউ।
সকল দৃশ্যের কাছে থমকে যেতে হয় বলে
চক্ষু মুদে থাকি।
ও আসন্ন শবদেহ,
সকল দৃশ্যের কাছে থমকে যেতে হয়।
তাই আমি বন্ধ রাখি চোখ।
সুপ্রাচীন তালপত্রে রাখি হাত।
হাতে শুধু উঠে আসে পিশাচের ডানার পালক।
২৬.
দণ্ডকারণ্য
ফিরে এসে দেখি, শহরটা হয়ে গেছে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড।
আকাশসমান উঁচু এক সবুজ বিল্ডিং-এর পাশ দিয়ে যখন
আমি হাঁটছিলাম, ওপরে তাকিয়ে দেখি দশতলার এক
জানালায় দৈত্যের মতো এক কিশোরী বুয়া, ঝুড়ি হাতে
ময়লা ফেলছে নীচে। আমার ক্ষুদ্রত্ব দেখে সে একটু মুচকি
হাসে। সবকিছু এত মহান আর গৌরবোজ্জ্বল হয়ে গেছে!
শহর ছাড়িয়ে আমি হাইওয়ে ধরে নির্জনে হাঁটতে থাকি।
এক ঝুপড়ি চায়ের দোকানে ঢুকে দোকানির হাতে একটা
ঘষা-আনি দিয়ে দুটো লাঠিবিস্কুট চাই। তাজ্জবমুখে লোকটা
আমার দিকে তাকালে সমস্বরে হেসে ওঠে একদল লোক।
চকিতে আমি দেখি একটা লাল টেলিভিশন আর তার
বিকিরণে অনেকগুলি দাঁত আর চোখের আভাস।
এবারে আমি রাস্তা ছেড়ে নেমে হাঁটতে থাকি জঙ্গলের দিকে।
ছোট্ট এক পাথরের ওপর বসে ডোবার জলে মুখ দেখার চেষ্টা
করছে এক বিষমরঙ প্রজাপতি। আমিও বসে পড়ি আর
ডোবার জলে বহুদিন পর নিজের মুখ দেখতে চাই।
আশ্চর্য, সেই জলে আমার কোনো প্রতিবিম্ব তৈরি হয় না!
২৭.
বিড়াল নগরী
আমি বিড়াল নগরীতে থাকি।
আমার সন্তান থাকে বোররাক নগরীতে।
আমি সে নগরী কোনোদিন দেখি নাই।
মেজো কন্যা নীল মখমল ভালোবাসে।
তার পেতলের ঘুঙুরদানিও আছে।
প্যাস্টেল রঙের অজস্র ফুলের মাঝখানে তার বসবাস।
সবচে’ ছোটোটা এখনো আসেনি।
জলের সমুদ্রে তার জলতরঙ্গ শোনা যায়।
দূরাগমনী জাহাজের নীল সঙ্কেতের মতো।
২৮.
সুরমার জলে
আজ আবার এসে দাঁড়িয়েছি সুরমার জলে।
সুর্মার মতো ঘন আকাশ দূরে ঝিকমিক করছে।
নদীর ওইপারে কেউ চলে গেল,
মানুষ, সরীসৃপ, নাকি উড়ন্ত খেচর কোনো?
কী হবে সেসব জেনে?
দুইপারে ভাঁটফুল, শাদা শাদা, অঢেল ফুটেছে।
২৯.
ইসকুল
রাস্তায় রাস্তায় ফেরিওয়ালা।
হাতে বাঁশি আছে।
নিবেদিতাপ্রাণ ভগিনীরা চলিয়াছে,
নীল ফ্রক, শাদা পাজামার ঝাঁকে ঝাঁকে।
দূরে শাদা ইসকুল খুলে যায়।
পেতলের ঘণ্টাধ্বনি ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে।
আজো ফ্ল্যাগ মেঘ চূর্ণ করে দেবে।
ছোট কপাটের ছোট জানালারা আছে।
সারি সারি বেঞ্চ, অন্ধকার।
দাবানলের মতো বেজে উঠছে আলো,
ছুটি হলে পরে।
ঘরে ঘরে এত উৎসব!
শান্ত বরইগাছ, একা দূরে নির্জন ঘরটির পাশে।
৩০.
লাল
আবার একটি রক্তপাতের জন্য প্রস্তুত হই কিন্তু রক্তের
রঙ কীভাবে ভুলি? লাল তুলিতে আঁকা সেই হৃৎপিণ্ডগুলি?
তাই থেকে কমল, তাই থেকে কোমলগান্ধার।
কীভাবে ভুলি সেই অন্ধকার জবাফুলের স্মৃতি?
আঙিনায় আঙিনায় আমি বর্তুল মৌমাছি আর অনতিনির্জন
শুঁয়োপোকা। জেলেপাড়া থেকে ফেরার পথে রক্তগোলাপের
বন আর মাটিলেপা শীতল গুচ্ছের অন্ধকার। আছড়ে পড়েছে
হলুদ করবীর বন। তার ওপর আসমান থেকে ভাঙাচাকের
মধু পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে।
আরেকবার রক্তপাতের আগে রক্তের রঙের কথাই মনে
পড়ছে বারবার।
৩১.
ডাকপিয়ন
ঈশ্বরও সৃষ্টির আগে সেই মন্ত্রপূত মাঠে জড়ো হলো
বালকেরা আর বহুদূর থেকে হাওয়াই কমলার ঘণ্টা
বাজাতে বাজাতে মেঘ ফুঁড়ে বাইসাইকেল চেপে এলো
ডাকপিয়ন।
তার হাত থেকে লেফাফা নিয়ে ছেলেরা তড়িঘড়ি সরে
গেল আরও গভীরে, বংশবৃক্ষের ছায়ায়।
তাদের উজ্জ্বল চোখে দেখা দিল জ্বলন্ত ডাকটিকিট আর
দূর বনের জঙ্গল ভরে উঠলো অসংখ্য বাঘিনীর মুখে।
৩২.
মূর্তি
লাল চাদরে মুখ-ঢাকা মূর্তির আবির্ভাবের পরেই সবকিছু পালটে
যেতে থাকে।
ঘোরের মধ্যে আমরা ঘর থেকে একে একে বেরিয়ে আসি আর
আবিষ্কার করি তস্করদের ফেলে যাওয়া সারি সারি নষ্ট তৈজস,
গ্লাস, প্লেট। অন্ধকারে রাখা মালামালের ভিতর আরো উদ্ধার হয়
এক হাঁড়ি তপ্ত অন্ন, এক পাত্র ভোজ্য আলু।
আমাদের মধ্যে চিরক্ষুধার্ত মৃতরা জেগে ওঠে আর তস্করদের
রেখে যাওয়া অন্ন নিয়ে তড়িঘড়ি বসে পড়ে যেন এরকমই হবার
কথা।
তারপর আমরা নিজেরা মত্ত হই এক দীর্ঘ লড়াইয়ে। দল আর
উপদলে চলে লড়াই আর লড়াই। রাবারের মতো মৃতরা ছোট
থেকে বড় হয়, বড় থেকে বার বার ছোট হয়ে যায়। তাদের
প্রত্যাঘাত বাতাসের মতো আমাদের বিদ্ধ করতে থাকে।
মৃত চন্দ্রের নিচে আমরা ক্লান্তিহীন─ রক্ত থেকে দেহ, দেহ থেকে
পুনরায় রাবার হতে থাকি।
[কথিত আছে যে, এইরূপে কয়েকশত বৎসর অতিক্রান্ত হইবার পর
জনৈক বৃদ্ধ সহিস অসীম কৌতূহলে চুপি চুপি পুনরায় ফিরিয়া আসে
সেই পূর্বকার গৃহে। লাল চাদরে আপাদমস্তক ঢাকা সেই রহস্যময় মূর্তি
তখনো ধীরে ধীরে হাঁটিয়া বেড়াইতেছে। বহুকাল পূর্বে পাতা উৎসবের
টেবিল চেয়ারগুলিতে ঘন পুরু শেওলা জমিয়াছে। দু’একটি চেয়ার কাত
হইয়া আছে। আকাশ হইতে ঝুলিতেছে নিভু নিভু পেট্রোম্যাক্সের আলো।
দূরে চরাচরব্যাপী দিগন্তের শাদা আভাস।
বৃদ্ধ সহিস নিকটে আসিয়া হঠাৎ একটানে খুলিয়া ফেলে সেই মূর্তির
লাল চাদর। দ্যাখে, হায়, ভিতরে কিছুই তো নাই! বৃথাই তাহারা
এতকাল ভয় পাইয়াছে।
আদিম বিপন্ন বাতাস শুধু খেলিয়া বেড়ায়।]
৩৩.
চণ্ডালের প্রেমিকা
চণ্ডালের প্রেমিকাকে মাঝে মাঝে দেখি।
রাস্তায়। এখানে সেখানে।
মোনালিসা। মোনালিসা বললেই ঈষৎ গর্ভিণী
এক রমণীর কথা মনে আসে।
পেছনে আদিম হ্রদ, আরো দূরে সবুজ বনানী,
হিম নীলাকাশ।
এই নারী সেরকম নয়।
বেদনার ফরমালিনে ডুবোনো জামরুলের মতো
কান্নাময়, রঙহীন, শাদা।
চণ্ডালের সপ্রাণ সখারা আজকাল দূর থেকে তাকে
ছায়ার মতন ঘিরে রাখে।
চণ্ডাল গাঁয়ে থাকে। কাব্য লেখে।
৩৪.
ফিরে এসো, প্রেম
(বিষ্ণু, তোর জন্যে)
জানালায় শুয়ে আছে দোলনার ছায়া, শিশুকাল।
মনে হয় ঝাঁপ দিই, অন্ধকার অতল মহাকাল, ঐপাশে।
আজ আবার ভালোবাসি সবকিছু, ভোরের উজ্জ্বল চাঁদ,
তার পাশে শুয়ে-থাকা সরস্বতী, স্বাতি।
কী ভীষণ ভয় পাই তোকে দেখে,
যেন এক মৃত্যুপাখি দাঁড়িয়ে রয়েছে তবু, নেই।
পৃথিবীতে হাসি নেই।
সবুজ সাবান নেই।
উদ্বেলিত গোপন বুদ্বুদ নেই কোনো।
শিশু নেই।
সন্তাপও চলে গেছে দূরে।
রক্ত এতো শাদা হয়!
গল্প এমন চির অচেনার মতো একাকীও হতে পারে
৩৫.
ফণা
এইতো বিদ্যুৎ─ আর সাপের খোঁড়লে হাত বাড়িয়ে আমি
ঝটকায় তুলে এনেছি তীব্রতম ফণা─ পাশেই ঢোলকলমির
শাখায়-পাতায় দোল খাচ্ছে সবুজ-টিপ চন্দ্রমুখি আর তিরতির
বয়ে-চলা পাতার নদীতে বিন্দু বিন্দু রঙধনু ঝিলিক দিয়ে
ছড়িয়ে যাচ্ছে দিকচক্রবালে।
একদিন নক্ষত্রনীলাভ রৌদ্রে এইসব স্মৃতি আর ধূলিকণা নিয়ে
যখন হেঁটে যাচ্ছি লোকালয় থেকে দূরে─ ক্রমশই দূরে আরো
সরে সরে যায় লোকালয়, তার বিন্দুরঙিন ঝিকিমিকি, পথে পথে
ছড়ানো গরল এড়িয়ে, পিছু পিছু হেঁটে আসে একপাল রঙিন
সারস, যেন কোনো চন্দ্রসকালে তারা একে একে বেরিয়ে এসেছে
এক অলস কোটর ফুঁড়ে, কুয়াশায়, সমুদয় বৃত্ত ঘিরে ঘিরে।
৩৬.
জহির এসেছিলো
জহির এসেছিলো।
আজ? না কাল?
জহির চলে গেল।
আজ, না কাল?
জহির কবি বলে মনে পড়ে।
জহির রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কথা বলছিল?
কবি বলে?
জহিরের হলুদ কয়েকটি চুল।
জহিরের কয়েকটি চোখে পাখির প্রলাপ।
৩৭.
পোকা
মুলো ও পটলের সাথে যাই। অসীম গোপন সুড়ঙ্গ দিয়ে,
যেইপথে সারি সারি পোকাদের অন্ধকার শ্বেতসার গমন।
লাউ ঝোলে, আজ তার রোমশ ত্বকের ’পরে সবুজের আবছায়া
পড়িয়াছে।
বেড়ার ওপাশে ঘর, আফসার আমেদ, চাঁচের ওপরে রঙ, উড়ে
যাওয়া প্লেন, তার মুহূর্তেক ছায়া একফালি শেষ কবে চলে
গেছে প্রান্তর, প্রান্তর দিয়ে।
আরো নিচে অন্ধকার, শয্যা, আফসার আমেদ, আজ কোনো কথা
হলো না, মলিন বাঁশের থেকে পানি পড়ে ফোঁটা ফোঁটা সিঞ্চনে,
উড়ে যায় পুনরায় প্লেন, তার নিচে ভেসে যায় তিমি, শব্দময়
বনান্তর অহেতুক কেঁপে ওঠে মৃদু।
পটল পাকলে পরে কমলাবরণ, তখন সে স্বাদ নাই, রঙ শুধু
পড়ে আছে ভূমির ওপর।
৩৮.
উল্কাকাহিনি
সকলেই জানে সেই ক্রমউত্থিত ডালপালার নিচে কিভাবে নেতিয়ে
আসে চাঁদ (তখন জাগে না কেউ চরাচরে, শুধু কিছু রাতজাগা, আর
কিছু সন্তাপের বিষণ্ণ নুড়ি), ক্রমশ পাল্টে যায় কিভাবে দখিনা
বাতাস থেকে নিরন্তর জলমগ্ন হাওয়া, কার আহবানে দোদুল বরষায়
একা-দোলনা দোল খায় তেঁতুলের বুড়ো হাড়ে, কার আচানক বর্ধিত
জিভ মাটি থেকে টেনে নেয় লহমায় বিদ্যুৎ
সকলেই জানে কোন্ আসন্ন রাত্রিতে গোলাপবাগের মন দুমড়ে চলে
যায় শ্মশানযাত্রীর দল, কোন্ আতসবাজির ঈর্ষায় পুড়ে খাক হয়
সোনালি তরল, তার দুগ্ধফেনামাখা জোয়ারের ওপর বাদামের
খোসার মতো টালমাটাল জাহাজের ভেঁপু দূরবর্তী সংকেতে কেন
বার বার কাঁপিয়ে তোলে এই প্রাকারের হলুদ জানালা
কেউই জানে না কেন নিভন্ত মশাল হাতে নগ্ন আমি একা একা
ছুটে যাই ভাঙা অট্টালিকার পাশ দিয়ে ভুজঙ্গ আর কেয়াপাতার
ধারাল সবুজ থেকে লক্ষবর্ষী চতুরতায় নিজেকে বাঁচিয়ে, কোন্ দুরূহ
অভিসন্ধিক্ষণে অনির্দেশ্য গন্তব্যে এক সমান্তরাল উল্কাখণ্ডের মতো...
০০০০০০০০০০০
আবার সে বনে যাওয়া যায়। বারবার
যাওয়াই তো যায়।
কে কোথায় সরিয়ে রেখেছে ভাসমান
সোনার প্রাসাদ? নীল বাড়ির ছাদে,
বারান্দায়, লাল বালতি রাখা আছে।
ঘুড়ি নেই কোনো?
এখনো ঘুমিয়ে রয়েছে বসতি।
০০০
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১২:২৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



