ঘটনা : ১
ক্লাস ওয়ান। নতুন স্কুল। নতুন ইউনিফর্ম। নতুন নতুন বই-খাতা। নতুন টিচার, নতুন বন্ধু। নতুন এক অনুভূতি!
কয়েকদিন স্কুলে যেয়েই ভক্ত হয়ে গেলাম স্কুলের। সপ্তাহের যেদিনটা সবচেয়ে বিরক্ত লাগতো তা হল শুক্রবার। কারনটা সোজা, স্কুল বন্ধ থাকে শুক্রবার!
স্কুলে বেশি লাগতো অবশ্যই টিফিন টাইম। আর সবচেয়ে ভাল লাগতো শ্রেণী আর বাড়ির কাজের খাতায় টিচারের লিখে দেওয়া ভেরি গুড!
কিন্তু কয়েকদিন পর স্কুলে যেতেই ভয় লাগতো, বিশেষ করে অংকের ক্লাসে।
একদিন খালি ঘর পূরণ কর অংকের বাড়ির কাজ দিলেন স্যার। বাড়ির কাজ আমরা করেও নিয়ে আসলাম। কিন্তু সমস্যা হল স্যারের নিয়মের সাথে আমাদের কারো নিয়মই মেলেনি। তাই প্রত্যেকর বাহুতে জুটলো দুটি করে বেতের বাড়ি। অনেক বন্ধুকে কাঁদতে দেখলাম। আমি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম। কারন সবার সামনে এভাবে কাঁদতে লজ্জা লাগতো!
বাসায় ফিরতেই আন্টি দেখলেন আমার বাহু ফুলে গেছে। লাল দাগ হয়ে আছে। রাতে বাবা-মা অফিস থেকে এসে সব শুনলেন। আমাদের বিল্ডিং এর তিন তলাতেই আমার ক্লাসের এক বন্ধু থাকতো নাম শিশির। বাবা আমাকে নিয়ে শিশিরদের বাসায় গেলেন। মার খেয়ে শিশিরের জ্বর এসেছে।
আঙ্কেল আর বাবা মিলে ঠিক করলেন এটা স্কুলে জানানো দরকার। ছাত্ররা ভুল করলে শিক্ষক ভুল শুধরে দেবেন। কিন্তু এভাবে মার দেওয়াটা মানতে পারলেননা।
রাতে আমারও জ্বর আসলো। সকালে কমে আসলো বলেই যেতে পারলাম স্কুলে। বাবার সাথেই গেলাম। আমাদের সাথে শিশিরের বাবাও গেলেন।
ক্লাসে আসলাম। সব বন্ধুরা ভয়ে আছে। অনেকের বাসা থেকেই স্যারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে।
স্যার আসলেন। এসে আমাদের কয়েকজনের নাম বলে দাড়াতে বললেন। আমরা দাঁড়ালাম।
এরপরে যা করলেন তা আমাদের ধারণাতেও ছিলনা। কালকে যার যেখানে মেরেছিলেন, আজকে সেখানেই আবার মারলেন বেত দিয়ে এবং শাসিয়ে গেলেন আর যদি কেউ বাসায় স্যারের নামে অভিযোগ করি তাহলে আবার মারবেন।
কালকের থেকেও বেশি হাতে ব্যাথা নিয়ে বাসায় ফিরলাম। বাবা জানতে চাইলেন, আজকে স্যার কি বলেছেন?
চোখের সামনে স্যারের শাসানো ভেসে উঠলো। বললাম, আজেকে স্যার আর কিছু বলেননি। কাউকে কোন শাস্তিও দেননি।
এই ঘটনার পরে জীবনে কখনোই শিক্ষকের দেওয়া কোন শাস্তির কথা বাসায় জানানোর সাহস আমার হয়নি।
ঘটনা : ২
ক্লাস ফোরে নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। নতুন নতুন বন্ধু পেয়েছি। স্কুল্টাও অনেক সুন্দর। বিশাল খেলার মাঠ। তাছাড়া সরকারি স্কুল বলে টিফিন দেবার একটা ব্যাবস্থা ছিল!
আমাদের ইংরেজি ম্যাম অনেক ভালবাসতেন আমাদের। অনেক আদর করতেন। কিন্তু সে আদর বেশিদিন সইলো না আমাদের। অন্য স্কুলে ম্যামের বদলি হয়ে গেছে।
নতুন ম্যাম আসলেন ক্লাস নিতে। স্কুলে নতুন না কিন্তু আমাদের জন্য নতুন। ইংরেজি ট্রান্সলেশন পড়া দিলেন এবং বলেও দিলেন আগামিকাল পড়া ধরবেন। পড়া যে পারবেনা তাকে শাস্তি দেওয়া হবে।
রাতেই পড়ে ফেললাম ম্যামের পড়া। সকালে উঠে আবার ঝালাই করে তারপর গেলাম স্কুলে।
ম্যাম আসলেন। রোল অনুযায়ী ৪ জন করে ডাকলেন। বোর্ডে লিখতে হবে। যে যে পারলনা তাদের মাথায় বেত দিয়ে বাড়ি দিলেন।
সবাই তো ভয়েই অস্থির। একে বেত দিয়ে মারে, তাও আবার মাথায়!
এভাবেই চলতে থাকলো। চারজন করে যাচ্ছে, বোর্ডে লিখছে, ভুল করছে, মাথায় বাড়ি খেয়ে ফিরে আসছে।
সময় মতো আমারও ডাক পড়লো। গেলাম বোর্ডের কাছে। ম্যাম ট্রান্সলেশন দিলে করেও ফেললাম। সব ঠিক থাকলেও একটা জায়গায় ভুল করে ফেললাম। সেন্টেন্সের শেষে ফুল স্টপ দিতে ভুলে গেছি।
মাথায় বেতের বাড়ি খেয়ে ফিরে আসলাম।
ঘটনা : ৩
ক্লাস ফোরের বলাল মত আরেকজন টিচার ছিলেন। তিনি হচ্ছেন আমিনুল্লাহ স্যার। অনেক ভাল পড়াতেন। কিন্তু আমরা স্যারকে ভয়ও পেতাম খুব। এখানেও কারনটা সহজেই অনুমেয়। কারনটা হচ্ছে স্যারের শাস্তি এবং শাস্তি দেবার ধরন।
স্যার ক্লাসে এসে শুরুতেই ক্যাপ্টেনদের বাড়ির কাজের খাতা উঠাতে বলতেন। তারপর বলতেন যারা যারা বাড়ির কাজের খাতা জমা দেয়নি তাদের দাড়িয়ে থাকতে। দাঁড়ানোদের মধ্যে থেকে স্যার একজন একজন করে ডাকতেন। কথা বলতেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ ঠাস করে গালে থাপ্পড় লাগাতেন। থাপ্পড় খাওয়া হলে আসামি ফিরে আসতো। নতুন আসামি যেতো। থাপ্পড় খেয়ে ফিরে আসতো।
এভাবেই চলতে লাগলো। আমি বাড়ির কাজ কখনোই না করে স্কুলে আসতামনা। তাই আমাকে মার খেতেও হতোনা। কিন্তু একদিন আমার দিন আসলো।
বাড়ির কাজ করলেও স্কুলে আনতে ভুলে গেছি।
প্রতিদিনের মতো স্যার আসলেন। বাড়ির কাজ জমা না দেওয়া ছাত্রদের দাঁড়াতে বললেন। এরপর একজন একজন করে ডাকতে লাগলেন।আমার ডাক আসলো। স্যারের কাছে গেলাম।
‘বাড়ির কাজ করিসনি কেন?’
‘স্যার, করেছি। কিন্তু আনতে ভুলে গেছি।’
‘সকালে নাস্তা করেছিস?’
‘জী স্যার করেছি।’
‘কি দিয়ে?’
‘ডিম আর রুটি।’
ভাবলাম আমিতো প্রতিদিন বাড়ির কাজ করি। তাই স্যার আমাকে মারবেননা। মনে মনে সাহস আনলাম।
‘তা তোর গ্রামের বাড়ি কোথায়?’
‘স্যার, খুলনায়।’
হঠাৎ ঠাস করে আমার গালে স্যার থাপ্পড় দিলেন। কতক্ষন যে চোখে অন্ধকার দেখলাম বলতে পারবোনা। শব্দও শুনতে পারছিলামনা। ভেবেছিলাম কানের পর্দা মনেহয় ফেটে গেছে। কিন্তু কপাল ভাল আমার। একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যায়।
এরপর আর অন্য খাতা আনতে ভুল করলেও বাড়ির কাজের খাতা আনতে ভুলতামনা। ভালোই চলছিল। কিন্তু আবার একদিন ভুলে গেলাম খাতা আনতে! এখন? আবার মার খেতে হবে আমাকে!
স্যার এসে বরাবরের মতো আসামিদের দাড় করালেন। একে একে যায়। মার খেয়ে ফিরে আসে।
বন্ধুদেরকে এভাবে মার খেতে দেখতে খারাপ লাগছিল। কিন্তু এক্তুপরে আমাকেও এভাবে মার খেয়ে ফিরতে হবে।
কিছু একটা করা দরকার।
আমার ডাক আসলো। গেলাম স্যারের কাছে।
‘কেমন আছিস?’
‘ভাল না স্যার।’
‘চিন্তা নেই। তোর ভাল লাগার ব্যাবস্থা করছি।
তা ভাল নেই কেন?’
‘সকালে নাস্তা করে আসতে পারিনি স্যার।’
‘কেন?’
‘মা ঘুম থেকে উঠতে দেরি করে ফেলেছেন। নাস্তা তৈরি করতে পারেননি। অফিসে চলে গেছেন। তাই আজকে নাস্তা করা হয়নি স্যার।’
‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’
‘আপু আছে। কিন্তু ও স্কুলে গেছে।’
‘আর তোর বাবা?’
‘বাবা অফিসের কাজে দেশের বাইরে স্যার।’
‘তোর মা অফিস থেকে আসবেন কখন?’
‘স্যার ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা তো বাজবেই।’
‘তাহলে দুপুরে কি খাবি?’
‘আজকে মনেহয়না দুপুরে খাওয়া হবে স্যার। কিন্তু আপু কিছু না কিছু নিয়ে আসবে আমার জন্য। ওর স্কুলের টিফিন ও না খেয়ে আমার জন্য নিয়ে আসে।’
‘কেন?’
‘ওর টিফিন খেতে ভাল লাগেনা স্যার।’
আমার কথায় স্যার অনেক অবাক হলেন। ব্যাথিতও হলেন।
‘বাড়ির কাজ করিসনি কেন?’
‘কলমের কালি শেষ স্যার।’
‘তো? একটা কলম কিনে নিলেই পারতি।’
‘আমার কাছে টাকা থাকেনা স্যার। আর বাসার কাছে কোন দোকানও নেই। মা যখন আসেন তখন আর দোকানে যাওয়াও সম্ভব হয়না স্যার।’
‘তুই যা। আর কাল থেকে যেন বাড়ির কাজ মিস হয়না।’
মার না খেয়েই ফিরে আসতে পেরেছিলাম সেদিন। এরপর আর কখনো ভুল করিনি স্যারের বাড়ির কাজ করে আনতে।
ঘটনা : ৪
ক্লাস নাইন। ধর্ম ক্লাস নেন আব্দুল মান্নান স্যার। আমাদের স্কুলে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্ম ক্লাস হতো। হিন্দু ধর্ম হতোনা। সিলেবাস দেওয়া থাকতো। সময় আসলে শুধু পরিক্ষাই দিতে হতো ছাত্রদের।
আব্দুল মান্নান স্যার ছিলেন চরম মাত্রায় হিন্দু বিরোধী। রবীন্দ্রনাথ বিরোধীতাও করতেন। ধর্ম ক্লাসে হিন্দু ছেলেদের পিছনের বেঞ্চে একসাথে বসতে বলতেন। চুপ করে বসে থাকতো ওরা। কথা বললেই মাইর।
একদিন স্যার বোর্ডে লিখলেন, ‘ভগবান’।
‘আজকে আমি তোমাদের শিখাইবো হিন্দুরা এতো খারাপ কেন? কেন ওরা আজকে ইসলামের শত্রুতে পরিণত হয়েছে।
এই সব কিছুর মুলে হইতেসে এই ‘ভগবান’।
কোন কিছুর অতীত না জানিয়া তোমরা কখনোই তার সম্পর্কে ভাল ধারণা পাইতে পারবানা। তাই আজকে তোমাদের আমি শিখাইবো ‘ভগবান’ শব্দের মানে কি।
‘ভগবান’ এর শব্দ থেকে যদি ‘ভ’ কেটে দাও তাহলে থাকে ‘গবান’।
তোমরা কেউ কি এই ‘গবান’ শব্দের মানে জানো? এর মানে হইতেসে গবেট। হিন্দুরা হইতেসে গবেট তাই তারা শান্তির ধর্ম ইসলাম কবুল না করিয়া মূর্তি পূজা করে। এদেরকে আমরা গবেট না বলিয়া আর কি বলিতে পারি?
এবার যদি আমরা ‘গবান’ থেকে ‘গ’ অক্ষরটি সরিয়ে ফেলি তাহলে থাকে ‘বান’। এটা হচ্ছে সেই বাণ যে বাণ তোমাদের বুকে বিঁধে তোমাদের রক্তাক্ত করবে। হিন্দুরা হচ্ছে তোমাদের জন্য একেকটি বাণ।
এবার যদি আমরা ‘বান’ এর থেকে ‘বা’ কেটে নেই তাহলে থাকে ‘ন’। ‘ন’ মানে নাথিং। কিছু নেই।
হিন্দু ধর্ম বলে কিছু নেই। হিন্দুদের ভগবান নেই’।
স্যারের ক্লাস শেষে আমরা হিন্দু-মুসলমান বন্ধুরা একে অন্যের সাথে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। স্যার কি সব বলে গেলেন। আমরা অনেকে বললাম, স্যারের এসব বলা ঠিক হয়নি আবার কেউ কেউ বলল, স্যার যা বলেছেন একদম ঠিক বলেছেন। হিন্দুদের সাথে মেলামেশা করা ঠিক না।
যাই হোক। অনেকদিন কেটে গেল স্যারের এই লেকচারের পর।
একদিন আমার এক হিন্দু বন্ধুর ধর্ম খাতা দেখার জন্য আমি নিলাম। পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে একটা জায়গায় একটা লেখা আমার চোখ আটকে দিল।
খোদা।
খোদা শব্দ থেকে যদি ‘এ কার’ বাদ দেই তাহলে থাকে ‘খাদা’। ‘খাদা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে খাদ। ইসলাম হচ্ছে এমন একটি খাদ যে খাদ আমাদের গিলে খাবে।
এবার যদি ‘খাদা’ থেকে ‘খ’ কেটে নেই তাহলে থাকে ‘আদা’ যার অর্থ হচ্ছে আদতে বা শুরুতে। অর্থাৎ ইসলাম হচ্ছে সব ধ্বংসের শুরু।
এরপর যদি ‘আদা’ থেকে ‘আ’ অক্ষরটি আমরা সরিয়ে ফেলি তবে থাকে ‘দ’। ‘দ’ হচ্ছে দৈত্য, ‘দ’ হচ্ছে দানব।
ঘটনা : ৫
স্কুলে আমাদের এক বাংলা ম্যাম ছিলেন। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন পর্যন্ত আমাদের ক্লাস নিয়েছেন তিনি।
ক্লাস নিয়েছেন আসলে নামেই। ক্লাসে ঢুকেই প্রতিদিন তিনি একটা কথা বলতেন। আর তা হচ্ছে,
‘আজকে আমি অনেক অসুস্থ। তারপরেও তোমাদের কথা ভেবেই আমাকে ক্লাসে আসতে হয়েছে। আমি না আসলে এতগুলো ছেলে সমস্যায় পরবে একজন শিক্ষক হিসেবে এটা ভাবতেই আমার খারাপ লাগছে বলেই আসলাম। যাইহোক তোমরা চুপচাপ যে যার কাজ কর। আমি বিশ্রাম নিবো। কথাও বলতে পারো কিন্তু আস্তে। পাশেই ক্লাস হচ্ছে। তাই কোন শব্দ যেন ক্লাসের বাইরে না যায়।’
ম্যাম মাঝে মাঝে হাতের লেখা লিখতে দিয়ে বিশ্রাম নিতেন। কখনোবা আমাদের রিডিং পড়তে দিয়ে বিশ্রাম নিতেন। কিন্তু পরীক্ষার আগে আগে ম্যাম একটা ‘উপকার’ আমাদের করতেন। তা হচ্ছে সাজেশন দেওয়া।
ক্লাস সিক্স থেকে টেন পর্যন্ত এভাবেই ম্যাম আমাদের ক্লাস নিয়েছেন।
স্কুল ছেড়েছি আজকে প্রায় ৭ বছর হয়ে গেছে। জানিনা ম্যাম এখনো সুস্থ হয়েছেন কিনা। আশাকরি তার অসুস্থতার জন্য আমার ছোট ভাইদের ভুগতে হচ্ছেনা আমার মতো।
বিঃদ্রঃ স্কুল লাইফের দীর্ঘ একটা সময়ে এমন বা এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা একেবারে কম ছিলোনা। কিন্তু আমার ‘জীবন থেকে নেওয়া’ সিরিজে কোন বিষয়ের ৫টি ঘটনাই আমি তুলে ধরবো ঠিক করেছি। তাই বেছে বেছে এই ৫ টি ঘটনাই আজকে তুলে ধরলাম। অন্য ঘটনা গুলো হয়তো ভবিষ্যতে লেখার সুযোগ হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


