somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অন্ধ ডায়ের

১৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ দুপুর ২:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


একবার এক অন্ধের বাড়ি কাটানো জীবনের শ্রেষ্ঠ রাতটার কথা আজো ভুলতে পারিনি, আর কোনদিন পারবো বলেও মনে হয় না। কোন অন্ধের বাড়ি রাত কাটিয়ে তার আহামরি কোন খাতির আপ্যায়নে প্রীত হয়ে এ কথা বলছি তা কিন্তু নয়, বরং তার পিছনে প্রীত হবার মত বিশেষ একটি কারণও ছিল।

হঠাৎ হঠাৎ মানুষ তার জীবনের বিশেষ কোন সময়ে একাকী নিভৃতে এ ধরনের প্রীত প্রীত ঘটনা গুলো স্বরন করে মজা পায়, আমিও পাচ্ছি। শুধু মজাই পাচ্ছিনা বরং তা নিজের ডায়েরীতে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে লিপিবদ্ধ করারও চেষ্টা করছি। কেননা ইহা একটি লিপিবদ্ধ করবার মতই ঘটনা ছিল আমার জীবনে। এক কাপ গরম কফিতে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছি আর এক লাইন দুই লাইন করে লিখে চলেছি। মূলত সেই অন্ধের কাছ থেকে পাওয়া বিশেষ কিছু শিক্ষা বা তথ্য আমাকে চমৎকার ভাবে চমৎকৃত করেছিল।

সেদিন ছিল বৈশাখ মাসের শেষ দিন। সারা মাসের অকল্পনীয় তান্ডব শেষে বৈশাখ তার ব্রম্মাস্ত্র নিয়ে হাজির হয়েছিল যেন। চারিদিকে কালো কুচকুচে ঘন মেঘে রাত্রি সমতুল্য হয়ে উঠেছিল পরিবেশ। মাঝে মাজেই গুড়গুড় করে গর্জে ওঠা মেঘের পিছনের দানবটার গুরুগম্ভীর হুংকারে কেঁপে কেঁপে উঠছিলো ধরনী, তার সাথে সাথে কাঁপছিলাম আমি। এই বুঝি প্রকৃতি তার সর্বচ্চো হিংস্র রূপ নিয়ে ঝাপিয়ে পরবে ধরীত্রীর বুকে আর লন্ডভন্ড করে দিয়ে তবেই থামবে সে, নতুবা নয়। কোন কুলক্ষনে যে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম আজ, তা ভাবতেই প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল নিজের উপর।

মাগুরা বাস স্ট্যান্ডে এসে গাড়ি থামলো। আমি তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নামতেই কন্টাক্টর সাহেব বাধ সাধল -
“কি মামা, ভাড়া না দিয়া যাইতাছেন গা কই?”
ইসস দেখ কান্ড! ঝড়ের ভয়ে ভাড়া দেবার কথা ভুলেই গেছি! দোষটা আমারই, আমার কাছে ভাড়া চাইতে আসলে আমিই বলেছিলাম একটু পরে নিতে। তাড়াহুড়ো করে মানিব্যাগ বের করলাম, কিন্তু পকেট হাতরে মানিব্যাগ হাতরে কোথাও কোন খুচরা টাকা না পেয়ে এক হাজার টাকার নোট বের করে দিতেই খেঁকিয়ে উঠল কন্টাক্টর সাহেব -
“মিয়া মশকরা করেন?”
“জী, না। মশকরা করি না। আকাশে মেঘ করেছে, যখন তখন ঝড় নামবে ভাই সুতরাং এই মূহুর্থে মশকরা করার মত সময় আমার হাতে নেই।”
“মিয়া, ৩৫ টেকা ভাড়া নিবার লাগি আপনের হাজার টেকার নোট ভাঙ্গানি লাগবে? এইডে মশকরা নাতি আর কি?”
চোখমুখ খিঁচিয়ে বলল কন্টাক্টর সাহেব। আমি কিছু একটা বলতে যাব এমন সময় -
“ওনার ভাড়া আমি দিচ্ছি”
পিছন থেকে ৬০-৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ বলে উঠলো। একটা লাঠিতে ভর দিয়ে অন্য হাত শূন্যে হাতরে হাতরে বাসের দরজার কাছে আসতে দেখে বুঝলাম উনি অন্ধ। লোকটা পকেট থেকে টাকা বের করে কন্টাক্টরের হাতে দিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলে তাকে বাস থেকে নামতে সাহায্য করলাম আমি। যদিও অন্ধদের কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয়না। অন্ধরা দিব্যি সব কাজ করে নিজে একা এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায় কারো সাহায্য ছাড়াই। আল্লাহ্‌ তাদের দ্বিতীয় দৃষ্টি কেড়ে নিয়ে তৃতীয় দৃষ্টি নামক কিছু দিয়েছেন কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল এবং এখনো আছে। বাস টা চলে গেলে অন্ধের হাত ধরে আস্তে আস্তে রাস্তা পার হয়ে একটা টেম্পু স্ট্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম। যেতে যেতে খুনখুনে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বৃদ্ধ আমাকে বলল-
“আচ্ছা, তুমি কোথায় যাবে বাবা?”
“এইতো শ্রীনগর, ছোট কাকার বাড়ি”
“ও আচ্ছা। আকাশের যে অবস্থা তাতে …”
কি যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল বৃদ্ধ। আকাশের দিকে ভীত চোখে তাকিয়ে দেখলাম তার ভয়ংকর রূপ ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করছে। ভয়াবহ অবস্থা। তার সাথে বয়ে চলেছে হিম শীতল ঠান্ডা বাতাস। আমি বললাম -
“থামলেন যে? কি যেন বলতে চাইলেন?”
বৃদ্ধ একটু ইতস্তত করে অপ্রিয় অনুরোধের সুরে বলল -
“না, আসলে বলতে চাচ্ছিলাম, আমাকে একটু আমার বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারো বাবা?”
সত্যি কথা বলতে একজন অসহায় অন্ধ মানুষ যেকিনা নির্দ্বিধায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল আমার প্রতি, তাকে দুর্যোগের এই সন্ধ্যায় কাল বৈশাখীর হাতে একাকী ছাড়তে মন সায় দিলনা আমারও। আমি বললাম -
“জী তা তো পারি, কিন্তু ঝড় তুফান শুরু হয়ে গেলে আপনার বাড়ি আশ্রয় মিলবে তো?”
যেন ভিষণ মজার কিছু বলে ফেলেছি এমন ভঙ্গিতে বৃদ্ধ হো হো করে হেসে উঠল! এবং আমার হাতটা শক্ত করে ধরে হাঁটতে হাঁটতেই বলল-
“তোমাকে তুমি করে বলায় আবার রাগ করনি তো?”
“ছি ছি, রাগ করবো কেন! আপনি আমার পিতৃতূল্য”

বলে একটা টেম্পুতে উঠে পাশাপাশি বসে পরলাম আমরা দুজন । একহাতে লাঠি আর অন্য হাত দিয়ে শক্ত করে আমার হাতটা ধরে রেখেছেন বৃদ্ধ। যেন দুই হাতে দুই লাঠি।

এমন সময় আকাশ ভেঙা একটা বজ্রপাতের শব্দে চমকে উঠল টেম্পুর যাত্রীগন। যদিও একটা টেম্পুর দুই দিকে ছয় ছয় বারো জন যাত্রী পুর্ন না হওয়া পর্যন্ত গাড়ী স্টার্ট দিতে চায়না কোন টেম্পু ড্রাইভার! তবুও বজ্রপাতের শব্দে বেচারি এক প্রকার ভয়েই দ্রুত গতিতে গাড়ির ইন্জিন চালু করল এবং পইপই করে গড়াতে থাকল গাড়ির চাকা। আমি আর বৃদ্ধ জড়োসড়ো হয়েই বসে রইলাম।

বৃদ্ধের নাম- আব্বাস মিয়া। তার বাড়ি মাগুরার এক সময়কার বিখ্যাত রাজা সীতারাম রায়ের প্রাসাদ-দুর্গ থেকে ৩০ কদম দক্ষিনে। এটি মাগুরা সদর উপজেলা থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে মধুমতী নদীর তীরের একটি প্রত্নস্থান, যা স্থানীয়ভাবে রাজবাড়ী নামে পরিচিত। কোন এক পুরনো রাজবাড়ীর আসে পাশে একটা রাত থাকতে পারবো এবং ভৌতিক একটা পরিবেশ উপভোগ করতে পারবো ভেবে রমাঞ্চ অনুভব করলাম।

কোন প্রকারের দূর্ঘটনা ছাড়াই, মাঝে মাঝে মেঘের পরিচিত গর্জন শুনতে শুনতে প্রায় ৬ কিমিঃ পথ পারি দিয়ে আমরা পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্য স্থলে। টেম্পু থেকে নেমেই জোরসে আড়মোড়া ভেঙ্গে শরীরের প্রত্যেকটা হাড় মটমট করে ফুটিয়ে নিলাম। যদিও এখনো নাকি প্রায় ১ কিমিঃ পথ হাঁটতে হবে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটা চলে যেতেই রাস্তাটা একদম নিরিবিলি হয়ে গেল। আমি বুড়োর হাত ধরে হাঁটতে থাকলাম। সুনসান নিরিবিলি রাস্তার দুই দিকেই ঘন গাছের সারিবদ্ধ মিছিল, আর মাঝে মাঝে এক পাশের বাঁশঝাড় আরেক পাশে এসে অবৈধ সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করছে। যদিও মানব জাতির মত গাছ গাছালিরও অবৈধ বা নিষিদ্ধ কাজের প্রতি কোন আকর্ষণ আছে কিনা আমার জানা নেই।

কিছুক্ষন বাদে আব্বাস মিয়া হালকা কাশি দিয়ে গলা পরিস্কার করে আমায় বললেন-
“আচ্ছা তোমার নামটা তো জানা হলনা… মিঃ?”
“নাঈম... নাঈম ফয়সাল আমার নাম”
চটপট উত্তর দিলাম আমি। তিনি বললেন-
“হ্যাঁ, মিঃ নাঈম, আচ্ছা বলতো এত মানুষের ভীড়ে আমি তোমার গাড়ি ভাড়া কেন দিলাম?”
“তাতো জানিনা”!!
“জানতে চাও না?”
“জ্বী চাই তো, বলুন”
“আসলে, আমি ভাল আর মন্দ আলাদা করতে পারি!! সব অন্ধরা পারে কিনা জানিনা। তবে আমি পারি।”
“কেমন করে?”
“এই যেমন ধরো, আমি পৃথিবীর সমস্ত ভাল জিনিস ‘সাদা’ রংয়ের আর সমস্ত খারাপ জিনিস ‘কালো’ রঙের দেখি। সাদা রঙ আমার জন্য নিরাপদ, আর কালো রঙ আমার জন্য বিপদজনক”
বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম বুড়োর কথায়। ব্যাটা আমার সাথে মশকরা করছে কিনা সেটাও একটু ভাববার বিষয়। কিন্তু আমি আমার সন্দেহ গোপণ করে তার কথা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেছি এমন সুরে বললাম -
“তার মানে বাসের ভিতরে আমাকে আপনি সাদা রঙে দেখেছেন?”
“ঠিক তাই। ভালমন্দ আলাদা করতে না পারলে তো অন্ধদের জন্য পথ চলা দুষ্কর হয়ে যেত। তবে খুব আশ্চর্যের বিষয় কি জানো?”
“জী না, জানিনা। বলুন”
ঠিক এমন সময় কোথা থেকে একটা বিচ্ছিরি রকমের কালো কুচকুচে কুকুর উদয় হল, আর সাথে সাথে বুড়োকে শক্ত করে চেপে ধরলাম। কুকুরটা আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যেতেই আব্বাস মিয়া একটু হেসে বলল -
“হাহাহা ওকে ভয় পেওনা। ও কামরাবে না।”
বলে একটু থেমে আবার বললেন -
“পৃথীবির সমস্ত পশুপাখিকে আমি সাদা রঙে দেখি!! অথচ সৃষ্টির সেরা জীব এই মানুষ্য জাতি দিন দিন কালো রঙে পরিণত হচ্ছে! যেমন ধরো এতবড় বাসের ভিতরে শুধু একজনকেই আমার মস্তিষ্ক সিগন্যাল দিল যে, ‘এই লোকটি ভাল মানুষ’। আর বাকিসব ধান্দাবাজ, বিপদজনক!! একটা বাসের ভিতরের অবস্থা যদি এমন হয়, তবে ধারণা করতে পারো সমগ্র দুনিয়াটার বর্তমান অবস্থা কেমন?”
কথাগুলো শুনে একটু অবাক হলাম বটে, তবুও বললাম -
“জী ধারণা করতে পারছি”
আসলে কিছুই ধারণা করতে পারছিনা। কেননা জীবনে এই প্রথম কেউ একজন আমাকে ভাল মানুষের খেতাব দিল দেখে খুব চিন্তায় পরে গেছি। আমি ভাল মানুষ কিনা জানিনা তবে কারো জন্যই ক্ষতিকর না এটা জানি।

বৃদ্ধ আবারো বলতে শুরু করল -
“জানো, আমার এখন আর মানুষের সাথে মিশতে ভাল লাগেনা, সবাই স্বার্থপর, সুবিধাবাদী, ঠকবাজ, লোভী। তবে ছোট বাচ্চাদেরকে আমার বেশ ভাল লাগে। কারণ তারা পাপ মুক্ত। তাদের সবাইকেই সাদা রঙে দেখি আমি। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে যায় যখন দেখি বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ধীরে ধীরে তারাও কালো বর্ন ধারন করতে থাকে!!
একবার এক মজার ঘটনা ঘটেছিল। এলাকার প্রায় সব বাচ্চারা যখন ধীরে ধীরে সাদা থেকে কালোই রূপান্তরিত হচ্ছে তখন একটি বাচ্চা সাদাই রয়ে গেল দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। এবং পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম বেচারা মানসিক প্রতিবন্ধী!! যার অর্থ দাড়ায় পৃথিবীর সব পাগলরাই নিরাপদ, হাহাহা”

আমি একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। কিছুক্ষণ বাদেই একটা ভাঙাচোরা আধাপাকা বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম আমরা। এবং ঝোড়ো বাতাস ছাড়তে শুরু করলো চারিদিকে সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি। বাড়ির সামনেই হারিকেন হাতে দাড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে দৌড়ে এসে আব্বাস মিয়ার বুকে ঝাপিয়ে পরে হাউমাউ করে কাদতেঁ শুরু করলো। এত সুন্দর নারী কন্ঠের কান্না কোনদিন শুনেছি বলে মনে করতে পারলাম না। মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতেই বলল -
“কেন এত দেরী করলি আজ বাপজান? কেন? আমি যদি মরে যেতাম তবে কি হত তোর?”
বলে আবারো কাদতেঁ থাকলো মেয়েটি। বুঝলাম সে আব্বাস মিয়ার মেয়ে। আব্বাস মিয়া তার মেয়ের কপালে চুমু খেতে খেতে বলল -
“আজ অনেক লম্বা লাইন ছিলরে মা। কাঁদিস না পাগলী, এমনটি আর হবেনা।”

জানতে পারলাম প্রতি মাসের একটা নির্দিষ্ট দিনে আব্বাস মিয়া মাগুরার মূল শহরে যান তার পেনশনের টাকা তুলতে। আর যৎসামান্য সেই টাকা দিয়েই মা মরা একমাত্র মেয়াটাকে নিয়ে কোনরকমে বেচেঁ আছেন তারা দুজন।

আব্বাস মিয়া তার মেয়েকে বুক থেকে ছাড়িয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন -
“ইনি আমাকে এতটা পথ আসতে সাহায্য করেছে মা, সালাম দে”

হালকা হারিকেনের আলোয় মেয়েটার চাঁদমুখ দেখলাম। আমি বুঝে শুনেই তাকে চাদেঁর সাথে তুলনা করেছি! এতে মোটেও চাঁদকে ছোট করা হয়নি। বরং এমন মায়াবতী ষোড়শীর সাথে চাদেঁর তুলনা করে চাঁদকে সম্মানিতই করেছি। যদিও এত অল্প আলোয় মেয়েটার পূর্ণ সৌন্দর্য চোখভোরে উপভোগ করতে পারিনি। তবে কিছুক্ষণের জন্য বিমোহিত হয়েছিলাম সেকথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই।

মেয়েটা একটু জড়োসড়ো হয়ে গেল। এতক্ষণে খেয়াল হল যে, বাবার সাথে অপরিচিত একজন আগুন্তক আছে! তৎক্ষণাৎ গায়ের কাপড়টা একটু ঠিকঠাক করে ছোট্ট করে একটা সালাম দিল আমাকে। আমি সালামের উত্তর দিতেই শুরু হয়ে গেল ঝড়। ধীরে ধীরে ঝড়ের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে শুরু করলো। দপ করে নিভে গেল হারিকেনের আলো। ঝড়ের বিপরীতে অনেকটা ধরাধরি করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো বাপ, মেয়ে। আর তাদেরকে অনুসরণ করলাম আমি।

মেয়েটার নাম “ইরা”, ইশরাত জাহান ইরা। ওর মায়ের নাম ছিল “মীরা”। মা খুব সখ করে নিজের সাথে মিল রেখে মেয়ের নাম রেখেছিলেন “ইরা”।

রাত প্রায় ১টা পর্যন্ত আমি, আব্বাস মিয়া, আর ইরা গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম। বাইরে প্রচন্ড ঝড় আর বজ্রপাতের শব্দে কাঁপছিল যেন বাড়িটা। ঝড় বৃষ্টির শব্দে শিরশিরে একটা আমেজ তৈরী হচ্ছিল শরীরের ভিতরে। ইরা তার বাবার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরেছে। হারিকেনের দপদপে আলোক শিখায় ওর মুখটা কেমন জ্বলজ্বল করছে দেখে খুব মায়া হল মেয়েটার প্রতি।

“কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করবো চাচা?”
ইরার নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে নিরব ভঙ্গিতে বললাম আব্বাস মিয়া কে।
“এতক্ষনেও তোমার আপন হতে পারিনি বুঝি! কি জানতে চাও বল”
মৃদু হেসে বললেন ইরার বাবা। আমি কোন রকম সংকোচ ছাড়াই বলে ফেললাম -
“আপনার মেয়েকে আপনি কি রঙে দেখেন? সাদা নাকি কালো?”
হাসি হাসি মুখটা যেন গম্ভীর হয়ে গেল অন্ধ আব্বাস মিয়ার। মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে দৃঢ় কন্ঠে বললেন -
“পৃথিবীর কোন বাবা তার মেয়েকে কালো রঙে দেখেনা। প্রত্যেক বাবার কাছেই তার মেয়ে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাল মেয়ে। তবুও বলছি, আমার মেয়েটাকে কোন রঙেই দেখিনা আমি! আমার ধারনা অতিরিক্ত হতভাগ্য বা হতভাগী ভাল মানুষদের কোন রং হয়না।”
“এমনটা মনে হবার কারণ?”
“জানিনা। মনেহয়, ওর কপালে সুখ নেই”
বলে মাথা নিচু করে চোখের কোনাটা মুছলেন তিনি। কেন বা কি জন্য, সেসব প্রশ্ন না করে সোজা অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলাম।

ইরার হাতের মাছ রান্না, শাকভাজি, আলুরদম এত ভাল হয়েছিল যে আড়াই প্লেট ভাত নাক ডুবিয়ে খেয়ে ফেললাম! তারপর নানান গল্প-সল্প করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেল। এইটুকু সময়ের ভিতরেই ইরার সাথে একটা মিষ্টি সম্পর্ক হয়ে গেল।

কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে পরলাম আমি। বাপ মেয়ে হয়তো এখোনো ঘুমোচ্ছে। আমি তাদের পাশের ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। এরপর টুকটুক করে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে আব্বাস মিয়াকে উদ্দেশ্য করে একটা ছোট চিঠি লিখলাম -

“সালাম জানবেন, আপনার এই এক রাতের আতিথিয়ত্য কোনদিন ভুলবো না। নিশ্চয় আবার দেখা হবে। ভাল থাকবেন।
----ফয়সাল”

তারপর রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হলাম। গত রাতের কাল বৈশাখীর নিষ্ঠুরতা লেপ্টে রয়েছে প্রকৃতির গায়ে। মূল রাস্তায় উঠতে যাব এমন সময় দেখি একটা বাশ ঝাড়ের নিচে নীল রঙের কামিজ পরে দাড়িয়ে আছে ইরা! এই প্রথম তার আসল রূপ চোখে ধরা দিল। কিন্তু ভোরের আলোয় সে রূপের বর্ননা না হয় নাই দিলাম। আমি তার দিকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে গিয়ে বললাম -
“কেমন আছো ইরা?”
কিন্তু ইরা কেমন যেন একটা অসহায় মুখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। খুব অসহ্য লাগলো তার এই দৃষ্টি আমার কাছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছিলাম কোন রাস্তা দিয়ে বের হওয়া যায়। এমন সময় সে বলল -
“চলে যাচ্ছেন তাইনা?”
আমি বললাম -
“হ্যা, নিজের খেয়াল রেখো.. ভাল থেকো কেমন!”
বলে হাটা শুরু করলাম। পিছন থেকে আবারো সে বলে উঠলো -
“আর কোনদিন দেখা হবেনা তাইনা?”
ততক্ষণে আমি বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে যাওয়াই তার কথাটা শুনতে পাইনি। আর সে জন্যই তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ারও কোন প্রয়োজন মনে করলাম না! তাই হেটেই চললাম।
কিন্তু প্রশ্ন হল- আসলেই কি শুনতে পাইনি? ….!!!
………….

ঘটনার ২৫ বছর পর যখন এই ডায়েরী লিখছি তখন আমিও অন্ধ! কোন এক দূর্ঘটনায় হারিয়েছি চোখের আলো। আমি অন্ধ, আমার ডায়েরীও অন্ধ! “অন্ধ ডায়েরী”।

আব্বাস মিয়ার মত ভাল মন্দ আলাদা করতে পারিনা, তবে সব দেখতে পাই! স্পষ্ট দেখতে পাই … কারণ আমার যে আরো দুটি চোখ আছে … সেই চোখ দুটো যা যা দেখে আমিও তাই তাই দেখি! যাইহোক, অনেক রাত হয়েছে। আজ এখানেই রাখছি, ইরা ঘুমোতে ডাকছে আমায়।
১৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×