মা কে দেখার ইচ্ছে পূরণ হলো বেশ তাড়াতাড়িই। বাবা মায়ের কথা ভেবেই গ্রেগর দিনে জানালার যেতে চাইতো না। ছোট্ট একটি ঘরের মেঝেতে নাড়াচড়াও তেমন বেশী হতো না, রাতে চুপচাপ শুয়ে থাকাও আসহ্য, খাবারও বিস্বাদ। নিজের অজান্তেই নতুন এক অভ্যাস তৈরী হলো তার। এদিক সেদিক দেয়াল বেয়ে বেয়ে কড়িকাঠে ওঠা। নীচে শোওয়ার চেয়ে কড়িকাঠে ঝুলতে ভাল লাগতো। ভাল নি:শ্বাস নেয়া যেত, হালকা এক তরঙ্গ বয়ে যেত শরীরে। আনন্দে আত্মভোলা হয়ে একদিন নীচে পড়ে নিজেই অবাক হলো। তার শরীরের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা আগের চেয়ে অন্যরকম, এত উঁচু থেকে পড়েও কোন ব্যাথা পেলো না সে। সে তার জন্যে নতুন এক আনন্দের উপকরণ খুঁজে পেয়েছ, তা বোনের চোখ এড়ালো না। তার শরীরের আঠালো পদার্থের দাগ দেখা গেল সর্বত্রই। হামাগুড়ি দিতে গ্রেগরের যাতে আরো বেশী জায়গা হয়, সেজন্যে বোন চাইল ঘরের কিছু আসবাব, টেবিল ও বাক্সটি সরিয়ে দিতে। একা কাজটি করার মতো শক্তি তার নেই, বাবার সাহায্য চাইতেও ভরসা হলোনা। আগের আয়াকে ছাড়িয়ে দেবার পর প্রায় ষোল বছর বয়েসের নতুন একটা মেয়ে রান্নার কাজের দ্বায়িত্বে। তবে তার কাছে সাহায্যের আশা বৃথা। সে এই শর্তে কাজ নিয়েছে, যাতে রান্নাঘরের দরজা সারাক্ষন বন্ধ রাখতে পারে। কারো বিশেষ সংকেতেই কেবল খুলবে। সুতরাং বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে মায়ের সাহায্য ছাড়া বোনের কোন উপায় রইল না। মেয়ের ডাক শুনে আনন্দ ও উত্তেজনায় মা এলেন, কিন্তু দরজার সামনে এসেই চুপ হয়ে গেলেন। বোন প্রথমে ঘরে ঢুকে দেখল, সব ঠিক আছে কি না, তারপর মা কে ঢুকতে দিল। খুব দ্রুত গ্রেগর তার এলোমেলো চাদরে ভাজের আরো গভীরে স্থান নিল। মা এসেছেন, তাতেই এত আনন্দিত সে, চাদরের ফাঁকে মা কে একবার দেখার সুযোগটিও নিল না। 'চল মা, ওকে দেখা যাচ্ছে না', হাত ধরে মা কে ঘরের বাইরে নিয়ে গেল বোন। সে শুনতে পেল, দু'জন দুর্বল মেয়েলোকের ভারী বাক্স ঠেলে ঠেলে জায়গা থেকে সরানো চেষ্টা। বেশী পরিশ্রম বোনই করছে, মা তাকে সাবধান করছিলেন বারবার, যাতে কোন ব্যথা না পায়। অনেক সময় লাগলো। পনেরো মিনিট পর ওটা আগের জায়গাতেই রাখার পরামর্শ দিলেন মা। প্রথমত: বেশ ভারী, দ্বিতীয়ত: বাবা ফেরার আগে সরানো কাজ শেষ না হবার বেশী সম্ভাবনা। তাতে ঘরের মাঝখানে বাক্সটি গ্রেগরের চলাফেরারই অসুবিধা ঘটাবে। তাছাড়া বাক্সটি এঘর থেকে সরানো গ্রেগরের আদৌ পছন্দ হচ্ছে কি না, সে সম্পর্কেও তিনি নিশ্চিত নন। বাক্সটি সরানোয় খালি দেয়াল শেল হয়ে বিঁধছে তার নিজের বুকেই, একই অনুভুতি গ্রেগরেরও হতে পারে। সে তো ঘরের আসবাব এভাবেই দেখে অভ্যস্ত। বাকী কথাগুলো তিনি ফিসফিসিয়ে এমনভাবে বললেন, যাতে গ্রেগর কিছুতেই শুনতে না পারে। 'এগুলো সরালে কি মনে করবে না গ্রেগর, যে আমরা তার সুস্থতার আশা পুরোপুরি ছেড়ে, ওর দিকে কোন নজর না রেখে পাষানের মতো একা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি? আমার মনে হয়, ঘরটি আগের মতো রাখাই ভাল, যা সাথে সে পরিচিত। তাতে নিজের মাঝে ফিরে এসে সে মাঝখানের সময়টি সহজে ভুলে যেতে পারবে'।
মায়ের এ কথা শুনে গ্রেগর টের পেল, মানুষের মতো সন্বোধিত না হয়ে ও পরিবারের মাঝখানে গত দু্থমাসের একঘেয়ে জীবন তার বোধশক্তিকে অনেকটাই ভোতা করে দিয়েছে। তার কথা বলার ক্ষমতা থাকলে সে নিজেও এগুলো সরিয়ে নিতেই বলতো। আসবাবে সাজানো উষ্ণ এই ঘরকে নরকে পরিণত করে স্বাধীনভাবে এদিক ওদিক লাফিয়ে বেড়ানো চায় কি সে? এত দ্রুত, মূহুর্তেই পুরো ভুলে যেতে চায় যে একসময় সে মানুষ ছিল? হয়তো এ পথেই যেত, যদি না মায়ের কথা আবার জাগিয়ে না দিত তাকে। কোনকিছুই সরানো যাবে না আর, সবই থাকবে। সাজানো এই ঘরের প্রভাবকে অস্বীকার করা একেবারেই ঠিক হবে না। তাতে যদি তার চলাফেরার অসুবিধাও হয়, লাভ ছাড়া কোন ক্ষতি নেই তাতে।
দু:খজনকভাবে বোনের মতামত অন্যরকম। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতিদিনের অবদানের কারণে বাবা মায়ের সাথে গ্রেগর সম্পর্কিত আলোচনায় বিশেষজ্ঞের ভুমিকা নিতে অভ্যস্ত সে। সেজন্যেই মায়ের পরামর্শ তার কাছে খুব গ্রহনযোগ্য হলো না। আগের পরামর্শ অনুযায়ী শুধুমাত্র টেবিল আর বাক্স নয়, সোফাটি বাদে বাকী অন্যান্য সব আসবাবই তার সরানোর পরিকল্পনা। শুধুমাত্র শিশুসুলভ জেদ বা গত কয়েকদিনের পরিশ্রমে অর্জিত আত্মবিশ্বাস নয়, সে সত্যিসত্যিই দেখেছে, গ্রেগরের চলাফেরার জন্যে আরো জায়গা দরকার। গ্রেগরের কাছে এই আসবাপত্রের কোন ব্যাবহারই নেই। হয়তো তার কম বয়েসও তার জেদের কারণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। প্রতিটি সুযোগেই আত্মসন্তুষ্টির পথ খোঁজা। গ্রেগরের আবস্থা আরো ভয়াবহ করে তাকে নিজের উপর আরো বেশী নির্ভর করানো। কারণ এমন এক ঘর, যে ঘরের খালি চার দেয়ালের মাঝে গ্রেগরের বাস, সে ঘরে অন্য কেউ নয়, একমাত্র গ্রেটেরই ঢোকার সাহস!
সুতরাং বোন মায়ের কথাকে পাত্তা না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তেই অটল রইল। মাকেও এই উত্তেজনার মাঝে বেশ বিচলিত মনে হলো। চুপ হয়ে গেলেন ও মেয়েকে বাক্সটি সরাতে শারিরীক সাহায্য করলেন। বাক্সটি যাক, কিন্তু টেবিল থাকবে এঘরেই! তাই ঠেলে বাক্সটি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পরপরই গ্রেগর সোফার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার উদ্দেশ্য সাবধানে ও যথাসম্ভব সতর্কতায় এ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করা। বাইরে গ্রেটের বাক্স আঁকড়ে ঠেলাঠেলির শব্দ, একচুলএ সরাতে পারছে না, এরই মাঝে মা আবার ঢুকলেন ঘরে। গ্রেগরের চেহারা দেখে অভ্যস্ত নন তিনি, অসুস্থ হয়ে যেতে পারেন। ভয় পেয়ে গ্রেগর দ্রুত পেছনে হেঁটেই চাদরে নীচে পালালো। পেছনের টানে সামনের দিকে একটু নড়ে উঠলো চাদরটি। এটাই তাঁকে সতর্ক করার জন্যে যথেষ্ট ছিল। থমকে এক মূহুর্ত দাঁড়িয়ে তিনি গ্রেটের কাছে ফিরে গেলেন আবার।
এত কিছু ঘটার পরও গ্রেগর এই বলে নিজেকে স্বান্তনা দিল যে, কয়েকটি আসবাব ছড়ানো ছাড়া খারাপ কিছু আর কি ঘটলো? কিন্তু পরমূহুর্তেই স্বীকার করতে বাধ্য হলো, দুজনের বারবার এই আসাযাওয়া, ডাকাডাকি, টানাটানির আওয়াজ চতুর্দিক থেকে বিরাট এক অত্যাচার তার উপর। সে তখন পা গুলো টেনে মাথা নীচু করে সমস্ত শরীরে মেঝের উপর লেপ্টে তার সহ্যসীমার শেষ প্রান্তে। তার ঘরটি পুরো খালি করলো ওরা, যা তার পছন্দের, সেগুলো সহ সব। একটি বাক্স, এযখানে তার করাত ও আন্যান্য যন্ত্রপাতি ছিল, সেটা বের করে মেঝেতে প্রায় আটকে থাকা পড়ার টেবিল বের করতে ব্যাস্ত। এই টেবিলে বসে সে ব্যবসাপ্রশাসন, কলেজ ও স্কুলে পড়াশোনার সময় তার বাড়ীর কাজ করেছে। তাদের উদ্দেশ্যের ভালমন্দের বিচারের সময় আর নেই। তাদের কথাও তার আর মনে রইল না। তাছাড়া শারিরীক পারিশ্রমে তারা এতই ক্লান্ত যে, শুধুমাত্র ভারী পায়ের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যাচ্ছে না আর।
ওরা দু্থজন যখন পাশের ঘরে টেবিলে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রামে, আড়াল থেকে বেরিয়ে এল গ্রেগর। চারবার দিক বদলে এদিক ওদিক দৌড়ালো। প্রথম সত্যিসত্যিই বুঝতে পারছিল না, কোনটি আগে রক্ষা করতে পারে। পরপরই খালি দেয়ালের গায়ে পশমি পোষাক পড়া মহিলার ছবিটির দিকে চোখ পড়লো। দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে ফ্রেমের কাঁচে চেপে ধরলো নিজেকে। উত্তেজনায় উত্তপ্ত শরীরে কাঁচের শীতলতায় একটু আরাম হলো ওর। ছবিটি যেভাবে ঢেকে রাখছে সে, অন্তত:পক্ষে এটা সরাবে না কেউ! মাথাটি ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালো ওদের ফিরে আসার অপেক্ষায়।
খুব লম্বা বিশ্রাম না নিয়েই ফিরে এল ওরা। গ্রেটে মা কে জড়িয়ে টেনে আনছে প্রায়। 'এখন কি নেব'? বলেই এদিক সেদিক তাকালো সে। দেয়ালের উপর গ্রেগরে সাথে চোখাচোখি হলো। হয়তো মায়ের উপস্থিতির কারনেই নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো বোন। মায়ের চোখের দিকে তাকালো, যাতে মা এদিকে না তাকান। কম্পিত স্বরে কিছু না ভেবেই বললো মা কে, 'চল, আরেকটু বিশ্রাম নিই ওঘরে'। গ্রেটের উদ্দেশ্য গ্রেগরের কাছে পরিস্কার। সে মাকে নিরাপদে রেখে এসে গ্রেগরকে দেয়াল থেকে তাড়াতে চাইছে। ঠিক আছে, আসুক আবার, সে ছবির উপর বসে, সরাতে দেবেনা কিছুতেই। বেশী বাড়াবাড়ি করলে লাফিয়ে পড়বে ওর মুখের উপর।
কিন্তু গ্রেটের কথায় ধরণ শান্ত না হয়ে আরো বেশী বিচলিত হলেন মা। একপাশে সরে গেলেন। ফুল তোলা কার্পেটের উপর এক বড় বাদামী দাগের উপর চোখ পড়লো। যেন এতক্ষনে টের পেলেন, এটা গ্রগরের কর্ম। দুই হাত তুলে কর্কশ আওয়াজে ্তুহায় খোদা, হায় খোদা্থ বলতে বলতে অবশের মতো বাক্সের উপর এলিয়ে পড়লেন। 'গ্রেগর'! বলে মুঠে হাত উপরে তুলে তীব্র ও শাসনের ভঙ্গীতে গ্রেগরের দিকে তাকালো বোন। তার এই পরিবর্তনের পর এই প্রথম কেউ একজন সরাসরি তার সাথে কথা বললো। পাশের ঘরে ছুটে গেল বোন, হয়তো মায়ের জ্ঞান ফেরানো জন্যে কোন ঔষধ খুঁজতে চাইছে। ছবিটার কথা নাহয় পরেই ভাববে, আপাতত: বোনকে সাহায্য করা দরকার, ছবির উপর থেকে নেমে বোনের পেছনে পেছনে যেতে চাইল গ্রেগর। কিন্তু তার শরীরের আঠায় কাঁচে আটকে আছে তার শরীর। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে পাশের ঘরে ছুটলো সে, বোনকে কোন পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে, যেভাবে এ ধরণের পরিস্থিতিতে সে চিরদিনই করে এসেছে। বোন তখন অজস্র শিশি বোতলের মাঝে দরকারী শিশিটি খোঁজায় ব্যাস্ত। ঠিক তারই পেছনে হতবাক হয়ে দাঁড়ানো গ্রেগর। পেছনে ঘুরেই হঠাৎ তাকে দেখতে পেয়ে ভীষন ভয় পেলো বোন। হাত থেকে একটি বোতল মাটিতে পড়ে চুরমার হয়ে গেল। ভাঙ্গা কাঁচের একটি টুকরো গ্রেগরের মুখে লোগে সেখানে ক্ষত তৈরী করলো। ছিটকে এক দুর্গন্ধজনক তরল পদার্থ ছড়ালো তার শরীরে। কিন্তু গ্রেটে থামলো না। যে ক্থটি বোতল হাতে নেয়া যায় নিয়ে ছুটলো পাশের ঘরে মায়ের কাছে, মাঝের দরজাটি পায়ের ধাক্কায় বন্ধ করে দিল। গ্রেগরের এখন আর মায়ের কাছাকাছি হবার কোন উপায় নেই, তারই দোষে মা এখন হয়তো মৃত্যুমুখে। দরজা খুলে ওঘরে ঢুকে বোনকে তাড়াতে চাইল না সে। অপেক্ষায় থেকে থেকে, নিজের প্রতি দোষ আর ধিক্কারের গ্লানিতে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো গ্রেগর। ভেতরের অদম্য অস্থিরতায় ঘরের দেয়াল, আসবাবপত্র, উপরের ছাদ সবখানে দৌড়ে বেড়ালো। একসময় ঘরের চারপাশই যেন তার চোখের সামনে ঘুরতে শুরু করলো। তারপরই ঘরের বড় টেবিলের উপর স্থির হয়ে বসে পড়লো সে।
অসমাপ্ত ....

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


