ছোট থাকতে একবার আমার এক ফুফাতো বোন আমাকে খামছে দিয়েছিলো, তখন তার বয়স ৪ মাস মাত্র। সেই খামছির দাগ মুছতে প্রায় ৪ মাস লেগেছিলো, আর ব্যাথা সারতে প্রায় ৫/৬ দিন।
ঐ সময় একাধিক বার শুনেছি, মানুষের খামছি নাকি কুকুর বিড়ালের থেকে বিষাক্ত। মানুষের নখের ভিতরে নাকি অনেক বিষ। এটাও শুনেছি যে মানুষের কামড়েও নাকি প্রচন্ড বিষ। ঘটনা হয়ত এমন না; আবার হয়ত এমন।
তবে আমি অবাক হই মানুষের মনের বিষাক্ত অবস্থা দেখে। কোন পার্টিকুলার কারণ ছাড়াই আমি দেখেছি একজন আর একজনের কি পরিমান ক্ষতি করে। আমি নিজেও একাধিকবার এর স্বীকার হয়েছি। আমি চেষ্টা করে এর থেকে দূরে থাকতে। কে জানে, হয়ত পারি না; অথবা পারি।
কয়েকদিন আগে আমাকে ভার্সিটির এক সহপাঠি কল করেছে, ফেসবুকে। আমি একটু অবাকই হয়েছি। কারণ পরিচিত কেউ আমাকে সাধারণত কল করে না। তার উপর সেটা যদি হয় ভার্সিটির সহপাঠি, তাহলেতো কথাই নাই।
কল রিসিভ করে বেশ কিছু আলোচনা হলো, এরপর হঠাৎ সে বললো যে তার ছেলে অসুস্থ, হসপিটালে ভর্তি, আর ২৫ হাজার টাকা দরকার একটা অপারেশনের জন্য। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো যে কোন ভাবে সাহায্য করতে পারবো কি না। আমি 'চেষ্টা করে দেখি' বলে ফোন রাখলাম।
আমি কয়েকজনের কাছে টাকা পাই, তাদের ফোন দিলাম, এর কাছ থেকে ওর কাছ থেকে ম্যানেজ করে মোট ২০ হাজার জোগাড় হয়ে গেলো, বাকি ৫হাজার আমি পাঠিয়ে দিলাম। এর মধ্যে ঐ সহপাঠি বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করলো, আমি তাকে আস্বস্ত করলাম যে একটা না একটা ব্যবস্থা হবে ইন শা আল্লাহ। তার হাতে টাকাটা মোটামুটি সঠিক সময়েই পৌঁছেছে।
কিন্তু এর মধ্যে আমি মানুষের সেই বিষাক্ততার কিছু নমুনা দেখলাম। ঐ সহপাঠী কল করার পর থেকে আমার ভার্সিটির প্রায় ৭-৮ জন সহপাঠি আমাকে কল করেছে। তারা সবাই আমাকে কল করছে এমন না, তারা সবাই সবাইকে কল করছে। তাদের একটাই চেষ্টা, যেন কেউ ওকে হেল্প না করে।
আমি প্রথমে তাদের কথা শুনছিলাম, ভেবেছিলাম হয়ত সে মিথ্যা বলে টাকা নিচ্ছে। পরে তাদের মুখের কথা থেকেই বুঝতে পারলাম যে ঘটনা সত্য, এবং সত্যিই তার টাকা দরকার।
সবাই যখন বুঝে গেছে যে আমি চেষ্টা করছি টাকা দেওয়ার, সবাই মিলে একজোট হয়ে আমাকে বোঝানোর জন্য গ্রুপ কল পর্যন্ত দিয়েছে। সবার একটাই যুক্তি, এই ছেলের সাথে ভার্সিটিতে আমার গ্যাঞ্জাম ছিলো!
আসলে গ্যাঞ্জাম না, দু-চারবার হাতাহাতি পর্যায়ে গিয়েছে তার সাথে। কিন্তু ১২/১৩ বছর পর এসে সেই কথা মনে রেখে তার ছেলের চিকিৎসার জন্য হাত না বাড়ানোর কোন কারণ আমি পাইনি। খুব অবাক লেগেছে, যে ৭/৮জন আমাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে, তাদের মধ্যে থেকে তিনজনের পাশে দাড়িয়েছি করণার সময়। তাদের কঠিন সময়ে নিজের পকেট থেকে যেমন সাহায্য করেছি, মানুষ থেকে সাহায্য চেয়ে নিয়েও তাদের দিয়েছি। এমনকি আরও কয়েকজনকে ছোট ব্যবসা শুরু করার জন্য পুঁজি পর্যন্ত যোগাড় করে দিয়েছি, সেটাও তারা জানে। কিন্তু অন্যকে সাহায্য করতে দেখে তাদের এত জ্বলে যাচ্ছে কেন সেটা বুঝলাম না।
সৌদী এসেছি প্রায় সাড়ে ৬ বছর, এর মধ্যে কেউ নিজের প্রয়োজন ছাড়া একবার কল করেনি। ২০১৯ এর শেষের দিকে যখন দেশে গিয়েছিলাম, এদের কেউ আমার সাথে দেখা করার সময়ও পায়নি। আজকে অন্য একজনকে সাহয্য করছি দেখে তাদের প্রচুর সময় আছে বাধা দেওয়ার! কি অদ্ভুত বিষাক্ততা!
Photo by Adrien King on Unsplash