হালকা করে একটা ধাক্কা দিলেই হবে, যেই ভাবা সেই কাজ। ধাক্কা দিয়ে লোকটিকে বলল, 'স্যরি ভাই।'
লোকটা কিছু বলল না, এত লোকের মাঝে ধাক্কা খাওয়াটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যেই কাজের কাজটা সারা হয়ে গেছে রবিনের, আস্তে আস্তে ভীড় কেটে সরে এল একটা দোকানের পিছনে। মানিব্যাগটা খুলে দেখে কাগজভর্তি তবুও টাকা আছে মোটামুটি; কয়েকটা পাঁচশ টাকার নোট, দুইটা একশ টাকার নোট আর বাকী খুচরো দশ বিশ টাকা। খারাপ না এই দাওটা মোটামুটি হলো, ঈদের মৌসুমে দেখা যায় লোকেরা টাকা একটু বেশি নিয়েই হাঁটে, কেনাকাটা করবে বাড়ির সবার জন্য তাই হয়তো। লোকটা যখন মানিব্যাগ বের করবে টাকা অন্যকে দেওয়ার জন্য তখন তার মুখের অবস্থা কি রকম হবে ভেবে একটা কেলিয়ে হাসি দিল সে। সামনের টং দোকান থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে সামনে হাঁটা ধরল নতুন দাওয়ের খোঁজে। এভাবে চলে দিনকাল তার, গুলিস্থানের মোড়ে কিংবা আশেপাশে ভীড়ের মাঝে পকেট মেরে সে ইনকাম করে। তার মতে, "বড়লোকেরা দূর্নীতি কইরা ট্যাকা কামায় আর আমরা ভাত পাই না, আর আমি তাগো পকেট মাইরা পেডে লাত্থি দিই, হালারা আমাগো পেডের খাওনে ভাগ বসাও, না?? আমিও তগোর খাওনে ভাগ বসামু।" যদিও বড়লোক মানুষের পকেটের টাকা ঐ অল্প পরিমাণ সরলেও তার সম্পদ থেকে কিছু কমে যায় না, তবুও সে বেছে বেছে মালদার পার্টি দেখে পকেট মারে।
অনেকক্ষণ ধরে এক লোকের দিকে নজর রাখছে রবিন, লোকটা মনে হয় মালদার হবে, ব্যবসা ট্যবসা করে মনে হয়, কাপড় কিনতে আসছে পাইকারীতে এখানে। লোকটা দোকানে দোকানে ঘুরছে, হঠাত্ সুযোগ পেয়ে গেল সে, লোকটা রাস্তার ওপারের দোকানে যাবে মনে হয়। সে রাস্তায় নামল লোকটিকে নজরে রেখে, লোকটি যখনই ভীড়ের মধ্যে ঢুকতে যাবে তখনই তার সামনে দুইটা লোক এসে পড়ায় চলায় বাঁধাগ্রস্ত হল আর এই সুযোগে সে নিমেষের মধ্যে হাওয়া করে দিল মানিব্যাগ। তারপর পার হয়ে গেল রাস্তার ঐ পারে, দোকানের পিছনে এসে মানিব্যাগ খুলে অবাক হয়ে গেল, যেমন ধারনা করছিল তেমনই। অনেক টাকা, হাজার দশেক এর মতো হবে। গুনে টাকাগুলো নিজের মানিব্যাগে রাখল আর ঐ লোকের মানিব্যাগটা ফেলে গেল। এতগুলো টাকা পেয়ে মনটা খুশি হয়ে গেল, বউটা অনেক দিন ধরে বায়না ধরে আছে ঈদে তাকে একটা কচুয়া রঙের জামদানি শাড়ি কিনে দিতে হবে, আর সাথে শাড়ির সাথে মিলিয়ে কাচের চুড়ি থেকে সব। আজ যে টাকা পেয়েছে তাতে মনে হচ্ছে বউকে শাড়ি কিনে দেওয়া যাবে কিন্তু পরক্ষনেই মাথায় একটা চিন্তা ঢুকল টাকার ভাগ নিয়ে, টাকার একটা ভাগ তো তার উস্তাদ মোসাদ্দেক ভাইকে দিতে হবে। মানিব্যাগটা পকেট থেকে বের করে পাঁচশ টাকার কয়েকটা নোট সরিয়ে রাখল প্যান্টের গোপন পকেটে।
কাদা মাড়িয়ে গলির ভিতর গিয়ে উঠল মোসাদ্দেক ভাইয়ের দোকানে। এইটা একটা ভিসিডির দোকান, দোকানের পিছনে একটা রুম আছে ঐখানে ব্যবসা সংক্রান্ত আলাপ হয়। দোকানে গিয়ে দেখে বাচ্চু বসে আছে, ইশারা দিয়ে বুঝালো মোসাদ্দেক ভাই ভিতরে আছে।
-স্লামালাইকুম ভাই
-কিরে আইজকা এত ছকাল ছকাল আয়া পড়লি যে?
-না ভাই ছরীলডা বেচি ভালা না, কেমুন জ্বর জ্বর লাগতাছে।
-কত কামাইলি আইজকা?
-বেচি না ভাই, দুইডা মারচি। হালারা বেচি চালাক হইবার লাগচে, টাকা লইয়া পকেটে বাইর অয় না।
-দে তো দেহি কত আনলি?
-ভাই আইজকা পাঁচশ টাকা বেচি দিয়েন, বউয়েরে একখান শাড়ি দিমু, বউ চাইছে।
-ভালা কথা দিবি ছমইছ্যা নাইক্কা। রোজা রাখছ নাকি?
-হ ভাই, এর লাইগাই চরীরডা ভালা লাগতাচে না।
-রোজা রাইখাও পকেট মারছ !! ইমানদার আইছে কোনহানের!!
-হ ভাই করমু কি? পেট চালাইতে অইব না?
মাথা নেড়ে সায় জানাল মোসাদ্দেক, তা ঠিক পেট চালতে হবে, পেট না চালালে তো সব বন্ধ হয়ে যাবে। আর পেট চালানোর জন্যে যেকোনো কিছুই করা যায়েজ আছে মোসাদ্দেকের আইনে। এই এলাকার সকল পকেটমারে টাকার ভাগ সে পায়, তাকে টাকার ভাগ না দিলে এই এলাকায় পকেটমারিঙের ব্যবসা করা যায় না। রবিনের হাতে বাকী টাকা ফিরিয়ে দিল সে, সালাম দিয়ে বেরিয়ে আসল রবিন। মনে মনে খুশি হল অনেক টাকা আজকে বাঁচিয়ে ফেলেছে পকেটে লুকিয়ে রেখেছে বলে।
সন্ধ্যায় ইফতারি করতে আসল বঙ্গবাজারে সাচ্চু মামার তেহারির ঘরে। একটা ভিখেরী মহিলা পিছু নিয়েছে অনেকক্ষন কিছু খাবার আর টাকার আশায়। রবিন কড়া কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে তবুও মহিলাটা যাচ্ছে না। পরে দেখেও না দেখার ভান করে এসে বসল তেহারির ঘরে। দোকানটা গিজগিজ করছে লোকে, ইফতারির আগ মুহূর্ত বলে কথা। বাইরে পসরা সাজিয়ে ইফতারি বিক্রি চলছে। একদল লোক ইফতারি কিনতে ভীড় করছে। ভিতরেও অনেক লোক বসে পড়েছে যারা কিনা এখানেই ইফতার সেরে নিতে চায় রবিনের মতো। মহিলাটাও এসে একটু দূরত্ব রেখে তার পায়ের কাছে মাটিতে বসে রইল। আজান দিচ্ছে মসজিদে, সবাই ইফতারিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো, মহিলাটা তখনও বসে আছে একটুখানি খাবারের আশায়। রবিন দোকানের ভাগনা শমশেরকে ডেকে খাবার দিতে বলল। খাবার পেয়ে মহিলা খুব খুশিতে খেতে লাগল, দেখেই বুঝা যায় অনেক ক্ষুধার্থ। রবিন মহিলার খাওয়ার দিকে চেয়ে রইল, তারও তৃপ্তি লাগছে মহিলার খাওয়া দেখে। খাবার শেষে রবিন বিল দিয়ে উঠতে যাবে হঠাত্ তার মনে হল, 'হালার বড়লোকেরা ঈদে ফিতরা দেয় যাকাত দেয়, আমিও দিমু, আমার কাছে এখন টেকা আছে আমিও দিমু।' সে মহিলাকে মানিব্যাগ থেকে পাঁচশ টাকার একটা নোট বের করে হাতে ধরিয়ে দিল। মহিলার অনেকক্ষন লাগল বুঝতে যে টাকাটা তাকেই দেয়া হচ্ছে! মহিলার কান্না দেখে সে আর দাঁড়াল না, হাঁটা ধরল রাস্তার দিকে। এখন বাসে উঠে যাবে নিউমার্কেটে, ঐখানে নাকি ভালো ভালো শাড়ি পাওয়া যায়।
গাউছিয়া মার্কেট থেকে অনেক ঘুরাঘুরি করে একটা শাড়ি কিনল রবিন, হালকা সবুজ রঙের জমিনে কাজ করা সূতার আর সাদা রঙের কাজ করা পাড়। বউকে শাড়ি দিলে যে কি খুশিই না হবে এটা ভেবে সে খুব আনন্দ পাচ্ছে। মেয়েটা খুব খুশি হলে আহ্লাদি হয়ে যায়, তার খুব ভালো লাগে বৌয়ের আহ্লাদি দেখতে। বউকে অনেকদিন কিছু দেওয়া হয় না, বেচারী বুঝে যে এটা অভাবের সংসার, চাইলেই পাওয়া যায় না সব তাই তেমন কিছু চায়ও না। এইবার প্রথম কিছু চেয়েছে মুখ ফুটে, বাচ্চা মেয়ে- কত আর বয়স হবে মেয়েটার? সবে কুড়ি পেরিয়েছে, আর এই বয়সেই কি সুন্দর করে সংসারটা ধরে রেখেছে। আর ছেলেটাকে কি যত্ন করে বড় করে তুলছে, সারাদিন ছেলেটার পিছনে পড়ে থাকে। রবিন কপট রাগ করে তার বৌয়ের কাছে, 'সারাদিন খালি পোলাডারেই আদর করো! আমি যে একজন আছি সেইডা কি খেয়াল আছে??'
তার বৌ খুব লজ্জা পায় এই কথায়, আর সে তা দেখে মুচকি মুচকি হাসে। বৌকে দাক দেয়, 'ও, বৌ', 'কাছে আসো, এতো দূরে দূরে থাকো ক্যা?'
বেচারি লজ্জা পেয়ে গুটিসুটি মেরে তার দিকে এগুয়।
রবিন ভাবল ছেলেটাকেও কিছু কিনে দিতে হবে, কিছুক্ষন আরও দেখেশুনে ফুটপাতের বাচ্চাদের দোকান থেকে একটা শার্ট আর প্যান্ট কিনল। তারপর একটা সিগারেট কিনে ধরাল বেনসন, আজকে টাকা আছে পকেটে একটু বেশি খরচ করলে কিছুই হবে না। সবসময় কমদামী সিগারেট টানে, একদিন দামী সিগারেট টানলে কিছুই হয় না। মনটা তার অনেক ফুরফুরে নিজেকে আজ বড়লোক বড়লোক লাগছে। খুশিমনে ভীড় ঠেলে নিউমার্কেটের ওভারব্রীজে গিয়ে উঠল। মনে মনে ভাবল, এখান থেকে যাওয়ার সময় আরেক দাও পকেট মেরে গেলে আর মোসাদ্দেক ভাইকে দেওয়া লাগবে না এবং টাকাটাও বেঁচে যাবে। ওভারব্রিজের উপর পা ঝুলিয়ে বসে রইলো, এখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। যতদূর দেখা যায় ততদুরই শুধু গাড়ি আর গাড়ি, গাড়ির পিছনের হাজারো লাল বাতির সারি। লোকজন সবাই ব্যস্ত নিজেকে নিয়ে, কেনাকাটা নিয়ে। রবিন নিজেও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, নিজের মনে একা একা আনন্দবিলাস করছে। মনের ভিতর সুক্ষ্ণ একটা উদাসভাব, তার মনে হচ্ছে, এই মুহুর্তে যদি তার বউটা পাশে থাকতো! মেয়েটা ঢাকা শহর ঘুরতে তেমন বের হয় নি। যতবারই বের হয়েছে, গাড়ির জানালা দিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রয়েছিল।
কিছুক্ষন আরও বসে রইল ওভারব্রীজের দেওয়ালে পা উঠিয়ে, বসে বসে অনেক স্মৃতি মনে করতে লাগলো সে। বিয়ের পরের কিছু মধুর স্মৃতি, বউকে নিয়ে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার স্মৃতি। মনটা তার বেশ ফুরফুরা মনে হলো, সিদ্ধান্ত নিলো তাড়াতাড়ি পকেট মেরে বাসায় যাবে। বউটাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছে হঠাত, বৌয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতে মন চাচ্ছে তার। একটা ছেলেকে দেখা যাচ্ছে মনে হয় টাকা আছে পকেটে বেশিই। মুখের ভাবটা অনেক খুশি খুশি, নতুন কাপড় কিনবে বোধহয়। রবিন ছেলেটার পিছন পিছন গেলো এবং সুযোগ বুঝে পকেটে হাত দিল। কিন্তু ছেলেটা অনেক চালু সাথে সাথে রবিনের হাত ধরে ফেলল, 'পকেটমার, পকেটমার' বলে চেঁচাতে লাগল। এরই মধ্যে অনেক লোক জমে গেল, রবিন পকেট মারতে পারে নি। তবুও সবাই মিলে মারতে লাগল তাকে, উত্তেজিত জনতা তাকে মারতে মারতে মাটিতে ফেলে দিল। সে আকুতি জানাচ্ছে, 'ভাইজান আমি পকেট মারি নি, এমনেই ভীড়ে হাআত লাগছে উনার পকেটে, আমারে আর মাইরেন না..' রবিন তখনও তার হাতের শাড়ির ব্যাগটা শক্ত করে ধরে রেখেছে। একজন তার ব্যাগ ধরে টানতে লাগল, সে তবুও ধরে রাখতে চেষ্টা করল। এত মার রবিন জীবনেও খায় নাই, মাদ্রাসার রফিক হুজুরও কখনও এত মার মারে নি। তার চোখের সামনের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে, সে চাইছে চোখটা মেলে ধরতে, তার চোখের সামনে বউয়ের চেহারাটা ভেসে উঠল; তার মনে পড়ল ব্যাগের কথা। সে অজ্ঞান হতে হতে অস্পষ্ট স্বরে বলতে লাগল, 'ভাই ব্যাগটা দিয়া যান আমার বউরে শাড়িটা দিমু, বউ তোমার শাড়িটা লইয়া গ্যাছে গা....'
[পরিমার্জিত]
পরিশিষ্টঃ এই গল্পটা দুই বছর আগের ঈদ উপলক্ষে লেখা এবং তখন ডাকপিয়নে পোস্ট হয়েছিল। একটা মজার কথা বলি এই গল্প নিয়ে, গল্পটা লেখার পর থেকে যতবার আমি গুলিস্তান গিয়েছি কিংবা নিউমার্কেটের ওভারব্রিজের উপর উঠেছি ততবারই পকেটে হাত দিয়ে রেখেছি যেন কেউ আমার পকেট মেরে না নিতে পারে। হাস্যকর
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৪ দুপুর ১২:৩৫