ঘটনা ১:
দুপুরের কড়া রোদ। গায়ের চামড়া যেন পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরেও অনিক হাঁটছে। হেটে হেটেই বাসায় ফিরছে। একটু হাঁটলেই যে ২০টা টাকা বেঁচে যাবে অনিকের। টিউশুনি করে যে টাকা পায় তাতে চলে যায় কোনরকমে। এখন আর বাবার কাছে হাত পাততে ইচ্ছা করেনা।
রাস্তায় গাড়ি ঘোড়াও বেশ কম। এই সময়ে ব্যাস্ততা আসলে অফিস গুলোতে, রাস্তায় নয়।
বাসার বেশ কাছেই চলে এসেছে অনিক। ছোট থেকেই এই এলাকায় বড় হয়েছে। সব কিছুই খুব ভালো মতো চেনা তার। এলাকাতেই সে বেশ পরিচিত স্থানীয় ছেলে বলে।
সামনের মোড়ের দোকানে সিগারেট ফুকছে সিরাজ ভাইরা। সিরাজ ভাই ছোট ভাইয়ের মতো দেখেন অনিককে। বলেও দিয়েছেন কোন সমস্যা হলেই যেন অনিক তাকে জানায়।
পা চালায় অনিক।
সামনে এক ছেলে দাড়িয়ে আছে। সিরাজ ভাইরা যে দোকানে বসে আছে ঠিক তার কয়েক পা আগে। খুব অস্থির দেখাচ্ছে। এক হাতে সিগারেট। অন্য হাত পকেটে ঢুকানো।
পিছন থেকে এক রিকশা আসছে। বেল দিতেই এক পাশে সরে সাইড দেয় অনিক। রিকশা তাকে পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে।
হঠাৎ সামনে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটি হাতের ইশারায় রিকশাকে থামতে বলে।
দাড়িয়ে যায় অনিক।
ছেলেটি রিকশার কাছে এগিয়ে যায়। রিকশায় একটি মেয়ে। বয়স অনিকের মতোই হবে।
ছেলেটা কি যেন বলছে মেয়েটিকে। মেয়েটাকে বেশ ভীত মনে হচ্ছে। চোখে মুখে রাজ্যের ভয়।
ওদের কথা অনিকের কানে আসছেনা। তবুও সে দাড়িয়ে থাকে।
ছেলেটি পকেটের থেকে হাত টা একটু বের করে মেয়েকে দেখায়। অনিক দেখতে পায়, ছেলেটার হাতে পিস্তল।
মেয়েটা তার পার্স দিয়ে দেয়। পার্স থেকে মোবাইল আর একটা ছোট ব্যাগ বের করে নিয়ে চলে যায় ছেলেটি। যাওয়ার সময় রাস্তায় ছুড়ে ফেলে পার্স।
মেয়েটা রিকশা থেকে নামে পার্সটা তুলে নেবার জন্য। পার্স তুলেই লক্ষ্য করে একটু পিছনেই একটি ছেলে দাড়িয়ে আছে। মেয়েটা অসহায়ভাবে অনিকের দিকে তাকায়।
অনিক দেখেও না দেখার ভান করে সামনে পা চালায়।
সে কি কিছু করতে পারতোনা? কিন্তু কেন করবে?
সে কিছু দেখবেনা, কিছু করবেনা, কিছু বলবেনা।
ঘটনা ২:
রামপুরা ব্রিজে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে অভি। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়ালেও বাসের দেখা নেই। দুই একটা যা আসছে তাতে উঠার জায়গা নেই। কিভাবে আজকে ভার্সিটি যাবে কে জানে!
পিয়াসটাও আসছেনা। পিয়াস আসলে একসাথে যাবার কথা। পকেট থেকে মোবাইল বের করে অভি।
‘হ্যা, পিয়াস। কই তুই? কি চলে এসেছিস? কই দেখছি নাতো। ওহ, হ্যা হ্যা দেখতে পেয়েছি। চলে আয়।’
পিয়াস কে দেখতে পায় সে। রিকশায় আসছে। পিয়াস তার ছোটবেলার বন্ধু। কিন্তু অভি যেখানে এতো হাটে, পিয়াস হাটতেই চায়না। দুনিয়ার অলস!
এক বুড়ো চাচার রিকশায় আসছে পিয়াস। বয়স কম করে হলেও ৬০ তো হবেই। এদের দেখলে খুব খারাপ লাগে অভির।
পিয়াসের রিকশা চলে আসে। অভি এগিয়ে যায়
১০ টাকার একটি নোট রিকশাওয়ালারকে ধরিয়ে দেয় পিয়াস।
‘ভাড়া তো ১৫ টাকা মামা।’
’১৫ টাকা? কোন দুনিয়ায়? ১০ টাকা ভাড়া।’
‘না মামা, ভাড়া ১৫ টাকা। আর ৫ টাকা দেন।’
ঠাস করে এক থাপ্পড় বুড়ো চাচার গালে লাগিয়ে দেয় পিয়াস।
থাপ্পড় খাওয়া গালে হাত দিয়ে দাড়িয়ে আছে বুড়ো চাচা।
‘চলতো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
অভির হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় পিয়াস। অভিও চলে যায় পিয়াসের সাথে।
সে কি কিছু করতে পারতোনা? কিন্তু কেন করবে?
সে কিছু দেখবেনা, কিছু করবেনা, কিছু বলবেনা।
ঘটনা ৩:
টুটুল রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। নিউমার্কেট থেকে বাসায় ফিরবে। নিউমার্কেটে এসেছিল একটা শার্ট কিনতে।
অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে রিকশার জন্য। রিকশা যে নেই এমন নয়। কিন্তু যে ভাড়া চাচ্ছে তাতে ওর পোষাচ্ছে না।
হঠাৎ খেয়াল করলো ওর পাশেই একটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে। অসম্ভব সুন্দরী । মেয়েটার দিকে একটু পরপর তাকাচ্ছে টুটুলের। মেয়েটাও বুঝতে পারছে পাশেই দাড়িয়ে থাকা ছেলেটা বার বার তাকাচ্ছে তার দিকে।
কি মনে করে সামনে হাটে মেয়েটি। টুটুলও মেয়েটার পিছন পিছন কিছুদুর যায়। আবার কি ভেবে থেমে যায়। মেয়েটা আরেকটু সামনে যেয়ে দাড়ায়।
টুটল দূর থেকেই মেয়েটার দিকে তাকায়। তাকাতে চাইছেনা কিন্তু কেন জানি বারবার চোখ চলে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে।
হঠাৎ দুইটা ছেলে মেয়েটার কাছে যায়। দুজনই স্কুল পড়ুয়া। স্কুলের ইউনিফর্ম পড়া। মেয়েটার গায়ে হাত দেয় ওরা। তারপর হাসতে হাসতে চলে যায়। মেয়েটা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে। লজ্জায় যেন মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।
মেয়েটা টুটলের দিকে তাকায়। টুটুল চোখ সরিয়ে নেয়।
সে কি কিছু করতে পারতোনা? কিন্তু কেন করবে?
সে কিছু দেখবেনা, কিছু করবেনা, কিছু বলবেনা।
ঘটনা ৪:
সামি ছোট বোনকে পড়াচ্ছে। ওর ছোট বোনের নাম অমি, ক্লাস টুতে পরে। সামি আর অমি দুই ভাই বোন ওরা। সামি পড়ছে ইন্টার মিডিয়েটে।
নিজের পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই অমিকে নিয়ে বসে সে। আর বসবেনা কেন? বাবা-মা দুইজনই চাকুরী করেন। সেই সকালে বাসা থেকে বের হন আর ফেরেন সন্ধ্যার পর। অমিকে স্কুলে দিয়ে কলেজে যায় সামি। আর কলেজ শেষে অমিকে স্কুল থেকে বাসায় নিয়ে আসে। তাই বলতে গেলে অমি আর সামি দুপুরের পর থেকে বাসায় থাকে শুধু। অবশ্য এক কাজের মেয়েও থাকে সামিদের সাথে। নাম সুলতানা, ১০ বছর বয়স। সুলতানার বাবা-মা কেউ নেই।
সুলতানা প্রায় এক বছর ধরে কাজ করছে সামিদের বাসায়। সুলতানার মামা রেখে গিয়েছিলেন। কিন্তু সেই যে রেখে গেলেন এরপর একদিন খোঁজও নিতে আসেননি।
সামির মা সুলতানাকে দিয়ে তেমন একটা কাজ করাননা। শুধু ঘর ঝাড়ু দেওয়া, বাসন মাজা, আসবাবপত্র মোছা আর কাপড় কাচা। রান্নার কাজ সামির মা নিজেই করেন।
অমিকে নিয়ে বসেছে সামি। পড়াশুনায় একেবারেই মন নেই মেয়েটার। সেই কখন স্কুলের কাজ নিয়ে বসেছে, এখনো শেষ হয়নি।
‘অমি, এবার কিন্তু আমি মারবো।’
অমি কিছু বলেনা। আবার লিখতে মনোযোগী হয় সে।
সুলতানা এসে অমির টেবিলের পাশে দাড়ায়। অমির লেখা দেখে।
অমি সুলতানার দিকে তাকায়। আবার মনোযোগী হয় লেখায়।
‘সুলতানা, কাজ নেই তোর? এখানে দাড়িয়ে কি দেখছিস?’
সুলতানা মাথা নিচু করে দাড়ায়।
‘ভাইয়া, ওকে কিছু বলোনা। জানো সুলতানা আমার থেকেও দ্রুত কবিতা মুখস্থ করে ফেলতে পারে। পড়তেও হয়না! শুনে শুনেই মুখস্থ করে ফেলে!’
সামি অমির দিকে তাকায়। অমি ভয় পেয়ে যায়। আবার লেখায় মনোযোগী হয় সে।
সামি সুলতানার দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে চলে যায় সুলতানা।
সামি বুঝতে পারে সুলতানার পড়ালেখার প্রতি আগ্রহ রয়েছে। নিজের কাজে মন দেয় সামি।
সে কি কিছু করতে পারতোনা? কিন্তু কেন করবে?
সে কিছু দেখবেনা, কিছু করবেনা, কিছু বলবেনা।
ঘটনা ৫:
ফারদিন পড়ছে। সামনেই এ লেভেল এক্সাম। মাঝে এতো বেশি ফাকিবাজি করেছে যে যথেষ্ট টেনশনে পড়েছে সে।
ওর অন্য সব বন্ধুর অবস্থা এতটা খারাপ নয়। রাওয়ান, সাঁজ, অনন্যা যথেষ্টই সিরিয়াস ছিল, এদের অবস্থাও বেশ ভালো। বন্ধুদের মধ্যে এক নাসিরের অবস্থাই খারাপ।
নাসির ছিল দুর্দান্ত মেধাবী এক ছেলে। লেখাপড়া, ক্রিকেট, কুইজ, আর্ট সব কিছুতেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো নাসির।
গত বছর ক্লাব ফাইনালে বলতে গেলে একাই ম্যাচ জিতিয়েছিল নাসির। নিশ্চিত হারা ম্যাচে প্রতিপক্ষকে যেভাবে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করলো তা এখনো ফারদিনের চোখের সামনে ভাসে।
কলিং বেলের শব্দ শুনতে পায় ফারদিন। কেউ এসেছে ওদের বাসায়। পড়ায় মন দিতে চেষ্টা করে সে।
হঠাৎ ওর রুমের দরজা খুলে যায়।
ফারদিন দরজার দিকে তাকায়। নাসির এসেছে।
লাল টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে আছে নাসির। উষ্কো খুষ্কো চুল, দেখলে বোঝা যায় মাথায় চিরুনির আঁচর পড়েনি অনেকদিন।
ফারদিন কিছু বলেনা। ড্রয়ার থেকে হাজার টাকার কয়েকটা নোট নাসিরের হাতে দিয়ে দেয়।
‘দোস্ত, খুব তাড়াতাড়ি তোর সব টাকা দিয়ে দেবো।’
‘আচ্ছা।’
না তাকিয়েই উত্তর দেয় ফারদিন। নাসির চলে যায় টাকা নিয়ে।
টাকা দিয়ে নাসির কি করবে ফারদিন জানে। খুব ভালমতোই জানে।
অর্থী চলে যাবার পর থেকেই ড্রাগ নেওয়া শুরু করে নাসির। তারপর থেকেই ওর এই অবস্থা।
ফারদিন বারান্দায় এসে দাড়ায়। দেখতে পায় নাসির চলে যাচ্ছে তাড়াহুড়ো করে।
সে কি কিছু করতে পারতোনা? কিন্তু কেন করবে?
সে কিছু দেখবেনা, কিছু করবেনা, কিছু বলবেনা।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


