১.
ডিসেম্বরে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমরা দুই ভাই গেছি নানু বাড়ী বেড়াতে। নানা নেই। আছেন এক মামা। মামাত ভাই-বোন ছিল পিঠাপিঠি। তাই আমরা অনেক মজা করতাম। সারা বছর তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করতাম কখন মামা বাড়ী যাব। আমাদের মামা বাড়ী গল্প কবিতার মামা বাড়ী ছিল না। ছোট একটা বাড়ী। ছোট একটা পুকুর। ছোট দুইটা বাগান। যেখানে আমারদের বাড়ীর চৌহদ্দী ঘুরে আসতে লাগত ঘন্টা খানেক। এতসব কিছু উপেক্ষা করে আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল মামাত ভাই-বোনদের সাথে আড্ডাবাজি। আমরা একসাথ হলেই দুনিয়াটা আমাদের হাতের মুঠোয় থাকত।
দুই ভাই। আমি আর আমার ছোট। মামা বাড়ী যাওয়ার দু’একদিন পরেই শুরু হল তীব্র শীত। তখন আমরা খুবই ছোট। ছোট ছোট হাফ প্যান্ট পরি। তীব্র শীতে হাঁটুর নিচটা ঠক ঠক করে কাঁপছে। দুই হাত বগলের নিছে ঢুকিয়ে শীত জয়ের অপচেস্টা অব্যাহত রাখা।
নানু এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে তোদের লম্বা প্যান্ট কই? এই শীতে তো মরে যাবি। আমি ঘটনা বুঝতে পারলাম। লম্বা প্যান্ট নেই এটা কিভাবে বলি? লজ্জা পেলাম। চুপ করে রইলাম। ছোট ফস করে বলে ফেলল, না নানু, আঙ্গো লম্বা প্যান্ট নাই!
আমি তার এই স্বীকারোক্তিতে খুব বিরক্ত হলাম। আমার মনে হল সে আমার মান-সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিল। তীব্র শীতে লম্বা প্যান্ট থাকবে না কেন? অবশ্যই থাকা উচিত। কিন্তু আমাদের নেই। তাই বলে এটা বলে বেড়ানোরও কিছু নেই। ছোটকে এসব ব্যাপার ভাল করে বুঝিয়ে দিতে হবে। যেখানে সেখানে এসব বলে বেড়ানো যায় না।
২.
স্কুলে তখন আমরা লুঙ্গি পরে যাই। প্যান্ট পরার জন্য খুব একটা চাপ তখনো আসেনি। আমার বন্ধুরা সবাই লিনেন লুঙ্গি কিনেছে। এটার খুব চল। হঠাৎ সবাই পরতে শুরু করল। তাই আমাকেও লিনেন লুঙ্গি কিনতে হবে। মাকে বলেছি। মা আশ্বস্ত করেছে কিনে দিবে। কিন্তু বাবার হাতে টাকা নেই। এদিকে বন্ধুদের কাছে মান সম্মান টেকানো দায়। ভয়ে বাবার কাছে আমরা কোনদিনই কিছু চাইতাম না। সব আবদার মায়ের কাছেই। মাকে খুব জ্বালাতন করতে লাগলাম। এক হাটবারে মা তার পালিত মোরগ বিক্রি করতে দিলেন। এই মোরগ বিক্রির টাকা দিয়ে আমার লিনেন লুঙ্গি কেনা হবে। বাজারে গিয়ে বড় রাতা মোরগ বিক্রি করলাম নব্বই টাকা। হাঁসের ডিম বিক্রি করলাম দেড় কুড়ি। কুড়ি ষাট টাকা করে নব্বই টাকা। সব টাকা বাবাকে দিয়ে দিলাম। বাবা জানেন এটা কিসের টাকা। আমরা বাপ-বেটা লুঙ্গি কেনার জন্য কাপড়ের দোকানে দোকানে ঘুরছি। কেউ লিনেন লুঙ্গি চিনে না। তাদের কাছে নেই। তখন বাবা আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, এই লুঙ্গির দাম কত রে?
এটা একটা সহজ জিজ্ঞাসা। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি। বাবা ভাবছে, দোকানিরা যে কাপড় চিনতে পারছে না তার নিশ্চয় অনেক দাম। বাবার কন্ঠে ছিল উৎকন্ঠা। সেই উৎকন্ঠায় সচকিত হয়ে আমি বললাম, আব্বা লুঙ্গি যেহেতু পাওয়া যাচ্ছে না তাহলে এখন কিনব না। পরে না হয় কিনব। এখন চলেন বাড়ী যাই।
তার পর দিন দেখি বাবা আমার জন্য লিনেন লুঙ্গি নিয়ে এসেছেন। তখন আমার কাছে মনে হল বাবা যেন কানে কানে বলছে, এই লুঙ্গির দাম কত রে?
চলবে...
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মে, ২০২০ রাত ১০:৩৭